পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

১৩৭ আয়াত

৭ ) এরাই তো সেই সব লোক যারা বলে, আল্লাহর রসূলের সাথীদের জন্য খরচ করা বন্ধ করে দাও যাতে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। অথচ আসমান ও যমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডারের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। কিন্তু এই মুনাফিকরা তা বুঝে না।
هُمُ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنفِقُوا۟ عَلَىٰ مَنْ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ حَتَّىٰ يَنفَضُّوا۟ ۗ وَلِلَّهِ خَزَآئِنُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَلَـٰكِنَّ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ ٧
৮ ) এরা বলে, আমরা মদীনায় ফিরে যেতে পারলে যে সম্মানিত সে হীন ও নীচদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে। ১৫ অথচ সম্মান ও মর্যাদা তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের জন্য। ১৬ কিন্তু এসব মুনাফিক তা জানে না।
يَقُولُونَ لَئِن رَّجَعْنَآ إِلَى ٱلْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ ٱلْأَعَزُّ مِنْهَا ٱلْأَذَلَّ ۚ وَلِلَّهِ ٱلْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِۦ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَـٰكِنَّ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ ٨
৯ ) হে ১৭ সেই সব লোক যারা ঈমান এসেছো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না দেয়। ১৮ যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَٰلُكُمْ وَلَآ أَوْلَـٰدُكُمْ عَن ذِكْرِ ٱللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْخَـٰسِرُونَ ٩
১০ ) আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো। সে সময় সে বলবেঃ হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম। অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ‌
وَأَنفِقُوا۟ مِن مَّا رَزَقْنَـٰكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِىَ أَحَدَكُمُ ٱلْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَآ أَخَّرْتَنِىٓ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ قَرِيبٍۢ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ ١٠
১১ ) তাকে আর কোন অবকাশ মোটেই দেন না। তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আল্লাহ‌ পুরোপুরি অবহিত।
وَلَن يُؤَخِّرَ ٱللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَآءَ أَجَلُهَا ۚ وَٱللَّهُ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ ١١
১ ) আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর তাসবীহ করছে। তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং সব প্রশংসাও তারই।
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۖ لَهُ ٱلْمُلْكُ وَلَهُ ٱلْحَمْدُ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌ ١
২ ) তিনি সবকিছু করতে সক্ষম। তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কাফের এবং কেউ মু’মিন। তোমরা যা করছো আল্লাহ‌ তা দেখছেন।
هُوَ ٱلَّذِى خَلَقَكُمْ فَمِنكُمْ كَافِرٌۭ وَمِنكُم مُّؤْمِنٌۭ ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ٢
৩ ) তিনি আসমান ও যমীনকে যথাযথরূপে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তোমাদেরকে আকার-আকৃতি দান করেছেন এবং অতি উত্তম আকার-আকৃতি দান করেছেন। অবশেষে তাঁর কাছেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِٱلْحَقِّ وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ ۖ وَإِلَيْهِ ٱلْمَصِيرُ ٣
৪ ) আসমান ও যমীনের সবকিছু সম্পর্কেই তিনি জানেন। আর তোমরা যা গোপন করো এবং যা প্রকাশ করো তাও তিনি জানেন। মানুষের অন্তরের কথাও তিনি খুব ভাল করে জানেন।
يَعْلَمُ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعْلِنُونَ ۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ٤
৫ ) এরপূর্বে যেসব মানুষ কুফরী করেছে এবং নিজেদের অপকর্মের পরিণামও ভোগ করেছে তাদের খবর কি তোমাদের কাছে পৌঁছেনি? তাদের জন্য নির্দিষ্ট আছে অতীব কষ্টদায়ক শাস্তি। ১০
أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَبَؤُا۟ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن قَبْلُ فَذَاقُوا۟ وَبَالَ أَمْرِهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ ٥
.
১৫.
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম বলেনঃ আমি যখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের এ কথা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম এবং সে এসে শপথ করে পরিষ্কার ভাষায় তা অস্বীকার করলো তখন আনসারদের প্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধ লোকজন এবং আমার আপন চাচা আমাকে অনেক তিরস্কার করলেন। এমনকি আমার মনে হলো নবীও ﷺ আমাকে মিথ্যাবাদী এবং আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে সত্যবাদী মনে করেছেন। এতে আমার এত দুঃখ ও মনঃকষ্ট হলো যা সারা জীবনে কখনো হয়নি। আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজের জায়গায় বসে পড়লাম। পরে এ আয়াতগুলো নাযিল হলে রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে ডেকে হাসতে হাসতে আমার কান ধরে বললেনঃ ছোকরাটার কান ঠিকই শুনেছিল। আল্লাহ‌ নিজে তা সত্য বলে ঘোষণা করেছেন। (ইবনে জারীর। এ বর্ণনা অনুরূপ বর্ণনা তিরমিযীতেও আছে)।
১৬.
অর্থাৎ সম্মান ও মর্যাদা মূলত আল্লাহর সত্তার জন্য নির্দিষ্ট আর রসূলের মর্যাদা রিসালাতের কারণে এবং ঈমানদারদের মর্যাদা তাদের ঈমানের কারণে। এরপর থাকে কাফের, ফাসেক ও মুনাফিকদের মর্যাদার ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদায় তাদের কোন অংশ নেই।
.
১৭.
যেসব লোক ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করেছে, তারা সত্যিকার ঈমানদার হোক বা শুধু ঈমানের মৌখিক স্বীকৃতিদানকারী হোক, তাদের সবাইকে সম্বোধন করে একটা উপদেশ দেয়া হচ্ছে। এর আগে আমরা কয়েকবার এ কথাটি বলেছি যে, কুরআন মজীদেالَّذِينَ آمَنُوا (যারা ঈমান এনেছে) কথাটি বলে কোন সময় সাচ্চা ঈমানদারকে সম্বোধন করা হয়েছে। আবার কখনো মুনাফিকদের সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ, তারাও মৌখিকভাবে ঈমানের স্বীকৃতি দেয়। আবার কখনো সাধারণভাবে সব শ্রেণীর মুসলমানদের সম্বোধন করা বুঝানো হয়। কোথায় কোন শ্রেণীর লোককে একথা দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও পূর্বাপর অবস্থাই নির্দেশ করে দেয়।
১৮.
বিশেষভাবে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য যে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এসব স্বার্থের কারণে ঈমানের দাবী পূরণ না করে মুনাফীকী অথবা ঈমানের দুর্বলতা অথবা পাপাচার ও নাফরমানীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে মূলত এখানে দুনিয়ার এমন প্রতিটি জিনিসকে বুঝানো হয়েছে যা মানুষকে এমনভাবে নিমগ্ন করে রাখে যে, সে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে যায়। আর আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে যাওয়াটাই সমস্ত অকল্যাণের উৎস। মানুষ যদি একথা স্মরণ রাখে যে, সে স্বাধীন নয়, বরং এক আল্লাহর বান্দা। আর সে আল্লাহ‌ তার সমস্ত কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত, একদিন তাঁর সামনে হাজির হয়ে নিজের সব কাজ-কর্মের জবাবদিহি তাকে করতে হবে, তাহলে সে কখনো কোন খারাপ কাজ বা গোমরাহীতে লিপ্ত হতে পারবে না। মানবিক দুর্বলতার কারণে কোন সময় তার পদস্খলন যদি ঘটেও তাহলে সম্বিত ফিরে পাওয়ামাত্র সে সংযত ও সংশোধিত হয়ে যাবে।
.
.
.
১.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হাদীদ, টীকা ১। এ আয়াতাংশ দিয়ে বক্তব্য শুরু করার কারণ পরবর্তী বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে আপনা থেকেই বোধগম্য হয়। পরবর্তী আয়াতসমূহে বিশ্ব-জাহান এবং মানুষ সৃষ্টির যে তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, এর স্রষ্টা, মালিক ও শাসক একমাত্র আল্লাহ। তিনি এই বিশ্ব-জাহানকে অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। তাছাড়া মানুষকে এখানে দায়িত্বহীন বানিয়েও ছেড়ে দেয়া হয়নি যে, সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে অথচ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কেউ থাকবে না। এই বিশ্ব-জাহানের শাসক এমন কোন বেখবর বাদশাহও নন যে, তাঁর সাম্রাজ্যে যা কিছু ঘটেছে তা তাঁর আদৌ জানা থাকবে না। এ ধরণের বিষয়বস্তু বর্ণনা করার জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সূচনা কথা বা ভূমিকা যা হতে পারতো সংক্ষিপ্ত এ আয়াতাংশে তাই বলা হয়েছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুসারে এই ভূমিকা বা সূচনা কথার অর্থ হলো, পৃথিবী থেকে শুরু করে মহাকাশের সর্বশেষ বিস্তৃত পর্যন্ত যেদিকেই তাকাও না কেন যদি তোমরা বিবেক বুদ্ধিহীন না হয়ে থাকো তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারবে যে, পরমাণু থেকে নিয়ে বিশাল ছায়াপথ পর্যন্ত সবকিছুই শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্যই দিচ্ছে না বরং তিনি যে সব রকম দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা, দুর্বলতা এবং ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র সে সাক্ষ্যও দিচ্ছে। তাঁর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর কাজকর্ম ও আদেশ-নিষেধসমূহে যদি কোন প্রকার কলুষ-কালিমা ও ভুল-ত্রুটি কিংবা কোন দুর্বলতা ও অপূর্ণতার নামমাত্র সম্ভাবনাও থাকতো তাহলে চরম পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই যুক্তিভিত্তিক ও জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থা আদিকাল থেকে অন্তকাল পর্যন্ত এই অলংঘনীয় ও অবিচল পন্থায় চলা তো দূরের কথা অস্তিত্ব লাভ করতেও পারতো না।
২.
অর্থাৎ এ গোটা বিশ্ব-জাহান তাঁরই সাম্রাজ্য। তিনি একে সৃষ্টি করে এবং একবার চালু করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনিই এর ওপর কার্যত সার্বক্ষণিক শাসন পরিচালনা করছেন। এই শাসন ও কর্তৃত্বে অন্য কারো আদৌ কোন অংশ বা অধিকার নেই। এই বিশ্ব-জাহানের কোন জায়গায় কেউ যদি সাময়িকভাবে সীমিত পর্যায়ে ক্ষমতা কিংবা মালিকানা অথবা শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে থাকে তাহলে তা তার নিজের শক্তিতে অর্জিত ক্ষমতা ও ইখতিয়ার নয় বরং আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা ও ইখতিয়ার। আল্লাহ‌ যতদিন চান ততদিন তা তার অধিকারে থাকে এবং যখনই চান তা তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেন।
৩.
অন্য কথায় তিনি একাই কেবল প্রশংসার যোগ্য। অন্য আর যার মাধ্যমে প্রশংসার যোগ্য কোন গুণ বা সৌন্দর্য আছে তা তারই দেয়া। আর حمد শব্দকে যদি শোকর বা কৃতজ্ঞতা অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে শোকর ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার প্রকৃত অধিকারীও কেবল তিনিই। কারণ সমস্ত নিয়ামত তাঁরই সৃষ্টি এবং সমস্ত সৃষ্টিরও প্রকৃত উপকারী ও কল্যাণদাতাও তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। অন্য কোন ব্যক্তি বা সত্তার কোন উপকারের জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তা করি এই জন্য যে, ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর নিয়ামত আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। অন্যথায় সে যেমন এই নিয়ামতের স্রষ্টা নয়, তেমনি আল্লাহর দেয়া তাওফীক ও সামর্থ্য ছাড়া সে ঐ নিয়ামত আমাদের কাছে পৌঁছাতেও সক্ষম হতো না।
৪.
অর্থাৎ তিনি চূড়ান্ত ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম। তাঁর ক্ষমতা ও সামর্থ্যকে সীমিত করার মতো কোন শক্তি নেই।
৫.
একথাটির চারটি অর্থ ও চারটি অর্থই যথাস্থানে সঠিকঃ

একঃ তিনিই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সৃষ্টিকর্তা হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার আর কেউ এ সত্যটিকে স্বীকার করে। আয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ এক সাথে মিলিয়ে পড়লে সর্বপ্রথম এ অর্থটিই বোধগম্য হয়।

দুইঃ তোমরা ইচ্ছা করলে কুফরীর পথ অবলম্বন করতে পার আবার ইচ্ছা করলে ঈমানও গ্রহণ করতে পার। এভাবে তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফরীর দু’টি পথের কোনটি গ্রহণ করতেই তিনি তোমাদের বাধ্য করেননি। তাই নিজেদের ঈমান ও কুফরীর ব্যাপারে তোমরা নিজেরাই দায়ী। পরবর্তী আয়াতাংশ “তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ‌ তা সবই দেখছেন” এ অর্থ সমর্থন করে। অর্থাৎ এই স্বাধীনতা ও ইখতিয়ার দিয়ে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছেন। এই ইখতিয়ার ও স্বাধীনতাকে তোমরা কিভাবে কাজে লাগাও তিনি তা দেখছেন।

তিনঃ তিনি তো তোমাদেরকে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দাবী হলো, তোমরা সবাই ঈমানের পথ অবলম্বন করবে। কিন্তু এই সুস্থ প্রকৃতির ওপর জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতির পরিপন্থী কুফরীর পথ অনুসরণ করেছে। আবার কেউ কেউ তাদের জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতির অনুকূল ঈমানের পথ অনুসরণ করেছে। এ আয়াতটিকে সূরা রূমের ৩০ নং আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়লে এ অর্থটিই বোধগম্য হয়। সূরা রূমের ঐ আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তুমি একাগ্র ও একনিষ্ঠ হয়ে নিজের লক্ষ্য ও মনযোগকে দ্বীনের দিকে করে দাও এবং যে প্রকৃতির ওপর আল্লাহ‌ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেই প্রকৃতির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর বানানো স্বভাব-প্রকৃতি বদলানো যাবে না। এটিই পুরোপুরি সত্য ও সঠিক দ্বীন।” কিছু সংখ্যক হাদীস ও এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছে। এসব হাদীসে নবী (সা.) বলেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ সঠিক প্রকৃতির ওপর জন্মলাভ করে থাকে। কিন্তু পরে বাইরে থেকে কুফরী, শিরক ও গোমরাহী তার ওপর চড়াও হয়। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূর, টীকা ৪২ থেকে ৪৭)। এখানে এ বিষয়টি বিশেষ উল্লেখ্য যে, জন্মগতভাবে মানুষের পাপী হওয়ার ধারণাকে খৃস্টবাদ দেড় হাজার বছর ধরে তাদের মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস বানিয়ে রেখেছে। অথচ আসমানী কিতাবসমূহ মানুষের জন্মগতভাবে পাপী হওয়ার ধারণা কখনো পেশ করেনি। বর্তমানে ক্যাথলিক পণ্ডিত পুরোহিতগণ নিজেরাই বলতে শুরু করেছেন যে, এই ধর্মবিশ্বাসের কোন ভিত্তিই বাইবেলে নেই। বাইবেলের একজন বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত রিভারেণ্ডে হার্বার্ট হগ (Haag) তার “Is Original Sin In Scripture” গ্রন্থে লিখছেন, প্রথম যুগের খৃস্টানদের মধ্যে অন্তত তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন অস্তিত্বই ছিল না যে, মানুষ জন্মগতভাবে পাপী। এই ধ্যান-ধারণা যখন বিস্তার লাভ করতে শুরু করে তখন থেকে পরবর্তী দুইশত বছর পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতগণ তার প্রতিবাদ করেছেন। পরবর্তী সময়ে পঞ্চম শতকে সেন্ট অগাস্টাইন যুক্তি ও কূটতর্কের জোরে এ বিশ্বাসটিকে খৃস্টবাদের মূল ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। অর্থাৎ “মানবজাতি উত্তরাধিকার সূত্রে আদমের পাপের বোঝা লাভ করেছে। তাই ঈসা মাসীহর কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্তের সুবাদে মুক্তি লাভ করা ছাড়া মানুষের মুক্তি লাভের আর কোন উপায় নেই।”

চারঃ একমাত্র আল্লাহ‌ তা’আলাই তোমাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। এক সময় তোমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তারপর তোমরা অস্তিত্ব লাভ করেছ। এটি এমন একটি ব্যাপার যে, তা নিয়ে তোমরা যদি সহজ-সরলভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে তাহলে উপলব্ধি করতে পারতে যে, এই অস্তিত্বই প্রকৃতপক্ষে সেই আসল নিয়ামত যার সাহায্যে তোমরা অন্যসব নিয়ামত ভোগ করতে সক্ষম হচ্ছো। এই উপলব্ধি থাকলে তোমাদের কেউই তার স্রষ্টার সাথে কুফরী ও বিদ্রোহের আচরণ করতে পারতে না। কিন্তু তোমাদের অনেকে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি, কিংবা করে থাকলেও ভ্রান্ত পন্থায় চিন্তা-ভাবনা করেছে এবং কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে। অনেকে আবার সঠিক ও নির্ভুল চিন্তা-ভাবনার দাবী ঈমানের পথটিই অনুসরণ করেছে।

৬.
এ আয়াতাংশে যে দেখার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ শুধু দেখাই নয়, বরং আপনা থেকেই এর এই অর্থ প্রকাশ পায় যে, তোমাদের আমল অনুপাতে তোমাদের প্রতিদান ও শাস্তি দেয়া হবে। এটা ঠিক এরূপ যেন কোন শাসক কাউকে তার অধীনে চাকরীতে নিয়োগ করে বলছে যে, তুমি কিভাবে কাজ করো তা আমি দেখবো। এক্ষেত্রে এ ধরণের কথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, যদি ঠিকমত কাজ করো তাহলে পুরস্কার ও উন্নতি দান করবো। আর অন্যথা হলে কঠোরভাবে পাকড়াও করবো।
৭.
এই আয়াতে গভীর যৌক্তিক সম্পর্কের পারম্পর্য ও ক্রমানুসারে তিনটি কথা বলা হয়েছেঃ

প্রথম কথাটি বলা হয়েছে এই যে, আল্লাহ‌ তা’আলা এই বিশ্ব-জাহানকে যথাযথ ও যৌক্তিক পরিণতির জন্য সৃষ্টি করেছেন। بالحق শব্দটি যখন কোন খবর সম্পর্কে বলা হয় তখন তার অর্থ হয় সত্য খবর। হুকুম বা নির্দেশের জন্য বলা হলে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক হুকুম বা নির্দেশ, কথার ব্যাপারে বলা হলে তার অর্থ হয় সত্য ও সঠিক কথা এবং কোন কাজ সম্পর্কে ব্যবহৃত হলে তার অর্থ হয় এমন কাজ যা বিজ্ঞোচিত ও যুক্তিসঙ্গত, অনর্থক ও অযথা কাজ নয়। এটা স্পষ্ট যে, خلق বা সৃষ্টি করা একটি কাজ। তাই বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করাকে যথাযথ ও যৌক্তিক বলার অনিবার্য অর্থ এই যে, এই বিশ্ব-জাহানকে খেল-তামাশার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং এটি একজন বিজ্ঞ স্রষ্টার একান্ত সুচিন্তিত কাজ। এর প্রতিটি বস্তুর পেছনে একটি যুক্তিসঙ্গত উদ্দেশ্য আছে। এসব সৃষ্টির মধ্যে এই উদ্দেশ্যবাদ এতই সুস্পষ্ট যে, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষ যদি এর কোনটির রূপ প্রকৃতি ভালভাবে বুঝতে পারে তাহলে ঐ জিনিস সৃষ্টির যৌক্তিক ও বিজ্ঞোচিত উদ্দেশ্য কি হতে পারে তা জানা তার জন্য কঠিন কাজ নয়। পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত বৈজ্ঞানিক উন্নতি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, গভীর চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা এবং অনুসন্ধান দ্বারা মানুষ যে জিনিসেরই রূপ-প্রকৃতি বুঝাতে সক্ষম হয়েছে শেষ পর্যন্ত ঐ জিনিস সম্পর্কে সে একথাও জানতে পেরেছে যে, তা কোন্ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে আর সেই উদ্দেশ্যকে জানা ও বুঝার পরই সে এমন অসংখ্য জিনিস আবিষ্কার করেছে যা বর্তমানে মানব সভ্যতার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিশ্ব-জাহান যদি কোন ক্রীড়ামোদীর খেলার উপকরণ হতো এবং এর মধ্যে কোন যুক্তি ও উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল না থাকতো তাহলে এসব আবিষ্কার উদ্ভাবন কখনো সম্ভব হতো না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনয়াম, টীকা ৪৬; ইউনূস, টীকা ১১; ইবরাহীম, টীকা ২৬; আল নাহল, টীকা ৬; আল আম্বিয়া, টীকা ১৫-১৬; আল মু’মিনূন, টীকা ১০২; আল আনকাবূত, টীকা ৭৫; আর রূম, টীকা ৬; আদ দুখান, টীকা ৩৪; আল জাসিয়া, টীকা২৮)।

দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছে এই যে, আল্লাহ‌ এই বিশ্ব-জাহানে মানুষকে সর্বোত্তম আকার আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আকার আকৃতি অর্থ শুধু মানুষের চেহারা নয়। বরং এর অর্থ তার গোটা দৈহিক কাঠামো এবং দুনিয়াতে কাজ করার জন্য তাকে দেয়া সব রকম শক্তি ও যোগ্যতা ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই দু’টি দিক দিয়ে মানুষকে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ কারণেই সে পৃথিবী ও তার আশেপাশের সমস্ত সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করার যোগ্য হয়েছে। তাকে দীর্ঘ দেহ কাঠামো দেয়া হয়েছে, চলাফেরার জন্য উপযুক্ত পা দেয়া হয়েছে এবং কাজ-কর্ম করার জন্য উপযুক্ত হাত দেয়া হয়েছে। তাকে এমন সব ইন্দ্রিয় এবং জ্ঞান আহরণ যন্ত্র দেয়া হয়েছে যার সাহায্যে সে সব রকম তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তাকে চিন্তা-ভাবনা করার, বুঝার এবং বিভিন্ন তথ্য একত্র করে তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত উন্নত পর্যায়ের একটি মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে একটি নৈতিক বোধ ও অনূভূতি এবং ভালমন্দ ও ভুল শুদ্ধ নিরূপক শক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী শক্তি দেয়া হয়েছে যার সাহায্যে সে নিজেই তার চলার পথ বেছে নেয় এবং কোন পথে সে তার চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করবে আর কোন পথে করবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাকে এতটা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, সে ইচ্ছা করলে তার স্রষ্টাকে মানতে এবং তাঁর আনুগত্য ও দাসত্ব করতে পারে, কিংবা তাঁকে অস্বীকার করতে পারে কিংবা যাদেরকে ইচ্ছা সে তার খোদা বানিয়ে নিতে পারে অথবা যাকে সে খোদা বলে স্বীকার করে ইচ্ছা করলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। এসব শক্তি এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আর কার্যত সে এ ক্ষমতা প্রয়োগও করছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিন টীকা ৯১)

ওপরে বর্ণিত এ দু’টি কথার যৌক্তিক ফলাফল হিসেবে এই আয়াতের তৃতীয় অংশে বর্ণিত কথাটি আপনা থেকেই এসে পড়ে। আয়াতটির এই অংশে বলা হয়েছেঃ “অবশেষে তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।” একথা স্পষ্ট যে, এরূপ একটি যুক্তিসঙ্গত ও উদ্দেশ্যমূলক বিশ্ব-ব্যবস্থায় এমন স্বাধীন একটি সৃষ্টিকে যখন সৃষ্টি করা হয়েছে তখন যুক্তির দাবী কখনো এটা হতে পারে না যে, তাকে এখানে দায়িত্বহীন বানিয়ে লাগামহীন উটের মত ছেড়ে দেয়া হবে। বরং এর অনিবার্য দাবী হবে যিনি তাকে ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা দিয়ে তাঁর সৃষ্ট জগতে এই মর্যাদা ও অবস্থান দিয়েছেন তাঁর সামনে সে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। এই আয়াতে উল্লেখিত “ফিরে যাওয়া” এর অর্থ নিছক ফিরে যাওয়া নয়, বরং এর অর্থ জবাবদিহির জন্য ফিরে যাওয়া। পরবর্তী আয়াতসমূহে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এই ফিরে যাওয়াটা পার্থিব এই জীবনে হবে না বরং মৃত্যুর পরের আরেকটি জীবন হবে। গোটা মানবজাতিকে পুনরায় জীবিত করে হিসেব-নিকেশ গ্রহণের জন্য যখন এক সাথে একই সময়ে জড়ো করা হবে, সেটি হবে এর প্রকৃত সময়। আর সেই হিসেব-নিকেশের ফলাফল স্বরূপ পুরস্কার ও শাস্তির ভিত্তি হবে মানুষ আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা ও ইখতিয়ারকে সঠিক পন্থায় কাজে লাগিয়েছে, না ভুল পন্থায় কাজে লাগিয়েছে তার ওপর। এখন প্রশ্ন হলো, জবাবদিহির এই কাজটি দুনিয়ার বর্তমান এই জীবনে হওয়া সম্ভব নয় কেন? আর এর প্রকৃত সময় মৃত্যুর পরের জীবনই বা কেন? তাছাড়া এ পৃথিবীর গোটা মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আগের ও পরে সব মানুষকে যে সময় পুনরায় জীবিত করে জড়ো করা হবে সে সময়টিই বা এর প্রকৃত সময় হবে কেন? মানুষ যদি বিবেক-বুদ্ধিকে কিছুটা কাজে লাগায় তাহলে সে বুঝতে পারবে যে, এ সবই যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার। সে এ কথাও বুঝতে পারবে যে, জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির দাবী হলো, মানুষের হিসেব-নিকেশ ও জবাবদিহির কাজটি মৃত্যুর পরের জীবনেই হওয়া দরকার এবং সমস্ত মানুষের এক সাথে হওয়া দরকার। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে তার গোটা জীবনের কাজকর্মের জন্য। তাই তার জীবনের সমস্ত কাজকর্ম ও দায়িত্ব-কর্তব্যের জন্য জবাবদিহির সঠিক ও অনিবার্য সময় সেটিই হওয়া উচিত যখন তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, মানুষের কাজ-কর্মের ফলাফল, প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব ফেলে এবং প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সৃষ্টি করে, তেমনি তার মৃত্যুর পরেও তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এসব ফলাফল, প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার জন্য সে-ই দায়ী। তাই সঠিক জবাবদিহি ও হিসেব-নিকেশ কেবল তখনই হতে পারে যখন গোটা মানবজাতির জীবন কর্মের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে এবং আগের ও পরের সমস্ত মানুষকে একই সময়ে একত্রিত করা হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আরাফ, টীকা, ৩০; ইউনূস, টীকা ১০-১১; হূদ, টীকা ১-৫; আন নাহল, টীকা ৩৫; আল হজ্জ, টীকা ৯; আন নামল, টীকা ২৭; আর রূম, টীকা ৫-৬; সোয়াদ, টীকা ২০-৩০; আল মু’মিন, টিকা ৮০; আল জাসিয়া, টীকা ২৭ থেকে ২৯)।

৮.
এর আরেকটি অনুবাদ হতে পারে “যা তোমরা গোপনে করো এবং যা তোমরা প্রকাশ্যে করো।”
৯.
অর্থাৎ তিনি শুধু সেই সব কাজ-কর্ম সম্পর্কেই অবগত নন যা মানুষের গোচরে আসে বরং সেই সব কাজ-কর্ম সম্পর্কেও তিনি অবহিত যা সবার কাছেই গোপন থাকে। তাছাড়াও তিনি শুধু কাজ-কর্মের বাহ্যিক রূপটাই দেখেন না বরং মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে কি ধরণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দেশ্য সক্রিয় ছিল, সে যা করেছে তা কি নিয়তে করেছে এবং কি বুঝে করেছে তাও তিনি জানেন। এটা এমন এক সত্য, যে বিষয়ে চিন্তা করলে মানুষ বুঝতে পারবে যে, ইনসাফ ও সুবিচার কেবল আখেরাতেই হতে পারে এবং শুধু আল্লাহ‌ তা’আলার আদালতেই ইনসাফ হওয়া সম্ভব। মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও দাবী করে যে, মানুষের তার প্রতিটি অপরাধের জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু কে না জানে যে, কৃত অপরাধের বেশীর ভাগই দুনিয়াতে হয় গোপন থাকে নয়তো প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ার কারণে অপরাধী নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। কিংবা অপরাধ প্রকাশ পেয়ে গেলেও অপরাধী এমন প্রভাবশালী ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে যে, তাকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এও দাবী করে যে, কোন ব্যক্তির কাজের ধরণ ও প্রকৃতি শুধু অপরাধমূলক কাজের মত হলেই তার শাস্তি না পাওয়া উচিত। বরং এই মর্মে তার অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা হওয়া উচিত যে, যে কাজ সে করেছে তা ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে বুঝে করেছে কিনা। এ অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনাও হওয়া উচিত যে, ঐ কাজ করার সময় সে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবেই তা করছিল। অপরাধ সংঘটনই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এবং সে এ কথাও জানতো যে, সে যা করছে তা অপরাধ। এ কারণে দুনিয়ার বিচারালয়সমূহ মামলা মোকাদ্দমার নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে এসব বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে থাকে এবং এসব বিষয়ের অনুসন্ধানকে সুবিচার নীতির দাবী বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এই পৃথিবীতে সত্যি সত্যিই কি এমন কোন উপায়-উপকরণ আছে যার সাহায্যে এ বিষয়ে এমন ন্যায়ানুগ অনুসন্ধান হতে পারে যা সব রকম সংশয়ের ঊর্ধ্বে? এদিক দিয়ে বিচার করলে এ আয়াতটিও আল্লাহ‌ তা’আলার এই বাণীর সাথে গভীর যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান যাতে বলা হয়েছেঃ “তিনি আসমান ও যমীনকে যৌক্তিক পরিণামের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” যৌক্তিক পরিণামের জন্য সৃষ্টি করার অনিবার্য দাবী হলো, এই বিশ্ব-জাহানে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার থাকবে। এ ধরণের ন্যায়বিচার কেবল তখনই কায়েম হতে পারে যখন ন্যায়বিচারকারীর দৃষ্টি থাকে মানুষের মত দায়িত্বশীল সৃষ্টির কোন কাজ শুধু গোপন থাকবে না তাই নয়, বরং যে নিয়ত ও উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি কোন কাজ করেছে তাও তাঁর থেকে গোপন থাকবে না। এ কথা স্পষ্ট যে, বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ছাড়া আর কোন সত্তা এমন হতে পারে না যার দ্বারা এরূপ ন্যায়বিচার কায়েম হতে পারে। এমন কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ‌ ও আখেরাতকে অস্বীকার করে তা হলে সে যেন প্রকারান্তরে এ দাবীই করছে যে, আমরা এমন বিশ্ব-জাহানে বাস করছি যেখানে বাস্তবে কোন ইনসাফ নেই, এমনকি ইনসাফের কোন সম্ভাবনাই নেই। এরূপ আহম্মকি ও নির্বুদ্ধিতামূলক ধ্যান-ধারণায় যে ব্যক্তির জ্ঞানবুদ্ধি এবং মন ও বিবেক সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত সে যদি নিজেকে প্রগতিবাদী ও যুক্তিবাদী মনে করে এবং বিশ্ব-জাহান সম্পর্কে কুরআনের পেশকৃত এই চরম যুক্তিগ্রাহ্য ধারণাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বা প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা বলে মনে করে তাহলে তার মতো চরম নির্লজ্জ ও বেহায়া আর কেউই নেই।
১০.
অর্থাৎ তারা নিজেদের কৃতকর্মের যে শাস্তি পৃথিবীতে ভোগ করেছে তা তাদের অপরাধসমূহের উপযুক্ত শাস্তি যেমন নয় তেমনি পুরো শাস্তিও নয়। পূর্ণাঙ্গ ও যথোপযুক্ত শাস্তি তাদেরকে ভোগ করতে হবে আখেরাতে। তবে তাদের ওপর পৃথিবীতে যে আযাব এসেছে তা থেকে মানুষ এ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যে, যে জাতিই তাদের রবের সাথে কুফরীর আচরণ করেছে, তারা কেমন করে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কেমন পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৫-৬; হূদ, টীকা ১০৫)।
অনুবাদ: