পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

১৩৭ আয়াত

২১ ) আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর রসূল অবশ্যই বিজয়ী হবেন। ৩৬ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী।
كَتَبَ ٱللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا۠ وَرُسُلِىٓ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ قَوِىٌّ عَزِيزٌۭ ٢١
২২ ) তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালবাসছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা গোষ্ঠীভুক্ত ৩৭ হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ‌ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রূহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম।
لَّا تَجِدُ قَوْمًۭا يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ يُوَآدُّونَ مَنْ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوْ كَانُوٓا۟ ءَابَآءَهُمْ أَوْ أَبْنَآءَهُمْ أَوْ إِخْوَٰنَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ كَتَبَ فِى قُلُوبِهِمُ ٱلْإِيمَـٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍۢ مِّنْهُ ۖ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَا ۚ رَضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ حِزْبُ ٱللَّهِ ۚ أَلَآ إِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ ٢٢
১ ) আল্লাহরই তাসবীহ করছে আসমান ও যমীনের প্রতিটি জিনিস। তিনিই বিজয়ী এবং মহাজ্ঞানী।
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۖ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ ١
২ ) তিনিই আহলে কিতাব কাফেরদেরকে প্রথম আক্রমণেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে দিয়েছেন। তোমরা কখনো ধারণাও কর নাই যে, তারা বের হয়ে যাবে। তারাও মনে করে বসেছিলো যে, তাদের দুর্গসমূহ তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ‌ এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন, যে দিকের ধারণাও তারা করতে পারেনি। তিনি তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফল হয়েছে এই যে, তারা নিজ হাতেও নিজেদের ঘর-বাড়ী ধ্বংস করছিলো এবং মু’মিনদের হাত দিয়েও ধ্বংস করেছিলো। অতএব, হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা, শিক্ষাগ্রহণ করো।
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَخْرَجَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ مِن دِيَـٰرِهِمْ لِأَوَّلِ ٱلْحَشْرِ ۚ مَا ظَنَنتُمْ أَن يَخْرُجُوا۟ ۖ وَظَنُّوٓا۟ أَنَّهُم مَّانِعَتُهُمْ حُصُونُهُم مِّنَ ٱللَّهِ فَأَتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا۟ ۖ وَقَذَفَ فِى قُلُوبِهِمُ ٱلرُّعْبَ ۚ يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُم بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِى ٱلْمُؤْمِنِينَ فَٱعْتَبِرُوا۟ يَـٰٓأُو۟لِى ٱلْأَبْصَـٰرِ ٢
৩ ) আল্লাহ যদি তাদের জন্য দেশান্তর হওয়া নির্দিষ্ট না করতেন তাহলে তিনি দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন। আর আখেরাতে তো তাদের জন্য দোজখের শাস্তি রয়েছেই।
وَلَوْلَآ أَن كَتَبَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمُ ٱلْجَلَآءَ لَعَذَّبَهُمْ فِى ٱلدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابُ ٱلنَّارِ ٣
৪ ) এ হওয়ার কারণ হলো, তারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের চরম বিরোধিত করেছে। যে ব্যক্তিই আল্লাহর বিরোধিতা করে, তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ‌ অত্যন্ত কঠোর।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَآقُّوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ ۖ وَمَن يُشَآقِّ ٱللَّهَ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ ٤
৫ ) খেজুরের যেসব গাছ তোমরা কেটেছো কিংবা যেসব গাছকে তার মূলের ওপর আগের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো তা সবই ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে। (আল্লাহ এ অনুমতি দিয়েছিলেন এ জন্য) যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন। ১০
مَا قَطَعْتُم مِّن لِّينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَآئِمَةً عَلَىٰٓ أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ ٱللَّهِ وَلِيُخْزِىَ ٱلْفَـٰسِقِينَ ٥
৬ ) আল্লাহ তা’আলা যেসব সম্পদ তাদের দখলমুক্ত করে তাঁর রসূলের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন ১১ তা এমন সম্পদ নয়, যার জন্য তোমাদের ঘোড়া বা উট পরিচালনা করতে হয়েছে। বরং আল্লাহ‌ সবকিছুই করতে সক্ষম। ১২
وَمَآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنْهُمْ فَمَآ أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍۢ وَلَا رِكَابٍۢ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ يُسَلِّطُ رُسُلَهُۥ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌۭ ٦
৭ ) এসব জনপদের দখলমুক্ত করে যে জিনিসই আল্লাহ‌ তাঁর রসূলকে ফিরিয়ে দেন তা আল্লাহ, রসূল, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য। ১৩ যাতে তা তোমাদের সম্পদশালীদের মধ্যেই কেবল আবর্তিত হতে না থাকে। ১৪ রসূল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ‌ কঠোর শাস্তিদাতা। ১৫
مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنْ أَهْلِ ٱلْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِى ٱلْقُرْبَىٰ وَٱلْيَتَـٰمَىٰ وَٱلْمَسَـٰكِينِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ كَىْ لَا يَكُونَ دُولَةًۢ بَيْنَ ٱلْأَغْنِيَآءِ مِنكُمْ ۚ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمْ عَنْهُ فَٱنتَهُوا۟ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ ٧
৮ ) (তাছাড়াও এ সম্পদ) সেই সব গরীব মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও বিষয়-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। ১৬ এসব লোক চায় আল্লাহর মেহেরবানী এবং সন্তুষ্টি। আর প্রস্তুত থাকে আল্লাহ‌ ও তার রসূলকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। এরাই হলো সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ লোক।
لِلْفُقَرَآءِ ٱلْمُهَـٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخْرِجُوا۟ مِن دِيَـٰرِهِمْ وَأَمْوَٰلِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًۭا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَٰنًۭا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ ٨
৩৬.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আস, সাফ্ফাত, টীকা-৯৩।
.
৩৭.
এ আয়াতে দুইটি কথা বলা হয়েছে। একটি নীতি কথা। অন্যটি প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা। নীতি কথায় বলা হয়েছে যে, সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান এবং দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী জিনিস। এ দু’টি জিনিসের একত্র সমাবেশ বা অবস্থান কোনভাবে কল্পনাও করা যায় না। ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব একই হৃদয়ে একত্রিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের হৃদয়ে যখন একই সাথে নিজের প্রতি ভালবাসা এবং শত্রুর প্রতি ভালবাসা একত্রিত হতে পারে না তখন এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার। অতএব তোমরা যদি কাউকে দেখো, সে ঈমানের দাবীও করে এবং সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও রাখে তাহলে তোমাদর মনে কখনো যেন এ ভুল ধারণা না জন্মে যে, এ আচরণ সত্ত্বেও সে তার ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী। অনুরূপ যেসব লোক একই সাথে ইসলাম ও ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সে নিজেও যেন তার এ অবস্থান ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কি, মু’মিন না মুনাফিক? সে প্রকৃতপক্ষে কি হতে চায়, মু’মিন হয়ে থাকতে চায়, নাকি মুনাফিক হয়ে? তার মধ্যে যদি সততার লেশমাত্রও থেকে থাকে এবং মুনাফিকীর আচরণ যে নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের জন্য নিকৃষ্টতম আচরণ এ বিষয় তার মধ্যে সামান্যতম অনূভূতিও থাকে তা হলে তার উচিত একই সাথে দুই নৌকায় আরোহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করা। ঈমান এ ব্যাপারে তার কাছে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবী করে। সে যদি মু’মিন থাকতে চায় তাহলে যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন ইসলামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধনের সাথে সাংঘর্ষিক তার সবই তাকে বর্জন করতে হবে। ইসলামের সাথে সম্পর্কের চাইতে অন্য কোন সম্পর্ক প্রিয়তর হয়ে থাকলে ঈমানের মিথ্যা দাবী ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

এটি ছিল নীতিগত কথা। কিন্তু এখানে আল্লাহ তা’আলা শুধু নীতি বর্ণনা করাই যথেষ্ট মনে করেননি। বরং ঈমানের দাবীদারদের সামনে নমুনা স্বরূপ এ বাস্তব ঘটনাও পেশ করেছেন যে, সত্যিকার ঈমানদারগণ বাস্তবে সবার চোখের সামনে সে সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করেছিল যা আল্লাহর দ্বীনের সাথে সম্পর্কের পথে প্রতিবন্ধক ছিল। এটা ছিল এমন একটা ঘটনা যা বদর ও উহুদ যুদ্ধের সময় সমগ্র আরব জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল। যেসব সাবাহায়ে কিরাম মক্কা থেকে হিজরত করে এসেছিলেন তারা শুধু আল্লাহ এবং দ্বীনের খাতিরে নিজেদের গোত্র এবং ঘনিষ্টতর নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। হযরত আবু উবাদাহ তাঁর নিজের পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহকে হত্যা করেছিলেন। হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের আপন ভাই উবাদাহ ইবনে উমায়েরকে হত্যা করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাহকে হত্যা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর পুত্র আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন। হযরত আলী, হযরত হামযা এবং হযরত উবাইদা ইবনুল হারেস তাদের নিকটাত্মীয় উতবা, শায়বা এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবাকে হত্যা করেছিলেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে হযরত উমর (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাদের সবাইকে হত্যা করার আবেদন করে বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে হত্যা করবে। এ বদর যুদ্ধেই এক আনসারী হযরত মুসআব ইবনে উমায়েরের আপন ভাই আবু আযীয ইবনে উমায়েরকে পাকড়াও করে বাঁধছিলেন। তা দেখে হযরত মুসআব চিৎকার করে বললেনঃ বেশ শক্ত করে বাঁধো। এর মা অনেক সম্পদশালিনী। এর মুক্তির জন্য সে তোমাদেরকে অনেক মুক্তিপণ দিবে। একথা শুনে আবু আযীয বললোঃ তুমি ভাই হয়ে একথা বলছো? জবাবে হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের বললেনঃ এ মুহূর্তে তুমি আমার ভাই নও, বরং যে আনসারী তোমাকে পাকড়াও করছে সে আমার ভাই। বদর যুদ্ধেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা আবুল আস বন্দি হয়ে আসলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা হওয়ার কারণে তার সাথে অন্য সব কয়েদী থেকে ভিন্ন বিশেষ কোন সৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়নি। খাঁটি ও নিষ্ঠাবান মুসলমান কাকে বলে এবং আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্ক কি এভাবে বাস্তবে তা দুনিয়াকে দেখানো হয়েছে।

দায়লামী হযরত মুয়ায থেকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ দোয়াটি উদ্ধৃত করেছেনঃ

اللهم لاتجعل لفاجر (وفى رواية لفاسق) على يدا ولانعمة فيوده قلبى فانى وجدت فيما او حيت الى لا تجد قوما يؤمنون بالله اليوم الاخر يوادون من حاد الله ورسوله-

“হে আল্লাহ আমাকে কোন পাপী লোকের দ্বারা (অপর একটি বর্ণনায় আছে ফাসেক) উপকৃত হতে দিও না। তাহলে আমার মনে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। কারণ, তোমার নাযিলকৃত অহীর মধ্যে আমি একথাও পেয়েছি যে, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণকারী লোকদেরকে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না।”

.
১.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন সূরা হাদীদের তাফসীরের ১ও ২নং টীকা। বনী নাযিরের বহিষ্কার সম্পর্কে বিশ্লেষণ শুরু করার আগে এই প্রারম্ভিক কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো মন-মগজকে এ সত্য উপলব্ধি করতে প্রস্তুত করা যে, এই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তা মুসলমানদের শক্তির কারনে নয়, বরং আল্লাহর অসীম শক্তির বিস্ময়কর কীর্তি মাত্র।
২.
মূল শব্দ হলো لِأَوَّلِ الْحَشْرِ । হাশর ( (حشر) ) শব্দের অর্থ বিক্ষিপ্ত জনতাকে একত্র করা অথবা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তিদের একত্রিত করে বের হওয়া। আর لِأَوَّلِ الْحَشْرِ এর অর্থ হলো, প্রথমবার একত্রিত হওয়ার সাথে অথবা প্রথমবার একত্রিত হওয়ার সময়ে। এখন প্রশ্ন হলো, এখানে প্রথম হাশর বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একদলের মতে এর অর্থ মদীনা থেকে বনী নাযীরের বহিষ্কার। একে প্রথম হাশর এই অর্থে বলা হয়েছে যে, তাদের দ্বিতীয় হাশর হয়েছিলো হযরত ‘উমরের (রা.) সময়ে। এই সময় ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে আরব উপদ্বীপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আর তাদের শেষ হাশর হবে কিয়ামতের দিন। দ্বিতীয় দলের মতে এর অর্থ হলো মুসলমানদের সৈন্য সমাবেশের ঘটনা যা বনী নাযীর গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য করা হয়েছিল সুতরাং لِأَوَّلِ الْحَشْرِ এর অর্থ হলো, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুসলমানরা সবেমাত্র একত্রিত হয়েছিলো। লড়াই ও রক্তপাতের কোন অবকাশই সৃষ্টি হয়নি। ইতিমধ্যেই আল্লাহ‌ তা’আলার কুদরাতের তারা দেশান্তরিত হতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। অন্য কথায় এখানে এ বাক্যাংশটি আক্রমণের “প্রথম চোটে” বা “প্রথম আঘাতে” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এর অনুবাদ করেছেনঃ در اول جمع كردن لشكر । শাহ আবদুল কাদের সাহেবের অনুবাদ হলোঃ ( يهل هى بهير هوت ) আমাদের মতে এই দ্বিতীয় অর্থটিই এ আয়াতাংশের সঠিক ও বোধগম্য অর্থ।
৩.
এখানে প্রথমেই একটি বিষয় বুঝে নেয়া উচিত, যাতে বনী নাযীরের বহিষ্কারের ব্যাপারে কোন মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বনী নাযীর গোত্রের যথারীতি একটি লিখিত চুক্তি ছিল। এ চুক্তিকে তারা বাতিলও করেছিলো না যে, তার কোন অস্তিত্ব নেই মনে করা চলে। তবে যে কারণে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তা হলো, এই চুক্তি লংঘনের অনেকগুলো ছোট বড় কাজ করার পর তারা এমন একটি কাজ করে বসেছিল যা সুস্পষ্টভাবে চুক্তিভংগেরই নামান্তর। অর্থাৎ তারা চুক্তির অপর পক্ষ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর তাও এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়লো যে, সেজন্য তাদেরকে চুক্তিভংগের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলে তারা তা অস্বীকার করতে পারেনি। এরপর রসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে দশদিন সময় দিয়ে এই মর্মে চরমপত্র দিলেন যে, এই সময়ের মধ্যেই তোমরা মদীনা ছেড়ে চলে যাও। অন্যথায় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। এই চরম পত্র ছিল সম্পূর্ণরূপে কুরআন মজীদের নির্দেশ অনুসারে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ “যদি তোমরা কোন কওমের পক্ষ থেকে বিশ্বাসভংগের (চুক্তিলংঘনের)আশঙ্কা কর তাহলে সেই চুক্তি প্রকাশ্যে তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।” (সূরা আল আনফাল-৫৮) এ কারণে তাদের বহিষ্কারকে আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর নিজের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। কারণ, তা ছিল আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক। যেন তাদেরকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানগণ বহিষ্কার করেননি, বরং আল্লাহ‌ তা’আলা নিজে বহিষ্কার করেছেন। দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য তাদের বহিষ্কারকে আল্লাহ‌ তা’আলা নিজের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন তা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে।
৪.
একথাটি বুঝার জন্য মনে রাখা দরকার যে, বনী নাযীর শত শত বছর ধরে এখানে প্রভাব প্রতিপত্তির সাথে বসবাস করে আসছিল। মদীনার বাইরে তাদের গোটা জনবসতি একই সাথে ছিল। নিজের গোত্রের লোকজন ছাড়া আর কোন গোত্রের লোকজন তাদের মধ্যে ছিল না। গোটা বসতি এলাকাকে তারা একটি দুর্গে রূপান্তিরিত করেছিল। সাধারণত বিশৃংখলাপূর্ণ ও নিরাপত্তাহীন উপজাতীয় এ এলাকায় ঘর-বাড়ী যেভাবে নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাদের ঘর-বাড়ীও ঠিক তেমনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো ছিল ছোট ছোট দুর্গের মত। তাছাড়া তাদের সংখ্যাও সেই সময়ের মুসলমানদের সংখ্যার চেয়ে কম ছিল না। এমনকি মদিনার অভ্যন্তরেও বহু সংখ্যক মুনাফিক তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। তাই মুসলমানরাও কখনো এ আশা করেনি যে, লড়াই ছাড়া শুধু আবরোধের কারণেই দিশেহারা হয়ে তারা নিজেদের বসতভিটা ছেড়ে চলে যাবে। বনু নাযীর গোত্রের লোকজন নিজেরাও একথা কল্পনা করেনি যে, কোন শক্তি মাত্র ছয় দিনের মধ্যেই তাদের হাত থেকে এ জায়গা ছিনিয়ে নেবে। তাদের পূর্বে যদিও বনু কায়নুকা গোত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো এবং নিজেদের বীরত্বের অহংকার তাদের কোন কাজেই আসেনি। কিন্তু তারা ছিল মদীনার অভ্যন্তরে এক মহল্লার অধিবাসী। তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র কোন দুর্গ-প্রাকার বেষ্টিত জনপদ ছিল না। তাই বনীনাযীর গোত্র মনে করতো যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের টিকে থাকতে না পারা অযৌক্তিক বা অসম্ভব কিছু ছিল না। পক্ষান্তরে তারা নিজেদের সুরক্ষিত জনপদ এবং মজবুত দুর্গসমূহ দেখে ধারণাও করতে পারতো না যে, এখান থেকে কেউ তাদের বহিষ্কার করতে পারে। এ কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে দশ দিনের মধ্যে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার চরমপত্র দিলে তারা অত্যন্ত ধৃষ্টতার সাথে খোলাখুলি জবাব দিল, আমরা এখান থেকে চলে যাব না। আপনার কিছু করার থাকলে করে দেখতে পারেন।

এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নটি হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা কিভাবে একথা বললেন যে, তারা মনে করে নিয়েছিলো তাদের ছোট ছোট দুর্গের মত বাড়ীঘর তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে? বনী নাযীর কি সত্যি সত্যিই জানতো যে, তাদের মোকাবিলা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে নয়, বরং খোদ আল্লাহর সাথে? আর এটা জানার পরেও কি তারা একথা বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের দুর্গসমূহ আল্লাহর হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে? যারা ইহুদী জাতির মানসিকতা এবং তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত নয় এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তির মনে এ প্রশ্ন দ্বিধা ও সংশয়ের সৃষ্টি করবে। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে, আল্লাহর সাথে মোকাবিলা হচ্ছে সচেতনভাবে একথা জেনে শুনেও তারা এ ধরণের খোশ খেয়ালে মত্ত থাকবে এবং ভাববে যে, তাদের দুর্গ এবং অস্ত্রশস্ত্র তাদেরকে আল্লাহর থেকে রক্ষা করবে। এ কারণে একজন অনভিজ্ঞ লোক এখানে আল্লাহ‌ তা’আলার এ বাণীর অর্থ করবেন এই যে, বনী নাযীর বাহ্যত নিজেদের সুদৃঢ় দুর্গসমূহ দেখে ভুল ধারণা করে বসেছিল যে, তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তাদের মোকাবিলা ছিল আল্লাহর সাথে। এ আক্রমণ থেকে তাদের দুর্গসমূহ তাদের রক্ষা করতে সক্ষম ছিল না। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, এই পৃথিবীতে ইহুদীরা একটি অদ্ভুত জাতি যারা জেনে বুঝেও আল্লাহর মোকাবিলা করে আসছে। তারা আল্লাহর রসূলদেরকে আল্লাহর রসূল জেনেও হত্যা করেছে এবং অহংকারে বুক ঠুকে বলেছে, আমরা আল্লাহ রসূলকে হত্যা করেছি। এ জাতির লোকগাঁথায় রয়েছে যে “তাদের পূর্বপূরুষ হযরত ইয়া’কূবের (আ) সাথে আল্লাহ‌ তা’আলার সারা রাত ধরে কুস্তি হয়েছে এবং ভোর পর্যন্ত লড়াই করেও আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। অতঃপর ভোর হয়ে গেলে আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে বললেনঃ এখন আমাকে যেতে দাও। এতে ইয়া’কূব (আ) বললেনঃ যতক্ষণ না তুমি আমাকে বরকত দেবে ততক্ষণ আমি তোমাকে যেতে দেব না। আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার নাম কি? তিনি বললেনঃ ইয়া’কূব। আল্লাহ‌ তা’আলা বললেনঃ ভবিষ্যতে তোমার নাম ইয়া’কূব হবে না বরং ‘ইসরাঈল’ হবে। কেননা তুমি খোদা ও মানুষের সাথে শক্তি পরীক্ষা করে বিজয়ী হয়েছো।” দেখুন ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থের (The Holy Scriptures) আধুনিকতম অনুবাদ, প্রকাশক, জুয়িশ পাবলীকেশন সোসাইটি অব আমেরিকা, ১৯৫৪, আদিপুস্তক অধ্যায় ৩২, শ্লোক ২৫ থেকে ২৯। খৃস্টানদের অনুদিত বাইবেলেও এ বিষয়টি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইহুদীদের অনুবাদের ফুটনোটে ‘ইসরাঈল ‘শব্দের অর্থ লেখা হয়েছেঃ (He who Striveth with God) অর্থাৎ যিনি খোদার সাথে শক্তি পরীক্ষা করেন। ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিকাল লিটারেচারে খৃস্টান পুরোহিতগণ ইসরাঈল শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ (Wreslter with God) “খোদার সাথে কুস্তি লড়নেওয়ালা।” হোশেয় পুস্তকে হযরত ইয়াকূবের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,”তিনি তাঁর যৌবনে খোদার সাথে কুস্তি লড়েছেন। তিনি ফেরেশতার সাথে কুস্তি করে বিজয়ী হয়েছেন। “(অধ্যায় ১২, শ্লোক ৪) অতএব একথা স্পস্ট যে, বনী ইসরাঈলরা মহান সেই ইসরাঈলের বংশধর যার সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস হলো, তিনি খোদার সাথে শক্তি পরীক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর সাথে কুস্তি লড়েছিলেন। তাই খোদার সাথে মোকাবিলা একথা জেনে বুঝেও খোদার বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হওয়া তাদের জন্য এমন কি আর কঠিন কাজ? এ কারণে তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুসারে তারা আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছে এবং একই কারণে তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুসারে তারা আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছে এবং একই কারণে তাদের নিজেদের ধারণা অনুসারে তারা হযরত ঈসাকে শূলে চড়িয়েছে এবং বুক ঠুকে বলেছেঃ (إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ ) (আমরা আল্লাহর রসূল মাসীহ ‘ঈসা ইবনে মারয়ামকে হত্যা করেছি।) তাই মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রসূল একথা জেনে বুঝেও তারা যদি তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে তাহলে তা তাদের ঐতিহ্য বিরোধী কোন কাজ নয়। তাদের জনসাধারণ না জানলেও পণ্ডিত-পুরোহিত ও আলেম সমাজ ভাল করেই জানতো যে, তিনি আল্লাহর রসূল। এ বিষয়ের কয়েকটি প্রমাণ কুরআন মজীদেই বর্তমান। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ, টিকা ৭৯-৯৫; সাফ্ফাত, টীকা ৭০-৭৩।

৫.
আল্লাহ তা’আলার তাদের ওপর চড়াও হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি অন্য কোন স্থানে ছিলেন সেখান থেকে তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন। বরং এটি একটি রূপক বাক্য। এরূপ ধারণা দেয়াই মূলত উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে মোকাবিলার সময় তাদের ধারণা ছিল, শুধু একটি পন্থায় আল্লাহ‌ তাদের ওপর বিপদ আনতে পারেন। তাহলো সামনাসামনি কোন সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসা। আর তারা মনে করতো যে, দুর্গাভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে তারা সে বিপদ ঠেকাতে পারবে। কিন্তু এমন একটি পথে তিনি তাদের ওপর হামলা করেছেন, যে দিক থেকে কোন বিপদ আসার আদৌ কোনআশঙ্কা তারা করতো না। সে পথটি ছিল এই যে, ভিতর থেকেই তিনি তাদের মনোবল ও মোকাবিলার ক্ষমতা নিঃশেষ ও অন্তসারশূন্য করে দিলেন। এরপর তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং দুর্গ কোন কাজেই আসেনি।
৬.
অর্থাৎ ধ্বংসসাধিত হয়েছে দু’ভাবে। যে দুর্গের মধ্যে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা বাইরে থেকে অবরোধ করে তা ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করলো। আর ভেতর থেকে তারা নিজেরা প্রথমত মুসলমানদের প্রতিহত করার জন্য স্থানে স্থানে কাঠ ও পাথরের প্রতিবন্ধক বসালো এবং সেজন্য নিজেদের ঘর দড়জা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আবর্জনা জমা করলো। এরপর যখন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারলো যে, এ জায়গা ছেড়ে তাদেরকে চলে যেতেই হবে তখন তারা নিজেদের হাতে নিজেদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করতে শুরু করলো যাতে তা মুসলমানদের কোন কাজে না আসে। অথচ এক সময় বড় শখ করে তারা এসব বাড়ীঘর নির্মাণ করে সাজিয়ে গুছিয়েছিল। এরপর তারা যখন এই শর্তে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সন্ধি করলো যে, তাদের প্রাণে বধ করা হবে না এবং অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর যাই তারা নিয়ে যেতে সক্ষম হবে নিয়ে যেতে পারবে তখন যাওয়ার বেলায় তারা ঘরের দরজা, জানালা এবং খুঁটি পর্যন্ত উপড়িয়ে নিয়ে গেল। এমনকি অনেকে ঘরের কড়িকাঠ এবং কাঠের চাল পর্যন্ত উঠের পিঠে তুলে দিল।
৭.
এই ঘটনার মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের কয়েকটি দিক আছে। সংক্ষিপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ এই আয়াতাংশে সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই ইহুদীরা মূলত অতীত নবীদেরই উম্মাত ছিল। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করতো, কিতাববিশ্বাস করতো, পূর্ববর্তী নবীদের বিশ্বাস করতো এবং আখেরাত বিশ্বাস করতো। এসব বিচারে তারা ছিল মূলত সাবেক মুসলমান। কিন্তু তারা যখন দ্বীন ও আখলাককে উপেক্ষা করে শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির লালসা এবং পার্থিব উদ্দেশ্য ও স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্পষ্ট ও খোলাখুলীভাবে ন্যায় ও সত্যের প্রতি শত্রুতা পোষণের নীতি অবলম্বন করলো এবং নিজেদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির কোন তোয়াক্কাই করলো না তখন আল্লাহ‌ তা’আলার অনুগ্রহ-দৃষ্টিও আর তাদের প্রতি রইলো না। তা না হলে একথা সবারই জানা যে, তাদের সাথে আল্লাহ‌ তা’আলার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। তাই এই পরিণাম দেখিয়ে সর্বপ্রথম মুসলমানদের উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে যেন ইহুদীদের মত তারাও নিজেদেরকে খোদার প্রিয়পাত্র ও আদরের সন্তান মনে করে না বসে এবং এই খামখেয়ালীতে মগ্ন না হয় যে, আল্লাহর শেষ নবীর উম্মত হওয়াটাই তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য লাভের গ্যারান্টি। এর বাইরে দ্বীন ও আখলাকের কোন দাবী পূরণ তাদের জন্য জরুরী নয়। সাথে সাথে গোটা দুনিয়ার সেই সব লোককেও এ ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে যারা জেনে বুঝে সত্যের বিরোধিতা করে এবং নিজেদের সম্পদ ও শক্তি এবং উপায়-উপকরণের উপর এতটা নির্ভর করে যে, মনে করে তা তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। মদীনার ইহুদীদের একথা অজানা ছিল না যে, মুহাম্মাদ ﷺ কোন কওম বা গোত্রের মান মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন না। বরং তিনি একটি আদর্শিক দাওয়াত পেশ করছেন। এ দাওয়াতের লক্ষ গোটা দুনিয়ার সব মানুষ। এ দাওয়াত গ্রহণ করে যে কোন জাতি, গোষ্ঠি ও দেশের মানুষ কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই তাঁর উম্মাত হিসেবে গণ্য হতে পারে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজ খান্দানের লোকজনের মুসলিম সমাজে যে মর্যাদা ছিল হাবশার বেলাল (রা.), রোমের সুহাইব (রা.) এবং পরস্যের সালমানের (রা.) ও সেই একই মর্যাদা ছিল, এটা তারা নিজ চোখে দেখছিল। তাই কুরাইশ, খাযরাজ ও আওস গোত্রের লোকেরা তাদের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে এআশঙ্কা তাদের সামনে ছিল না। নবী ﷺ যে আদর্শিক দাওয়াত পেশ করছিলেন তা যে অবিকল সেই দাওয়াত যা তাদের নবী-রসূলগণ পেশ করে এসেছেন, এ বিষয়টিও তাদের অজানা ছিল না। এ দাবীও তো তিনি করেননি যে, তিনি নতুন একটি দ্বীন নিয়ে এসেছেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ আনেনি। এখন তোমরা নিজেদের দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা ছেড়ে আমার এই দ্বীন বা আদর্শ গ্রহণ করো। বরং তাঁর দাবী ছিল, এটা যে সেই একই দ্বীন, সৃষ্টির শুরু থেকে আল্লাহর নবী-রসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন। প্রকৃতই এটা যে সেই দ্বীন তার সত্যতা তারা তাওরাত থেকে প্রমাণ করতে পারতো। এর মৌল নীতিমালার সাথে নবী-রসূলের দ্বীনের মৌল নীতিমালার কোন পার্থক্য নেই। এ কারণেই কুরআন মজীদে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ (آمِنُوا بِمَا أَنْزَلْتُ مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ ) (তোমরা ঈমান আনো আমার নাযিলকৃত সেই শিক্ষার ওপরে যা তোমাদের কাছে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান শিক্ষার সত্যায়নকারী। সবার আগে তোমরাই তার অস্বীকারকারী হয়ো না) মুহাম্মাদ ﷺ কেমন চরিত্র ও আখলাকের লোক। তাঁর দাওয়াত কবুল করে মানুষের জীবনে কেমন সর্বত্মক বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা তারা চাক্ষুষ দেখছিল। আনসারগণ দীর্ঘদিন থেকে তাদের নিটক প্রতিবেশী। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের অবস্থা যা ছিল তাও তারা দেখেছে। আর এখন ইসলাম গ্রহণের পর তাদের যে অবস্থা হয়েছে তাও তাদের সামনে বর্তমান। এভাবে দাওয়াত, দাওয়াতদাতা ও দাওয়াত গ্রহণকারীদের পরিণাম ও ফলাফল সবই তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। এসব দেখে এবং জেনে বুঝেও তারা শুধু নিজেদের বংশগত গোঁড়ামি এবং পার্থিব স্বার্থের খাতিরে এমন একটি জিনিসের সন্দেহ করার কোন অবকাশ অন্তত তাদের জন্য ছিল না। এই সজ্ঞান শত্রুতার পরেও তারা আশা করতো, তাদের দুর্গ তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। অথচ গোটা মানব ইতিহাস, একথার সাক্ষী যে, আল্লাহর শক্তি যার বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয় কোন অস্ত্রই তাকে রক্ষা করতে পারে না।
.
৮.
দুনিয়ার আযাবের অর্থ তাদের নামনিশানা মুছে দেয়া। সন্ধি করে নিজেদের জীবন রক্ষা না করে যদি তারা লড়াই করতো তাহলে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। তাদের পুরুষরা নিহত হতো এবং নারী ও শিশুদের দাস-দাসী বানানো হতো। মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের উদ্ধার করারও কেউ থাকতো না।
.
.
৯.
এখানে একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুসলমানরা অবরোধ শুরু করার পর তা সহজসাধ্য করার জন্য বনী নাযীরের বসতির চারদিকে যে খেজুর বাগান ছিল তার অনেক গাছ কেটে ফেলে কিংবা জ্বালিয়ে দেয়। আর যেসব গাছ সামরিক বাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধক ছিল না সেগুলোকে যথাস্থানে অক্ষত রাখে। এতে মদীনার মুনাফিকরা ও বনী কুরায়যা এমনকি বনী নাযীর গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ ﷺ “ফাসাদ ফিল আরদ” বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজাশ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে। এটি কি “ফাসাদ ফিল আরদ” নয়? এই সময় আল্লাহ‌ তা’আলা এই নির্দেশ নাযিল করলেনঃ “তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয়। বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।” এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা “ফাসাদ ফিল আরদ” বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না। “ফাসাদ ফিল আরদ” হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং জনবসতি বিরাণ করবে না। কুরআন মজীদে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ “যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।” (বাকারাহ, ২০৫) হযরত আবু বকরের (রা.)এর এ নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোন ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে। তাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, قطعو منها ما كان موضعا للقتال “মুসলমানগণ বনী নাযীরের গাছপালার মধ্যে কেবল সেই সব গাছপালাই কেটেছিলেন যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থিত ছিল।” (তাফসীরে নায়শাপুরী) ফকীহদের কেউ কেউ ব্যাপারটির এ দিকটার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে মত পেশ করেছেন যে, বনী নাযীরের বৃক্ষ কাটার বৈধতা শুধু এ ঘটনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। এ থেকে এরূপ সাধারণ বৈধতা পাওয়া যায় না যে, সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলেই শত্রুর গাছপালা কেটে ফেলা এবং জ্বালিয়ে দেয়া যাবে। ইমাম আওযায়ী, লাইস ও আবু সাওর এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। তবে অধিকাংশ ফকীহর মত হলো, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে এরূপ করা জায়েজ। তবে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য এরূপ করা জায়েজ নয়।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কুরআন মজীদের এ আয়াত মুসলমানদের হয়তো সন্তুষ্ট করে থাকতে পারে কিন্তু কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করতো না নিজেদের প্রশ্নের এ জবাব শুনে তরা কি সান্ত্বনা লাভ করবে যে, এ দু’টি কাজই আল্লাহর অনুমতির ভিত্তিতে বৈধ? এর জবাব হলো শুধু মুসলমানদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছে। কাফেরদের সন্তুষ্ট করা এর আদৌ কোন উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু ইহুদী ও মুনাফিকদের প্রশ্ন সৃষ্টির কারণে কিংবা মুসলমানদের মনে স্বতস্ফূর্তভাবে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল আমরা “ফাসাদ ফীল আরদে” লিপ্ত হয়ে পড়ি নাই তো? তাই আল্লাহ‌ তা’আলা তাদেরকে সন্ত্বনা দিলেন যে, অবরোধের প্রয়োজনে কিছু সংখ্যক গাছপালা কেটে ফেলা এবং অবরোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এমন সব গাছপালা না কাটা এ দু’টি কাজই আল্লাহর বিধান অনুসারে বৈধ ছিল।

এসব গাছ কেটে ফেলা বা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই দিয়েছিলেন না মুসলমানরা নিজেরাই এ কাজ করে পরে এর শরয়ী বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন সে বিষয়ে মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমরের বর্ণনা হলো, নবী ﷺ নিজেই এর নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে জারীর)। ইয়াযীদ ইবনে রূমানের বর্ণনাও তাই। (ইবনে জারীর) অন্যদিকে মুজাহিদ ও কাতাদার বর্ণনা হলো, এসব গাছপালা মুসলমানরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই কেটেছিলেন। তারপর এ বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় যে, কাজটি করা উচিত হয়েছে কিনা? কেউ কেউ তা বৈধ বলে মত প্রকাশ করলেন। আবার কেউ কেউ এরূপ করতে নিষেধ করলেন। অবশেষে আল্লাহ‌ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে উভয় দলের কাজই সঠিক বলে ঘোষণা করলেন। (ইবনে জারীর) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এ রেওয়ায়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেনঃ এ বিষয়ে মুসলমানদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয় যে, আমাদের মধ্য থেকে অনেকে গাছপালা কেটেছে আবার অনেকে কাটেনি। অতএব এখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা উচিত, আমাদের কার কাজ পুরস্কার লাভের যোগ্য আর কার কাজ পাকড়াও হওয়ার যোগ্য? (নাসায়ী) ফকীহদের মধ্যে যারা প্রথম রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ রেওয়ায়াত থেকে প্রমাণ করেন যে, এটি ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইজতিহাদ। পরবর্তী সময়ে আল্লাহ‌ তা’আলা স্পষ্ট অহী দ্বারা তা সমর্থন ও সত্যায়ন করেছেন। এটা এ বিষয়ের একটা প্রমাণ যে, যেসব ব্যাপারে আল্লাহর কোন নির্দেশ বর্তমান থাকতো না সে সব ব্যাপারে নবী (সা.) ইজতিহাদ করে কাজ করতেন। অপরপক্ষে যেসব ফকীহ দ্বিতীয় রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ থেকে প্রমাণ পেশ করেন যে, মুসলমানদের দু’টি দল ইজতিহাদের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি মত গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ‌ তা’আলা দু’টি মতই সমর্থন করেছেন। অতএব জ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ যদি সৎনিয়তে ইজতিহাদ করে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন তবে তাদের মতসমূহ পরস্পর ভিন্ন হবে। কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে তারা সবাই হকের অনুসারী বলে গণ্য হবেন।

১০.
অর্থাৎ আল্লাহ‌ তা’আলার ইচ্ছা ছিল এসব গাছ কাটার দ্বারাও তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক এবং না কাটা দ্বারাও অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক। কাটার মধ্যে তাদের অপমান ও লাঞ্ছনার দিকটা ছিল এই যে, যে বাগান তারা নিজ হাতে তৈরী করেছিল এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তারা যে বাগানের মালিক ছিল সেই সব বাগানের গাছপালা তাদের চোখের সামনেই কেটে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তারা কোনভাবে কর্তনকারীদের বাধা দিতে পারছে না। একজন সাধারণ কৃষক বা মালিও তার ফসল বা বাগানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে পারে না। কেউ যদি তার সামনে তার ফসল বা বাগান ধ্বংস করতে থাকে তাহলে সে তার বিরুদ্ধে প্রাণপাত করবে। সে যদি নিজের সম্পদে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারে তবে তা হবে তার চরম অপমান ও দুর্বলতার প্রমাণ। কিন্তু এখানে পুরা একটি গোত্র যারা শত শত বছর ধরে এ স্থানে বসবাস করে আসছিলো অসহায় হয়ে দেখছিলো যে, তাদের প্রতিবেশী তাদের বাগানের ওপর চড়াও হয়ে এর গাছপালা ধ্বংস করছে। কিন্তু তারা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। এ ঘটনার পর তারা মদীনায় থেকে গেলেও তাদের কোন মান-মর্যাদা অবশিষ্ট থাকতো না। এখন থাকলো গাছপালা না কাটার মধ্যে অপমান ও লাঞ্ছনার বিষয়টি। সেটি হলো, যখন তারা মদীনা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো তখন নিজ চোখে দেখছিল যে, শ্যামল-সবুজ যেসব বাগান কাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় ছিল আজ তা মুসলমানদের দখলে চলে যাচ্ছে। ক্ষমতায় কুলালে তারা ওগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে যেতো এবং অবিকৃত একটি গাছও মুসলমানদের দখলে যেতে দিতো না। কিন্তু তারা নিরূপায়ভাবে সবকিছু যেমন ছিল তেমন রেখে হতাশা ও দুঃখ ভরা মনে বেরিয়ে গেল।
১১.
যেসব বিষয় সম্পত্তি বনী নাযীরের মালিকানায় ছিল এবং তাদের বহিষ্কারের পর তা ইসলামী সরকারের হস্তগত হয়েছিলো এখানে সেই সব বিষয় সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে। এসব সম্পদের ব্যবস্থাপনা কিভাবে করা যাবে এখান থেকে শুরু করে ১০নং আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ‌ তা’আলা সেই সব কথাই বলেছেন। কোন এলাকা বিজিত হয়ে ইসলামী সরকারের দখলভুক্ত হওয়ার ঘটনা যেহেতু এটাই প্রথম এবং পরে আরো এলাকা বিজিত হতে যাচ্ছিলো তাই এ জন্য বিজয়ের শুরুতেই বিজিত ভূমি সম্পর্কে বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভেবে দেখার মত বিষয় হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা (وَمَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ ) (যে সম্পদ তাদের দখলমুক্ত করে আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর রসূলের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন) বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। এ বাক্য থেকে স্বতঃই এ অর্থ প্রকাশ পায় যে, এই পৃথিবী এবং যেসব জিনিস এখানে পাওয়া যায় তাতে সেই সব লোকদের মূলত কোন অধিকার নেই যারা মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। তারা যদি এর ওপরে দখলকারী ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেও থাকে তাহলেও তার অবস্থা হলো বিশ্বাসঘাতক ভৃত্য কর্তৃক মনিবের বিষয়-সম্পদ কুক্ষিগত করার মত। প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পদের হক হলো তা তার আসল মালিক আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনের মর্জি অনুসারে তাঁর আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করা। আর এভাবে ব্যবহার কেবল নেককার ঈমানদার বান্দারাই করতে পারে। তাই বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের পরিণতিতে যেসব সম্পদ কাফেরদের দখলমুক্ত হয়ে ঈমানদারদের করায়ত্ত হবে তার মর্যাদা হলো তার মালিক এ সম্পদ নিজের বিশ্বাসঘাতক ভৃত্যদের দখল থেকে উদ্ধার করে তাঁর আনুগত ভৃত্যদের দখলে দিয়েছেন। তাই ইসলামী আইনের পরিভাষায় এসব বিষয় সম্পদকে ‘ফাই’ (প্রত্যাবর্তিত বা ফিরিয়ে আনা সম্পদ) বলা হয়েছে।
১২.
অর্থাৎ এসব সম্পদের অবস্থা ও প্রকৃতি এমন নয় যে, সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে লড়াই করে তা অর্জন করেছে। তাই এতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এ সম্পদ তাদের মধ্যেই বণ্টন করে দিতে হবে। বরং তার প্রকৃত অবস্থা হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা অনুগ্রহ করে তাঁর রসূলের এবং যে আদর্শের প্রতিনিধিত্ব এ রসূল করছেন সেই আদর্শকে তাদের ওপর বিজয় দান করেছেন। অন্য কথায়, এসব সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হওয়া সরাসরি সেনাবাহীনির শক্তি প্রয়োগের ফল নয়। বরং এটা সেই সামগ্রিক শক্তির ফল যা আল্লাহ‌ তাঁর রসূল, রসূলের উম্মাত এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শকে দান করেছেন। তাই এসব সম্পদ গনীমতের সম্পদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মর্যাদা সম্পন্ন। এতে যুদ্ধরত সৈনিকদের এমন কোন অধিকার বর্তায় না যে, তা তাদের মধ্যে গনীমতের মত বণ্টন করে দিতে হবে। এভাবে শরীয়াতে ‘গনীমত’ও ‘ফাই’-এর আলাদা আলাদা বিধান দেয়া হয়েছে। সূরা আনফালের ৪১ নং আয়াতে গনীমতের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। বিধানটি হলো, গনীমতের সম্পদ পাঁচটি অংশে ভাগ করা হবে। এর চারটি অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে এবং একটি অংশ বায়তুলমালে জমা দিয়ে উক্ত আয়াতে বর্ণিত খাতসমূহে খরচ করতে হবে। ফাইয়ের বিধান হলো, তা সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা যাবে না। বরং এর সবটাই পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত খাতসমূহের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। এই দুই ধরনের সম্পদের মধ্যে পার্থক্য প্রকাশ করা হয়েছেঃ (فَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلَا رِكَابٍ ) (তোমরা তার বিরুদ্ধে নিজেদের ঘোড়া বা উট পরিচালনা কর নাই) কথাটি দ্বারা ঘোড়া বা উট পরিচালনা করার অর্থ সামরিক তৎপরতা চালানো (Warlike Operations)। সুতরাং সরাসরি এ ধরনের তৎপরতার ফলে যেসব সম্পদ হস্তগত হয়ে থাকে তা গনীমতের সম্পদ। আর যেসব সম্পদ লাভের পেছনে এ ধরনের তৎপরতা নেই তা সবই ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য।

‘গনীমত’ ও ‘ফাই’ এর মোটামুটি যে অর্থ এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামের ফকীহগণ তা আরো স্পস্ট করে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ গণীমাত হলো সেই সব অস্থাবর সম্পদ যা সামরিক তৎপরতা চালানোর সময় শত্রু সেনাদের নিকট থেকে লাভ করা গিয়েছে। এসব ছাড়া শত্রু এলাকার ভূমি, ঘরবাড়ী এবং অন্যান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গনীমতের সংজ্ঞায় পড়ে না। এ ব্যাখ্যার উৎস হলো হযরত উমরের (রা.) সেই পত্র যা তিনি ইরাক বিজয়ের পর হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসকে লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছেনঃ ( فَانْظُرْ مَا اَجْلَبُوْا بِهِ عَلَيْكَ فِى الْعَسْكَرِ مِنْ كَرَاعِ اَوْمَالِ فَاقْسِمْهُ بَيْنَ مَنْ حَضَرَ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَاتْرَكِ الْارْضِيْنَ وَالْانْهَارْ لِعُمَّالِهَا لِيَكُونَ ذَالِكَ فِى اَعْطِيَاتِ الْمُسْلِمِيْنَ- )

“সেনাবাহিনীর লোকজন যেসব ধন-সম্পদ তোমাদের কাছে কুড়িয়ে আনবে তা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দাও। আর ভূমি ও সেচ খালে যেসব লোক কাজ করে ভূমি ও সেচ খাল তাদের জন্য রেখে দাও যাতে তার আয় মুসলমানদের বেতন ভাতা ও বৃত্তি দেয়ার কাজে লাগে।” (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসূফ, পৃষ্ঠা ২৪; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়েদ, পৃষ্ঠা ৫৯; কিতাবুল খারাজ, ইয়াহইয়া ইবনে আদম, পৃষ্ঠা ২৭, ২৮৪৮)

এ কারণে হাসান বসরী বলেনঃ শত্রুর শিবির থেকে যা হস্তগত হবে তা সেই সব সৈন্যদের হক যারা তা দখল করেছে। কিন্তু ভূমি সব মুসলমানদের জন্য। (ইয়াহইয়া ইবনে আদম ২৭) ইমাম আবু ইউসূফ বলেনঃ “শত্রুসেনাদের কাছ থেকে যেসব জিনিস মুসলমানদের হস্তগত হবে এবং যেসব দ্রব্য, অস্ত্রশস্ত্র ও জীবজন্তু তারা কুড়িয়ে ক্যাম্পে আনবে তাহলো গনীমত। এর মধ্য থেকে এক-পঞ্চমাংশ আলাদা করে রেখে অবশিষ্ট চার অংশ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।” (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১৮) ইয়াহইয়া ইবনে আদমও এ মত পোষণ করেন এবং তা তিনি তাঁর গ্রন্থ কিতাবুল খারাজে বর্ণনা করেছেন। (পৃষ্ঠা ২৭) যে জিনিসটি ‘গনীমতের ও ফাই’ এ পার্থক্য আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরে তা হলো, নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ শেষে গনীমতের সম্পদ বণ্টন এবং বিজিত এলাকা যথারীতি ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সায়েব ইবনে আকরা, নামক এক ব্যক্তি দুর্গের অভ্যন্তরে দু’টি থলী ভর্তি মণি মুক্তা কুড়িয়ে পান। এতে তার মনে খটকা সৃষ্টি হয় যে, তা ‘গনীমত’না ‘ফাই’? গনিমাত হলে তা সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর ‘ফাই’ হলে তা বায়তুলমালে জমা হওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত তিনি মদীনায় হাজির হলেন এবং বিষয়টি হযরত উমরের (রা.) সামনে পেশ করলেন। হযরত উমর (রা.) ফয়সালা করলেন যে, তা বিক্রি করে অর্থ বায়তুলমালে জমা দিতে হবে। এ থেকে জানা গেল যে, শুধু এমন সব অস্থাবর সম্পদ গনীমত হিসেবে গণ্য হবে যা যুদ্ধের সময় সৈন্যদের হস্তগত হবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ স্থাবর সম্পদের মতই ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য হয়। এ ঘটনাটি উল্লেখ করে ইমাম আবু উবায়েদ লিখছেনঃ ( مَا نِيْلَ مِنْ اَهْلِ الشِّرِكْ عُنْوَةً قَسْرًا وَالْحَرْبُ قَائِمَةٌ فَهُوَ الْغَنِيْمَةُ- وَمَانِيْلَ مِنْهُمْ بَعْدَ مَا تَضَعُ الْحَرْبُ اَوْ زَارَهَا وَتَصِيْرُ الدَّارُ دَارَ الْاِسْلَامِ- فَهُوَ فِىءٌ يَكُوْنَ لِلنَّاسِ عَامَّا وَلَا خُمُسَ فِيْهِ- )

“যুদ্ধ চলাকালে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেসব সম্পদ শত্রুর কাছ থেকে হস্তগত হবে তা গনীমত। আর যুদ্ধ শেষে দেশ দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হওয়ার পর যেসব সম্পদ হস্তগত হবে তা ‘ফাই’ হিসেবে পরিগণিত হবে। এ সম্পদ দারুল ইসলামের অধিবাসীদের কল্যাণ কাজে লাগা উচিত। তাতে এক-পঞ্চমাংশ নির্দিষ্ট হবে না।” (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২৫৪)

গনীমতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত ও নির্দিষ্ট করার পর কাফেরদের কাছ থেকে মুসলমানদের হস্তগত হওয়া যেসব সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি ও জায়গা-জমি অবশিষ্ট থাকে তা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক, লড়াই করে হস্তগত করা সম্পদ ইসলামী ফিকাহের পরিভাষায় যাকে শক্তি বলে দখলকৃত দেশ বা অঞ্চল বলা হয়। দুই, সন্ধির ফলে যা মুসলমানদের হস্তগত হবে। এ সন্ধি মুসলমানদের সামরিক শক্তির প্রভাব, দাপট কিংবা ভীতির কারণে হলেও। বাহুবলে হস্তগত না হয়ে অন্য কোনভাবে হস্তগত হওয়া সম্পদও এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম ফকীহদের মধ্যে যা কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা প্রথম প্রকারের সম্পদ সম্পর্কে হয়েছে। অর্থাৎ তার সঠিক শরয়ী মর্যাদা কি? কেননা, তা ( فما او خفتم عليه من خيل ولاركاب )-এর সংজ্ঞায় পড়ে না। এরপর থাকে দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ। এ প্রকারের সম্পদ সম্পর্কে সর্বসম্মত মত হলো, তা ‘ফাই’হিসেবে গণ্য। কারণ এর বিধান কুরআন মজিদে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। পরে আমরা প্রথম প্রকারের সম্পদের শরয়ী মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

১৩.
এসব সম্পদ আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর মধ্যে গনীমতের মত বণ্টন না করার কারণ কি এবং তার শরয়ী বিধান গনিমাতের সম্পর্কিত বিধান থেকে ভিন্ন কেন পূর্ববর্তী আয়াতে শুধু এতটুকু কথাই বলা হয়েছে। এখন এসব সম্পদের হকদার কারা এ আয়াতটিতে তা বলা হয়েছে।

এসব সম্পদের মধ্যে সর্বপ্রথম অংশ হচ্ছে আল্লাহ‌ এবং তাঁর রসূলের। রসূলুল্লাহ ﷺ এ নির্দেশ অনুসারে যেভাবে আমল করেছেন হযরত উমর (রা.) থেকে মালেক ইবনে আওস ইবনুল হাদাসান তা উদ্ধৃত করেছেন। হযরত উমর (রা.) বলেনঃ এ অংশ থেকে নবী ﷺ তাঁর নিজের ও পরিবার-পরিজনের খরচ নিয়ে নিতেন আর অবশিষ্ট অর্থ জিহাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং সাওয়ারী জন্তু সংগ্রহ করতে ব্যয় করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ইত্যাদি) নবীর(সা.) ইন্তিকালের পর এ অংশটি মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা দেয়া হতো যাতে আল্লাহ‌ তাঁর রসূলকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই কাজেই তা ব্যয়িত হয়। ইমাম শাফেয়ীর (র) মত হলো, যে অংশটি বিশেষভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নির্দিষ্ট ছিল তা তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর খলিফাদের জন্য নির্দিষ্ট হবে। কারণ ইমামত বা নেতৃত্বের পদমর্যাদার জন্য তিনি এর হকদার ছিলেন, রিসালাতের পদমর্যাদার জন্য নয়। তবে শাফেয়ী ফিকাহবিদগণের অধিকাংশ এ ব্যাপারে অন্যান্য অধিকাংশ ফিকাহবিদগণের অনুরূপ মতামত পোষণ করেন। অর্থাৎ এ অংশটি এখন আর কোন ব্যক্তিবিশেষের জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরং তা মুসলমানদের দ্বীনি ও সামাজিক কল্যাণে ব্যয়িত হবে।

দ্বিতীয় অংশটি হলো আত্মীয়-স্বজনের জন্য। এর অর্থ রসূলের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। অর্থাৎ বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব। এ অংশটি নির্ধারিত করা হয়েছিল। এ জন্য যে, রসূলুল্লাহ ﷺ যেন নিজের এবং নিজের পরিবার-পরিজনের হক আদায় করার সাথে সাথে নিজের সেই সব আত্মীয়-স্বজনের হকও আদায় করতে পারেন যারা তাঁর সাহায্যের মুখাপেক্ষী অথবা তিনি নিজে যাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর এ অংশেরও ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র মর্যাদা অবশিষ্ট নেই। বরং মুসলমানদের অন্য সব মিসকীন, ইয়াতীম এবং মুসাফিরদের মত বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবের অভাবী লোকদের অধিকারসমূহ ও বায়তুলমালের জিম্মাদারীতে চলে গিয়েছে। তবে যাকাতে তাদের অংশ না থাকার কারণে অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর, উমর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমের যুগে প্রথম দু’টি অংশ বাতিল করে শুধু অবশিষ্ট তিনটি অংশের (ইয়াতীম, মিসকীন ও ইবনুস সাবীল) হকদারদের জন্য ‘ফাই’ নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু তাঁর যুগে এ নীতি অনুসারে আমল করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইমাম মুহাম্মাদ বাকেরের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, যদিও হযরত আলীর (রা.) আহলে বায়তের রায়ই। [এ অংশ নবীর ﷺ আত্মীয়-স্বজনের পাওয়া উচিত] তাঁর ব্যক্তিগত রায় ছিল। তথাপি তিনি হযরত আবু বকর ও উমরের (রা.) সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করা পছন্দ করেননি। হাসান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া বলেনঃ নবীর ﷺ পরে ঐ দু’টি অংশ (অর্থাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের অংশ ও যাবিল কুরবার অংশ) সম্পর্কে মাতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু সংখ্যক লোকের মত ছিল, প্রথম অংশটি হুজুরের ﷺ খলীফার প্রাপ্য। কিছু সংখ্যক লোকের মত ছিল, দ্বিতীয় অংশ হুজুরের ﷺ আত্মীয়-স্বজনের পাওয়া উচিত। অপর কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ছিল, দ্বিতীয় অংশটি খলীফার আত্মীয়-স্বজনের দেয়া উচিত। অবশেষে এ মতে’ইজমা’ বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, এ দু’টি অংশই জিহাদের প্রয়োজনে খরচ করা হবে। আতা ইবনে সায়েব বলেনঃ হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) তাঁর শাসনকালে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অংশ এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনের অংশ বনী হাশেমদের কাছে পাঠাতে শুরু করেছিলেন। ইমাম আবু হানীফা এবং অধিকাংশ হানাফী ফকীহদের সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অনুসৃত কর্মনীতিই সঠিক ও নির্ভুল (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসূফ, পৃষ্ঠা ১৯ থেকে ২১)। ইমাম শাফেয়ীর (র) মত হলো, যারা হাশেম ও মুত্তালিব বংশের লোক বলে প্রমাণিত কিংবা সাধারণভাবে সবার কাছে পরিচিত তাদের সচ্ছল ও অভাবী উভয় শ্রেণীর লোককেই ‘ফাই’ এর সম্পদ থেকে দেয়া যেতে পারে। (মুগনিউল মুহতাজ) হানাফীদের মতে, এ অর্থ থেকে কেবল তাদের অভাবীদের সাহায্য করা যেতে পারে। অবশ্য অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রগণ্য। (রুহুল মায়ানী) ইমাম মালেকের মতে এ ব্যাপারে সরকারের ওপর কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা নেই। যে খাতে ইচ্ছা সরকার তা ব্যয় করতে পারেন। তবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধরদের অগ্রাধিকার দেয়া উত্তম। (হাশিয়াতুদ দুসুকী আলাশ্শারহিল কাবীর)

অবশিষ্ট তিনটি অংশ সম্পর্কে ফকীহদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই। তবে ইমাম শাফেয়ী এবং অন্য তিনজন ইমামের মধ্যে মতানৈক্য আছে। ইমাম শাফেয়ীর(র) মতে ‘ফাই’ এর সমস্ত অর্থ-সম্পদ সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে তার এক ভাগ উপরোক্ত খাতসমূহে এমনভাবে খরচ করা উচিত যেন তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সাধারণভাবে মুসলমানদের কল্যাণে, পাঁচ ভাগের এক ভাগ বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবের জন্য, পাঁচ ভাগের এক ভাগ ইয়াতিমের জন্য, পাঁচ ভাগের এক ভাগ মিসকীনদের জন্য এবং পাঁচ ভাগের এক ভাগ মুসাফিরদের জন্য ব্যয়িত হয়। অপরদিকে ইমাম মালেক, ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম আহমাদ এভাবে বন্টনের পক্ষপাতী নন। তাদের মতে, ‘ফাই’ এর সমস্ত অর্থ-সম্পদই সাধারণভাবে মুসলমানদের কল্যাণে ব্যয়িত হবে। (মুগনিউল মুহতাজ)

১৪.
এটি কুরআন মজীদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক আয়াতসমূহের একটি। এতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পলিসির একটি মৌলিক নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোটা সমাজে ব্যবপকভাবে সম্পদ আবর্তীত হতে থাকা উচিত। এমন যেন না হয় অর্থ-সম্পদ কেবল ধনবান ও বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকবে। কিংবা ধনী দিনে দিনে আরো ধনশালী হতে থাকবে আর গরীব দিনে দিনে আরো বেশী গরীব হতে থাকবে। কুরআন মজীদে এ নীতি শুধু বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি। বরং এ উদ্দেশ্যে সুদ হারাম করা হয়েছে, যাকাত ফরয করা হয়েছে, গনীমতের সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ বের করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন আয়াতে নফল সাদকা ও দান-খয়রাতের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা আদায়ের এমন সব পন্থা নির্দেশ করা হয়েছে যার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ সমাজের দরিদ্র মানুষের দিকে ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে। উত্তরাধিকারের জন্য এমন আইন রচনা করা হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ যেন ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, কার্পণ্য ও বখিলীকে নৈতিক বিচারে কঠোরভাবে নিন্দানীয় এবং দানশীলতাকে সর্বোত্তম গুণ বলে প্রশংসা করা হয়েছে আর সচ্ছল শ্রেণীকে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের সম্পদে প্রার্থী এবং বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে যাকে খয়রাত মনে করে নয় বরং তাদের অধিকার মনে করে আদায় করা উচিত। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের একটি বড় খাত অর্থাৎ’ফাই’ সম্পর্কে এমন একটি আইন রচনা করা হয়েছে যে, এর একটি অংশ যেন অনিবার্যরূপে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে সহায়তা দানের জন্য ব্যয়িত হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাত দু’টি একটি যাকাত এবং অন্যটি ‘ফাই’। মুসলমানদের নিসাবের অতিরিক্ত পূঁজি, গবাদি পশু, ব্যবসায় পন্য এবং কৃষি উৎপন্ন দ্রব্য থেকে আদায় করা হয়, আর এর বেশীর ভাগই গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট। আর ‘ফাই’ এর মধ্যে জিযিয়া ও ভূমি রাজত্ব সহ সেই সব আয়ও অন্তর্ভুক্ত যা অমুসলিমদের নিকট থেকে আসে। এরও বেশীর ভাগ গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা এ বিষয়েরই স্পষ্ট ইঙ্গিত যে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রকে তার আয় ও ব্যয়ের ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের গোটা আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যেন ধন-সম্পদের উপায়-উপকরণের ওপর বিত্তবান এবং প্রভাবশালী লোকদের ইজারাদারী প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সম্পদের প্রবাহ গরীবদের দিক থেকে ধনীদের দিকে ঘুরে না যায় আর বিত্তশালীদের মধ্যেই যেন আবর্তিত হতে না থাকে।
১৫.
বর্ণনার ধারাবাহিকতার দিক থেকে এ আয়াতের অর্থ হলো, বনী নাযীর গোত্র থেকে লব্ধ সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং অনুরূপভাবে পরবর্তীকালে লব্ধ ‘ফাই’এর সম্পদের বিলি-বন্টনের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ ﷺ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা কোন প্রকার আপত্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই মেনে নাও। তিনি যাকে যা দেবেন সে তা গ্রহণ করবে এবং যা কাউকে দেবেন না সেজন্য যেন আপত্তি বা দাবী উত্থাপন না করে। কিন্তু নির্দেশটির ভাষা যেহেতু ব্যাপকতাবোধক, তাই এ নির্দেশ শুধু ‘ফাই’ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সীমবদ্ধ নয়। বরং এর অভিপ্রায় হলো, মুসলমান সব ব্যাপারেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করবে। এ অভিপ্রায়কে আরো স্পষ্ট করে দেয় এ বিষয়টি যে,“রসূল তোমাদের যা কিছু দেন” কথাটির বিপরীতে “যা কিছু না দেন” বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে “যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন(নিষেধ করেন) তা থেকে বিরত থাকো।” এ নির্দেশের লক্ষ যদি শুধু ‘ফাই’ এর সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হতো তা হলে ‘যা দেন’ কথাটির বিপরীতে ‘যা না দেন’ বলা হতো। এক্ষেত্রে নিষেধ করা বা বিরত রাখা কথাটির ব্যবহার দ্বারা আপনা থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ নির্দেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নবীর(সা.) আদেশ ও নিষেধের আনুগত্য করা। রসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও একথাটি বলেছেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ (إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِامرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَمَا نَهَيْتُكُمْ عَنْه فَاجْتَنِبُوهُ- (بخارى – مسلم) )

“আমি কোন বিষয়ে তোমাদের নির্দেশ দিলে তা যথাসাধ্য পালন করো। আর যে বিষয়ে বিরত থাকতে বলি তা থেকে দূরে থাকো।” (বুখারী, মুসলিম)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার তিনি বক্তৃতাকালে বললেনঃ “আল্লাহ তা’আলা অমুক অমুক ফ্যাশনকারীনী মহিলাকে লা’নত করেছেন।” এই বক্তৃতা শুনে এক মহিলা তাঁর কাছে এসে বললঃ একথা আপনি কোথায় পেয়েছেন? আল্লাহর কিতাবে তো এ বিষয়ে আমি কোথাও দেখি নাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেনঃ তুমি আল্লাহর কিতাব পড়ে থাকলে একথা অবশ্যই পেতে। তুমি কি এ আয়াত ( مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ) পড়েছো? সে বললো হাঁ, এ আয়াত তো আমি পড়েছি। হযরত আবদুল্লাহ বললেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, এরূপ কাজে লিপ্ত নারীদের ওপর আল্লাহ‌ তা’আলা লা’নত করেছেন। মহিলাটি বললোঃ এখন বুঝতে পারলাম। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে ইবনে আবী হাতেম।)

১৬.
এ কথা দ্বারা সেই সব লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা ঐ সময় মক্কা মুয়াযযামা ও আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে ইসলাম গ্রহণের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বনী নাযীর গোত্রের এলাকা বিজিত হওয়া পর্যন্ত এসব মুহাজিরের জীবন যাপনের কোন স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল না। এখানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেসব অর্থ-সম্পদ এখন হস্তগত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেসব সম্পদ ‘ফাই’ হিসেবে হস্তগত হবে তাতে সাধারণ মিসকীন, ইয়াতীম এবং মুসাফিরদের সাথে সাথে এসব লোকেরও অধিকার আছে। উক্ত সম্পদ থেকে এমন সব লোকদের সহযোগিতা দেয়া উচিত যারা আল্লাহ, আল্লাহর রসূল এবং তাঁর দ্বীনের জন্য হিজরত করতে বাধ্য হয়েছে এবং দারুল ইসলামে চলে এসেছে। এই নির্দেশের ভিত্তিতে রসূলুল্লাহ ﷺ বনী নাযীরের সম্পদের একটি অংশ মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন এবং আনসারগণ যেসব খেজুর বাগান তাদের মুহাজির ভাইদের সাহায্যের জন্য দিয়ে রেখেছিলেন তা তাদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু এরূপ মনে করা ঠিক নয় যে, ‘ফাই’ এর সম্পদে মুহাজিরদের এ অংশ কেবল সেই যুগের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, কিয়ামাত পর্যন্ত যত লোকই মুসলমান হওয়ার কারণে নির্বাসিত হয়ে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে তাদের পুনর্বাসিত করা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়া উক্ত রাষ্ট্রের ইসলামী সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই তার উচিত যাকাত ছাড়া ‘ফাই’ এর সম্পদও এ খাতে খরচ করা।
.
অনুবাদ: