পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

১৪৮ আয়াত

৩৪ ) তারপর যখন ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই ৪৫ অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস ৪৬ অস্বীকার করলো। সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তর্ভুক্ত হলো। ৪৭
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَـٰٓئِكَةِ ٱسْجُدُوا۟ لِـَٔادَمَ فَسَجَدُوٓا۟ إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَٱسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلْكَـٰفِرِينَ ٣٤
৩৫ ) তখন আমরা আদমকে বললাম, “তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়েই জান্নাতে থাকো এবং এখানে স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না। ৪৮ অন্যথায় তোমরা দু’জন যালেমদের ৪৯ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।”
وَقُلْنَا يَـٰٓـَٔادَمُ ٱسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ ٱلْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَـٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٣٥
৩৬ ) শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো। আমি আদেশ করলাম, “এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। ৫০ তোমাদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে।”
فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيْطَـٰنُ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ ۖ وَقُلْنَا ٱهْبِطُوا۟ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّۭ ۖ وَلَكُمْ فِى ٱلْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّۭ وَمَتَـٰعٌ إِلَىٰ حِينٍۢ ٣٦
৩৭ ) তখন আদম তার রবের কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তাওবা করলো। ৫১ তার রব তার এই তাওবা কবুল করে নিলেন। কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী। ৫২
فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَـٰتٍۢ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٣٧
৩৮ ) আমরা বললাম, “তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। ৫৩ এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা।
قُلْنَا ٱهْبِطُوا۟ مِنْهَا جَمِيعًۭا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّى هُدًۭى فَمَن تَبِعَ هُدَاىَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ٣٨
৩৯ ) আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে ৫৪ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।” ৫৫
وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلنَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَـٰلِدُونَ ٣٩
৪০ ) হে বনী ইসরাঈল। ৫৬ আমার সেই নিয়ামতের কথা মনে করো, যা আমি তোমাদের দান করেছিলাম, আমার সাথে তোমাদের যে অঙ্গীকার ছিল, তা পূর্ণ করো, তা হলে তোমাদের সাথে আমার যে অঙ্গীকার ছিল, তা আমি পূর্ণ করবো এবং তোমরা একমাত্র আমাকেই ভয় করো।
يَـٰبَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتِىَ ٱلَّتِىٓ أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَوْفُوا۟ بِعَهْدِىٓ أُوفِ بِعَهْدِكُمْ وَإِيَّـٰىَ فَٱرْهَبُونِ ٤٠
৪১ ) আর আমি যে কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন। তোমাদের কাছে আগে থেকেই যে কিতাব ছিল এটি তার সত্যতা সমর্থনকারী। কাজেই সবার আগে তোমরাই এর অস্বীকারকারী হয়ো না। সামান্য দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না। ৫৭ আমার গযব থেকে আত্মরক্ষা করো।
وَءَامِنُوا۟ بِمَآ أَنزَلْتُ مُصَدِّقًۭا لِّمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوٓا۟ أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِهِۦ ۖ وَلَا تَشْتَرُوا۟ بِـَٔايَـٰتِى ثَمَنًۭا قَلِيلًۭا وَإِيَّـٰىَ فَٱتَّقُونِ ٤١
৪২ ) মিথ্যার রঙে রাঙিয়ে সত্যকে সন্দেহযুক্ত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করার চেষ্টা করো না। ৫৮
وَلَا تَلْبِسُوا۟ ٱلْحَقَّ بِٱلْبَـٰطِلِ وَتَكْتُمُوا۟ ٱلْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ ٤٢
৪৩ ) নামায কায়েম করো, যাকাত দাও ৫৯ এবং যারা আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও।
وَأَقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرْكَعُوا۟ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣
৪৫.
এর অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী ও তার সাথে সম্পর্কিত মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তরে যে পরিমাণ ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছেন তাদের সবাইকে মানুষের জন্য অনুগত ও বিজিত হয়ে যাবার হুকুম দেয়া হয়েছে। যেহেতু এই এলাকায় আল্লাহর হুকুমে মানুষকে তাঁর খলীফার পদে নিযুক্ত করা হচ্ছিল তাই ফরমান জারী হলোঃ আমি মানুষকে যে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দান করছি ভালো –মন্দ যে কোন কাজে মানুষ তা ব্যবহার করতে চাইলে এবং আমার বিশেষ ইচ্ছার অধীন তাকে সেটি করা সুযোগ দেয়া হলে তোমাদের যার যার কর্মক্ষেত্রের সাথে ঐ কাজের সম্পর্ক থাকবে। তাদের নিজেদের ক্ষেত্রের পরিধি পর্যন্ত ঐ কাজে তার সাথে সহযোগিতা করা হবে তোমাদের ওপর ফরয। সে চুরি করতে বা নামায পড়তে চাইলে, ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করার এরাদা করলে উভয় অবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করার অনুমতি দিতে থাকবো ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের দায়িত্ব হবে তার কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, কোন বাদশাহ যখন কোন ব্যক্তিকে নিজের রাজ্যের কোন প্রদেশের বা জেলার শাসক নিযুক্ত করেন তখন তার আনুগত্য করা সেই এলাকার সমস্ত সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। তিনি কোন সঠিক বা বেঠিক কাজে তার ক্ষমতা ব্যবহার করুন না কেন, যতদিন বাদশাহ চান ততদিন তাকে তার ক্ষমতা ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে। তবে বাদশাহর পক্ষ থেকে যখন যে কাজটি না করতে দেয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে তখনই সেখানেই ঐ শাসকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খতম হয়ে যাবে। এ সময় তিনি অনুভব করতে থাকেন যেন চারদিকের সমস্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ধর্মঘট করেছে। এমন কি বাদশাহর পক্ষ থেকে যখন ঐ শাসককে বরখাস্ত ও গ্রেফতার করার ফরমান জারী হয় তখন কাল পর্যন্ত তার অধীনে যারা কাজ করছিল এবং তার আঙুলের ইশারায় যারা ওঠা-বসা করতো তারাই আজ তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাকে ফাসেক তথা বিদ্রোহীদের আবাসস্থলের দিকে নিয়ে যেতে একটুও দ্বিধা করে না। ফেরেশতাদেরকে আদমের সামনে সিজদাবনত হবার হুকুম দেয়া হয়েছিল। এর ধরনটা কিছুটা এই রকমেরই ছিল। হতে পারে কেবল বিজিত হয়ে যাওয়াকেই হয়তো বা সিজদা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। আবার অনুগত হয়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে তার বাহ্যিক প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এটাও সম্ভবপর। তবে এটাই বেশী সঠিক বলে মনে হয়।
৪৬ .
‘ইবলিস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, “চরম হতাশ।” আর পারিভাষিক অর্থে এমন একটি জিনকে ইবলিস বলা হয় যে আল্লাহর হুকুমের নাফরমানি করে আদম ও আদম সন্তানদের অনুগত ও তাদের জন্য বিজিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার ও কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে ভুল পথে চলার প্রেরণা দান করার জন্য সে আল্লাহর কাছে সময় ও সুযোগ প্রার্থনা করেছিল। আসলে শয়তান ও ইবলিস নিছক কোন জড় শক্তি পিন্ডের নাম নয়। বরং সেও মানুষের মতো একটি কায়া সম্পন্ন প্রাণীসত্তা। তা ছাড়া সে ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এ ভুল ধারণাও কারো না থাকা উচিত। কারণ পরবর্তী আলোচনাগুলোয় কুরআন নিজেই তার জিনদের অন্তর্ভুক্ত থাকার এবং ফেরেশতাদের থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য পরিবেশন করেছে।
৪৭.
এই শব্দগুলো থেকে মনে হয় সম্ভবত শয়তান একা সিজদা করতে অস্বীকার করেনি। বরং তার সাথে জিনদের একটি দলই আল্লাহর নাফরমানি করতে প্রস্তুত হয়েছিল। এক্ষেত্রে একমাত্র শয়তানের নাম নেয়া হয়েছে তাদের নেতা হবার এবং বিদ্রোহের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে বেশী অগ্রসর থাকার কারণে। কিন্তু এই আয়াতটির আর একটি অনুবাদও হতে পারে সেটি হচ্ছেঃ ‘সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। ’ এ অবস্থায় এর অর্থ হবেঃ পূর্ব থেকেই জিনদের মধ্যে একটি বিদ্রোহী ও নাফরমান দল ছিল এবং ইবলিস এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কুরআনে সাধারণভাবে ‘শায়াতীন’ (শয়তানরা) শব্দটি এসব জিন ও তাদের বংশধরদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আর কুরআনের যেখানে ‘শায়াতীন’ শব্দের অর্থ ‘মানুষ’ বুঝার জন্য কোন স্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ নেই সেখানে এর অর্থ হবে জিন শয়তান।
৪৮.
এ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে অর্থাৎ নিজের কর্মস্থলে খলীফা নিযুক্ত করে পাঠাবার আগে মানসিক প্রবণতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে তাদের দু’জনকে পরীক্ষা করার জন্য জান্নাতে রাখা হয়। তাদেরকে এভাবে পরীক্ষা করার জন্য একটি গাছ বাছাই করা হয়। হুকুম দেয়া হয়, ঐ গাছটির কাছে যেয়ো না। গাছটির কাছে গেলে তার পরিণাম কি হবে তাও বলে দেয়া হয়। বলে দেয়া হয় এমনটি করলে আমার দৃষ্টিতে তোমরা যালেম হিসেবে গণ্য হবে। সে গাছটি কি ছিল এবং তার মধ্যে এমন কি বিষয় ছিল যেজন্য তার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়—এ বিতর্ক এখানে অবান্তর। নিষেধ করার কারণ এ ছিল না যে, গাছটি প্রকৃতিগতভাবে এমন কোন দোষদুষ্ট ছিল যার ফলে তার কাছে গেলে আদম ও হাওয়ার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল আদম ও হাওয়ার পরীক্ষা। শয়তানের প্রলোভনের মোকাবিলায় তারা আল্লাহর এই হুকুমটি কতটুকু মেনে চলে তা দেখা। এই উদ্দেশ্যে কোনো একটি জিনিস নির্বাচন করাই যথেষ্ট ছিল। তাই আল্লাহ‌ কেবল একটি গাছের নাম নিয়েছেন, তার প্রকৃতি সম্পর্কে কোন কথাই বলেননি।

এই পরীক্ষার জন্য জান্নাতই ছিল সবচেয়ে উপযোগী স্থান। আসলে জান্নাতকে পরীক্ষাগৃহ করার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, মানবিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে তোমাদের জন্য জান্নাতই উপযোগী স্থান। কিন্তু শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যদি তোমরা আল্লাহর নাফরমানির পথে এগিয়ে যেতে থাকো তাহলে যেভাবে শুরুতে তোমরা এ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলে তেমনি শেষেও বঞ্চিত হবে। তোমাদের উপযোগী এই আবাসস্থলটি এবং এই হারানো ফিরদৌসটি লাভ করতে হলে তোমাদেরঅবশ্যি নিজেদের সেই দুশমনের সফল মোকাবিলা করতে হবে, যে তোমাদেরকে হুকুম মেনে চলার পথ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

৪৯.
যালেম শব্দটি গভীর অর্থবোধক। ‘যুলুম’ বলা হয় অধিকার হরণকে। যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালেম। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালন করে না, তাঁর নাফরমানি করে সে আসলে তিনটি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে। প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে। কারণ আল্লাহর হুকুম পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার। দ্বিতীয়ত এই নাফরমানি করতে গিয়ে সে যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার সে হরণ করে তার দেহের অংগ-প্রত্যংগ, স্নায়ু মন্ডলী, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফেরেশতাগণ এবং যে জিনিসগুলো সে তার কাজে ব্যবহার করে –এদের সবার তার উপর অধিকার ছিল, এদেরকে কেবলমাত্র এদের মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যখন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে তাদের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ব্যবহার করে তখন সে আসলে তাদের ওপর যুলুম করে। তৃতীয়ত তার নিজের অধিকার হরণ করে। কারণ তার ওপর তার আপন সত্তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচবার অধিকার আছে। কিন্তু নাফরমানি করে যখন সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তি লাভের অধিকারী করে তখন সে আসলে নিজের ব্যক্তি সত্তার ওপর যুলুম করে। এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ‘গোনাহ’ শব্দটির জন্য যুলুম এবং ‘গোনাহগার’ শব্দটির জন্য যালেম পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
.
৫০.
অর্থাৎ মানুষের শত্রু শয়তান এবং শয়তানের শত্রু মানুষ। শয়তান মানুষের শত্রু, একথা তো সুস্পষ্ট। কারণ সে মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালনের পথ থেকে সরিয়ে রাখার এবং ধ্বংসের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু শয়তানের শত্রু মানুষ, একথার অর্থ কি? আসলে শয়তানের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করাই তো মানবতার দাবী। কিন্তু প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সামনে সে যে সমস্ত প্রলোভন এনে হাযির করে মানুষ সেগুলোর দ্বারা প্রতারিত হয়ে তাকে নিজের বন্ধু ভেবে বসে। এই ধরনের বন্ধুত্বের অর্থ এ নয় যে, প্রকৃতপক্ষে শত্রুতা বন্ধুত্বে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, এক শত্রু আর এক শত্রুর হাতে পরাজিত হয়েছে এবং তার জালে ফেঁসে গেছে।
.
৫১ .
অর্থাৎ আদম (আঃ) যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, তিনি আল্লাহর নাফরমানির পথ পরিহার করে তাঁর হুকুম মেনে চলার পথ অবলম্বন করতে চাইলেন এবং তাঁর মনে যখন নিজের রবের কাছে নিজের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার আকাঙ্ক্ষা জাগলো তখন ক্ষমা প্রার্থনা করার ভাষা তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁর অবস্থা দেখে আল্লাহ‌ তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা তাঁকে শিখিয়ে দিলেন। তাওবার আসল অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা। বান্দার পক্ষ থেকে তাওবার অর্থ হচ্ছে এই যে, সে সীমালঙ্ঘন ও বিদ্রোহের পথ পরিহার করে বন্দেগীর পথে পা বাড়িয়েছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবা করার অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজের লজ্জিত ও অনুতপ্ত দাসের প্রতি অনুগ্রহ সহকারে দৃষ্টি দিয়েছেন এবং বান্দার প্রতি তাঁর দান পুনর্বার বর্ষিত হতে শুরু করেছে।
৫২.
গোনাহর ফল অনিবার্য এবং মানুষকে অবশ্যি তা ভোগ করতে হবে, কুরআন এ মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এটা মানুষের মনগড়া ভুল মতবাদগুলোর মধ্যে একটি বড়ই বিভ্রান্তিকর মতবাদ। কারণ যে ব্যক্তি একবার গোনাহে লিপ্ত হয়েছে এই মতবাদ তাকে চিরকালের জন্য হতাশার সাগরে নিক্ষেপ করে। একবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঐ ব্যক্তি যদি তার অতীতের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় এবং ভবিষ্যতে সৎ-সুন্দর জীবন যাপন করতে আগ্রহ হয়, তাহলে এই মতবাদ তাকে বলে তোমার বাঁচার কোন আশা নেই, যা কিছু তুমি করে এসেছো তার ফল অবশ্যি তোমাকে ভোগ করতে হবে। এর বিপরীত পক্ষে কুরআন বলে, সৎকাজের পুরস্কার ও অসৎকাজের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। তোমরা যে সৎকাজের পুরস্কার পাও সেটা তোমাদের সৎকাজের স্বাভাবিক ফল নয়। সেটা আল্লাহর দান। তিনি চাইলে দান করতে পারেন, চাইলে নাও করতে পারেন। অনুরূপভাবে তোমরা যে অসৎকাজের শাস্তি লাভ করো সেটা তোমাদের অসৎকাজের অনিবার্য ফল নয়। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা ও ইখতিয়ার রয়েছে, তিনি চাইলে ক্ষমা করতে এবং চাইলে শাস্তি দিতে পারেন। তবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত তাঁর জ্ঞানের সাথে গভীর সূত্রে আবদ্ধ। তিনি জ্ঞানী হবার কারণে তাঁর ক্ষমতা কর্তৃত্ব অন্ধের মতো ব্যবহার করেন না। কোন সৎকাজের পুরস্কার দেয়ার সময় বান্দা আন্তরিকতা সহকারে, সাচ্চা নিয়তে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এই সৎকাজটি করেছে, এ দিকটি বিবেচনা করেই তিনি তাকে পুরস্কৃত করেন। আর কোন সৎকাজকে প্রত্যাখ্যান করলে এই উদ্দেশ্যে করেন যে, তার বাইরের রূপটি ছিল ঠিক সৎকাজের মতোই কিন্তু তার ভেতরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নির্ভেজাল প্রেরণা ও ভাবধারা কার্যকর ছিল না। অনুরূপভাবে বিদ্রোহাত্মক ধৃষ্টতা সহকারে কোন অসৎকাজ করা হলে তার পেছনে যদি লজ্জার মনোভাবের পরিবর্তে আরো বেশী অপরাধ করার প্রবণতা সক্রিয় থাকে তাহলে এ ধরনের অপরাধের তিনি শাস্তি দিয়ে থাকেন। আর যে অসৎকাজ করার পর বান্দা লজ্জিত হয় এবং ভবিষ্যতে নিজের সংশোধন প্রয়াসী হয় এই ধরনের অসৎকাজে ত্রুটি তিনি নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেন। মারাত্মক ধরনের অপরাধী কট্টর কাফেরের জন্যও আল্লাহর দরবার থেকে নিরাশ হবার কোন কারণ নেই। তবে শর্ত হচ্ছে, সে যদি তার অপরাধ স্বীকার করে, নিজের নাফরমানির জন্য লজ্জিত হয় এবং বিদ্রোহের মনোভাব ত্যাগ করে আনুগত্যের পথে এগিয়ে চলতে প্রস্তুত হয়, তাহলে আল্লাহ তার গোনাহ ও ত্রুটি মাফ করে দেবেন।
৫৩.
এই বাক্যটির পুনরাবৃত্তি তাৎপর্যপূর্ণ। আগের বাক্যে বলা হয়েছে আদম তাওবা করলেন এবং আল্লাহ‌ তা কবুল করে নিলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ালো, আদম তাঁর নাফরমানির জন্য আযাবের হকদার হলেন না। গোনাহগারীর যে দাগ তাঁর গায়ে লেগেছিল তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। না এ দাগের কোন চিহ্ন তাঁর বা তাঁর বংশধরদের গায়ে রইলো, ফলে আর না এ প্রয়োজন হলো যে, আল্লাহর –একমাত্র পুত্রকে (মায়াযাল্লাহ) (নাউযুবিল্লাহ) বনী আদমের গোনাহর কাফফারাহ আদায় করার জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়ে শূলে চড়াতে হলো। বিপরীত পক্ষে মহান আল্লাহ‌ আদম আলাইহিস সালামের কেবল তাওবাই কবুল করে ক্ষান্ত হননি এবং এরপর আবার তাঁকে নবুওয়াতও দান করলেন। এভাবে তিনি নিজের বংশধরদেরকে সত্য –সহজ পথ দেখিয়ে গেলেন।

এখানে আবার জান্নাত থেকে বের করে দেয়ার হুকুমের পুনরাবৃত্তি করে একথা বুঝানো হয়েছে যে, আদমকে পৃথিবীতে না নামিয়ে জান্নাতে রেখে দেয়া তাওবা কবুলিয়াতের অপরিহার্য দাবী ছিল না। পৃথিবী তাঁর জন্য দারুল আযাব বা শাস্তির আবাস ছিল না। শাস্তি দেয়ার জন্য তাঁকে এখানে পাঠানো হয়নি। বরং তাঁকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। জান্নাত তাঁর আসল কর্মস্থল ছিল না। সেখান থেকে বের করে দেয়ার হুকুম তাঁকে শাস্তি দেয়ার পর্যায়ভুক্ত ছিল না। তাঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়াটাই ছিল মূল পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। তবে এর আগে ৪৮নং টীকার যে পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই পরীক্ষার জন্যই তাকে জান্নাতে রাখা হয়েছিল।

.
৫৪.
আরবীতে আয়াতের আসল মানে হচ্ছে নিশানী বা আলামত। এই নিশানী কোন জিনিসের পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ দেয়। কুরআনে এই শব্দটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এর অর্থ হয়েছে নিছক আলামত বা নিশানী। কোথাও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনসমূহকে বলা হয়েছে আল্লাহর আয়াত। কারণ এই বিশ্ব-জাহানের অসীম ক্ষমতাধর আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুই তার বাহ্যিক কাঠামোর অভ্যন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে। কোথাও নবী-রসূলগণ যেসব ‘মু’জিযা’ (অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম) দেখিয়েছেন সেগুলোকে বলা হয়েছে আল্লাহর আয়াত। কারণ নবী-রসূলগণ যে এ বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন প্রভুর প্রতিনিধি এই মু’জিযাগুলো ছিল আসলে তারই প্রমাণ ও আলামত। কোথাও কুরআনের বাক্যগুলোকে আয়াত বলা হয়েছে। কারণ এ বাক্যগুলো কেবল সত্যের দিকে পরিচালিত করেই ক্ষান্ত নয় বরং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কোন কিতাবই এসেছে, তার কেবল বিষয়বস্তুই নয়, শব্দ, বর্ণনাভংগী ও বাক্য গঠনরীতির মধ্যেও এই গ্রন্থের মহান মহিমান্বিত রচয়িতার অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয়েছে। কোথায় ‘আয়াত’ শব্দটি কোন্ অর্থ গ্রহণ করতে হবে তা বাক্যের পূর্বাপর আলোচনা থেকে সর্বত্র সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
৫৫.
এটা হচ্ছে সৃষ্টির প্রথম থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর স্থায়ী ফরমান। তৃতীয় রুকূ’তে এটিকেই আল্লাহর ‘অঙ্গীকার’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নেয়া মানুষের কাজ নয়। বরং একদিকে বান্দা এবং অন্যদিকে খলীফার দ্বিবিধ ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে তার রব-নির্ধারিত পথের অনুসরণ করার জন্যই সে নিযুক্ত হয়েছে। দু’টো উপায়ে এ পথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এক, কোন মানুষের কাছে সরাসরি আল্লাহ পক্ষ থেকে অহী আসতে পারে। দুই, অথবা যে মানুষটির কাছে অহী এসেছে, তার অনুসরণ করা যেতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তৃতীয় কোন পথ নেই। এ দু’টি পথ ছাড়া বাদবাকি সমস্ত পথই মিথ্যা ও ভুল। শুধু ভুলই নয়, প্রত্যক্ষ বিদ্রোহের পথও। আর এর শাস্তি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়।

কুরআন মজীদের সাতটি জায়গায় আদমের জন্ম ও মানবজাতির সূচনা কালের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে। এ সাতটি জায়গার মধ্যে এটিই হচ্ছে প্রথম এবং আর ছয়টি জায়গায় হচ্ছেঃ সূরা আল আ’রাফ ২য় রুকু’, আল হিজর ৩য় রুকু, বনী ইসরাঈল ৭ম রুকূ’, আল কাহাফ ৭ম রুকু’, তা-হা ৭ম রুকু’ এবং সা’দ ৫ম রুকু’। বাইবেলের জন্ম অধ্যায়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অনুচ্ছেদেও এ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বাইবেল ও কুরআন উভয়ের বর্ণনার তুলনা করার পর একজন বিবেকবান ও সুস্থ্য জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নিজেই উভয় কিতাবের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন।

আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকালীন আল্লাহ ও ফেরেশতাদের মধ্যকার কথাবার্তার বর্ণনা তালমূদেও উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু কুরআন বর্ণিত কাহিনীতে যে গভীর অন্তর্নিহিত প্রাণসত্তার সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানে তা অনুপস্থিত। বরং সেখানে কিছু রসাত্মক আলাপও পাওয়া যায়। যেমন, ফেরেশতারা আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হচ্ছে?’ জবাবে আল্লাহ বললেন, ‘এ জন্য যে, তাদের মধ্যে সৎলোক জন্ম নেবে। ’ অসৎলোকদের কথা আল্লাহ বললেন না। অন্যথায় ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনার পক্ষে অনুমোদন দিতেন না। [Talmudic Miscellany, paul Issac Herson, London 1880. P . 294-95]

৫৬.
‘ইসরাঈল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আবদুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা। এটি হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের উপাধি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি এ উপাধিটি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র ও ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রপুত্র। তাঁরই বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাঈল। আগের চারটি রুকূ’তে যে ভাষণ পেশ করা হয়েছে তা একটি ভূমিকামূলক ভাষণ। এই ভাষণে সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এখন এই পঞ্চম রুকূ’ থেকে চৌদ্দ রুকু’ পর্যন্ত যে ভাষণ চলছে, এটি একটি ধারাবাহিক ভাষণ। এই ভাষণে মূলত বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে কোথাও কোথাও খৃস্টান ও আরবের মুশ্রিকদের দিকে লক্ষ্য করেও কথা বলা হয়েছে। আবার সুবিধা মতো কোথাও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে যারা ইসলামের ওপর ঈমান এনেছিল তাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। এ ভাষণটি পড়ার সময় নিম্নোক্ত কথাগুলো বিশেষভাবে সামনে রাখতে হবেঃ

একঃ পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাতের মধ্যে এখনো কিছু সংখ্যক সত্যনিষ্ঠ এবং সৎবৃত্তি ও সদিচ্ছা সম্পন্ন লোক রয়ে গেছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সত্যের আহবায়ক এবং যে আন্দোলনের মহানায়ক করে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার এবং তাঁর আন্দোলনে শরীক হবার জন্য আহবান জানানোই এ ভাষণের উদ্দেশ্য। তাই তাদের বলা হচ্ছে, ইতিপূর্বে তোমাদের নবীগণ এবং তোমাদের কাছে আগত সহীফাগুলো যে দাওয়াত ও আন্দোলন নিয়ে বার বার এসেছিল এই কুরআন ও এই নবী সেই একই দাওয়াত ও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। প্রথমে এটি তোমাদেরকেই দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তোমরা নিজেরা এ পথে চলবে এবং অন্যদেরকেও এদিকে আহবান জানাবে এবং এ পথে চালাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু অন্যদেরকে পথ দেখানো তো দূরের কথা তোমরা নিজেরাই সে পথে চলছো না। তোমরা বিকৃতির পথেই এগিয়ে চলছো। তোমাদের ইতিহাস এবং তোমাদের জাতির বর্তমান নৈতিক ও দ্বীনি অবস্থাই তোমাদের বিকৃতির সাক্ষ্য দিয়ে চলছে। এখন আল্লাহ সেই একই জিনিস দিয়ে তাঁর এক বান্দাকে পাঠিয়েছেন এটি কোন নতুন ও অজানা জিনিস নয়। তোমাদের নিজেদের জিনিস। কাজেই জেনে-বুঝে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করো না। বরং তাকে মেনে নাও। যে কাজ তোমাদের করার ছিল কিন্তু তোমরা করোনি। সেই কাজ আজ অন্যেরা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তোমরা তাদের সাথে সহযোগিতা করো।

দুইঃ সাধারণ ইহুদিদের কাছে চূড়ান্ত কথা বলে দেয়া এবং তাদের দ্বীনি ও নৈতিক অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্যে। তোমাদের নবীগণ যে দ্বীনের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ ﷺ সে দ্বীনেরই দাওয়াত দিচ্ছেন – একথাটিই তাদের সামনে প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বীনের মূলনীতির মধ্যে এমন একটি বিষয়ও নেই যেখানে কুরআনের শিক্ষা তাওরাতের শিক্ষা থেকে আলাদা-একথাই তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল তার আনুগত্য করার এবং নেতৃত্বের যে দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছিল তার হক আদায় করার ব্যাপারে তোমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছো। এমন সব ঘটনাবলী থেকে এর সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যার প্রতিবাদ করা তাদের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। আবার সত্যকে জানার পরও যেভাবে তারা তার বিরোধিতায় চক্রান্ত, বিভ্রান্তি সৃষ্টি, হঠধর্মিতা, কূটতর্ক ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছিল এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিশনকে সফলকাম হতে না দেয়ার জন্য যেমন পদ্ধতি অবলম্বন করছিল তা সবই ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। এ থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাদের বাহ্যিক ধার্মিকতা নিছক একটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে বিশ্বস্ততা ও সত্যনিষ্ঠার পরিবর্তে হঠধর্মিতা, অজ্ঞতা মূর্খতাপ্রসূত বিদ্বেষ ও স্বার্থান্ধতা। আসলে সৎকর্মশীলতার কোন কাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি তারা চায় না। এভাবে চূড়ান্ত কথা বলে দেয়ায় যে সুফল হয়েছে তা হচ্ছে এই যে একদিকে ঐ জাতির মধ্যে যেসব সৎলোক ছিল তাদের চোখ খুলে গেছে এবং অন্যদিকে মদীনার জনগণের বিশেষ করে আরব দেশের মুশরিকদের ওপর তাদের যে ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব ছিল, তা খতম হয়ে গেছে। তৃতীয়ত নিজেদের আবরণহীন চেহারা দেখে তারা নিজেরাই হিম্মতহারা হয়ে গেছে। ফলে নিজের সত্যপন্থী হবার ব্যাপারে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ রূপে নিশ্চিত সে যেমন সৎসাহস ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলায় এগিয়ে আসে তেমনটি করা তাদের পক্ষে কোন দিন সম্ভব হয়নি।

তিনঃ আগের চারটি রুকূ’তে সমগ্র মানবজাতিকে সাধারণভাবে দাওয়াত দিয়ে যেসব কথা বলা হয়েছিল সে একই প্রসঙ্গে যে জাতি আল্লাহ প্রেরিত বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তেমনি একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত দিয়ে তার পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য বনী ইসরাঈলকে বাছাই করার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। পৃথিবীর অসংখ্য জাতিদের মধ্যে বর্তমান বিশ্বে একমাত্র বনী ইসরাঈলই ক্রমাগত চার হাজার বছর থেকে সমগ্র মানবজাতির সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে আছে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার পথে কোন জাতির জীবনে যত চড়াই উতরাই আসতে পারে তার সবগুলোরই সন্ধান পাই আমরা এ জাতিটির মর্মান্তিক ইতিকথায়।

চারঃ মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের শিক্ষা দেয়াই এর উদ্দেশ্য। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাতরা অধঃপতনের যে গভীর গর্তে পড়ে গিয়েছিল তা থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে রক্ষা করাই এর লক্ষ্য। ইহুদিদের নৈতিক দুর্বলতা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং বিশ্বাস ও কর্মের গলদগুলোর মধ্য থেকে প্রতিটির দিকে অংগুলি নির্দেশ করে তার মোকাবিলায় আল্লাহর সত্য দ্বীনের দাবীসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে মুসলমানরা পরিষ্কারভাবে নিজেদের পথ দেখে নিতে পারবে এবং ভুল পথ থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে ইহুদি ও খৃস্টানদের সমালোচনা করে কুরআন যা কিছু বলেছে সেগুলো পড়ার সময় মুসলমানদের অবশ্যি নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিখ্যাত হাদীস মনে রাখা উচিত। হাদীসটিতে তিনি বলেছেনঃ তোমরাও অবশেষে পূর্ববর্তী উম্মাতদের কর্মনীতির অনুসরণ করবেই। এমন কি তারা যদি কোন গো-সাপের গর্তে ঢুকে থাকে, তাহলে তোমরাও তার মধ্যে ঢুকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ইহুদি ও খৃস্টানদের কথা বলছেন? জবাব দিলেন, তাছাড়া আর কি? নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তিটি কেবলমাত্র একটি ভীতি প্রদর্শনই ছিল না বরং আলাহ প্রদত্ত গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছিলেন, বিভিন্ন নবীর উম্মাতের মধ্যে বিকৃতি এসেছিল কোন্ কোন্ পথে এবং কো্ন আকৃতিতে তার প্রকাশ ঘটেছিল।

.
৫৭ .
‘সামান্য দাম’ বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা বুঝানো হয়েছে। এর বিনিময়ে মানুষ আল্লাহর বিধান প্রত্যাখ্যান করছিল। সত্যকে বিক্রি করে তার বিনিময়ে সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ হাসিল করলেও তা আসলে সামান্য দামই গণ্য হবে। কারণ সত্য নিঃসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান।
.
৫৮.
এ আয়াতটির অর্থ বুঝার জন্য সমকালীন আরবের শিক্ষাগত অবস্থাটা সামনে থাকা দরকার। আরববাসীরা সাধারণভাবে ছিল অশিক্ষিত। তাদের তুলনায় ইহুদিদের মধ্যে এমনিতেই শিক্ষার চর্চা ছিল অনেক বেশী। তাছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইহুদিদের মধ্যে এমন অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন যাদের খ্যাতি আরবের গণ্ডী ছাড়িয়ে বিশ্ব পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই আরবদের ওপর ইহুদিদের ‘জ্ঞানগত’ প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশী। এর ওপর ছিল আবার তাদের উলামা ও মাশায়েখের ধর্মীয় দরবারের বাহ্যিক শান –শওকত। এসব জাঁকালো দরবারে বসে তারা ঝাঁড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজ ইত্যাদির কারবার চালিয়েও জনগণের ওপর নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি গভীরতর ও ব্যাপকতর করেছিলেন। বিশেষ করে মদীনাবাসীদের ওপর তাদের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। কারণ তাদের আশেপাশে ছিল বড় বড় ইহুদি গোত্রের আবাস। ইহুদিদের সাথে তাদের রাত-দিন ওঠাবসা ও মেলামেশা চলতো। একটি অশিক্ষিত জনবসতি যেমন তার চাইতে বেশ শিক্ষিত, বেশী সংস্কৃতিবান ও বেশী সুস্পষ্ট ধর্মীয় গুণাবলীর অধিকারী প্রতিবেশীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, এই মেলামেশায় মদীনাবাসীরাও ঠিক তেমনি ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এ অবস্থায় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করলেন এবং লোকদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে থাকলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই অশিক্ষিত আরবরা আহলে কিতাব ইহুদিদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো, “আপনারাও তো একজন নবীর অনুসারী এবং একটি আসমানী কিতাব মেনে চলেন, আপনারাই বলুন, আমাদের মধ্যে এই যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করছেন তাঁর এবং তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কি?” মক্কার লোকেরাও ইতিপূর্বে ইহুদিদের কাছে এ প্রশ্নটি বার বার করেছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লালাহু ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসার পর এখানেও বহু লোক ইহুদি আলেমদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু ইহুদি আলেমরা কখনো এর জবাবে সত্য কথা বলেনি। ডাহা মিথ্যা কথা বলা তাদের জন্য কঠিন ছিল। যেমন, মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাওহীদ পেশ করছেন তা মিথ্যা। অথবা আম্বিয়া, আসমানী গ্রন্থসমূহ, ফেরেশতা ও আখেরাত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য সঠিক নয়। অথবা তিনি যে নৈতিক মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছেন তার মধ্যে কোন গলদ রয়ে গেছে। তবে যা কিছু তিনি পেশ করছেন তা সঠিক ও নির্ভুল—এ ধরনের স্পষ্ট ভাষায় সত্যের স্বীকৃতি দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল না, তারা প্রকাশ্যে সত্যের প্রতিবাদ করতে পারছিল না আবার সোজাসুজি তাকে সত্য বলে মেনে নিতেও প্রস্তুত ছিল না। এ দু’টি পথের মাঝখানে তারা তৃতীয় একটি পথ অবলম্বন করলো। প্রত্যেক প্রশ্নকারীর মনে তারা নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর জামায়াত ও তাঁর মিশনের বিরুদ্ধে কোন না কোন অসঅসা-প্ররোচনা দিয়ে দিত। তাঁর বিরুদ্ধে কোন না কোন অভিযোগ আনতো, এমন কোন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতো যার ফলে লোকেরা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে যেতো। এভাবে তারা মানুষের মনে সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ বপন করে তাদেরকে বেড়াজালে আটকে রাখতে এবং তাদের মাধ্যমে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদেরকেও আটকাতে চাইতো। তাদের এ দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতির কারণে তাদেরকে বলা হচ্ছেঃ সত্যের গায়ে মিথ্যার আবরণ চড়িয়ে দিয়ো না। নিজেদের মিথ্যা প্রচারণা এবং শয়তানী সন্দেহ-সংশয় আপত্তির সাহায্য সত্যকে দাবিয়ে ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করো না। সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে দুনিয়াবাসীকে প্রতারিত করো না।
৫৯.
নামায ও যাকাত প্রতি যুগে দ্বীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। অন্যান্য সব নবীদের মতো বনী ইসরাঈলদের নবীরাও এর প্রতি কঠোর তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদিরা এ ব্যাপারে গাফেল হয়ে পড়েছিল। তাদের সমাজে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থাপনা প্রায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেশীর ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়েও নামায ছেড়ে দিয়েছিল। আর যাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা সুদ খেতো।
.
অনুবাদ: