পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

১৮৫ আয়াত

৭১ ) তারপর সেই দিনের কথা মনে করো যেদিন আমি মানুষের প্রত্যেকটি দলকে তার নেতা সহকারে ডাকবো। সেদিন যাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে তারা নিজেদের কার্যকলাপ পাঠ করবে ৮৬ এবং তাদের ওপর সামান্যতমও জুলুম করা হবে না
يَوْمَ نَدْعُوا۟ كُلَّ أُنَاسٍۭ بِإِمَـٰمِهِمْ ۖ فَمَنْ أُوتِىَ كِتَـٰبَهُۥ بِيَمِينِهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَـٰبَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًۭا ٧١
৭২ ) আর যে ব্যক্তি এ দুনিয়াতে অন্ধ হয়ে থাকে সে আখেরাতেও অন্ধ হয়েই থাকবে বরং পথ লাভ করার ব্যাপারে সে অন্ধের চেয়েও বেশী ব্যর্থ।
وَمَن كَانَ فِى هَـٰذِهِۦٓ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًۭا ٧٢
৭৩ ) হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আমি যে অহী পাঠিয়েছি তা থেকে তোমাকে ফিরিয়ে রাখার জন্য এ লোকেরা তোমাকে বিভ্রাটের মধ্যে ঠেলে দেবার প্রচেষ্টায় কসুর করেনি, যাতে তুমি আমার নামে নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা তৈরি করো। ৮৭ যদি তুমি এমনটি করতে তাহলে তারা তোমাকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো।
وَإِن كَادُوا۟ لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ ٱلَّذِىٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ لِتَفْتَرِىَ عَلَيْنَا غَيْرَهُۥ ۖ وَإِذًۭا لَّٱتَّخَذُوكَ خَلِيلًۭا ٧٣
৭৪ ) আর যদি আমি তোমাকে মজবুত না রাখতাম তাহলে তোমার পক্ষে তাদের দিকে কিছু না কিছু ঝুঁকে পড়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।
وَلَوْلَآ أَن ثَبَّتْنَـٰكَ لَقَدْ كِدتَّ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْـًۭٔا قَلِيلًا ٧٤
৭৫ ) কিন্তু যদি তুমি এমনটি করতে তাহলে আমি এ দুনিয়ায় তোমাকে দ্বিগুণ শাস্তির মজা টের পাইয়ে দিতাম এবং আখেরাতেও, তারপর আমার মোকাবিলায় তুমি কোন সাহায্যকারী পেতে না। ৮৮
إِذًۭا لَّأَذَقْنَـٰكَ ضِعْفَ ٱلْحَيَوٰةِ وَضِعْفَ ٱلْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًۭا ٧٥
৭৬ ) আর এরা এ দেশ থেকে তোমাকে উৎখাত করার এবং এখান থেকে তোমাকে বের করে দেবার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু যদি এরা এমনটি করে তাহলে তোমার পর এরা নিজেরাই এখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারবে না। ৮৯
وَإِن كَادُوا۟ لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ ٱلْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا ۖ وَإِذًۭا لَّا يَلْبَثُونَ خِلَـٰفَكَ إِلَّا قَلِيلًۭا ٧٦
৭৭ ) এটি আমার স্থায়ী কর্মপদ্ধতি। তোমার পূর্বে আমি যেসব রসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের সবার ব্যাপারে এ কর্মপদ্ধতি আরোপ করেছিলাম। ৯০ আর আমার কর্মপদ্ধতিতে তুমি কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না।
سُنَّةَ مَن قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِن رُّسُلِنَا ۖ وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا ٧٧
৭৮ ) নামায কায়েম করো ৯১ সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে ৯২ নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত ৯৩ এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা করো। ৯৪ কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ৯৫
أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِدُلُوكِ ٱلشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ ٱلَّيْلِ وَقُرْءَانَ ٱلْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْءَانَ ٱلْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًۭا ٧٨
৭৯ ) আর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ো ৯৬ এটি তোমার জন্য নফল। ৯৭ অচিরেই তোমার রব তোমাকে “প্রশংসিত স্থানে” ৯৮ প্রতিষ্ঠিত করবেন।
وَمِنَ ٱلَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِۦ نَافِلَةًۭ لَّكَ عَسَىٰٓ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًۭا مَّحْمُودًۭا ٧٩
৮০ ) আর দোয়া করোঃ হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো। ৯৯ এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও। ১০০
وَقُل رَّبِّ أَدْخِلْنِى مُدْخَلَ صِدْقٍۢ وَأَخْرِجْنِى مُخْرَجَ صِدْقٍۢ وَٱجْعَل لِّى مِن لَّدُنكَ سُلْطَـٰنًۭا نَّصِيرًۭا ٨٠
৮৬.
কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় একথা বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন নেক লোকদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে এবং তারা সানন্দে তা দেখতে থাকবে বরং অন্যদেরকেও দেখাবে। অন্যদিকে অসৎলোকদের দুষ্কৃতির তালিকা তাদের বাঁ হাতে দেয়া হবে এবং তারা তা পাওয়ার সাথে সাথেই পেছন দিকে লুকাবার চেষ্টা করবে। এ প্রসঙ্গে দেখুন সূরা আল হাক্কাহ ১৯-২৮ এবং ইনশিকাক ৭-১৩ আয়াত।
.
.
৮৭.
বিগত দশ বারো বছর থেকে নবী ﷺ মক্কায় যে অবস্থার সাথে যুঝছিলেন এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি যে তাওহীদের দাওয়াত পেশ করছিলেন মক্কার কাফেররা তাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। তারা চাচ্ছিল তিনি তাদের শিরক ও জাহেলী রসম রেওয়াজের সাথে কিছু না কিছু সমঝোতা করে নেবেন। এ উদ্দেশ্যে তারা তাঁকে ফিতনার দিকে ঠেলে দেবার চেষ্টা করলো। তাঁকে ধোঁকা দিল, লোভ দেখালো, হুমকি দিল এবং মিথ্যা প্রচারণার তুফান ছুটালো। তারা তাঁর প্রতি জুলুম-নিপীড়ন চালালো ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করলো। তাঁকে সামাজিকভাবে বয়কট করলো। একটি মানুষের সংকল্পকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য যা কিছু করা যেতে পারে তা সবই তারা করে ফেললো।
.
.
৮৮.
এ সমগ্র কার্যবিবরণীর ওপর মন্তব্য প্রসঙ্গে আল্লাহ দু’টি কথা বলেছেন। এক, যদি তুমি সত্যকে সত্য জানার পর মিথ্যার সাথে কোন আপোস করে নিতে তাহলে বিক্ষুব্ধ জাতি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যেতো ঠিকই কিন্তু আল্লাহর গযব তোমার ওপর নেমে পড়তো এবং তোমাকে দুনিয়ায় ও আখেরাত উভয় স্থানেই দ্বিগুণ সাজা দেয়া হতো। দুই, মানুষ নবী হলেও আল্লাহর সাহায্য ও সুযোগ-সুবিধা তাঁর সহযোগী না হলে শুধুমাত্র নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে সে মিথ্যার তুফানের মোকাবিলা করতে পারে না। শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ধৈর্য ও অবিচলতার সাহায্যেই নবী ﷺ সত্য ও ন্যায়ের ওপর পাহাড়ের মতো অটল থাকেন এবং বিপদের সয়লাব স্রোত তাঁকে একচুলও স্থানচ্যুত করতে পারেনি।
৮৯.
এটি একটি সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী। সে সময় এটি তো নিছক হুমকি মনে হচ্ছিল। কিন্তু দশ বারো বছরের মধ্যেই এর সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ হয়ে গেলো। এ নিজের জন্মভূমি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করলো এবং এরপর ৮ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি বিজয়ীর বেশে মক্কা মুয়ায্যমায় প্রবেশ করলেন। তারপর দু’বছরের মধ্যেই সমগ্র আরব ভূখণ্ড মুশরিক শূন্য করা হলো। এরপর যারাই এ দেশে বসবাস করেছে মুসলমান হিসেবেই বসবাস করেছে, মুশরিক হিসেবে কেউ সেখানে টিকতে পারেনি।
৯০.
সকল নবীর ব্যাপারে আল্লাহ এ একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ যে জাতি তাদেরকে হত্যা ও দেশান্তরী করেছে, তারাপর সে আর বেশী দিন স্বস্থানে অবস্থান করতে পারেনি। এরপর হয় আল্লাহর আযাব তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে অথবা কোন শত্রু ভাবাপন্ন জাতিকে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা সেই নবীর অনুসারীদের দ্বারা তাকে বিপর্যস্ত ও বিজিত করা হয়েছে।
.
৯১.
পর্বত প্রমাণ সমস্যা ও সংকটের আলোচনা করার পর পরই নামায কায়েম করার হুকুম দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করেছেন যে, এ অবস্থায় একজন মু’মিনের জন্য যে অবিচলতার প্রয়োজন হয় তা নামায কায়েমের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে।
৯২.
(আরবী-----------------) এর অনুবাদ করেছি “সূর্য ঢলে পড়া।” অবশ্যি কোন কোন সাহাবা ও তাবেঈ “দুলূক” অর্থ নিয়েছেন সূর্যাস্ত। কিন্তু অধিকাংশের মতে এর অর্থ হচ্ছে দুপুরে সূর্যের পশ্চিমে ঢলে পড়া। হযরত উমর, ইবনে উমর, আনাস ইবনে মালিক, আবু বায়যাতাল আসলামী, হাসান বাস্রী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ এবং একটি বর্ণনামতে ইবনে আব্বাসও এ মতের সমর্থক। ইমাম মুহাম্মাদ বাকের ও ইমাম জাফর সাদেক থেকেও এই মত বর্ণিত হয়েছে। বরং কোন কোন হাদীসে নবী ﷺ থেকেও (আরবী-------------) এর এ ব্যাখ্যাও উদ্ধৃত হয়েছে, যদিও এর সনদ তেমন বেশী শক্তিশালী নয়।
৯৩.
(আরবী------------) এর অর্থ কেউ কেউ নিয়েছেন “রাতের পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়া।” আবার কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন মধ্যরাত। যদি প্রথম অর্থটি মেনে নেয়া হয় তাহলে এর মানে হবে এশার প্রথম ওয়াক্ত। আর দ্বিতীয় অর্থটি মেনে নিলে এখানে এশার শেষ ওয়াক্তের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
৯৪.
ফজর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভোর হওয়া বা প্রভাতের উদয় হওয়া অর্থাৎ একেবারে সেই প্রথম লগ্নটি যখন প্রভাতের শুভ্রতা রাতের আঁধার চিরে উঁকি দিতে থাকে।

ফজরের কুরআন পাঠ মানে হচ্ছে, ফজরের নামায, কুরআন মজীদে নামায প্রতিশব্দ হিসেবে কোথাও ‘সালাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আবার কোথাও বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে কোন একটির নাম নিয়ে সমগ্র নামাযটি ধরা হয়েছে। যেমন তাসবীহ, যিকির, হামদ (প্রশংসা) কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকূ’ সিজদাহ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে এখানে ফজরের সময় কুরআন পড়ার মানে শুধু কুরআন পাঠ করা নয় বরং নামাযে কুরআন পাঠ করা। এভাবে নামাযের উপাদান ও অংশ কি ধরনের হতে হবে কুরআন মজীদ সেদিকে পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে। আর এ ইঙ্গিতের আলোকে নবী ﷺ নামাযের কাঠামো নির্মাণ করেন। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নামাযের এ কাঠামোই প্রচলিত।

৯৫.
ফজরের কুরআন পরিলক্ষিত হওয়ার মানে হচ্ছে, আল্লাহর ফেরেশতারা এর সাক্ষী হয়। হাদীসে সুস্পষ্ট একথা বর্ণনা করা হয়েছে যদিও ফেরেশতারা প্রত্যেক নামায ও প্রত্যেক সৎকাজের সাক্ষী তবুও যখন ফজরের নামাযের কুরআন পাঠে তাদের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে তখন এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজটি একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ কারণেই নবী ﷺ ফজরের নামাযে দীর্ঘ আয়াত ও সূরা পড়ার পদ্ধতি অবলম্বন করেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং পরবর্তী ইমামগণ একে মুস্তাহাব গণ্য করেন।

এ আয়াতে সংক্ষেপে মি’রাজের সময় যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছিল তার সময়গুলো কিভাবে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করা হবে তা বলা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, একটি নামায পড়ে নিতে হবে সূর্যোদয়ের আগে। আর বাকি চারটি নামায সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত পড়ে নিতে হবে। তারপর এ হুকুমটি ব্যাখ্যা করার জন্য জিব্রীল আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযগুলোর সঠিক সময়ের শিক্ষা দান করেছেন। আবু দাউদ ও তিরমিযীতে ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ

“জিব্রীল দু’বার আমাকে বায়তুল্লাহর কাছাকাছি জায়গায় নামায পড়ান। প্রথম দিন যোহরের নামায ঠিক এমন সময় পড়ান যখন সূর্য সবেমাত্র হেলে পড়েছিল এবং ছায়া জুতার একটি ফিতার চাইতে বেশী লম্বা হয়নি। তারপর আসরের নামায পড়ান এমন এক সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমপরিমাণ ছিল। এরপর মাগরিবের নামায এমন সময় পড়ান যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে। অতঃপর পশ্চিমাকাশের লালিমা খতম হবার পরপরই এশার নামায পড়ান আর ফজরের নামায পড়ান ঠিক যখন রোযাদারের ওপর খাওয়া দাওয়া হারাম হয়ে যায় তেমনি সময়। দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে যোহরের নামায এমন সময় পড়ান যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমান ছিল। আসরের নামায পড়ান এমন সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের দ্বিগুণ ছিল। মাগরিবের নামায পড়ান এমন সময় যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে। এশার নামায পড়ান এমন সময় যখন রাতের তিনভাগের একভাগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং ফজরের নামায পড়ান আলো চারদিকে ভালভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর। তারপর জিব্রীল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে মুহাম্মাদ! এই হচ্ছে নবীদের নামায পড়ার সময় এবং এ দু’টি সময়ের মাঝখানেই হচ্ছে নামাযের সঠিক সময়।” (অর্থাৎ প্রথম দিন প্রত্যেক নামাযের প্রথম সময় এবং দ্বিতীয় দিন শেষ সময় বর্ণনা করা হয়। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামায এ দু’টি সময়ের মাঝখানে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।)

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায়ও পাঁচটি নামাযের এ ওয়াক্তসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন সূরা হূদে বলা হয়েছেঃ

আরবী------------------------------------

“নামায কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরিব) এবং কিছু রাত পার হয়ে গেলে (অর্থাৎ এশা)।” (১১৪ আয়াত)

সূরা ‘তা-হা’য়ে বলা হয়েছেঃ

আরবী-----------------------------------

“আর নিজের রবের হামদ (প্রশংসা) সহকারে তাঁর তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা) করতে থাকো সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর) এবং রাতের সময় আবার তাসবীহ করো (এশা) আর দিনের প্রান্তসমূহে (অর্থাৎ সকাল, যোহর ও মাগরিব)” (১৩০ আয়াত)

তারপর সূরা রূমে বলা হয়েছেঃ

আরবী----------------------------------

“কাজেই আল্লাহর তাসবীহ করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় (মাগরিব) এবং যখন সকাল হয় (ফজর)। তাঁরই জন্য প্রশংসা আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে এবং তাঁর তাসবীহ করো দিনের শেষ অংশে (আসর) এবং যখন তোমাদের দুপুর (যোহর) হয়।” [১৭-১৮ আয়াত]

নামাযের সময় নির্ধারণ করার সময় যেসব প্রয়োজনীয় দিকে নজর রাখা হয়েছে তার মধ্যে সূর্য পূজারীদের ইবাদাতের সময় থেকে দূরে থাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সকল যুগেই সূর্য মুশরিকদের সবচেয়ে বড় বা অনেক বড় মাবুদের স্থান দখল করেছে। সূর্য উদয় ও অস্তের সময়টায়ই তারা বিশেষ করে তার পূজা করে থাকে। তাই এসব সময় নামায পড়াকে হারাম করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণত সূর্য উদয়ের পর থেকে নিয়ে মধ্য গগণে পৌঁছার সময়ে তার পূজা করা হয়ে থাকে। কাজেই ইসলামে হুকুম দেয়া হয়েছে, দিনের বেলার নামাযগুলো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে পড়া শুরু করতে হবে এবং সকালের নামায সূর্য হবার আগেই পড়ে ফেলতে হবে। এ প্রয়োজনীয় বিষয়টি নবী ﷺ বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনা করেছেন। একটি হাদীসে হযরত আমর ইবনে আবাসাহ (রা.) বর্ণনা করছেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযের সময় জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ

আরবী-----------------------------------

“ফজরের নামায পড়ো এবং সূর্য উদিত হতে থাকলে বিরত হও, সূর্য ওপরে উঠে যাওয়া পর্যন্ত। কারণ সূর্য যখন উদিত হয় তখন শয়তানের শিং দু’টির মাঝখান দিয়ে বের হতে থাকে এবং এ সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে।”

তারপর তিনি আসরের নামাযের উল্লেখ করার পর বললেনঃ

আরবী-------------------------------------

“তারপর নামায থেকে বিরত হও সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। কেননা, সূর্য শয়তানের শিং দু’টির মাঝখানে অস্ত যায় এবং এ সময় কাফেররা তার পূজা করে।” (মুসলিম)

এ হাদীসে সূর্যের শয়তানের শিংয়ের মাঝখান দিয়ে উদয় হওয়া ও অস্ত যাওয়াকে একটা রূপক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় শয়তান লোকদের জন্য একটি বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয়। লোকেরা যখন সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় তার সামনে সিজদা করে তখন যেন মনে হয় শয়তান তাকে নিজের মাথায় করে এনেছে এবং মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। রসূল ﷺ তাঁর নিজের নিম্নোক্ত বাক্য দিয়ে এ রূপকের রহস্য ভেদ করেছেন “এ সময় কাফেররা তার পূজা করে।”

৯৬.
তাহাজ্জুদ মানে ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়া। কাজেই রাতের বেলা তাহাজ্জুদ পড়া মানে হচ্ছে, রাতের একটি অংশে ঘুমুবার পর উঠে নামায পড়ে নাও।
৯৭.
নফল মানে ফরযের অতিরিক্ত। এ থেকে আপনা আপনি এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আগের আয়াতে যে পাঁচটি নামাযের ওয়াক্ত বর্ণনা করা হয়েছিল সেগুলো ফরয এবং এ ষষ্ঠ নামাযটি ফরযের অতিরিক্ত।
৯৮.
অর্থাৎ দুনিয়ায় ও আখেরাতে তোমাদেরকে এমন মার্যাদায় পৌঁছে দেবেন যেখানে তোমরা মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে থাকবে। তোমাদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় একটি প্রশংসনীয় অস্তিত্বে পরিণত হবে। আজ তোমাদের বিরোধীরা গালাগালি ও নিন্দাবাদের মাধ্যমে তোমাদের অভ্যর্থনা করছে এবং সারাদেশে তোমাদের বদনাম করার জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের তুফান সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু সে সময় দূরে নয় যখন সারা দুনিয়ায় তোমাদের প্রশংসা শ্রুত হবে এবং আখেরাতেও তোমরা সমগ্র সৃষ্টির প্রশংসার অধিকারী হবে। কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতকারীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়াও এ প্রশংসনীয় মর্যাদারই একটি অংশ।
.
৯৯.
এ দোয়ার নির্দেশ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, হিজরতের সময় তখন একেবারে আসন্ন হয়ে উঠেছিল তাই বলা হয়েছে, তোমাদের এ মর্মে দোয়া করা উচিত যে, সত্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠা যেন কোনক্রমেই তোমাদের হাতছাড়া না হয়। যেখানে থেকেই বের হও সততা, সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার খাতিরেই বের হও এবং যেখানেই যাও সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে যাও।
১০০.
অর্থাৎ তুমি নিজেই আমাকে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দান করো অথবা কোন রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যাতে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে আমি দুনিয়ার বিকৃত ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারি, অশ্লীলতা ও পাপের সয়লাব রুখে দিতে পারি এবং তোমার ন্যায় বিধান জারি করতে সক্ষম হই। হাসান বাস্রী ও কাতাদাহ এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীরের ন্যায় মহান তাফসীরকারগণ এ ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীস থেকেও এরই সমর্থন পাওয়া যায়ঃ

আরবী--------------------

“আল্লাহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে এমনসব জিনিসের উচ্ছেদ ঘটান কুরআনের মাধ্যমে যেগুলোর উচ্ছেদ ঘটান না।”

এ থেকে জানা যায়, ইসলাম দুনিয়ায় যে সংশোধন চায় তা শুধু ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে হতে পারে না বরং তাকে কার্যকর করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতারও প্রয়োজন হয়। তারপর আল্লাহ নিজেই যখন তাঁর নবীকে এ দোয়া শিখিয়েছেন তখন এ থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও শরীয়তী আইন প্রবর্তন এবং আল্লাহ প্রদত্ত দণ্ডবিধি জারী করার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা হাসিল করার প্রত্যাশা করা এবং এজন্য প্রচেষ্টা চলানো শুধু জায়েযই নয় বরং কাংখিত ও প্রশংসিতও এবং অন্যদিকে যারা এ প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশাকে বৈষয়িক স্বার্থ পূজা ও দুনিয়াদারী বলে আখ্যায়িত করে তারা ভুলের মধ্যে অবস্থান করছে। কোন ব্যক্তি যদি নিজের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করতে চায় তাহলে তাকে বৈষয়িক স্বার্থ পূজা বলা যায়। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশা করা বৈষয়িক স্বার্থ পূজা নয় বরং আল্লাহর আনুগত্যের প্রত্যক্ষ দাবী।

অনুবাদ: