পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

১৩৭ আয়াত

১২ ) আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমনসব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটাই বড় সফলতা। ১৭
يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ وَمَسَـٰكِنَ طَيِّبَةًۭ فِى جَنَّـٰتِ عَدْنٍۢ ۚ ذَٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ ١٢
১৩ ) আর আরেক জিনিস যা তোমরা আকাংখা করো আল্লাহ‌ তাও তোমাদের দেবেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং অতি নিকটবর্তী সময়ে বিজয়। ১৮ হে নবী! ঈমানদারদেরকে এর সুসংবাদ দান করো।
وَأُخْرَىٰ تُحِبُّونَهَا ۖ نَصْرٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ وَفَتْحٌۭ قَرِيبٌۭ ۗ وَبَشِّرِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ١٣
১৪ ) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। ঠিক তেমনি, যখন ঈসা ইবনে মারয়াম হাওয়ারীদের ১৯ উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ আল্লাহর দিকে (আহবান করার ক্ষেত্রে) কে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীরা জবাব দিয়েছিলোঃ আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী। ২০ সেই সময় বনী ইসরাঈল জাতির একটি দল ঈমান আনয়ন করেছল এবং আরেকটি দল অস্বীকার করেছিল। অতঃপর আমি ঈমান আনয়নকারীদেরকে তাদের শত্রুদিগের বিরুদ্ধে শক্তি যোগালাম এবং তারাই বিজয়ী হয়ে গেল। ২১
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُونُوٓا۟ أَنصَارَ ٱللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّـۧنَ مَنْ أَنصَارِىٓ إِلَى ٱللَّهِ ۖ قَالَ ٱلْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ ٱللَّهِ ۖ فَـَٔامَنَت طَّآئِفَةٌۭ مِّنۢ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ وَكَفَرَت طَّآئِفَةٌۭ ۖ فَأَيَّدْنَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ عَلَىٰ عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا۟ ظَـٰهِرِينَ ١٤
১ ) আসমানে যা আছে এবং যমীনে যা আছে তার সবই আল্লাহর তাসবীহ করছে। তিনি বাদশাহ, অতি পবিত্র এবং মহা পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়।
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ٱلْمَلِكِ ٱلْقُدُّوسِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَكِيمِ ١
২ ) তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।
هُوَ ٱلَّذِى بَعَثَ فِى ٱلْأُمِّيِّـۧنَ رَسُولًۭا مِّنْهُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَـٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا۟ مِن قَبْلُ لَفِى ضَلَـٰلٍۢ مُّبِينٍۢ ٢
৩ ) (এ রসূলের আগমন) তাদের অন্য লোকদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে যোগ দেয়নি। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়।
وَءَاخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا۟ بِهِمْ ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ ٣
৪ ) এটা তাঁর মেহেরবানী, তিনি যাকে চান তা দান করেন। আল্লাহ‌ মহাকরুণার অধিকারী।
ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ ٤
৫ ) যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি তাদের উপমা সেই সব গাধা যা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকরে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না।
مَثَلُ ٱلَّذِينَ حُمِّلُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ ٱلْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًۢا ۚ بِئْسَ مَثَلُ ٱلْقَوْمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِ ٱللَّهِ ۚ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٥
৬ ) তুমি বল, হে ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকগণ! ১০ তোমরা যদি ভেবে থাকো যে, অন্য সব মানুষ বাদ দিয়ে কেবল তোমরাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র, ১১ আর তোমাদের এ ধারণার ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, ১২
قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ هَادُوٓا۟ إِن زَعَمْتُمْ أَنَّكُمْ أَوْلِيَآءُ لِلَّهِ مِن دُونِ ٱلنَّاسِ فَتَمَنَّوُا۟ ٱلْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ ٦
৭ ) তাহলে মৃত্যু চেয়ে নাও। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে ১৩ তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ‌ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন।
وَلَا يَتَمَنَّوْنَهُۥٓ أَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌۢ بِٱلظَّـٰلِمِينَ ٧
১৭.
এটা সেই ব্যবসায়ের আসল মুনাফা। আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে এই মুনাফাই অর্জিত হবে। এক, আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া। দুই, গোনাহসমূহ মাফ হওয়া। তিন, আল্লাহর সেই জান্নাতে প্রবেশ করা যার নিয়ামতসমূহ চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর।
১৮.
যদিও পৃথিবীতে বিজয়ী ও সফলতা লাভ করাও একটা বড় নিয়ামত। কিন্তু মু’মিনের নিকট প্রকৃত গুরুত্বের বিষয় এ পৃথিবীর সফলতা নয়, বরং আখেরাতের সফলতা। এ কারণেই দুনিয়ার এই জীবনে যে শুভ ফলাফল অর্জিত হবে তার উল্লেখ পরে করা হয়েছে আর আখেরাতে যে ফলাফল পাওয়া যাবে তার উল্লেখ আগে করা হয়েছে।
.
১৯.
হযরত ঈসা (আ) সঙ্গীদের জন্য বাইবেলে সাধারণত ‘শিষ্য’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে খৃস্টানদের মধ্যে তাদের জন্য রসূলحوارى পরিভাষাটি চালু হয়। তবে তারা আল্লাহর রসূল ছিল এ অর্থে তাদেরকে রসূল বলা হতো না, বরং তাদেরকে রসূল বলা হতো এ অর্থে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে মুবাল্লিগ হিসেবে পাঠাতেন। যেসব লোককে হাইকলের জন্য চাঁদা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পাঠানো হতো তাদের জন্য এ শব্দটির ব্যবহার ইহুদীদের মধ্যে পূর্ব থেকেই ছিল। পক্ষান্তরে কুরআন মজীদে এর পরিবর্তে হাওয়ারী পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যা এ দু’টি খৃষ্টীয় পরিভাষা থেকে উত্তম। এ শব্দটির মূল হলো حور যার অর্থ শুভ্রতা। ধোপাকে হাওয়ারী বলা হয়। এ জন্য যে, সে কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার ও সাদা করে দেয়। খাঁটি ও নিখাদ জিনিসকেও হাওয়ারী বলা হয়। চালুনি দিয়ে চেলে যে আটার ভূষি ও ছাল বের করে আলাদা করা হয়েছে তাকে حوارى (হাওয়ারা) বলে। এ অর্থে অকৃত্রিম বন্ধু ও নিঃস্বার্থ সাহায্যকারীকে বুঝাতে ও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ইবনে সাইয়েদ বলেনঃ যেসব ব্যক্তি কাউকে অধিক মাত্রায় সাহায্য করে তাকেও ঐ ব্যক্তির হাওয়ারী বলে। (লিসানুল আরব)।
২০.
যারা আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান জানায় এবং কুফরের মোকাবিলায় আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় তাদেরকে আল্লাহর সাহায্যকারী বলা হয়েছে এটি তার মধ্যে সর্বশেষ জায়গা। ইতিপূর্বে সূরা আলে ইমরানের ৫২ আয়াত, সূরা হজ্জের ৪০ আয়াত, সূরা মুহাম্মাদের ৭ আয়াত, সূরা হাদীদের ২৫ আয়াত এবং সূরা হাশরের ৮ আয়াতে এই একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাফহীমুল কুরআনে সূরা আলে ইমরানের ৫০ নং টীকা, সূরা হজ্জের ৮৪ নং টীকা, সূরা মুহাম্মাদের ১২নং টীকা এবং সূরা হাদীদের ৪৭ নং টীকায় আমরা এর ব্যাখ্যা পেশ করেছি। তাছাড়া সূরা মুহাম্মাদের ৯নং টীকায়ও এ বিষয়টির একটি দিক সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। এসব সত্ত্বেও কারো কারো মনে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, আল্লাহ‌ তা’আলা যখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী, সমস্ত সৃষ্টির কারো উপরই নির্ভরশীল নন, কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং সবাই তারই মুখাপেক্ষী তখন তার কোন বান্দা কেমন করে তাঁর সাহায্যকারী হতে পারে? এই খটকা এবং সন্দেহ-সংশয় দূর করার জন্য আমরা বিষয়টির আরো কিছু ব্যাখ্যা এখানে পেশ করেছি।

এসব লোককে আল্লাহর সাহায্যকারী মূলত এজন্য বলা হয়নি যে, কোন কাজের জন্য আল্লাহ‌ রাব্বুল আলামীন তাঁর কোন সৃষ্টির মুখাপেক্ষী (নাউযুবিল্লাহ)। বরং তাদেরকে আল্লাহর সাহায্যকারী এ জন্য বলা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা মানুষকে জীবনের যে গণ্ডিতে কুফর ও ঈমান এবং আনুগত্য ও নাফরমানীর যে স্বাধীনতা দিয়েছেন সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অজেয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জোর করে মানুষকে মু’মিন ও অনুগত বানান না। বরং নবী-রসূল ও কিতাবের সাহায্যে তাদেরকে উপদেশ দেন, শিক্ষাদান করেন এবং বুঝিয়ে সুজিয়ে সঠিক পথ দেখানোর পন্থা অবলম্বন করেন। যে ব্যক্তি এই উপদেশ ও শিক্ষাকে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে, গ্রহণ করে সে মু’মিন; যে কাজে পরিণত করে সে মুসলিম, অনুগত ও আবেদ; যে আল্লাহভীতির নীতি অনুসরণ করে সে মুত্তাকী, যে নেকীর কাজে অগ্রগামী হয় সে ‘মুহসিন’ এবং এ থেকে আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে যে এই উপদেশ ও শিক্ষার সাহায্য আল্লাহর বান্দাদের সংস্কার ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে এবং কুফর ও পাপাচারের স্থলে আল্লাহ‌ আনুগত্যের বিধান কায়েম করার জন্য কাজ করতে শুরু করে আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে তাঁর সাহায্যকারী বলে আখ্যায়িত করেন। যেমন উপরোক্ত আয়াতের কয়েকটি স্থানে স্পষ্ট ভাষায় এ কথাটিই বলা হয়েছে। যদি আল্লাহর সাহায্যকারী না বলে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী বলা মূল উদ্দেশ্য হতো তাহলে أَنْصَارُ اللَّهِ না বলে انصار دين الله বলা হতো, ينصرون الله না বলে ينصرون دين الله বলা হতো এবং ان تنصروا الله না বলে ان تنصروا دين الله বলা হতো। একটি বিষয় বলার জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা যখন এ কথাই প্রমাণ করে যে, এ ধরণের লোকদের আল্লাহর সাহায্যকারী বলাই এর মূল উদ্দেশ্য। তবে এই সাহায্য নাউযুবিল্লাহ এ অর্থে নয় যে, এসব লোক আল্লাহ‌ তা’আলার এমন কোন প্রয়োজন পূরণ করেছে যার তিনি মুখাপেক্ষী। বরং এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ তা’আলার যে কাজ তাঁর জবরদস্ত শক্তির জোরে না করে তাঁর নবী-রসূল ও কিতাবের সাহায্যে করতে চান এসব লোক সেই কাজে অংশগ্রহণ করছে।

২১.
ঈসা মাসীহর প্রতি ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী বলতে ইহুদী এবং ঈমান গ্রহণকারী বলতে খৃস্টান ও মুসলমান উভয়কে বুঝানো হয়েছে আর এই দুই জাতিকেই আল্লাহ‌ তা’আলা ঈসা মাসীহর অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন। এখানে একথাটি বলার উদ্দেশ্য মুসলমানদের এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া যে, হযরত ঈসার অনুসারীরা ইতিপূর্বেও যেভাবে তাঁর অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন এখনও তেমনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের অনুসারীরা তাঁর অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন।
১.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা হাদীদের ১ ও ২ নং টীকা, আল হাশরের ৩৬, ৩৭ ও ৪১ টীকা। পরবর্তী বিষয়ের সাথে এই প্রারম্ভিক কথাটির গভীর সম্পর্কে বিদ্যমান। আরবের ইহুদীরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিসত্তা, গুণাবলী ও কার্যকলাপে রিসালাতের স্পষ্ট নিদর্শন চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর সম্পর্কে তাওরাতে স্পষ্ট ভাষায় যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা যে তাঁর ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না তা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও শুধু এজন্য তাঁকে অস্বীকার করেছিল যে, নিজ জাতি ও বংশের বাইরের আর করো রিসালাত মেনে নেয়া তাদের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় ব্যাপার ছিল। তারা পরিষ্কার বলতো, আমাদের কাছে যা কিছু এসেছে আমরা কেবল তাই মানবো। কোনো অইসরাঈলী নবীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকেও কোনো শিক্ষা এসে থাকলে তো মেনে নিতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। এই আচরণের কারণে পরবর্তী আয়াতগুলোতে তাদেরকে তিরষ্কার করা হচ্ছে। তাই এই প্রারম্ভিক আয়াতাংশ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। এতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো, বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি বন্তু আল্লাহর তাসবীহ করছে। অর্থাৎ গোটা বিশ্ব-জাহান একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যেসব অপূর্ণতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে ইহুদীরা তাদের বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা কায়েম ও বদ্ধমূল করে রেখেছে আল্লাহ‌ তা’আলা তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি কারো আত্মীয় নন। তাঁর কাছে পক্ষপাতিত্বমূলক () কোন কাজ নেই। তিনি নিজের সমন্ত সৃষ্টির সাথে সমানভাবে ইনসাফ, রহমত ও প্রতিপালক সুলভ আচরণ করেন। কোনো বিশেষ বংশধারা বা কওম তাঁর প্রিয় নয় যে, তারা যাই করুক না কেন সর্বাবস্থায় তাঁর অনুগ্রহ তার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং অন্য কোনো জাতি গোষ্ঠী বা কওমের সাথে তাঁর কোন শত্রুতা নেই যে, তাদের মধ্যে সদগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তাঁর দান ও করুণা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। এরপর বলা হয়েছে তিনি বাদশাহ। অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের কোন শক্তিই তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ারকে সীমিত করতে পারে না। তোমরা তাঁর দাস এবং প্রজা। তোমাদের হিদায়াতের জন্য তিনি কাকে পয়গাম্বর বানাবেন আর কাকে বানাবেন না, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত পদমর্যাদা তোমরা কবে থেকে লাভ করছে? তারপর বলা হয়েছে, তিনিقدوس মহা পবিত্র। অর্থাৎ তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটির কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। তোমাদের বুঝ ও উপলব্ধিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু তার সিদ্ধান্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে না। শেষ দিকে আল্লাহ‌ তা’আলার আরো দু’টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে একটি হলো, তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশারী। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ জয়লাভ করতে পারে না। অপরটি হলো তিনি জ্ঞানময়, অর্থাৎ যা কিছু করেন, বুদ্ধি, বিবেক ও প্রজ্ঞার দাবীও হুবহু তাই। আর তাঁর কৌশল ও ব্যবস্থাপনা এতই সুদৃঢ় হয়ে থাকে যে, বিশ্ব-জাহানের কেউই তা ব্যর্থ করতে পারে না।
২.
এখানে ‘উম্মী’ শব্দটি ইহুদীদের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বা তিরষ্কার প্রচ্ছন্ন আছে। অর্থাৎ ইহুদীরা যাদেরকে অবজ্ঞা করে ‘উম্মী’ বলে থাকে এবং নিজেদের তুলনায় নগণ্য ও নীচু বলে মনে করে পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময় আল্লাহ‌ তাদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজে রসূল হয়ে বসেননি, বরং তাঁকে পাঠিয়েছেন তিনিই যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ, মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এরা নিজেদেরই ক্ষতি করবে তাঁর কোনো ক্ষতি করতে এরা আদৌ সক্ষম নয়।

জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন মজীদে, ‘উম্মী’ শব্দটি বেশ কটি স্থানে এসেছে। তবে সব জায়গায় শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও যাদের কাছে অনুসরণ করার জন্য কোন আসমানী কিতাব নেই আহলে কিতাবেরদের বিপরীতে তাদেরকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

قُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ (ال عمران : 20)

আহলে কিতাব ও উম্মীদের জিজ্ঞেস করঃ তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ? ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ২০)

এখানে উম্মী বলতে আরবের মুশরিকদের বুঝানো হয়েছে এবং তাদেরকে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী ও খৃস্টানদের থেকে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কোথাও এ শব্দটি আহলে কিতাবদেরই নিরক্ষর ও আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনবহিত লোকদের সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ (البقرة : 78)

“এই ইহুদীদের কিছু লোক আছে ‘উম্মী’ কিতাবের কোন জ্ঞান তাদের নেই। তারা কেবল নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনাকেই চিনে। “-(সূরা বাকারাঃ ৭৮)

আবার কোথাও এ শব্দটি নিরেট ইহুদী পরিভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘উম্মী’ বলতে অ-ইহুদী সবাইকে বুঝানো হয়েছে।

যেমন, বলা হয়েছেঃ

ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ (ال عمران : 75)

“তাদের মধ্যে এ অসাধুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, তারা বলেঃ ‘উম্মীদের অর্থ-সম্পদ লুটেপুটে ও মেরে খাওয়ার কোন দোষ নেই। “-(সূরা আলে ইমরানঃ ৭৫)

আলোচ্য আয়াতে এই তৃতীয় অর্থটিই গ্রহণ করা হয়েছে। এ শব্দটি ইব্রিয় ভাষায় “গোয়েম” শব্দের সমার্থক। ইংরেজী বাইবেলে এর অনুবাদ করা হয়েছে Gentiles এবং এর দ্বারা সমস্ত অ-ইহুদী বা-ইসরাঈলী লোককে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু শুধু এতটুকু ব্যাখ্যার, সাহায্য এ ইহুদী পরিভাষাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝা সম্ভব নয়। ইবরানী বা ইব্রিয় ভাষায় ‘গোয়েম’ শব্দটি প্রথমত কেবল জাতি বা কওমসমূহ অর্থে বলা হতো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইহুদীরা এটিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। প্রথমে তারা এটিকে নিজেদের ছাড়া অন্যসব কওমের জন্য নির্দিষ্ট করে। পরে এ শব্দটির অর্থে এ ভাবধারাও সৃষ্টি করে যে, ইহুদীরা ছাড়া অন্য সব জাতিই অসভ্য ও অভদ্র, ধর্মের দিক থেকে নিকৃষ্ট, অপবিত্র এবং নীচ ও হীন। শেষ পর্যন্ত অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা-বিদ্ধেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ শব্দটি উদ্দেশ্যে অগ্রীকদের জন্য গ্রীকদের ব্যবহৃত পরিভাষা Barbarian শব্দটিকেও ছাড়িয়ে যায়। রিব্বীদের সাহিত্যে ‘গোয়েম’রা এমনই ঘৃণ্য মানুষ যে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে ভাই বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং তাদের সাথে সফরও করা যেতে পারেনা। বরং তাদের কেউ যদি পানিতে ডুবে মারতে থাকে তাহলে তাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টাও করা যেতে পারে না। ইহুদীরা বিশ্বাস করতো, মাসীহ এসে সমস্ত গোয়েমকে ধ্বংস করে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবেন।-(আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান টীকা ৬৪)।

৩.
কুরআন মজীদের চারটি স্থানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রত্যেক স্থানই বর্ণনা করার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সূরা বাকারার ১২৯ আয়াতে এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছ আরববাসীদের একথা বলার জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হয়েছে আসাকে তারা যে নিজেদের জন্য দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বলে মনে করছে, তা ঠিক নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে তা তাদের জন্য একটি বড় নিয়ামত। এটি লাভের জন্য হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করতেন। সূরা বাকারার ১৫১ আয়াতে এসব গুণাবলী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানরা যেন নবীর ﷺ মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে নবী বানানোর মাধ্যমে যে নিয়ামত তাদের দিয়েছেন তা থেকে পুরোপুরি উপকৃত হতে পারে। সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ আয়াতে আবার এসব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের মানুষগুলোকে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তাদের কাছে তাঁর রসূল পাঠিয়ে কত বড় ইহসান করেছেন। কিন্তু তারা এমনই অপদার্থ যে, তাঁকে কোনো মর্যাদাই দিচ্ছে না। চতুর্থবারের মত এ সূরাতে ঐসব গুণাবলী পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ইহুদীদের একথা জানিয়ে দেয়া যে, মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের চোখের সামনে যেসব কাজ করেছেন, তা স্পষ্টত একজন রসূলের কাজ। তিনি আল্লাহর আয়াত শুনাচ্ছেন। এসব আয়াতের ভাষা, বিষয়বস্তু, বর্ণনাভঙ্গি সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তা প্রকৃতই আল্লাহর আয়াত। তা মানুষের জীবনকে সুন্দর, পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত করছে, তাদের নৈতিক চরিত্র, অভ্যাস ও রীতিনীতি এবং লেনদেন ও জীবনচারণকে সব রকমের কলূষ-কালিমা থেকে পবিত্র করছে এবং উন্নতমানের নৈতিক মর্যাদায় ভূষিত করছে। এটা ঠিক সেই কাজ যা ইতিপূর্বে সমস্ত নবী-রসূলও করেছেন। তাছাড়া তিনি শুধু আয়াতসমূহ শুনানোকেই যথেষ্ট মনে করেন না, বরং সবসময় নিজের কথা ও কাজ দ্বারা নিজের বাস্তব জীবনের উদাহরণ দ্বারা মানুষকে আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝাচ্ছেন। তিনি তাদের এমন যুক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞানের শিক্ষা দিচ্ছেন যা কেবল নবী-রসূলগণ ছাড়া আর কেউ-ই শিক্ষা দেয়নি। এ ধরনের চরিত্র ও কাজ নবী-রসূলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণ। এর সাহায্যেই তাদের চেনা যায়। সত্যিকার অর্থে নিজের কর্মকাণ্ড থেকে যার রসূল হওয়া প্রমাণিত হচ্ছে তাঁকে তোমরা কেবল এজন্য অস্বীকার করছো, যে তাঁকে তোমাদের কওমের মধ্য থেকে না পাঠিয়ে এমন এক কওমের মধ্য থেকে পাঠানো হয়েছে যাদেরকে তোমরা ‘উম্মী’ বলে অবজ্ঞা করে থাকেন।
৪.
এটা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আরো একটি প্রাণ। ইহুদীদের সত্যোপলদ্ধির জন্য এ প্রমাণটি পেশ করা হয়েছে। তারা শত শত বছর পূর্বে থেকে আরব ভূমিতে বসবাস করে আসছিল। আরবের অজানা ছিল না। তাদের পূর্বতন এ অবস্থার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলা হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে এ জাতির চেহারা যেভাবে আমূল পরিবর্তিত হয়েছে তা তোমরা নিজ চোখে দেখেছ। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এমন লোক যে অবস্থার মধ্যে ডুবে ছিল তা তোমাদের জানা আছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের অবস্থা কি হয়েছে তাও তোমরা নিজ চোখে দেখছ। আর এ জাতির যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের অবস্থাও কি তোমরা দেখতে পাচ্ছ। একজন অন্ধও এই স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে ও বুঝতে পারে। এটা কি তোমাদেরকে একথা বিশ্বাস করানোর জন্য যথেষ্ট নয় যে, একজন নবী ছাড়া এটা আর কারো কীর্তি হতে পারে না? বরং এর তুলনায় পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের কীর্তিও ম্লান হয়ে গিয়েছে।
৫.
অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত শুধু আরব জাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। তা সারা দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের مِنْهُمْ (তাদের মধ্য থেকে) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ () তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের---------(তাদের মধ্য থেকে, ) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে, অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার অ-ইসরাঈলী জাতি-গোষ্ঠীর লোক। দুই, তারা হবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণকারী। তবে এখনো ঈমানদারদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু পরে এসে শামিল হবে। এভাবে এ আয়াতটিও সেই সব আয়াতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত সমগ্র মানব জাতির জন্য এবং চিরদিনের জন্য। কুরআন মজীদের আর যেসব স্থানে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সূরা আল আনআম আয়াত ১৯, আল আরাফ১৫৮, আল আম্বিয়া ১০৭, আল ফুরকান, ১, সাবা ২৮; (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা টীকা ৪৭)।
৬.
অর্থাৎ এটি তাঁর শক্তি-সমর্থ ও জ্ঞানের বিস্ময়কর দিক যে, তিনি এ ধরনের এক অশিষ্ট উম্মী কওমের মধ্য থেকে এমন মহান নবী সৃষ্টি করেছেন যার শিক্ষা ও হিদায়াত এতটা বিপ্লবাত্মাক ও এমন বিশ্বজনীন স্থায়ী নীতিমালার ধারক, যার ওপর ভিত্তি করে গোটা মানব জাতি একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হতে পারে এবং এ নীতিমালা থেকে চিরদিন দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারে। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে কোনো মানুষই এই স্থান ও মর্যাদা লাভ করতে পারতো না। আরবদের মত পশ্চাদপদ জাতি তো দূরের কথা, দুনিয়ার কোন বড় জাতির সর্বাধিক মেধা-সম্পন্ন ব্যক্তিও এভাবে কোন জাতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে এবং গোটা মানব জাতিকে চিরদিনের জন্য একটি আদর্শ এবং একটি সংস্কৃতির বিশ্বজনীন ও সর্বাত্মক আদর্শ পরিচালনার যোগ্য হওয়ার মত একটা ব্যাপক নীতিমালা গোটা বিশ্বকে উপহার দিতে পারতো না। এটি আল্লাহর কুদরাতে সংঘটিত একটি মু’জিযা। আল্লাহ‌ তাঁর কৌশল অনুসারে যে ব্যক্তি, যে দেশ এবং যে জাতিকে চেয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে বাছাই করে নিয়েছেন। এতে কোন নির্বোধ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে পেতে থাকুক।
.
৭.
এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি সাধারণ অর্থ এবং অপরটি বিশেষ অর্থ। সাধারণ অর্থ হলো, যাদের ওপর তাওরাতের জ্ঞান অর্জন, তদনুযায়ী আমল এবং তাওরাত অনুসারে দুনিয়াকে পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা তাদের এ দায়িত্ব বুঝেনি এবং তার হকও আদায় করেনি। বিশেষ অর্থ হলো, তাওরাতের ধারক ও বাহক গোষ্ঠী হওয়ার কারণে যাদের কাজ ছিল সবার আগে অগ্রসর হয়ে সেই রসূলকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যার আগমনের সুসংবাদ তাওরাতের স্পষ্ট ভাষায় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাই তাঁর সবচেয়ে বেশী শত্রুতা ও বিরোধিতা করেছে এবং তাওরাতের শিক্ষার দাবী পূরণ করেনি।
৮.
অর্থাৎ গাধার পিঠে বই-পুস্তকের বোঝা চাপানো থাকলেও পিঠের ওপর কি আছে সে যেমন তা জানে না। অনুরূপ এই তাওরাতের বোঝাও তাদের ওপর চাপানো আছে। কিন্তু তারা আদৌ জানে না, এই মহান গ্রন্থ কি জন্য এসেছে এবং তাদের কাছে কি দাবী করছে।
৯.
অর্থাৎ তাদের অবস্থা গাধার চেয়েও নিকৃষ্টত। গাধার কোন বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি নেই বলে সে অক্ষম, কিন্তু এদের তো বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি আছে। এরা নিজেরা তাওরাত পড়ে এবং অন্যদের পড়ায় তাই এর অর্থ তাদের অজানা নয়। এরপরও তারা জেনে শুনে এর হিদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও উপেক্ষা করছে এবং সেই নবীকে মানতে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করছে যিনি তাওরাত অনুসারে অবিসংবাদিতভাবে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এরা জানে না বা বুঝে না বলে দোষী নয়, বরং জেনে শুনে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী।
.
১০.
এ বিষয়টি লক্ষণীয় যে, এখানে, “হে ইহুদীরা” বলা হয়নি। বলা হয়েছে “হে ইহুদী হয়ে যাওয়ার লোকগণ” অথবা “যারা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছো।” এর কারণ হলো, মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর আগের ও পরের নবী-রাসূগগণ আসল যে দ্বীন এনেছিলেন, তা ছিল ইসলাম। এসব-রসূলদের কেউই ইহুদী ছিলেন না এবং তাদের সময়ে ইহুদীদের সৃষ্টিও হয়েছিল না। এই নামে এ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে বহু পরে। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের চতুর্থ পুত্র ইয়াহুদার বংশোদ্ভুত গোত্রটির নামানুসারে এ ধর্মের নামকরণ হয়েছে। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের পরে তার সাম্রাজ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে এই গোত্রটি ইয়াহুদীয়া নামক রাষ্ট্রটির মালিক হয় এবং বনী ইসরাঈলদের অন্যান্য গোত্রগুলো নিজেদের একটি আলাদা রাষ্ট্র কায়েম, করে যা সামেরিয়া নামে খ্যাত হয়। পরবর্তীকালে আসিরীয়রা সামেরিয়াকে শুধু ধ্বংসই করেনি, বরং এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা ইসরাঈলী গোত্রগুলোর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছে। এরপরে শুধু ইয়াহুদা এবং তার সাথে বিন ইয়ামীনের বংশ অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তার ওপর ইয়াহুদা বংশের প্রভাব ও আধিপত্যের কারণে তাদের জন্য ইয়াহুদ শব্দটির প্রয়োগ হতে থাকে। ইহুদী ধর্মযাজক, রিব্বী এবং আহবাররা নিজেদের ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী এই বংশের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের যে কাঠামো শত শথ বছর ধরে নির্মাণ করেছে তার নাম ইহুদীবাদ। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই কাঠামো নির্মাণ শুরু হয় এবং খৃস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত চলতে থাকে। আল্লাহর রসূলদের আনীত আল্লাহর হিদায়াতের উপাদান খুব সামান্যই এতে আছে এবং যা আছে তার চেহারাও অনেকখানি বিকৃত হয়েছে। এ কারণে কুরআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে তাদেরকে الَّذِينَ هَادُوا বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ সেই সব লোক যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছে বা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যকার সবাই আবার ইসরাঈলী ছিল না। যেসব অইসরাঈলী ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছিল তারাও এর মধ্যে ছিল। কুরআন মজীদে যেখানে বনী ইসরাঈল জাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে “হে বনী ইসরাঈল” বলা হয়েছে। আর যেখানে ইহুদী ধর্মের অনুসারীদের সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে الَّذِينَ هَادُوا বলা হয়েছে।
১১.
কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের এই দাবী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনঃ তারা বলেন, ইহুদীরা ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। (আল বাকারাহ, ১১১)। দোযখের আগুন আমাদের কখনো স্পর্শ করতে না। আর আমাদেরকে যদি নিতান্তই শাস্তি দেয়া হয় তাহলে মাত্র কয়েক দিনের জন্য দেয়া হবে (আল বাকারাহ, ৮০; আলে ইমরান, ২৪)। আমরা আল্লাহর বেটা এবং তাঁর প্রিয়পাত্র (আল মায়েদা, ১৮)। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থসমূহেও এ ধরনের কিছু দাবী-দাওয়া দেখা যায়। সারা বিশ্বে অন্তত এতটুকু কথা জানে যে, তারা নিজেদেরকে আল্লাহর বাছাই করা সৃষ্টি বলে থাকে। তারা এরূপ এক খোশ খেয়ালে মত্ত যে, তাদের সাথে খোদার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে যা অন্য কোন মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে নেই।
১২.
এখানে কুরআন মজীদে একথাটি দ্বিতীয়বারের মত ইহুদীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। প্রথম সূরা বাকারায় বলা হয়েছিল, এদের বলো, আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষকে বাদ দিয়ে আখেরাতকের ঘর যদি কেবল তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থেকে থাকে আর এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু কামনা করো। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু করবে না। আল্লাহ‌ জালেমদের খুব ভাল করেই জানেন। বরং তোমরা দেখবে তারা কোন না কোন কোনভাবে বেঁচে থাকতে সমস্ত মানুষের চেয়ে এমনকি মুশরিকদের চেয়েও বেশী লালায়িত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা করে হাজার বছর বেঁচে থাকার। অথচ দীর্ঘ আয়ূ লাভ করলেও তা তাদেরকে এই আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। তাদের সমস্ত কৃতকর্মেই আল্লাহর দৃষ্টিতে আছে (আয়াত ৯৪-৯৬)। এ কথাটিই এখানে পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটা শুধু পুনরুক্তিই নয়। সূরা বাকারার আয়াতগুলোতে একথা বলা হয়েছে। তখন, যখন ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের কোন যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু এই সূরায় তার পুনরুক্তি করা হয়েছে এমন এক সময় যখন তাদের সাথে ইতিপূর্বে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর আরবভুমিতে চূড়ান্তভাবে তাদের শক্তি চূর্ণ করা হয়েছে। পূর্বে সূরা বাকারায় যে কথা বলা হয়েছিল এসব যুদ্ধ এবং তাদের পরিণাম অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষন দুই ভাবেই তা প্রমাণ করে দিয়েছিল। মদীনা এবং খায়বারে সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদী শক্তি কোনভাবেই মুসলমানদের তুলনায় কম ছিল না এবং উপায়-উপকরণ ও তাদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাছাড়া আরবের মুশরিকদের ধ্বংস করার জন্য তারা মুনাফিকরাও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করছিল। কারণ মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু এই অসম মোকাবিলায় যে জিনিসটি মুসলমানদের বিজয়ী এবং ইহুদীদের পরাজিত করেছিল তা ছিল এই যে, মুসলমানগণ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করতে ভীত হওয়া তো দূরের কথা বরং হৃদয়ের গভীর থেকে মৃত্যু কামনা করতো এবং মরণপণ করে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারা আল্লাহর পথে লড়াই করছে। আর এ বিষয়ে ও পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, এ পথে শাহাদাত বরণকারীর জন্য রয়েছে জান্নাত। অপরদিকে ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা কোন পথেই জান দিতে প্রস্তুত ছিল না; না খোদার পথে, না নিজের কওমের পথে এবং না নিজের জান, মাল ও ইজ্জত রক্ষার পথে। যে ধরনের জীবনই হোক না কেন তাদের প্রয়োজন ছিল কেবল বেঁচে থাকার। এ জিনিসটিই তাদেরকে ভীরু ও কাপুরুষ বানিয়ে দিয়েছিল।
১৩.
অন্য কথায় মৃত্যু থেকে তাদের এই পালানো বিনা কারণে নয়। মুখে তারা যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, আল্লাহর দ্বীনের সাথে তারা যে আচরণ করেছে এবং পৃথিবীতে তারা যা করেছে আখেরাতে সেই সব আচরণ ও কাজকর্মের কিরূপ ফলাফল আশা করা যায় তাদের জ্ঞান ও বিবেক তা ভাল করেই জানতো। এ কারণে তাদের প্রবৃত্তি আল্লাহর আদালতের মুখোমুখি হতে টালবাহানা করে।
.
অনুবাদ: