পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

৩৩৯ আয়াত

২২৪ ) আর কবিরা! তাদের পেছনে চলে পথভ্রান্ত যারা। ১৪২
وَٱلشُّعَرَآءُ يَتَّبِعُهُمُ ٱلْغَاوُۥنَ ٢٢٤
২২৫ ) তুমি কি দেখো না তারা উপত্যকায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় ১৪৩
أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِى كُلِّ وَادٍۢ يَهِيمُونَ ٢٢٥
২২৬ ) এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না? ১৪৪
وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ ٢٢٦
২২৭ ) তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরন করে আর তাদের প্রতি জুলুম করা হলে শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়। ১৪৫ ---আর জুলুমকারীরা শীঘ্রই জানবে তাদের পরিণাম কি! ১৪৬
إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَذَكَرُوا۟ ٱللَّهَ كَثِيرًۭا وَٱنتَصَرُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا۟ ۗ وَسَيَعْلَمُ ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓا۟ أَىَّ مُنقَلَبٍۢ يَنقَلِبُونَ ٢٢٧
১ ) ত্বা-সীন। এগুলো কুরআনের ও এক সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত,
طسٓ ۚ تِلْكَ ءَايَـٰتُ ٱلْقُرْءَانِ وَكِتَابٍۢ مُّبِينٍ ١
২ ) পথনির্দেশ ও সুসংবাদ এমন মু’মিনদের জন্য
هُدًۭى وَبُشْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ ٢
৩ ) যারা নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং তারা এমন লোক যারা আখেরাতে পুরোপুরি বিশ্বাস করে
ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُم بِٱلْـَٔاخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ٣
৪ ) আসলে যারা আখেরাত বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমি তাদের কৃতকর্মকে সুদৃশ্য করে দিয়েছি, ফলে তারা দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
إِنَّ ٱلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِٱلْـَٔاخِرَةِ زَيَّنَّا لَهُمْ أَعْمَـٰلَهُمْ فَهُمْ يَعْمَهُونَ ٤
৫ ) এদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট শাস্তি এবং আখেরাতে এরাই হবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত।
أُو۟لَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَهُمْ سُوٓءُ ٱلْعَذَابِ وَهُمْ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ هُمُ ٱلْأَخْسَرُونَ ٥
৬ ) আর (হে মুহাম্মাদ!) নিঃসন্দেহে তুমি এ কুরআন লাভ করছো এক প্রাজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।
وَإِنَّكَ لَتُلَقَّى ٱلْقُرْءَانَ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ عَلِيمٍ ٦
১৪২.
অর্থাৎ কবিদের সাথে যারা থাকে ও চলাফেরা করে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যাদেরকে চলাফেরা করতে তোমরা দেখছো তাদের থেকে স্বভাবে-চরিত্রে, চলনে-বলনে, অভ্যাসে-মেজাজে সম্পূর্ণ আলাদা। উভয় দলের ফারাকটা এতই সুস্পষ্ট যে, এক নজর দেখার পর যে কোন ব্যক্তি উভয় দলের কোনটি কেমন তা চিহ্নিত করতে পারে। একদিকে আছে একান্ত ধীর-স্থির ও শান্ত-শিষ্ঠ আচরণ, ভদ্র ও মার্জিত রুচি এবং সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহভীতি। প্রতিটি কথায় ও কাজে আছে দায়িত্বশীলতার অনুভূতি। আচার-ব্যবহারে মানুষের অধিকারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি। লেনদেনে চূড়ান্ত পর্যায়ের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা। কথা যখনই বলা হয় শুধুমাত্র কল্যাণ ও ন্যায়ের জন্যই বলা হয়, অকল্যাণ বা অন্যায়ের একটি শব্দও কখনো উচ্চারিত হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, এদেরকে দেখে পরিষ্কার জানা যায়, এদের সামনে রয়েছে একটি উন্নত ও পবিত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের নেশায় এরা রাতদিন সংগ্রাম করে চলছে এবং এদের সমগ্র জীবন একটি উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত হয়েছে। অন্যদিকে অবস্থা হচ্ছে এই যে, সেখানে কোথাও প্রেম চর্চা ও শরাব পানের বিষয় আলোচিত হচ্ছে এবং শ্রোতৃবর্গ লাফিয়ে লাফিয়ে তাতে বাহবা দিচ্ছে। কোথাও কোন দেহপশারিণী অথবা কোন পুরনারী বা গৃহ-ললনার সৌন্দর্যের আলোচনা চলছে এবং শ্রোতারা খুব স্বাদ নিয়ে নিয়ে তা শুনছে “কোথাও অশ্লীল কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে এবং সমগ্র সমাবেশের উপর যৌন কামনার প্রেত চড়াও হয়ে বসেছে। কোথাও মিথ্যা ও ভাঁড়ামির আসর বসেছে এবং সমগ্র মাহফিল ঠাট্টা-তামাশায় মশগুল হয়ে গেছে। কোথাও কারোর দুর্নাম গাওয়া ও নিন্দাবাদ করা হচ্ছে এবং লোকেরা তাতে বেশ মজা পাচ্ছে। কোথাও কারো অযথা প্রশংসা করা হচ্ছে এবং শাবাশ ও বাহবা দিয়ে তাকে আরো উসকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তা শুনে মানুষের মনে আগুন লেগে যাচ্ছে। এসব মজলিসে কবির কবিতা শোনার জন্য যে বিপুল সংখ্যক লোক জমায়েত হয় এবং বড় বড় কবিদের পেছনে যেসব লোক ঘুরে বেড়ায় তাদেরকে দেখে কোন ব্যক্তি একথা অনুভব না করে থাকতে পারে না যে, এরা হচ্ছে নৈতিকতার বন্ধনমুক্ত, আবেগ ও কামনার স্রোতে ভেসে চলা এবং ভোগ ও পাপ-পংকিলতার পূজারী অর্ধ-পাশবিক একটি নরগোষ্ঠি দুনিয়ায় মানুষের যে কোন উন্নত জীবনাদর্শ ও লক্ষ্যও থাকতে পারে এ চিন্তা কখনো এদের মন-মগজ স্পর্শও করতে পারে না। এ দু’দলের সুস্পষ্ট পার্থক্য ও ফারাক যদি কারো নজরে না পড়ে তাহলে সে অন্ধ। আর যদি সবকিছু দেখার পরও কোন ব্যক্তি নিছক সত্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ঈমানকে বেমালুম হজম করে একথা বলতে থাকে যে মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর আশেপাশে যারা সমবেত হয়েছে তারা কবি ও কবিদের সাংগোপাংগদের মতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছে।
১৪৩.
“অর্থাৎ তাদের নিজস্ব চিন্তার ও বাকশক্তি ব্যবহার করার কোন একটি নির্ধারিত পথ নেই। বরং চিন্তার পাগলা ঘোড়া বল্গাহারা অশ্বের মতো পথে-বিপথে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ায়। আবেগ, কামনা-বাসনা বা স্বার্থের প্রতিটি নতুন ধারা তাদের কণ্ঠ থেকে একটি নতুন বিষয়ের রূপে আবির্ভূত হয়। চিন্তা ও বর্ণনা করার সময় এগুলো সত্য ও ন্যায়সঙ্গত কিনা সেদিকে দৃষ্টি রাখার কোন প্রয়োজনই অনুভব করা হয় না। কখনো একটি তরংগ জাগে, তখন তার স্বপক্ষে জ্ঞান ও নীতিকথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দেয়া হয়। আবার কখনো দ্বিতীয় তরংগ জাগে, সেই একই কণ্ঠ থেকে এবার একেবারেই পুতিগন্ধময় নীচ, হীন ও নিম্নমুখী আবেগ উৎসারিত হতে থাকে। কখনো কারোর প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাকে আকাশে চড়িয়ে দেয়া হয় আবার কখনো নারাজ হলে সেই একই ব্যক্তিকেই পাতালের গভীর গর্ভে ঠেলে দেয়া হয়। কোন কুঞ্জুশকে হাতেম এবং কোন পুরুষকে বীর রুস্তম গণ্য করতে তাদের বিবেকে একটুও বাধে না যদি তার সাথে তাদের কোন স্বার্থ জড়িত থাকে। পক্ষান্তরে কেউ যদি তাদেরকে কোন দুঃখ দিয়ে থাকে তার পবিত্র জীবনকে কলঙ্কিত করার এবং তার ইজ্জত-আবরু ধূলায় মিশিয়ে দেবার বরং তার বংশধারার নিন্দা করার ব্যাপারে তারা একটুও লজ্জা অনুভব করে না। আল্লাহ‌ বিশ্বাস ও নাস্তিক্যবাদ, বস্তুবাদিতা ও আধ্যাত্মিকতা, সদাচার ও অসদাচার, পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা ও অপবিত্রতা-অপরিচ্ছন্নতা, গাম্ভীর্য ও হাস্য-কৌতুক এবং প্রশংসা ও নিন্দাবাদ সবকিছু একই কবির একই কাব্যে পাশাপাশি দেখা যাবে। কবিদের এ পরিচিত বৈশিষ্ট্য যারা জানে তারা কেমন করে এ কুরআনের বাহককে কবিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে? কারণ তাঁর ভাষণ মাপাজোকা, তাঁর বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন, তাঁর পথ একেবারে সুস্পষ্ট ও নির্ধারিত এবং সত্য, সততা ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহ্বান করা ছাড়া তাঁর কণ্ঠ থেকে অন্য কোন কথাই বের হয়নি। কুরআন মজীদের অন্য এক জায়গায় নবী ﷺ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কবিত্বের সাথে তাঁর প্রকৃতি ও মেজাজের আদৌ কোন সম্পর্ক নেইঃ

وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ

“আমি তাঁকে কবিতা শিখাইনি এবং এটা তাঁর করার মতো কাজও নয়।” (ইয়াসিন, ৬৯)

এটি এমন একটি সত্য ছিল, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন তাঁরা সবাই একথা জানতেন। নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ কোন একটি কবিতাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুরোপুরি মুখস্থ ছিল না। কথাবার্তার মাঝখানে কোন কবির ভালো কবিতার চরণ তাঁর মুখে এলেও তা অনুপযোগীভাবে পড়ে যেতেন অথবা তার মধ্যে শব্দের হেরফের হয়ে যেতো। হযরত হাসান বাসরী বলেন, একবার ভাষণের মাঝখানে তিনি এক কবিতার চরণ এভাবে পড়লেনঃ

كفى بالاسلام والشيب للمرء ناهيا-

হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! চরণটি হবে এ রকম,

كفى الشيب والاسلام للمرء ناهيا-

একবার তিনি আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামীকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কবিতাটা কি তোমার?

أَتَجْعَلُ نَهْبِى وَنَهْبَ الْعُبَيْدِ وبَيْنَ وَالأَقْرَعِ وعُيَيْنَةَ আব্বাস বললেন, শেষ বাক্যাংশটি ওভাবে নয়, বরং এভাবে হবেঃ بَيْنَ عُيَيْنَةَ وَالأَقْرَعِ একথায় রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, কিন্তু অর্থ তো উভয়ের এক।

হযরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হয়, নবী ﷺ কি কখনো নিজের ভাষণের মধ্যে কবিতা ব্যবহার করতেন? তিনি বলেন, কবিতার চেয়ে বেশী তিনি কোন জিনিসকে ঘৃণা করতেন না। তবে কখনো কখনো তিনি বনী কায়েসের কবিতা পড়তেন। কিন্তু প্রথমটা শেষে এবং শেষেরটা প্রথম দিকে পড়ে ফেলতেন। হযরত আবু বকর (রা.) বলতেন, হে আল্লাহর রসূল! এভাবে নয় বরং এভাবে। তখন তিনি বলতেন, “আমি কবি নই এবং কবিতা পাঠ করা আমার কাজ নয়।” আরবের কবিতা অঙ্গনে যে ধরনের বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছিল তা ছিল যৌন আবেদন ও অবৈধ প্রেমচর্চা অথবা শরাব পান কিংবা গোত্রীয় ঘৃণা, বিদ্বেষ ও যুদ্ধবিগ্রহ বা বংশীয় ও বর্ণগত অহংকার। কল্যাণ ও সুকৃতির কথার স্থান সেখানে অতি অল্পই ছিল। এছাড়া মিথ্যা, অতিরঞ্জন, অপবাদ, নিন্দাবাদ, অযথা প্রশংসা, আত্মগর্ব, তিরস্কার, দোষারোপ, পরিহাস ও মুশরিকী অশ্লীল পৌরানিকতা তো এ কাব্যধারার শিরায় শিরায় প্রবাহিত ছিল। তাই এ কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রায় ছিলঃ

لَأَنْ يَمْتَلِئَ جَوْفُ أَحَدِكُمْ قَيْحًا , خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمْتَلِئَ شِعْرًا

“তোমাদের কারো পেট পুঁজে ভরা থাকা কবিতায় ভরা থাকার চেয়ে ভালো। তবুও যে কবিতায় কোন ভালো কথা থাকতো তিনি তার প্রশংসা করতেন।” তাঁর উক্তি ছিলঃ امن شعره وكفر قلبه “তার কবিতা মু’মিন কিন্তু অন্তর কাফের।” একবার একজন সাহাবী একশোটা ভালো ভালো কবিতা তাঁকে শুনান এবং তিনি চলে যেতে থাকলে বলেনঃ هيه অর্থাৎ “আরো শুনাও।”

১৪৪.
এটি হচ্ছে কবিদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। নবী (সা.) সম্পর্কে তাঁর প্রত্যেক পরিচিত জন জানতেন, তিনি যা বলতেন তাই করতেন এবং যা করতেন তাই বলতেন। তাঁর কথা ও কর্মের সামঞ্জস্য এমনই একটি জাজ্বল্যমান সত্য ছিল যা তাঁর আশেপাশের সমাজের কেউ অস্বীকার করতে পারতো না। অথচ সাধারণ কবিদের সম্পর্কে সবাই জানতো যে, তারা বলতেন এক কথা এবং করতেন অন্য কিছু। তাদের কবিতায় দানশীলতার মাহাত্ম এমন উচ্চ কণ্ঠে প্রচারিত হবে যেন মনে হবে তাদের চেয়ে বড় আর কোন দাতা নেই। কিন্তু তাদের কাজ দেখলে বুঝা যাবে তারা বড়ই কৃপণ। বীরত্বের কথা তারা বলবেন কিন্তু নিজেরা হবেন কাপুরুষ। অমুখাপেক্ষিতা, অল্পে তুষ্টি ও আত্মমর্যাদাবোধ হবে তাদের কবিতার বিষয়বস্তু কিন্তু নিজেরা লোভ, লালসা ও আত্ম বিক্রয়ের শেষ সীমানাও পার হয়ে যাবেন। অন্যের সামান্যতম দুর্বলতাকেও কঠোরভাবে পাকড়াও করবেন কিন্তু নিজেরা চরম দুর্বলতার মধ্যে হাবুডুবু খাবেন।
১৪৫.
ওপরে সাধারণভাবে কবিদের প্রতি যে নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয়েছে তা থেকে এমন সব কবিদেরকে এখানে আলাদা করা হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে চারটি বৈশিষ্ট্য।

একঃ যারা মু’মিন অর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর কিতাবগুলো যারা মানেন এবং আখেরাত বিশ্বাস করেন।

দুইঃ নিজেদের কর্মজীবনে যারা সৎ, যারা ফাসেক, দুষ্কৃতিকারী ও বদকার নন। নৈতিকতার বাঁধন মুক্ত হয়ে যারা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় না দেন।

তিনঃ আল্লাহকে যারা বেশী বেশী করে স্মরণ করেন নিজেদের সাধারণ অবস্থায়, সাধারণ সময়ে এবং নিজেদের রচনায়ও। তাদের ব্যক্তি জীবনে আল্লাহভীতি ও আল্লাহর আনুগত্য রয়েছে কিন্তু তাদের কবিতা পাপ-পংকিলতা, লালসা, কামনা রসে পরিপূর্ণ, এমন যেন না হয়। আবার এমনও যেন না হয়, কবিতায় বড়ই প্রজ্ঞা ও গভীর তত্ত্বকথা আওড়ানো হচ্ছে কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর স্মরণের কোন চিহ্ন নেই। আসলে এ দু’টি অবস্থা সমানভাবে নিন্দনীয়। তিনিই একজন পছন্দনীয় কবি যার ব্যক্তিজীবন যেমন আল্লাহর স্মরণে পরিপূর্ণ তেমনি নিজের সমগ্র কাব্য প্রতিভাও এমন পথে উৎসর্গীকৃত যা আল্লাহ‌ থেকে গাফিল লোকদের নয় বরং যারা আল্লাহকে জানে, আল্লাহকে ভালোবাসে ও আল্লাহর আনুগত্য করে তাদের পথ।

চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটি বর্ণনা করা হয়েছে এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী কবিদের যারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কারোর নিন্দা করে না এবং ব্যক্তিগত, বংশীয় বা গোত্রীয় বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বালায় না। কিন্তু যখন জালেমের মোকাবিলায় সত্যের প্রতি সমর্থন দানের প্রয়োজন দেখা দেয় তখন তার কণ্ঠকে সেই একই কাজে ব্যবহার করে যে কাজে একজন মুজাহিদ তার তীর ও তরবারিকে ব্যবহার করে। সবসময় আবেদন নিবেদন করতেই থাকা এবং বিনীতভাবে আর্জি পেশ করেই যাওয়া মু’মিনের রীতি নয়। এ সম্পর্কেই হাদীসে বলা হয়েছে, কাফের ও মুশরিক কবিরা ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দোষারোপ, অপবাদের যে তাণ্ডব সৃষ্টি করতো এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে বিষ ছড়াতো তার জবাব দেবার জন্য নবী (সা.) নিজে ইসলামী কবিদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ও সাহস যোগাতেন। তাই তিনি কা’ব ইবনে মালেককে (রা.) বলেনঃ

اهْجُهُمْ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَهُو أَشَدُّ عليهم مِنَ النَّبْلِ

“ওদের নিন্দা করো, কারণ সেই আল্লাহর কসম, যার হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ আবদ্ধ, তোমার কবিতা ওদের জন্য তীরের চেয়েও বেশী তীক্ষ্ন ও ধারালো।”

হাসসান ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেনঃ

قل وروح القدس معك এবং اهْجُهُمْ وَجِبْرِيلُ مَعَكَ

“তাদের মিথ্যাচারের জবাব দাও এবং জিব্রীল তোমার সঙ্গে আছে।” এবং “বলো এবং পবিত্র আত্মা তোমার সঙ্গে আছে।”

তাঁর উক্তি ছিলঃ

إِنَّ الْمُؤْمِنَ يُجَاهِدُ بِسَيْفِهِ وَلِسَانِهِ

“মু’মিন তলোয়ার দিয়েও লড়াই করে এবং কণ্ঠ দিয়েও।”

১৪৬.
জুলুমকারী বলতে এখানে এমনসব লোকদের কথা বুঝানো হয়েছে যারা সত্যকে খাটো ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সম্পূর্ণ হঠকারিতার পথ অবলম্বন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কবি, গণক, যাদুকর ও পাগল হবার অপবাদ দিয়ে বেড়াতো। এ ধরনের অপবাদ দেবার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যারা তাঁর সম্পর্কে জানে না তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে তাদের মনে কু-ধারণা সৃষ্টি করা এবং তাঁর শিক্ষার প্রতি যাতে তারা আকৃষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করা।
১.
“সুস্পষ্ট কিতাবের” একটি অর্থ হচ্ছে, এ কিতাবটি নিজের শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশগুলোর একেবারে দ্ব্যর্থহীন পদ্ধতিতে বর্ণনা করে দেয়। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এটি সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে তুলে ধরে। আর এর তৃতীয় একটি অর্থ এই হয় যে, এটি যে আল্লাহর কিতাব সে ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। যে ব্যক্তি চোখ খুলে এ বইটি পড়বে, এটি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের তৈরী করা কথা নয় তা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
২.
অর্থাৎ এ আয়াতগুলো হচ্ছে পথনির্দেশ ও সুসংবাদ। “পথনির্দেশকারী” ও “সুসংবাদদানকারী” বলার পরিবর্তে এগুলোকেই বলা হয়েছে “পথনির্দেশ” ও “সুসংবাদ” এর মাধ্যমে পথনির্দেশনা ও সুসংবাদদানের গুণের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণতার প্রকাশই কাম্য। যেমন কাউকে দাতা বলার পরিবর্তে ‘দানশীলতার প্রতিমূর্তি’ এবং সুন্দর বলার পরিবর্তে ‘আপাদমস্তক সৌন্দর্য’ বলা।
.
৩.
অর্থাৎ কুরআন মজীদের এ আয়াতগুলো কেবলমাত্র এমনসব লোকদেরই পথনির্দেশনা দেয় এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদও একমাত্র এমনসব লোকদের দান করে যাদের মধ্যে দু’টি বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে, তারা ঈমান আনে। ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে তারা কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত গ্রহণ করে। এক আল্লাহকে নিজেদের একমাত্র উপাস্য ও রব বলে মেনে নেয়। কুরআনকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে স্বীকার করে নেয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য নবী বলে মেনে নিয়ে নিজেদের নেতা রূপে গ্রহণ করে। এ সঙ্গে এ বিশ্বাসও পোষণ করে যে, এ জীবনের পর দ্বিতীয় আর একটি জীবন আছে, সেখানে আমাদের নিজেদের কাজের হিসেব দিতে এবং প্রত্যেকটি কাজের প্রতিদান লাভ করতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা এ বিষয়গুলো কেবলমাত্র মেনে নিয়েই বসে থাকে না বরং কার্যত এগুলোর অনুসরণ ও আনুগত্য করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এ উদ্বুদ্ধ হবার প্রথম আলামত হচ্ছে এই যে, তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। এ দু’টি শর্ত যারা পূর্ণ করবে কুরআন মজীদের আয়াত তাদেরকেই দুনিয়ায় সত্য সরল পথের সন্ধান দেবে। এ পথের প্রতিটি পর্যায়ে তাদেরকে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দেবে। তার প্রত্যেকটি চৌমাথায় তাদেরকে ভুল পথের দিকে অগ্রসর হবার হাত থেকে রক্ষা করবে। তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করবে যে, সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন করার ফল দুনিয়ায় যাই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত তারই বদৌলতে চিরন্তন সফলতা তারাই অর্জন করবে এবং তারা মহান আলাহর সন্তুষ্টি লাভের সৌভাগ্য লাভে সক্ষম হবে। এটা ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার যেমন একজন শিক্ষকের শিক্ষা থেকে কেবলমাত্র এমন এক ব্যক্তি লাভবান হতে পারে যে তার প্রতি আস্থা স্থাপন করে যথার্থই তার ছাত্রত্ব গ্রহণ করে নেয় এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজও করতে থাকে। একজন ডাক্তার থেকে উপকৃত হতে পারে একমাত্র এমনই একজন রোগী যে তাকে নিজের চিকিৎসক হিসেবে গ্রহণ করে এবং ঔষধপত্র ও পথ্যাদির ব্যাপারে তার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কাজ করে। একমাত্র এ অবস্থায়ই একজন শিক্ষক ও ডাক্তার মানুষকে তার কাঙ্খিত ফলাফল লাভ করার নিশ্চয়তা দান করতে পারে।

কেউ কেউ এ আয়াতে يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ বাক্যাংশের অর্থ গ্রহণ করেছেন, যারা চারিত্রিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ করবে। কিন্তু কুরআন মজীদে নামায কায়েম করার সাথে যাকাত আদায় করার শব্দ যেখানেই ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই এর অর্থ হয়েছে যাকাত দান করা। নামাযের সাথে এটি ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। এছাড়াও যাকাতের জন্য ايتاء শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি সম্পদের যাকাত দান করার সুনির্দিষ্ট অর্থ ব্যক্ত করে। কারণ আরবী ভাষায় পবিত্রতা অর্জন করার ক্ষেত্রে تزكى শব্দ বলা হয়ে থাকে, ايتاء زكوة বলা হয় না। আসলে এখানে যে কথাটি মনে বদ্ধমূল করে দেয়া উদ্দেশ্য সেটি হচ্ছে এই যে, কুরআনের পথনির্দেশনা থেকে লাভবান হবার জন্য ঈমানের সাথে কার্যত আনুগত্য ও অনুসরণের নীতি অবলম্বন করাও জরুরী। আর মানুষ যথার্থই আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করছে কিনা নামায কায়েম ও যাকাত দান করাই হচ্ছে তা প্রকাশ করার প্রথম আলামত। এ আলামত যেখানেই অদৃশ্য হয়ে যায় সেখানেই বুঝা যায় যে, মানুষ বিদ্রোহী হয়ে গেছে, শাসককে সে শাসক বলে মেনে নিলেও তার হুকুম মেনে চলতে রাজী নয়।

৪.
যদিও আখেরাত বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ এবং এ কারণে মু’মিন বলতে এমনসব লোক বুঝায় যারা তাওহীদ ও রিসালাতের সাথে সাথে আখেরাতের প্রতিও ঈমান আনে কিন্তু এটি আপনা আপনি ঈমানের অন্তর্ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ বিশ্বাসটির গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্য বিশেষ জোর দিয়ে একে পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, যারা পরকাল বিশ্বাস করে না তাদের জন্য এ কুরআন উপস্থাপিত পথে চলা বরং এর উপর পা রাখাও সম্ভব নয়। কারণ এ ধরণের চিন্তাধারা যারা পোষণ করে তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ভালমন্দের মানদণ্ড কেবলমাত্র এমন সব ফলাফলের মাধ্যমে নির্ধারিত করে থাকে যা এ দুনিয়ায় প্রকাশিত হয় বা হতে পারে। তাদের জন্য এমন কোন পথনির্দেশনা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না যা পরকালের পরিণাম ফলকে লাভ-ক্ষতির মানদণ্ড গণ্য করে ভালো ও মন্দ নির্ধারণ করে। কিন্তু এ ধরণের লোকেরা প্রথমত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের শিক্ষায় কর্ণপাত করে না। কিন্তু যদি কোন কারণে তারা মু’মিন দলের মধ্যে শামিল হয়েও যায় তাহলে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস না থাকার ফলে তাদের জন্য ঈমান ও ইসলামের পথে এক পা চলাও কঠিন হয়। এ পথে প্রথম পরীক্ষাটিই যখন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে ইহকালীন লাভ ও পরকালীন ক্ষতির দাবী তাদেরকে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন দিকে টানতে থাকবে তখন মুখে যতই ঈমানের দাবী করতে থাকুক না কেন নিঃসংকোচে তারা ইহকালীন লাভের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং পরকালীন ক্ষতির সামান্যতমও পরোয়া করবে না।
৫.
অর্থাৎ এটি আল্লাহর প্রাকৃতিক নিয়ম আর মানবিক মনস্তত্বের স্বাভাবিক যুক্তিবাদিতাও একথাই বলে যে, যখন মানুষ জীবন এবং তার কর্ম ও প্রচেষ্টার ফলাফলকে কেবলমাত্র এ দুনিয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ মনে করবে, যখন সে এমন কোন আদালত স্বীকার করবে না যেখানে মানুষের সারা জীবনের সমস্ত কাজ যাচাই-পর্যালোচনা করে তার দোষ-গুণের শেষ ও চূড়ান্ত ফায়সালা করা হবে এবং যখন সে মৃত্যুর পরে এমন কোন জীবনের কথা স্বীকার করবে না যেখানে দুনিয়ার জীবনের কর্মকাণ্ডের প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদা অনুযায়ী যথাযথ পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে তখন অনিবার্যভাবে তার মধ্যে একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগী বিকাশ লাভ করবে। তার কাছে সত্য ও মিথ্যা, শিরক ও তাওহীদ, পাপ ও পুণ্য এবং সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্রের যাবতীয় আলোচনা একেবারেই অর্থহীন মনে হবে। এ দুনিয়ায় যা কিছু তাকে ভোগ, আয়েশ-আরাম, বস্তুগত উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং শক্তি ও কর্তৃত্ব দান করবে, তা কোন জীবন-দর্শন, জীবন-পদ্ধতি ও নৈতিক ব্যবস্থা হোক না কেন, তার কাছে তাই হবে কল্যাণকর। প্রকৃত তত্ত্ব ও সত্যের ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যাথা থাকবে না। তার মৌল আকাঙ্ক্ষা হবে কেবলমাত্র দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সাফল্য। এগুলো অর্জন করার চিন্তা তাকে সকল পথে বিপথে টেনে নিয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে যা কিছুই করবে তাকে নিজের দৃষ্টিতে মনে করবে বড়ই কল্যাণকর এবং যারা এ ধরনের বৈষয়িক স্বার্থোদ্ধারে ডুব দেয়নি এবং চারিত্রিক সততা ও অসততা থেকে বেপরোয়া হয়ে স্বেচ্ছাচারীর মত কাজ করে যেতে পারেনি তাদেরকে সে নির্বোধ মনে করবে।

কারো অসৎকার্যাবলীকে তার জন্য শোভন বানিয়ে এ কাজকে কুরআন মজীদে কখনো আল্লাহর কাজ আবার কখনো শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। যখন বলা হয় যে, অসৎকাজগুলোকে আল্লাহ‌ শোভন করে দেন তখন তার অর্থ হয়, যে ব্যক্তি এ দৃষ্টিভংগী অবলম্বন করে তার কাছে স্বভাবতই জীবনের এ সমতল পথই সুদৃশ্য অনুভূত হতে থাকে। আর যখন বলা হয় যে, শয়তান ওগুলোকে সুদৃশ্য করে দেয়। তখন এর অর্থ হয়, এ চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি অবলম্বনকারী ব্যক্তির সামনে শয়তান সবসময় একটি কাল্পনিক জান্নাত পেশ করতে থাকে এবং তাকে এই বলে ভালোভাবে আশ্বাস দিতে থাকে, শাবাশ! বেটা খুব চমৎকার কাজ করছো।

৬.
এ নিকৃষ্ট শাস্তিটি কিভাবে, কখন ও কোথায় হবে। তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। কারণ এ দুনিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও জাতি নানাভাবে এ শাস্তি লাভ করে থাকে। এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার সময় একেবারে মৃত্যুর দ্বারদেশেও জালেমরা এর একটি অংশ লাভ করে। মৃত্যুর পরে “আলমে বরযখে” ও (মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পূর্ববর্তী সময়) মানুষ এর মুখোমুখি হয়। আর তারপর হাশরের ময়দানে এর একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে এবং তারপর এক জায়গায় গিয়ে তা আর কোনদিন শেষ হবে না।
.
৭.
অর্থাৎ এ কুরআনে যেসব কথা বলা হচ্ছে এগুলো কোন উড়ো কথা নয়। এগুলো কোন মানুষের আন্দাজ অনুমান ও মতামত ভিত্তিকও নয়। বরং এক জ্ঞানবান প্রাজ্ঞ সত্তা এগুলো নাযিল করছেন। তিনি নিজের সৃষ্টির প্রয়োজন ও কল্যাণ এবং তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সম্পর্কে পুরোপুরি জানেন। বান্দাদের সংশোধন ও পথনির্দেশনার জন্য তাঁর জ্ঞান সর্বোত্তম কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন করে।
অনুবাদ: