পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

২৪৬ আয়াত

২৩ ) এটাই সেই জিনিস যার সুসংবাদ আল্লাহ‌ তাঁর সেই সব বান্দাদের দেন যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। হে নবী, এসব লোককে বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। ৪০ তবে আত্মীয়তার ভালবাসা অবশ্যই চাই। ৪১ যে কল্যাণ উপার্জন করবে আমি তার জন্য তার সেই কল্যাণের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দেব। নিশ্চয়ই আল্লাহ‌ বড় ক্ষমাশীল ও নেক কাজের মর্যাদাদাতা। ৪২
ذَٰلِكَ ٱلَّذِى يُبَشِّرُ ٱللَّهُ عِبَادَهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ ۗ قُل لَّآ أَسْـَٔلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا ٱلْمَوَدَّةَ فِى ٱلْقُرْبَىٰ ۗ وَمَن يَقْتَرِفْ حَسَنَةًۭ نَّزِدْ لَهُۥ فِيهَا حُسْنًا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ شَكُورٌ ٢٣
২৪ ) এ লোকেরা কি বলে, এই ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে অপবাদ তৈরী করেছে? ৪৩ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমার দিলের ওপর মোহর মেরে দিতেন। ৪৪ তিনি বাতিলকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং নিজের আদেশে সত্যকে সত্য প্রমাণ করে দেখান। ৪৫ তিনি মনের গোপন বিষয়ও জানেন। ৪৬
أَمْ يَقُولُونَ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًۭا ۖ فَإِن يَشَإِ ٱللَّهُ يَخْتِمْ عَلَىٰ قَلْبِكَ ۗ وَيَمْحُ ٱللَّهُ ٱلْبَـٰطِلَ وَيُحِقُّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦٓ ۚ إِنَّهُۥ عَلِيمٌۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ٢٤
২৫ ) তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং মন্দ কাজসমূহ ক্ষমা করেন। অথচ তোমাদের সব কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁর জানা আছে। ৪৭
وَهُوَ ٱلَّذِى يَقْبَلُ ٱلتَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِۦ وَيَعْفُوا۟ عَنِ ٱلسَّيِّـَٔاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ ٢٥
২৬ ) তিনি ঈমানদার ও নেক আমলকারীদের দোয়া কবুল করেন এবং নিজের দয়ায় তাদের আরো অধিক দেন। কাফেরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
وَيَسْتَجِيبُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَيَزِيدُهُم مِّن فَضْلِهِۦ ۚ وَٱلْكَـٰفِرُونَ لَهُمْ عَذَابٌۭ شَدِيدٌۭ ٢٦
২৭ ) আল্লাহ যদি তাঁর সব বান্দাদেরকে অঢেল রিযিক দান করতেন তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি একটি হিসাব অনুসারে যতটা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে অবহিত এবং তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। ৪৮
۞ وَلَوْ بَسَطَ ٱللَّهُ ٱلرِّزْقَ لِعِبَادِهِۦ لَبَغَوْا۟ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَـٰكِن يُنَزِّلُ بِقَدَرٍۢ مَّا يَشَآءُ ۚ إِنَّهُۥ بِعِبَادِهِۦ خَبِيرٌۢ بَصِيرٌۭ ٢٧
২৮ ) তিনিই সে মহান সত্তা যিনি মানুষের নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং রহমত বিস্তার করে দেন। তিনি প্রশংসার যোগ্য অভিভাবক। ৪৯
وَهُوَ ٱلَّذِى يُنَزِّلُ ٱلْغَيْثَ مِنۢ بَعْدِ مَا قَنَطُوا۟ وَيَنشُرُ رَحْمَتَهُۥ ۚ وَهُوَ ٱلْوَلِىُّ ٱلْحَمِيدُ ٢٨
২৯ ) এই আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং এ দু’জায়গায় তিনি যেসব প্রাণীকুল ছড়িয়ে রেখেছেন এসব তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। ৫০ যখন ইচ্ছা তিনি এদেরকে একত্র করতে পারেন। ৫১
وَمِنْ ءَايَـٰتِهِۦ خَلْقُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَمَا بَثَّ فِيهِمَا مِن دَآبَّةٍۢ ۚ وَهُوَ عَلَىٰ جَمْعِهِمْ إِذَا يَشَآءُ قَدِيرٌۭ ٢٩
৩০ ) তোমাদের ওপর যে মসিবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে এসেছে। বহু সংখ্যক অপরাধকে তো আল্লাহ‌ ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন। ৫২
وَمَآ أَصَـٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٍۢ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا۟ عَن كَثِيرٍۢ ٣٠
৩১ ) তোমরা তোমাদের আল্লাহকে পৃথিবীতে অচল ও অক্ষম করে দিতে সক্ষম নও এবং আল্লাহ‌ ছাড়া তোমাদের আর কোন সহযোগী ও সাহায্যকারী নেই।
وَمَآ أَنتُم بِمُعْجِزِينَ فِى ٱلْأَرْضِ ۖ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِىٍّۢ وَلَا نَصِيرٍۢ ٣١
৩২ ) সমুদ্রের বুকে পাহাড়ের মত দৃশ্যমান এসব জাহাজ তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
وَمِنْ ءَايَـٰتِهِ ٱلْجَوَارِ فِى ٱلْبَحْرِ كَٱلْأَعْلَـٰمِ ٣٢
৪০.
‘এ কাজ’ অর্থ যে প্রচেষ্টার মাধ্যমে নবী ﷺ মানুষকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচানো এবং জান্নাতের সুসংবাদের উপযুক্ত বানানোর জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
৪১.
মূল আয়াতের বাক্যাংশ হলো অর্থাৎ আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। তবে إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى র ভালবাসা অবশ্যই প্রত্যাশা করি। এই قُرْبَى শব্দটির ব্যাখ্যায় মুফসসিরদের মধ্যে বেশ মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে।

এক দল এ শব্দটিকে আত্মীয়তা (আত্মীয়তার বন্ধন) অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং আয়াতের অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, “আমি এ কাজের জন্য তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক বা বিনিময় চাই না। তবে তোমাদের ও আমাদের মাঝে আত্মীয়তার যে বন্ধন আছে তোমরা (কুরাইশরা) অন্তত সেদিকে লক্ষ্য রাখবে এতটুকু আমি অবশ্যই চাই। তোমাদের উচিত ছিল আমার কথা মেনে নেয়া। কিন্তু যদি তোমরা তা না মানো তাহলে গোটা আরবের মধ্যে সবার আগে তোমরাই আমার সাথে দুশমনী করতে বদ্ধপরিকর হবে তা অন্তত করো না।” এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যা। ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর, তাবারানী, বায়হাকী, ইবনে সা’দ ও অন্যান্য পণ্ডিতগণ বহু সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এ ব্যাখ্যাটি উদ্ধৃত করেছেন এবং মুজাহিদ, ইকরিমা, কাতাদা, সুদ্দী, আবু মালেক, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম, দাহহাক, আতা ইবনে দীনার এবং আরো অনেক বড় বড় মুফাসসির এ ব্যাখ্যাটাই বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয় দলটি قُرْبَى শব্দটিকে নৈকট্য বা নৈকট্য অর্জন অর্থে গ্রহণ করেন এবং আয়াতটির অর্থ করেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্যের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ছাড়া আমি তোমাদের কাছে এ কাজের জন্য আর কোন বিনিময় চাই না। অর্থাৎ তোমরা সংশোধিত হয়ে যাও। শুধু এটাই আমার পুরস্কার। এ ব্যাখ্যা হাসান বাসারী থেকে উদ্ধৃত হয়েছে এবং কাতাদা থেকেও এর সমর্থনে একটি মত বর্ণিত হয়েছে। এমনকি তাবারানীর একটি বর্ণনায় ইবনে আব্বাসের সাথেও এ মতকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। কুরআন মজীদেরও আরেক স্থানে বিষয়টি এ ভাষায় বলা হয়েছেঃ

قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِلَّا مَنْ شَاءَ أَنْ يَتَّخِذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلًا- الفرقان : 58

“এদের বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। যার ইচ্ছা সে তার রবের পথ অনুসরণ করুক, আমার পারিশ্রমিক শুধু এটাই।” তৃতীয় দলটি قُرْبَى শব্দটিকে নিকট আত্মীয় (আত্মীয় স্বজন) অর্থে গ্রহণ করেন। তারা আয়াতের অর্থ করেনঃ “তোমরা আমার আত্মীয় ও আপনজনদের ভালবাসবে এছাড়া আমার এ কাজের কোন পারিশ্রমিক আমি চাই না।” এই দলের কেউ আত্মীয়দের মধ্যে গোটা বনী আবদুল মুত্তালিবকে অন্তর্ভুক্ত করেন আবার কেউ কেউ একে শুধু হযরত আলী, ফাতেমা ও তাঁদের সন্তান-সন্ততি পর্যন্ত সীমিত রাখেন। এ ব্যাখ্যাটি সাঈদ ইবনে জুবায়ের এবং ‘আমর ইবনে শু’আইব থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আবার কোন কোন বর্ণনাতে একে ইবনে আব্বাস ও হযরত আলী ইবনে হুসাইনের (যয়নুল আবেদীন) সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু কারণে এ ব্যাখ্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রথমত সন্তানের প্রশ্ন তো দূরের কথা মক্কায় যে সময় এ সূরা শূরা নাযিল হয় সে সময় হযরত আলী ও ফাতিমার বিয়ে পর্যন্ত হয়নি। বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীরও সবাই আবার নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সহযোগিতা করছিলো না। বরং তাদের কেউ কেউ তাঁর প্রকাশ্য দুশমনদের সহযোগী ছিল। এক্ষেত্রে আবু লাহাবের শত্রুতার বিষয় তো সর্বজনবিদিত। দ্বিতীয়ত, শুধু বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মীয় ছিল না। নবীর ﷺ মহিয়ষী মা, তাঁর মহান বাপ এবং হযরত খাদীজার (রা.) মাধ্যমে কুরাইশদের সকল পরিবারের সাথেই তাঁর আত্মীয়তা ছিল। সেই সব পরিবারে নবীর ﷺ গুণী সাহাবা যেমন ছিলেন তেমনি ঘোরতর শত্রুও ছিল। তাই ঐ সব আত্মীয়দের মধ্য থেকে তিনি কেবল বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীকে নিজের ঘনিষ্ঠজন আখ্যায়িত করে এই ভালবাসার দাবীকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট রাখবেন তা নবীর ﷺ জন্য কি করে সম্ভব ছিল? তৃতীয়ত, যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, একজন নবী যে উচ্চাসনে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ কন্ঠে আল্লাহর দিকে আহবান জানান সেই উচ্চাসন থেকে এ মহান কাজের জন্য তিনি এত নীচ পর্যায়ের পুরস্কার চাইবেন যে, তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালবাসো, তা কোনত্রুমেই সম্ভব নয়। এটা এমনই নীচ পর্যায়ের ব্যাপার যে কোন সুস্থ-স্বাভাবিক রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না যে, আল্লাহ‌ তাঁর নবীকে একথা শিখিয়ে থাকবেন আর নবী কুরাইশদের মধ্যে দাঁড়িয়ে একথা বলে থাকবেন। কুরআন মজীদে নবী-রসূলদের যেসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাতে আমরা দেখি একের পর এক নবী এসে তাঁদের কওমকে বলছেনঃ আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় প্রত্যাশা করি না। আমার পারিশ্রমিক বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর কাছে প্রাপ্য (ইউনুস ৭২, হূদ ২৯ ও ৫১, আশ-শুআরা ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০ আয়াত)। সূরা ইয়াসীনে নবীর সত্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড বলা হয়েছে এই যে, তিনি দাওয়াতের ব্যাপারে নিস্বার্থ হন (আয়াত ২১)। কুরআন মজিদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে বার বার একথা বলানো হয়েছে যে, আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না (আল আনয়াম ৯০, ইউসুফ ১০৪, আল মু’মিনুন ৭২, আল ফুরকান ৫৭, সাবা ৪৭, সোয়াদ ৮৬, আত তুর ৪০, আল কলম ৪৬ আয়াত)। এরপরে একথা বলার কি কোন সুযোগ থাকে যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান জানানোর যে কাজ করছি তার বিনিময়ে তোমরা আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসো। তাছাড়া যখন আমরা দেখি, এ ঈমানদারদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়নি বরং এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফেরদেরকে তখন তা আরো খাপছাড়া বলে মনে হয়। আগে থেকেই কাফেরদেরকে লক্ষ্য করেই গোটা বক্তব্য চলে আসছে এবং পরবর্তী বক্তব্যও তাদের লক্ষ্য করেই পেশ করা হয়েছে। বক্তব্যের এই ধারাবাহিকতার মধ্যে বিরোধীদের কাছে কোন রকম বিনিময় চাওয়ার প্রশ্ন কি করে আসতে পারে? বিনিময় চাওয়া যায় তাদের কাছে যাদের কাছে কোন ব্যক্তির তাদের জন্য সম্পাদিত কাজের কোন মূল্য থাকে। কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের কি মূল্য দিচ্ছিলো যে, তিনি তাদের কাছে বলতেন, আমি তোমাদের জন্য যে কাজ করেছি তার বিনিময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনদের ভালবাসবে? তারা তো উল্টা সেটাকে অপরাধ মনে করছিলো এবং সেজন্য তাঁকে হত্যা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলো।

৪২.
অর্থাৎ যারা জেনে বুঝে নাফরমানী করে সেই সব অপরাধীদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় নেক কাজে সচেষ্ট বান্দাদের সাথে আল্লাহর আচরণ তেমন নয়। তাদের সাথে আল্লাহর আচরণ হচ্ছে (১) তারা নিজের পক্ষ থেকে যতটা সৎকর্মশীল হওয়ার চেষ্টা করে আল্লাহ‌ তাদেরকে তার চেয়েও বেশী সৎকর্মশীল বানিয়ে দেন। (২) তাদের কাজকর্মে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায় অথবা সৎকর্মশীল হওয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে গোনাহ সংঘটিত হয় আল্লাহ‌ তা উপেক্ষা করেন এবং (৩) যে সামান্য পরিমাণ নেক কাজের পুঁজি তারা নিয়ে আসে সেজন্য আল্লাহ‌ তাদেরকে মর্যাদা দেন এবং অধিক পুরস্কার দান করেন।
৪৩.
এই প্রশ্নবোধক বাক্যাংশে তীব্র তিরস্কার প্রচ্ছন্ন আছে, যার সারকথা হলো, হে নবী, এসব লোক কি এতই দুঃসাহসী ও নির্ভিক যে তোমার বিরুদ্ধে আল্লাহ‌ সম্পর্কে মিথ্যা বলার মত ঘৃণিত অপবাদ আরোপ করতে আদৌ লজ্জা অনুভব করলো না? এরা তোমার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে যে তুমি নিজেই এ কুরআন রচনা করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করছো?
৪৪.
অর্থাৎ এত বড় মিথ্যা কেবল তারাই বলে যাদের হৃদয়ে মোহর করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌ ইচ্ছা করলে তোমাকেও তাদের মধ্যে শামিল করে দেবেন। কিন্তু এটা তাঁর মেহেরবানী যে তিনি তোমাকে এই দল থেকে আলাদা করে রেখেছেন। এই জবাবের মাধ্যমে সেই সব লোকদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করা হয়েছে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ অপবাদ আরোপ করছিলো। এর তাৎপর্য হচ্ছেঃ হে নবী, এরা তোমাকেও তাদের মত স্বভাবের মানুষ মনে করে নিয়েছে। এরা যেমন নিজ স্বার্থের জন্য বড় বড় মিথ্যা বলতে কুন্ঠিত হয় না। তেমনি মনে করে নিয়েছে তুমিও অনুরূপ আপন স্বার্থ হাসিলের জন্য একটি মিথ্যা সাজিয়ে এনেছো। কিন্তু এটা আল্লাহরই মেহেরবানী যে তিনি তাদের মত তোমার হৃদয়ে তো মোহর লাগাননি।
৪৫.
অর্থাৎ এটা আল্লাহর নিয়ম যে তিনি বাতিলকে কখনো স্থায়িত্ব দান করেন না এবং পরিশেষে ন্যায় ও সত্যকে ন্যায় ও সত্য হিসেবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। অতএব, হে নবী (সা.), তুমি এসব মিথ্যা অপবাদের আদৌ পরোয়া করো না এবং নিজের কাজ করতে থাকো। এমন এক সময় আসবে যখন এসব মিথ্যা ধূলিকণার মত উড়ে যাবে। কিন্তু তুমি যা পেশ করছো তার ন্যায় ও সত্য হওয়া স্পষ্ট হয়ে যাবে।
৪৬.
অর্থাৎ তিনি জানেন, তোমার বিরুদ্ধে এসব অপবাদ কেন আরোপ করা হচ্ছে এবং তোমাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যে চেষ্টা-সাধনা করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তার পেছনে কি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাজ করছে।
৪৭.
পূর্ববর্তী আয়াতের পর পরই তাওবার প্রতি উৎসাহ দান থেকে স্বতই এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, হে জালেমরা সত্য নবীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে নিজেরাই নিজেদেরকে কেন আরো বেশী আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত বানিয়ে নিচ্ছো? এখনো যদি নিজেদের এই আচরণ থেকে বিরত থাকো এবং তাওবা করো তাহলে আল্লাহ‌ ক্ষমা করে দেবেন। তাওবার অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে, যে অপরাধ করেছে বা করে এসেছে তা থেকে বিরত হবে এবং ভবিষ্যতে আর তা করবে না। তাছাড়া সত্যিকার তাওবার অনিবার্য দাবী হচ্ছে কোন ব্যক্তি পূর্বে যে অন্যায় করেছে নিজের সাধ্যমত তার ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবে। যেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের কোন উপায় বের করা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছে তা পরিষ্কার করতে থাকবে। তবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য না থাকলে কোন তাওবাই সত্যিকার তাওবা নয়। অন্য কোন কারণে বা উদ্দেশ্যে কোন খারাপ কাজ পরিত্যাগ করা আদৌ তাওবার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।
.
৪৮.
যে প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে তা সামনে রাখলে স্পষ্ট বুঝা যায়, মক্কার কাফেরেদের বিদ্রোহের পেছনে যে কার্যকারণ কাজ করছিলো আল্লাহ‌ এখানে মূলত সেদিকেই ইঙ্গিত করছেন। যদিও রোম ও ইরানের তুলনায় তাদের কোন মর্যাদাশীল অস্তিত্বই ছিল না এবং আশেপাশের জাতিসমূহের মধ্যে তারা একটি পশ্চাদপদ জাতির একটি ব্যবসায়জীবী গোষ্ঠী বা অন্য কথায় ফেরিওয়ালার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী ছিল না। কিন্তু নিজেদের এই ক্ষুদ্র জগতের মধ্যে অন্য আরবদের তুলনায় তারা যে সচ্ছলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিলো তা তাদেরকে এতটাই অহংকারী করে তুলেছিল যে, তারা আল্লাহর নবীর কথা শুনতে কোনভাবে প্রস্তুত ছিল না এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নেতা হবে আর তারা তাঁকে অনুসরণ করবে তাদের গোত্রাধিপতিগণ একে তাদের মার্যাদার পরিপন্থী মনে করতো। এ কারণে বলা হচ্ছে, আমি যদি এসব সংকীর্ণমনা লোকদের জন্য সত্যিই রিযিকের দরজা খুলে দিতাম তাহলে তারা পুরোপুরি গর্বে ফেটে পড়তো। কিন্তু আমি তাদেরকে আমার পর্যবেক্ষণে রেখেছি এবং বুঝে শুনে ঠিক ততটাই দিচ্ছি যতটা তাদের গর্বে স্ফীত হতে দেবে না। এ অর্থ অনুসারে এ আয়াত ঠিক সেই অর্থ প্রকাশ করছে যা সূরা তাওবার ৬৮ ও ৭০ আয়াত, আল কাহাফের ৩২ ও ৪২ আয়াত, আল কাসাসের ৭৫ ও ৮২ আয়াত, আর রূম ৯ আয়াত, সাবা ৩৪ ও ৩৬ আয়াত এবং আল মু’মিনের ৮২ ও ৮৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
৪৯.
এখানে অলী অর্থ এমন সত্তা যিনি তাঁর নিজের তৈরী সমস্ত সৃষ্টির সব ব্যাপারের তত্বাবধায়ক, যিনি বান্দাদের সমস্ত অভাব ও প্রয়োজন পূরণের সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
৫০.
অর্থৎ যমীন ও আসমান উভয় স্থানেই। জীবনের অস্তিত্ব যে শুধু পৃথিবীতেই নয়, অন্য সব গ্রহেও প্রাণী ও প্রাণধারী সত্তা আছে এটা তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
৫১.
অর্থাৎ তিনি যেমন তাদের ছড়িয়ে দিতে সক্ষম তেমনি একত্র করতেও সক্ষম। তাই কিয়ামত আসতে পারে না এবং আগের ও পরের সবাইকে একই সময়ে উঠিয়ে একত্রিত করা যেতে পারে না এ ধারণা মিথ্যা।
৫২.
প্রকাশ থাকে যে, এখানে মানুষের সব রকম বিপদাপদের কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে না। এখানে বক্তব্যের লক্ষ্য সেই সব লোক যারা সেই সময় পবিত্র মক্কায় কুফর ও নাফরমানিতে লিপ্ত হচ্ছিলো। তাদের বলা হচ্ছে, আল্লাহ‌ যদি তোমাদের সমস্ত দোষ-ত্রুটির জন্য পাকড়াও করতেন তাহলে তোমাদেরকে জীবিতই রাখতেন না। তবে যে বিপদাপদ তোমাদের ওপর নাযিল হয়েছে (সম্ভবত মক্কার দুর্ভিক্ষের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে) তা কেবল সতর্কীকরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে যাতে তোমাদের সম্বিত ফিরে আসে এবং নিজেদের কাজকর্মের পর্যালোচনা করে দেখো যে, তোমরা আপন রবের বিরুদ্ধে কি ধরনের আচরণ করেছো। একথাও বুঝার চেষ্টা করো, যে আল্লাহর বিরুদ্ধে তোমরা বিদ্রোহ করছো তার কাছে তোমরা কত অসহায়। তাছাড়া জেনে রাখো, তোমরা যাদেরকে অভিভাবক ও সাহায্যকারী বানিয়ে বসে আছো কিংবা তোমরা যেসব শক্তির ওপর ভরসা করে আছো আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য তারা কোন কাজে আসবে না।

আরো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এ বিষয়টিও বর্ণনা করা প্রয়োজন যে এ ব্যাপারে খাঁটি মু’মিনের জন্য আল্লাহর বিধান ভিন্ন। মু’মিনের ওপর যে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ আসে তার গোনাহ, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতার কাফফারা হতে থাকে। সহীহ হাদীসে আছেঃ

مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا ، إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ (بخارى , مسلم)

“মুসলমান যে দুঃখ-কষ্ট, চিন্তা ও দুর্ভাবনা এবং কষ্ট ও অশান্তির সম্মুখীনই হোক না কেন এমন কি একটি কাঁটা বিদ্ধ হলেও আল্লাহ‌ তাকে তার কোন না কোন গোনাহর কাফফারা বানিয়ে দেন।”

এরপর থাকে এমন সব বিপদাপদের প্রশ্ন যা আল্লাহর পথে তাঁর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য কোন ঈমানদারকে বরদাশত করতে হয়, তা কেবল ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারাই হয় না, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা বৃদ্ধিরও কারণ হয়। এসব বিপদাপদ গোনাহর শাস্তি হিসেবে নাযিল হয়ে থাকে এমন ধারণা পোষণ করার আদৌ কোন অবকাশ নেই।

.
.
অনুবাদ: