পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

৩৫৭ আয়াত

৩৩ ) তখন (সে হুকুম দিল) তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো তারপর তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে হাত বুলাতে লাগলো। ৩৫
رُدُّوهَا عَلَىَّ ۖ فَطَفِقَ مَسْحًۢا بِٱلسُّوقِ وَٱلْأَعْنَاقِ ٣٣
৩৪ ) আর (দেখো) সুলাইমানকেও আমি পরীক্ষায় ফেলেছি এবং তার আসনে নিক্ষেপ করেছি একটি শরীর। তারপর সে রুজু করলো
وَلَقَدْ فَتَنَّا سُلَيْمَـٰنَ وَأَلْقَيْنَا عَلَىٰ كُرْسِيِّهِۦ جَسَدًۭا ثُمَّ أَنَابَ ٣٤
৩৫ ) এবং বললো, হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান করো যা আমার পরে আর কারো জন্য শোভন হবে না; নিঃসন্দেহে তুমিই আসল দাতা।” ৩৬
قَالَ رَبِّ ٱغْفِرْ لِى وَهَبْ لِى مُلْكًۭا لَّا يَنۢبَغِى لِأَحَدٍۢ مِّنۢ بَعْدِىٓ ۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْوَهَّابُ ٣٥
৩৬ ) তখন আমি বাতাসকে তাঁর জন্য অনুগত করে দিলাম, যা তাঁর হুকুমে যেদিকে সে চাইতো মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো। ৩৭
فَسَخَّرْنَا لَهُ ٱلرِّيحَ تَجْرِى بِأَمْرِهِۦ رُخَآءً حَيْثُ أَصَابَ ٣٦
৩৭ ) আর শয়তানদেরকে বিজিত করে দিয়েছি, সব ধরনের গৃহনির্মাণ কারিগর ও ডুবুরী
وَٱلشَّيَـٰطِينَ كُلَّ بَنَّآءٍۢ وَغَوَّاصٍۢ ٣٧
৩৮ ) এবং অন্য যারা ছিল শৃংখলিত। ৩৮
وَءَاخَرِينَ مُقَرَّنِينَ فِى ٱلْأَصْفَادِ ٣٨
৩৯ ) (আমি তাঁকে বললাম) “এ আমার দান, তোমাকে ইখতিয়ার দেয়া হচ্ছে, যাকে চাও তাকে দাও এবং যাকে চাও তাকে দেয়া থেকে বিরত থাকো, কোন হিসেবে নেই।” ৩৯
هَـٰذَا عَطَآؤُنَا فَٱمْنُنْ أَوْ أَمْسِكْ بِغَيْرِ حِسَابٍۢ ٣٩
৪০ ) অবশ্যই তাঁর জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। ৪০
وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلْفَىٰ وَحُسْنَ مَـَٔابٍۢ ٤٠
৪১ ) আর স্মরণ করো আমার বান্দা আইয়ূবের কথা ৪১ যখন সে তাঁর রবকে ডাকলো এই বলে যে, শয়তান আমাকে কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ৪২
وَٱذْكُرْ عَبْدَنَآ أَيُّوبَ إِذْ نَادَىٰ رَبَّهُۥٓ أَنِّى مَسَّنِىَ ٱلشَّيْطَـٰنُ بِنُصْبٍۢ وَعَذَابٍ ٤١
৪২ ) (আমি তাঁকে হুকুম দিলাম) তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করো, এ হচ্ছে ঠাণ্ডা পানি গোসল করার জন্য এবং পান করার জন্য। ৪৩
ٱرْكُضْ بِرِجْلِكَ ۖ هَـٰذَا مُغْتَسَلٌۢ بَارِدٌۭ وَشَرَابٌۭ ٤٢
৩৫.
এ আয়াতগুলোর অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে।

একটি দল এগুলোর অর্থ বর্ণনা করে বলেনঃ হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম ঘোড়া দেখাশুনা ও তাদের দৌড় প্রতিযোগিতায় এতবেশী মশগুল হয়ে পড়েছিলেন যার ফলে আসরের নামাযের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা কারো কারো কথা মেনে নিজের কোন বিশেষ ওযীফা পড়তে ভুলে গিয়েছিলেন। এ ওয়ীফাটি তিনি পাঠ করতেন আসর ও মাগরিবের নামাযের মাঝামাঝি সময়। কিন্তু সেদিন সূর্য ডুবে গিয়েছিল অথচ তিনি নামায পড়তে বা ওযীফা পাঠ করতে পারেনি। ফলে তিনি হুকুম দিলেনঃ ঘোড়াগুলো ফিরিয়ে আনো। আর সেগুলো ফিরে আসার পর হযরত সুলাইমান (আ) তরবারির আঘাতে সেগুলোকে হত্যা করতে বা অন্য কথায় আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে লাগলেন। কারণ, সেগুলো তাঁকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছিল। এ ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে এ আয়াতগুলোর অনুবাদ এভাবে করা হয়েছেঃ “তখন সে বললো, আমি এ সম্পদের প্রতি আসক্তি এত বেশী পছন্দ করেছি যার ফলে আমার রবের স্মরণ (আসরের নামায বা বিশেষ ওযীফা) থেকে গাফেল হয়ে গেছি, এমনকি (সূর্য পশ্চিমাকাশের অন্তরালে) লুকিয়ে পড়েছে। (তখন সে হুকুম দিল) ফিরিয়ে আনো ঐ (ঘোড়া) গুলোকে। (আর যখন সেগুলো ফিরে এলো) তখন তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে (তরবারির) হাত চালিয়ে দিল।” এ ব্যাখ্যাটি কোন কোন খ্যাতিমান তাফসীরকারের দেয়া হলেও এটি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়। কারণ, এখানে তাফসীরকারকে নিজের পক্ষ থেকে তিনটি কথা বাড়াতে হয়, যেগুলোর কোন উৎস ও ভিত্তি নেই। প্রথমত তিনি ধরে নেন, হযরত সুলাইমানের আসরের নামায বা এ সময় তিনি যে একটি বিশেষ ওযীফা পড়তেন তেমন কোন ওযীফা এ কাজে মশগুল থাকার কারণে ছুটে গিয়েছিল। অথচ কুরআনের শব্দাবলী হচ্ছে কেবলমাত্রঃ

إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَنْ ذِكْرِ رَبِّي

এ শব্দগুলোর অনুবাদ তো এভাবেও করা যেতে পারে যে, “আমি এ সম্পদ এত বেশী পছন্দ করে ফেলেছি, যার ফলে আমার রবের স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে পড়েছি।” কিন্তু এর মধ্যে আসরের নামায বা কোন বিশেষ ওযীফার অর্থ গ্রহণ করার কোন প্রসঙ্গ বা পূর্বসূত্র নেই। দ্বিতীয়ত তারা এটাও ধরে নেন যে, সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। অথচ সেখানে সূর্যের কোন কথা বলা হয়নি। বরং حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ শব্দাবলী পড়ার পর মানুষের চিন্তা স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসে পেছনের আয়াতে উল্লেখিত الصَّافِنَاتُ الْجِيَادُ এর দিকে। তৃতীয়ত, এটাও ধরে নেন যে, হযরত সুলাইমান ঘোড়াগুলোর পায়ের গোড়ায় ও ঘাড়ে খালি হাত বুলাননি বরং তলোয়ারসহ হাত বুলান। অথচ কুরআনে مَسْحًا بِالسيف শব্দ বলা হয়নি এবং এখানে এমন কোন প্রসঙ্গ বা পর্বসূত্রও নেই যার ভিত্তিতে হাত বুলানোকে তরবারিসহ হাত বুলানো অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে। কুরআনের ব্যাখ্যা করার এ পদ্ধতির সাথে আমি নীতিগতভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আমার মতে কুরআনের শব্দাবলীর বাইরে অন্য অর্থ গ্রহণ করা কেবলমাত্র চারটি অবস্থায়ই সঠিক হতে পারে। এক, কুরআনের বাক্যের মধ্যেই তার জন্য কোন পূর্বসূত্র বা প্রসঙ্গ থাকবে। দুই, কুরআনের অন্য কোন জায়গায় তার প্রতি কোন ইঙ্গিত থাকবে। তিন . কোন সহীহ হাদীসে এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অথবা চার, তার অন্য কোন নির্ভরযোগ্য উৎস থাকবে। যেমন ইতিহাসের বিষয় হলে ইতিহাসে এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওযা যেতে হবে। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের বিষয় হলে নির্ভরযোগ্য তাত্বিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে হবে। আর শরীয়াতের বিধানের বিষয় হলো ইসলামী ফিকহের উৎস এর ব্যাখ্যা পেশ করবে। যেখানে এর মধ্য থেকে কোন একটি বিষয়ও থাকবে না সেখানে নিছক নিজস্বভাবে একটি কিসসা রচনা করে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া আমার মতে সঠিক নয়।

একটি দল উপরোক্ত অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সামান্য বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেন, حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ এবং رُبُّوهَا عَلىّ উভয়ের মধ্যে যে সর্বনাম রয়েছে সেটি হচ্ছে সূর্য। অর্থাৎ যখন আসরের নামায ছুটে গেলো এবং সূর্য অস্তমিত হলো তখন হযরত সুলাইমান (আ) বিশ্ব-জাহান পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে অর্থাৎ ফেরেশতাগণকে বললেন, সূর্যকে ফিরিয়ে আনো, যাতে আসরের সময় ফিরে আসে এবং আমি নামায পড়তে পারি। এর ফলে সূর্য ফিরে এলো এবং তিনি নামায পড়ে নিলেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি ওপরের ব্যাখ্যাটির চাইতেও আরো বেশী অগ্রহণযোগ্য। এজন্য নয় যে, আল্লাহ‌ সূর্যকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম নন বরং এজন্য যে, আল্লাহ‌ আদৌ এর কোন উল্লেখই করেননি। বরং হযরত সুলাইমানের জন্য যদি এত বড় মু’জিযার প্রকাশ ঘটতো তাহলে অবশ্যই তা উল্লেখযোগ্য হওয়া উচিত ছিল। এর আরো একটি কারণ এই যে, সূর্যের অস্তমিত হয়ে তারপর আবার ফিরে আসা এমন একটি অসাধারণ ঘটনা যে, যদি সত্যিই তা ঘটে থাকতো তাহলে দুনিয়ার ইতিহাসে তা কখনো অনুল্লেখিত থাকতো না। এ ব্যাখ্যার সপক্ষে তাঁরা কতিপয় হাদীস পেশ করেও একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সূর্যের অস্তমিত হয়ে পুনর্বার ফিরে আসার ঘটনা মাত্র একবার ঘটেনি বরং কয়েকবার এ ঘটনা ঘটেছে। মি’রাজের ঘটনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। খন্দকের যুদ্ধের সময়ও নবী করীমের ﷺ জন্য তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। আর হযরত আলীর (রা) জন্যও ফিরিয়ে আনা হয় যখন নবী (সা) তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছিলেন এবং তাঁর আসরের নামায কাযা হয়ে গিয়েছিল। নবী করীম ﷺ সূর্যকে ফিরিয়ে আনার দোয়া করেন এবং তা ফিরে আসে। কিন্তু যে ব্যাখ্যার সমর্থনে এ হাদীসগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এগুলো থেকে তার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করা তার চাইতেও দুর্বল। হযরত আলী সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণনা করা হয়ে থাকে তার সকল বর্ণনা পরম্পরা ও বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে ইবনে তাইমিয়া একে বনোয়াট ও জাল হাদীস প্রমাণ করেছেন। ইমাম আহমাদ বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই। ইবনে জাওযী বলেন, নিঃসন্দেহে এটি জাল হাদীস। খন্দকের যুদ্ধের সময় সূর্যকে ফিরিয়ে আনার হাদীসটিও অনেক মুহাদ্দিসের মতে যঈফ এবং অনেকের মতে বানোয়াট। অন্যদিকে মি’রাজের হাদীসের আসল ব্যাপারটি হচ্ছে, যখন নবী করীম ﷺ মক্কার কাফেরদের কাছে মি’রাজের রাতের অবস্থা বর্ণনা করছিলেন তখন কাফেররা তাঁর কাছে প্রমাণ চাইলো। তিনি বললেন, বাইতুল মাকদিসের পথে অমুক জায়গায় একটি কাফেলার দেখা পেয়েছিলাম এবং তাদের সাথে অমুক ঘটনা ঘটেছিল। কাফেররা জিজ্ঞেস করলো, সে কাফেলাটি কবে মক্কায় পৌঁছবে? তিনি জবাব দিলেন, অমুক দিন। যখন সেদিনটি এলো কুরাইশরা সারদিন কাফেলার অপেক্ষা করতে লাগলো, এমনকি সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তখন নবী (সা.) দোয়া করলেন যেন সূর্য ততক্ষণ পর্যন্ত অস্তমিত না হয় যতক্ষণ কাফেলা না এসে যায়। কাজেই দেখা গেলো সূর্য ডুবার আগে তারা পৌঁছে গেছে। এ ঘটনাটিকে কোন কোন বর্ণনাকারী এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সেদিন দিনের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং এই বাড়তি সময় পর্যন্ত সূর্য দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের হাদীস এত বড় অস্বাভাবিক ঘটনার প্রমাণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে যথেষ্ট হতে পারে কি? যেমন আমি আগেই বলে এসেছি, সূর্যের ফিরে আসা বা ঘণ্টা খানিক আটকে থাকা কোন সাধারণ ঘটনা নয়।

এ ধরনের ঘটনা যদি সত্যিই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকতো তাহলে সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ পড়ে যেতো। দু-চারটে খবরে ওয়াহিদের (যে হাদীসের বর্ণনাকারী কোন স্তরে মাত্র একজন) মধ্যে তার আলোচনা কেমন করে সীমাবদ্ধ থাকতো?

মুফাসসিরগণের তৃতীয় দলটি এ আয়াতগুলোর এমন অর্থ গ্রহণ করেন যা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি এর শব্দগুলো পড়ে এ থেকে গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ঘটনা কেবলমাত্র এতটুকুঃ হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের সামনে যখন উন্নত ধরনের ভাল জাতের ঘোড়ার একটি পাল পেশ করা হলো তখন তিনি বললেন, অহংকার বা আত্মম্ভরিতা করার জন্য অথবা শুধুমাত্র আত্মস্বার্থের খাতিরে এ সম্পদ আমার কাছে প্রিয় নয়। বরং এসব জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণকে আমি আমার রবের কালেমা বুলন্দ করার জন্য পছন্দ করে থাকি। তারপর তিনি সে ঘোড়াগুলোর দৌড় করালেন এমনকি সেগুলো দৃষ্টি বাইরে চলে গেলো। এরপর তিনি সেগুলো ফেরত আনালেন। সেগুলো ফেরত আসার পর ইবনে আব্বাসের বক্তব্য অনুযায়ীঃ

جعل يمسح اعراف الخيل وعراقيبها حبالها

“তিনি তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে আদর করে হাত বুলাতে লাগলেন” আমাদের মতে এ ব্যাখ্যাটিই সঠিক। কারণ কুরআন মজীদের শব্দাবলীর সাথে এটি পূর্ণ সামঞ্জস্য রাখে এবং অর্থকে পূর্ণতা দান করার জন্য এর মধ্যে এমন কোন কথা বাড়িয়ে বলতে হয় না যা কুরআনে নেই, কোন সহীহ হাদীসে নেই এবং বনী ইসরাঈলের ইতিহাসেও নেই।

এ প্রসঙ্গে একথাটিও সামনে থাকা উচিত যে, আল্লাহ‌ হযরত সুলাইমানের পক্ষে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেনঃ نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ (নিজের রবের দিকে বেশী বেশী ফিরে আসা ব্যক্তিই হচ্ছে সর্বোত্তম বান্দা) এর প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করার অব্যবহিত পরেই করেছেন।

এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, আসলে একথা বলাই এখানে উদ্দেশ্য ছিল যে, দেখো, সে আমার কত ভাল বান্দা ছিল, বাদশাহীর সাজ সরঞ্জাম তার কাছে পছন্দনীয় ছিল দুনিয়ার খাতিরে নয় বরং আমার জন্য, নিজের পরাক্রান্ত অশ্ববাহিনী দেখে দুনিয়াদার ও বৈষয়িক ভোগ লালসায় মত্ত শাসনকর্তাদের মতো সে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেনি বরং সে সময়ও তার মনোজগতে ভেসে উঠেছে আমারই স্মৃতি।

.
৩৬.
বক্তব্যের ধারাবাহিকতা অনুসারে এখানে একথা বলাই মূল উদ্দেশ্য এবং পেছনের আয়াতগুলো এরই জন্য মুখবন্ধ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন প্রথমে হযরত দাউদের প্রশংসা করা হয়েছে, তারপর যে ঘটনার ফলে তিনি ফিতনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন সেটি উল্লেখ করা হয়েছে, একথা বলা হয়েছে যে, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ নিজের এত প্রিয় বান্দাকেও জবাবদিহি না করে ছড়েননি, তারপর তাঁর এ কাজকর্ম দেখান যে, ফিতনা সম্পর্কে সজাগ করে দেবার সাথে সাথেই তিনি তাওবা করেন এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে নিজের ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে ফিরে আসেন, অনুরূপভাবে এখানেও বক্তব্য বিন্যাস এভাবে করা হয়েছেঃ প্রথমে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের উচ্চ মর্যাদা ও মহিমান্বিত বন্দেগীর কথা বলা হয়েছে, তারপর বলা হয়েছে, তাঁকেও পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়েছিল, তারপর তাঁর বন্দেগীর এ কৃতিত্ব দেখান যে, যখন তাঁর সিংহাসনে একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়া হয় তখন সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজের পদস্খলন সম্পর্কে সজাগ হন, নিজের রবের সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং যে কথার জন্য তিনি ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন নিজের সে কথা ও কার্যক্রম থেকে ফিরে আসেন। অন্য কথায় বলা যায়, এ দু’টি কাহিনী থেকে আল্লাহ একই সঙ্গে দু’টি কথা বুঝতে চান। এক, তাঁর নিরপেক্ষ সমালোচনা পর্যালোচনা ও জবাবদিহি থেকে সাধারণ তো দূরের কথা নবীরাও বাঁচতে পারেননি। দুই, অপরাধ করে ঘাড় বাঁকা করে থাকা বান্দার জন্য সঠিক কর্মনীতি নয়। বরং তার কাজ হচ্ছে যখনই সে নিজের ভুল অনুভব করতে পারবে তখনই বিনীতভাবে নিজে রবের সামনে ঝুঁকে পড়বে। এ কর্মনীতিরই ফল স্বরূপ মহান আল্লাহ‌ এ মনীষীদের পদস্খনগুলো কেবল ক্ষমাই করে দেননি বরং তাঁদের প্রতি আরো বেশী দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেছেন।

এখানে আবার এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম যে ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটি কেমন ফিতনা ছিল? তাঁর আসনের ওপর একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়ার অর্থ কি? এ দেহাবয়ব এনে তাঁর আসনে ফেলে দেয়া তাঁর জন্য কোন্ ধরনের সতর্কীকরণ ছিল যার ফলে তিনি তাওবা করেন? এর জবাবে মুফাস্‌সিরগণ চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত অবলম্বন করেছেন।

একটি দল একটি বিরাট কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এর বিস্তারিত বিবরণের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে আবার বহু ধরনের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাদের সবার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ হযরত সুলাইমানের থেকে এই ত্রুটি সংঘটিত হয়েছিল যে, তাঁর মহলে এক বেগম সাহেবা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পূজায় লিপ্ত ছিলেন এবং তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে বেখবর। অথবা তিনি কয়েকদিন পর্যন্ত গৃহমধ্যে বসেছিলেন এবং কোন মজলুমের ফরিয়াদ শুনেননি। এর ফলে তিনি যে শাস্তি পেয়েছিলেন তা ছিল এই যে, এক শয়তান যে কোনভাবেই তাঁর এমন একটি আংটি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল যার বদৌলতে তিনি জিন ও মানুষ জাতি এবং বাতাসের ওপর রাজত্ব করতেন। আংটি হাতছাড়া হয়ে যেতেই হযরত সুলাইমানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব খতম হয়ে গিয়েছিল এবং চল্লিশ দিন পর্যন্ত তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। এই অন্তরবর্তীকালে সেই শয়তান সুলাইমানের রূপ ধারণ করে রাজত্ব করতে থাকলো। সুলাইমানের সিংহাসনে একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর সিংহাসনে উপবেশনকারী এই শয়তান। কেউ কেউ একথাও বলে ফেলেছেন যে, সে এই শয়তানের হাত থেকে সুলাইমানের হারেমের মহিলাদের সতীত্বও সংরক্ষিত থাকেনি। শেষ পর্যন্ত দরবারের আমাত্যবর্গ, পরিষদ ও উলামায়ে কেরামের মনে তার কার্যকলাপ দেখে সন্দেহের সৃষ্টি হলো এবং তারা মনে করতে থাকলেন, এ ব্যক্তি সুলাইমান নয়। কাজেই তারা তার সামনে তাওরাত খুলে মেলে ধরলেন এবং সে ভয়ে পালিয়ে গেলো। পথে তার হাত থেকে আংটি খুলে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলো অথবা সে নিজেই তা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। একটি মাছ তা গিলে ফেললো। ঘটনাক্রমে সে মাছটি হযরত সুলাইমানের হস্তগত হলো। মাছটি রান্না করার জন্য তিনি তার পেট কেটে ফেললেন। সেখান থেকে আংটি বের হয়ে পড়লো। আংটি হাতে আসার সাথে সাথেই জিন মানুষ ইত্যাদি সবাই সালাম করতে করতে তাঁর সামনে হাজির হয়ে গেলো।--এ পুরো কাহিনীটিই ছিল একটি পৌরনিক গালগল্প। নওমুসলিম আহ্‌লি কিতাবগণ তালমুদ ও অন্যান্য ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করে এটি মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের বড় বড় পণ্ডিতগণ একে কুরআনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা মনে করে নিজেদের ভাষায় এগুলো বর্ণনা করেছেন। অথচ সুলাইমানের আংটির কোন সত্যতা নেই। হযরত সুলাইমানের কৃতিত্ব কোন আংটির ভেল্কিবাজি ছিল না। শয়তানদেরকেও আল্লাহ‌ নবীদের আকৃতি ধরে আসার ও মানুষকে গোমরাহ করার ক্ষমতা দেননি। তাছাড়া আল্লাহ‌ সম্পর্কে এমন কোন ধারণাও করা যেতে পারে না যে, তিনি কোন নবীর কোন ভুলের শাস্তি এমন ফিতনার আকৃতিতে দান করবেন যার ফলে শয়তান নবী হয়ে একটি উম্মাতের সমগ্র জনগোষ্ঠীর সর্বনাশ করে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন নিজেই এ তাফসীরের প্রতিবাদ করছে। সামনের আয়াতে আল্লাহ‌ বলেছেন, হযরত সুলাইমান যখন এ পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তিনি আমার কাছে ক্ষমা চান তখন আমি বায়ু ও শয়তানদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। কিন্তু এ তাফসীর এর বিপরীতে একথা বলছে যে, আংটির কারণে শয়তানরা পূর্বেই হযরত সুলাইমানের হুকুমের অনুগত হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যেসব মনীষী এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন তারা পরবর্তী আয়াত কি বলেছে তা আর দেখেননি।

দ্বিতীয় দলটি বলেন, ২০ বছর পর হযরত সুলাইমানের একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। শয়তানরা বিপদ গণে। তারা মনে করে যদি হযরত সুলাইমানের পর তার এ পুত্র বাদশাহ হয়ে যায় তাহলে তাদেরকে আবার একই গোলামীর জিঞ্জির বহন করে চলতে হবে। তাই তারা তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। হযরত সুলাইমান একথা জানতে পারেন। তিনি পুত্রকে মেঘের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। সেখানেই তার লালন-পালনের ব্যবস্থা করেন। এটিই ছিল সেই ফিতনা যার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরিবর্তে তিনি মেঘের হেফাজতের ওপর ভরসা করেছিলেন। এর শাস্তি তাঁকে এভাবে দেয়া হয় যে, সে শিশুটি মরে গিয়ে তাঁর সিংহাসনের ওপর এসে পড়ে।--এ কাহিনীটিও আগাগোড়া ভিত্তিহীন ও উদ্ভট এবং স্পষ্ট কুরআন বিরোধী। কারণ এখানেও ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, বায়ু ও শয়তানরা পূর্ব থেকেই হযরত সুলাইমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। অথচ কুরআন পরিষ্কার ভাষায় তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হবার ব্যাপারটিকে এ ফিতনার পরবর্তীকালের ঘটনা বলে উল্লেখ করছে।

তৃতীয় দলটি বলেন, একদিন হযরত সুলাইমান কসম খান, আজ রাতে আমি সত্তরজন স্ত্রীর কাছে যাবো এবং প্রত্যেক গর্ভে একজন করে আল্লাহর পথের মুজাহিদ জন্ম দেব। কিন্তু একথা বলতে গিয়ে তিনি ইনশাআল্লাহ বলেননি। এর ফলে মাত্র একজন স্ত্রী গর্ভবতী হয় এবং তাঁর গর্ভেও একটি অসমাপ্ত ও অপরিপক্ব শিশুর জন্ম হয়। দাই শিশুটিকে এনে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর ফেলে দেয়। এ হাদীসটি হযরত আবু হুরাইরা (রা.) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে এটি উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী শরীফেই এ হাদীসটি যেসব রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে স্ত্রীদের সংখ্যা বলা হয়েছে ৬০, কোনটিতে ৭০, কোনটিতে ৯০, কোনটিতে ৯৯, আবার কোনটিতে ১০০ও বলা হয়েছে। সনদের দিক দিয়ে এর মধ্য থেকে অধিকাংশই শক্তিশালী এবং রেওয়ায়াত হিসেবে এগুলোর নির্ভুলতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা যেতে পারে না। কিন্তু এ হাদীসের বিষয়বস্তু সুস্পষ্টভাবে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী। এর ভাষা বলছে, একথা নবী ﷺ কখনো এভাবে বলেননি যেভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বরং তিনি সম্ভবত ইহুদীদের মিথ্যা ও অপবাদমূলক কিচ্ছা-কাহিনীর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কোন পর্যায়ে একে এভাবে উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করে থাকবেন এবং শ্রোতার মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকবে যে, নবী করীম ﷺ নিজেই এ ঘটনা বর্ণনা করছেন। এ ধরনের রেওয়ায়াতকে নিছক জোরে লোকদের হজম করাবার চেষ্টা করানো দ্বীনকে হাস্যাস্পদ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই হিসেব কষে দেখতে পারেন, শীতের দীর্ঘতম রাত ও এশা থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত দশ এগারো ঘণ্টার বেশী সময় হয় না। যদি স্ত্রীদের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ জন বলে মেনে নেয়া যায়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, সেই রাতে হযরত সুলাইমান আলাইহি সালাম কোন প্রকার বিশ্রাম না নিয়েই অবিরাম ১০ বা ১১ ঘণ্টা ধরে প্রতি ঘণ্টায় ৬ জন স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে থেকেছেন। কার্যত এটা কি সম্ভব? আর একথাও কি আশা করা যেতে পারে যে, নবী করীম ﷺ বাস্তব ঘটনা হিসেবে একথাটি বর্ণনা করে থাকবেন? তারপর হাদীসে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কুরআন মজীদে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর যে দেহাবয়বটি ফেলে রাখার কথা বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে এ অপরিণত শিশু। তাই নবী করীম ﷺ এ ঘটনাটি এ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তা বলা যায় না। তাছাড়া এ সন্তানের জন্মের পর হযরত সুলাইমানের ইসতিগফার করার কথা তো বোধগম্য হতে পারে কিন্তু তিনি ইসতিগফারের সাথে সাথে “আমাকে এমন রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করো যা আমার পরে আর কারো জন্য শোভনীয় নয়”-এ দোয়াটি কেন করেছিলেন তা বোধগম্য নয়।

এর আর একটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ইমাম রাযী এটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, হযরত সুলাইমান কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন অথবা কোন বিপদের কারণে এতবেশী চিন্তান্বিত ছিলেন যার ফলে তিনি শুকাতে শুকাতে হাড্ডিচর্মসার হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি কুরআনের শব্দের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কুরআনের শব্দাবলী হচ্ছেঃ “আমি সুলাইমান কে পরীক্ষায় ফেলে দিলাম এবং তার আসনের ওপর একটি দেহাবয়ব নিক্ষেপ করলাম তারপর সে ফিরে এলো।” এ শব্দগুলো পড়ে কোন ব্যক্তিও একথা বুঝতে পারে না যে, এ দেহাবয়ব বলতে হযরত সুলাইমানকেই বুঝানো হয়েছে। এ থেকে তো পরিষ্কার জানা যায়, এ পরীক্ষার সম্মুখীন করার মূলে হযরত সুলাইমানের কোন ভুলচুক বা পদস্খলন ছিল। এ ভুলচুকের কারণে তাকে সতর্ক করে জানিয়ে দেয়া হয় যে, আপনার আসনের ওপর একটি দেহ এনে ফেলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে নিজের ভুলচুক বুঝতে পেরে তিনি ফিরে আসেন।

আসলে এটি কুরআন মজীদের জটিলতম স্থানগুলোর মধ্যে একটি। চূড়ান্তভাবে এর ব্যাখ্যা করার মতো কোন নিশ্চিত বুনিয়াদ আমাদের কাছে নেই। কিন্তু হযরত সুলাইমানের দোয়ার এ শব্দাবলীঃ “হে আমার বর! আমাকে মাফ করে দিন এবং আমাকে এমন রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করুন যা আমার পরে আর কারোর জন্য শোভনীয় নয়” যদি বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের আলোকে পড়া যায় তাহলে আপাতদৃষ্ট অনুভূত হবে, তাঁর মনে সম্ভবত এ আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, তাঁর পরে ছেলে হবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত এবং শাসন ও রাষ্ট্র কর্তৃত্ব আগামীতে তাঁর পরিবারের মধ্যে অব্যাহত থাকবে। এ জিনিসটিকেই আল্লাহ‌ তাঁর জন্য ফিতনা গণ্য করেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি এমন সময় সজাগ হয়েছেন যখন তাঁর পুত্র যুবরাজ রাজুবয়াম এমন এক অযোগ্য তরুণ হিসেবে সামনে এসে গিয়েছিল যার আচরণ পরিষ্কার বলে দিচ্ছিল যে, সে দাউদ ও সুলাইমান আলাইহি সালামের সালতানাত চারদিনও টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তাঁর আসনে একটি দেহ নিক্ষেপ করার ভাবার্থ সম্ভবত এই হবে যে, যে পুত্রকে তিনি সিংহাসনে বসাতে চাচ্ছিলেন সে ছিল একটি আযোগ্য পুত্র। এ সময় তিনি নিজের আকাঙ্ক্ষা পরিহার করেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে এ মর্মে আবেদন জানান যে, এ বাদশাহী যেন আমার পর শেষ হয়ে যায় এবং আমার পরে আমার বংশের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অব্যাহত রাখার আকাঙ্ক্ষা আমি প্রত্যাহার করলাম। বনী ইসরাঈলের ইতিহাস থেকেও একথাই জানা যায় যে, হযরত সুলাইমান নিজের পরে আর কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য অসিয়াত করে যাননি এবং কারো আনুগত্য করার জন্য লোকদেরকে বাধ্যও করেননি। পরবর্তীকালে তাঁর রাষ্টীয় পরিষদবর্গ রাজুবয়ামকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু সামান্য কিছুদিন যেতে না যেতেই বনী ইসরাঈলের দশটি গোত্র উত্তর ফিলিস্তিনের এলাকাটি নিয়ে আলাদা হয়ে যায় এবং একমাত্র ইয়াহুদা গোত্র বাইতুল মাকদিসের রাষ্টীয় প্রশাসনের সাথে সংযুক্ত থাকে।

৩৭.
সূরা আল আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া, ৭৪ টীকা) তবে এখানে একটি কথা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, সূরা আল আম্বিয়ায় যেখানে বাতাসকে নিয়ন্ত্রিত করার কথা বলা হয়েছে সেখানে الرِّيحَ عَاصِفَةً (প্রবল বায়ু) শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। আর এখানে সে একই বাতাস সম্পর্কে বলা হচ্ছে, تَجْرِي بِأَمْرِهِ رُخَاءً (তার হুকুমে সে মৃদুমন্দভাবে প্রবাহিত হতো)। এর অর্থ হচ্ছে, সে বাতাস মূলত প্রবল ছিল যেমন বাতাস চালিত জাহাজ চালাবার জন্য প্রবল বায়ুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু হযরত সুলাইমানের জন্য তাকে এ অর্থে মৃদুমন্দ করে দেয়া হয়েছিল যে, তাঁর বাণিজ্যবহর যেদিকে সফর করতে চাইতো সেদিকেই তা প্রবাহিত হতো।
.
৩৮.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া, ৭৫ টীকা, আন নামল ২৩, ২৮, ৪৫ ও ৪৭ টীকা।---শয়তান বলতে জিন বুঝানো হয়েছে। আর শৃংখলিত জিন বলতে এমনসব সেবক জিন বুঝানো হয়েছে যাদেরকে বিভিন্ন দুষ্কর্মের কারণে বন্দী করা হতো। যেসব বেড়ী ও জিঞ্জির দিয়ে এ জিনগুলোকে বাঁধা হতো সেগুলো লোহা নির্মিত হওয়া এবং বন্দীদেরকেও মানুষদের মতো প্রকাশ্যে শৃংখলিত দেখতে পাওয়াও অপরিহার্য ছিল না। মোটকথা তাদেরকে এমন পদ্ধতিতে বন্দী করা হতো যার ফলে তারা পালাবার ও কুকর্ম করার সুযোগ পেতো না।
৩৯.
এ আয়াতের তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, এটি আমার বেহিসেব দান। তুমি যাকে ইচ্ছা দিতে পারো, যাকে ইচ্ছা নাও দিতে পারে। দুই, এটি আমার দান। যাকে ইচ্ছা দাও এবং যাকে ইচ্ছা না দাও, দেয়া বা না দেয়ার জন্য তোমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। কোন কোন মুফাসসির এর আরো একটি অর্থ করেছেন। সেটি হচ্ছে, এ শয়তানদেরকে পুরোপুরি তোমার অধীনে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এদের মধ্য থেকে যাকে চাও মুক্তি দিয়ে দাও এবং যাকে চাও আটকে রাখো, এজন্য তোমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না।
৪০.
এখানে একথা উল্লেখ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানিয়ে দেয়া যে, বান্দার অহংকার আল্লাহর কাছে যত বেশী অপ্রিয় ও অপছন্দনীয় তার দ্বীনতা ও বিনয়ের প্রকাশ তাঁর কাছে তত বেশী প্রিয়। বান্দা যদি অপরাধ করে এবং সতর্ক করার কারণে উল্টো আরো বেশী বাড়াবাড়ি করে, তাহলে এর পরিণাম তাই হয় যা সামনের দিকে আদম ও ইবলিসের কাহিনীতে বর্ণনা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে বান্দার যদি সামান্য পদস্খলন হয়ে যায় এবং সে তাওবা করে দ্বীনতা সহকারে তার রবের সামনে মাথা নত করে, তাহলে তার প্রতি এমন সব দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করা হয়, যা ইতিপূর্বে দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমাস সালামের ওপর প্রদর্শিত হয়। হযরত সুলাইমান ইসতিগফারের পরে যে দোয়া করেছিলেন আল্লাহ‌ তাকে অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেন এবং বাস্তবে তাঁকে এমন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করেন যা তাঁর পূর্বে কেউ লাভ করেনি এবং তাঁর পরে আজও পর্যন্ত কাউকে দেয়া হয়নি। বায়ু নিয়ন্ত্রণ ও জিনদের ওপর কর্তৃত্ব এ দু’টি এমন ধরনের অসাধারণ শক্তি যা মানুষের ইতিহাসে একমাত্র হযরত সুলাইমানকেই দান করা হয়েছে। অন্য কাউকে এর কোন অংশ দেয়া হয়নি।
৪১.
এ নিয়ে চতুর্থবার হযরত আইয়ুবের কথা কুরআন মজিদে আলোচিত হয়েছে। এর আগে সূরা নিসার ১৬৩, সূরা আন’আমের ৮৪ ও সূরা আম্বিয়ার ৮৩-৮৪ আয়াতে এ সম্পর্কিত আলোচনা এসেছে। ইতিপূর্বে সূরা আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় আমি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। (তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৭৬-৭৯ টীকা)
৪২.
এর অর্থ এ নয় যে, শয়তান আমাকে রোগগ্রন্ত করে দিয়েছে এবং আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, রোগের প্রচণ্ডতা, ধন-সম্পদের বিনাশ এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণে আমি যে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছি তার চেয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা আমার জন্য এই যে, শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে আমাকে বিপদগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় সে আমাকে আমার রব থেকে হতাশ করার চেষ্টা করে, আমাকে আমার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ করতে চায় এবং আমি যাতে অধৈর্য হয়ে উঠি সে প্রচেষ্টায় রত থাকে। হযরত আইয়ূবের ফরিয়াদের এ অর্থটি দু’টি কারণে আমাদের কাছে প্রাধান্য লাভের যোগ্য। এক, কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে আল্লাহ‌ শয়তানকে কেবলমাত্র প্ররোচণা দেবার ক্ষমতাই দিয়েছেন। আল্লাহর বন্দেগীকারীদেরকে রোগগ্রস্ত করে এবং তাদেরকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে বন্দেগীর পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদেরকে দেননি। দুই, সূরা আম্বিয়ায় যেখানে হযরত আইয়ূব আল্লাহর কাছে তাঁর রোগের ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করছেন সেখানে তিনি শয়তানের কোন কথা বলেন না। বরং তিনি কেবল বলেন,

أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ

“আমি রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছি এবং তুমি পরম করুণাময়।”

৪৩.
অর্থাৎ আল্লাহ‌র হুকুমে মাটিতে পায়ের আঘাত করতেই একটি পানির ঝরণা প্রবাহিত হলো। এর পানি পান করা এবং এ পানিতে গোসল করা ছিল হযরত আইয়ূবের জন্য তাঁর রোগের চিকিৎসা। সম্ভবত হযরত আইয়ূব কোন কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাইবেলও একথাই বলে যে, তাঁর সারা শরীর ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল।
অনুবাদ: