পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

১৭০ আয়াত

৪৩ ) একদিন ৩৬ বাদশাহ বললো, “আমি স্বপ্ন দেখেছি, সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও সাতটি শুকনো শীষ। হে সভাসদবৃন্দ! আমাকে এ স্বপ্নের তা’বীর বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্নের মানে বুঝে থাকো।” ৩৭
وَقَالَ ٱلْمَلِكُ إِنِّىٓ أَرَىٰ سَبْعَ بَقَرَٰتٍۢ سِمَانٍۢ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌۭ وَسَبْعَ سُنۢبُلَـٰتٍ خُضْرٍۢ وَأُخَرَ يَابِسَـٰتٍۢ ۖ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلْمَلَأُ أَفْتُونِى فِى رُءْيَـٰىَ إِن كُنتُمْ لِلرُّءْيَا تَعْبُرُونَ ٤٣
৪৪ ) লোকেরা বললো, “এসব তো অর্থহীন স্বপ্ন, আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের মানে জানি না।”
قَالُوٓا۟ أَضْغَـٰثُ أَحْلَـٰمٍۢ ۖ وَمَا نَحْنُ بِتَأْوِيلِ ٱلْأَحْلَـٰمِ بِعَـٰلِمِينَ ٤٤
৪৫ ) সেই দু’জন কয়েদীর মধ্য থেকে যে বেঁচে গিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে এখন যার মনে পড়েছিল, সে বললো, “আমি আপনাদের এর তা’বীর বলে দিচ্ছি, আমাকে একটু (কারাগারে ইউসুফের কাছে) পাঠিয়ে দিন।” ৩৮
وَقَالَ ٱلَّذِى نَجَا مِنْهُمَا وَٱدَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ أَنَا۠ أُنَبِّئُكُم بِتَأْوِيلِهِۦ فَأَرْسِلُونِ ٤٥
৪৬ ) সে গিয়ে বললো, “হে সত্যবাদিতার প্রতীক ইউসুফ! ৩৯ আমাকে এ স্বপ্নের অর্থ বলে দাওঃ সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি শীষ সবুজ ও সাতটি শীষ শুকনো সম্ভবত আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারবো এবং তারা জানতে পারবে। ৪০
يُوسُفُ أَيُّهَا ٱلصِّدِّيقُ أَفْتِنَا فِى سَبْعِ بَقَرَٰتٍۢ سِمَانٍۢ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌۭ وَسَبْعِ سُنۢبُلَـٰتٍ خُضْرٍۢ وَأُخَرَ يَابِسَـٰتٍۢ لَّعَلِّىٓ أَرْجِعُ إِلَى ٱلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَعْلَمُونَ ٤٦
৪৭ ) ইউসুফ বললো, “তোমরা সাত বছর পর্যন্ত লাগাতার চাষাবাদ করতে থাকবে। এ সময় তোমরা যে ফসল কাটবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ তোমাদের আহারের প্রয়োজনে বের করে নেবে এবং বাদবাকি সব শীষ সমেত রেখে দেবে।
قَالَ تَزْرَعُونَ سَبْعَ سِنِينَ دَأَبًۭا فَمَا حَصَدتُّمْ فَذَرُوهُ فِى سُنۢبُلِهِۦٓ إِلَّا قَلِيلًۭا مِّمَّا تَأْكُلُونَ ٤٧
৪৮ ) তারপর সাতটি বছর আসছে বড়ই কঠিন। এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তা সমস্ত এ সময়ে খেয়ে ফেলা হবে। যদি কিছু বেঁচে যায় তাহলে তা হবে কেবলমাত্র সেটুকুই যা তোমরা সংরক্ষণ করবে।
ثُمَّ يَأْتِى مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ سَبْعٌۭ شِدَادٌۭ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًۭا مِّمَّا تُحْصِنُونَ ٤٨
৪৯ ) এরপর আবার এক বছর এমন আসবে যখন রহমতের বৃষ্টি ধারার মাধ্যমে মানুষের আবেদন পূর্ণ করা হবে এবং তারা রস নিংড়াবে।” ৪১
ثُمَّ يَأْتِى مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ عَامٌۭ فِيهِ يُغَاثُ ٱلنَّاسُ وَفِيهِ يَعْصِرُونَ ٤٩
৫০ ) বাদশাহ বললো, “তাঁকে আমার কাছে আনো।” কিন্তু বাদশাহর দূত যখন ইউসুফের কাছে পৌঁছল তখন সে বললো, ৪২ তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যে মহিলারা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটা কি? আমার রব তো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত।” ৪৩
وَقَالَ ٱلْمَلِكُ ٱئْتُونِى بِهِۦ ۖ فَلَمَّا جَآءَهُ ٱلرَّسُولُ قَالَ ٱرْجِعْ إِلَىٰ رَبِّكَ فَسْـَٔلْهُ مَا بَالُ ٱلنِّسْوَةِ ٱلَّـٰتِى قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ ۚ إِنَّ رَبِّى بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌۭ ٥٠
৫১ ) একথায় বাদশাহ সেই মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, ৪৪ “তোমরা যখন ইউসুফকে অসৎকাজে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলে তোমাদের তখনকার অভিজ্ঞতা কি?” সবাই এক বাক্যে বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! আমরা তার মধ্যে অসৎ প্রবণতার গন্ধই পাইনি।” আযীযের স্ত্রী বলে উঠলো, “এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে। আমিই তাঁকে ফুসলাবার চেষ্টা করেছিলাম, নিঃসন্দেহে সে একদম সত্যবাদী।” ৪৫
قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ إِذْ رَٰوَدتُّنَّ يُوسُفَ عَن نَّفْسِهِۦ ۚ قُلْنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِن سُوٓءٍۢ ۚ قَالَتِ ٱمْرَأَتُ ٱلْعَزِيزِ ٱلْـَٔـٰنَ حَصْحَصَ ٱلْحَقُّ أَنَا۠ رَٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفْسِهِۦ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ٥١
৫২ ) (ইউসুফ বললোঃ) ৪৬ “এ থেকে আমার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, আযীয জানতে পারুক, আমি তার অবর্তমানে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি এবং আল্লাহ‌ বিশ্বাসঘাতকতাকারীদের চক্রান্ত সফল করেন না।
ذَٰلِكَ لِيَعْلَمَ أَنِّى لَمْ أَخُنْهُ بِٱلْغَيْبِ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى كَيْدَ ٱلْخَآئِنِينَ ٥٢
৩৬.
মাঝখানে কারাগার জীবনের কয়েক বছরের অবস্থা বাদ দিয়ে এখন হযরত ইউসুফের পার্থিব উন্নতির সূচনালগ্নের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়া হয়েছে।
৩৭.
বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা মতে এ স্বপ্ন দেখার পর বাদশাহ বড়ই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে নিজের রাজ্যের বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল গোষ্ঠী, জ্যোতিষী, গণক, ধর্মীয় নেতা ও যাদুকরদের একত্র করে তাদের সবার সামনে এ স্বপ্ন পেশ করেছিলেন।
.
৩৮.
কুরআন এখানে ঘটনার আলোচনা সংক্ষেপে সেরে দিয়েছে। বাইবেল ও তালমূদে এর যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে (বস্তুত যুক্তির আলোকে এ বিবরণই সঠিক মনে হয়।) তা হচ্ছে এইঃ মদ পরিবেশকদের সরদার ইউসুফ আলাইহিস সালামের অবস্থা বাদশাহর কাছে বর্ণনা করে এবং এ সঙ্গে জেলখানায় তাদের স্বপ্ন এবং হযরত ইউসুফ (আ) তার যে তা’বীর করেছিলেন আর এ তা’বীর যেভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে তা সবই তার সামনে তুলে ধরে। শেষে সে বাদশাহর কাছে আবেদন করে, আমি জেলখানায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে এর তা’বীর জিজ্ঞেস করে আসবো, আমাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেয়া হোক।
৩৯.
মূল ভাষ্যে صِّدِّيقُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি আরবী ভাষায় সর্বোচ্চ মানের সততা ও সত্যবাদিতার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, কারাগারে অবস্থানকালে এ ব্যক্তি হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের পবিত্র জীবন ও চরিত্র দ্বারা কী বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল! দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পরও এ প্রভাব কেমন অটুট ছিল! “সিদ্দীক” শব্দটির আরো বেশী ব্যাখ্যা জানার জন্য দেখুন সূরা নিসার ৯৯ টীকা।
৪০.
অর্থাৎ তারা আপনার মর্যাদা ও মূল্য বুঝতে পারবে। তারা অনুভব করতে পারবে কত উঁচু দরের ব্যক্তিত্বকে তারা কোথায় আটকে রেখেছে। এভাবে আপনার সাথে কারাবাসের সময় আমি যে ওয়াদা করেছিলাম তা পূর্ণ করার সুযোগ আমি পেয়ে যাবো।
.
.
৪১.
মূল ভাষ্যে يَعْصِرُونَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর শাব্দিক মানে হচ্ছে ‘নিংড়ানো’। এখানে এর মাধ্যমে পরবর্তীকালের চতুর্দিকের এমন শষ্য শ্যামল তরতাজা পরিবেশ বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য যা দুর্ভিক্ষের পর রহমতের বৃষ্টিধারা ও নীল নদের জোয়ারের পানি সিঞ্চনের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে। জমি ভালোভাবে পানিসিক্ত হলে তেল উৎপাদনকারী বীজ, রসাল ফল ও অন্যান্য ফলফলাদি বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং ভালো ঘাস খাওয়ার কারণে গৃহপালিত পশুরাও প্রচুর পরিমাণে দুধ দেয়।

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এ তা’বীরে শুধুমাত্র বাদশাহর স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিনি এ সঙ্গে প্রাচুর্যের প্রথম সাত বছরে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা ও শস্য সংরক্ষণ করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি দুর্ভিক্ষের পরে সুদিন আসার সুখবরও দিয়েছেন অথচ বাদশাহর স্বপ্নে এর কোন উল্লেখ ছিল না।

৪২.
এখান থেকে শুরু করে বাদশাহর সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত আলোচনাটি এ কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সম্পর্কে যা কিছু কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তার কোন উল্লেখ বাইবেল ও তালমূদে নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, বাদশাহর ডাকে হযরত ইউসুফ (আ) সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি ক্ষৌরকর্ম শেষ করলেন, পোশাক বদলালেন এবং রাজ দরবারে হাযির হয়ে গেলেন। তালমূদ এর চাইতেও নিকৃষ্ট ভংগীতে এ ঘটনাকে পেশ করেছে। তার বর্ণনামতে, “বাদশাহ তার কর্মচারীদেরকে হুকুম দিলেন ইউসুফকে আমার সামনে হাজির করো এবং এ সঙ্গে এও নির্দেশ দিলেন যে, দেখো এমন কোন কাজ করো না যাতে ছেলেটি ভয় পেয়ে যায় এবং সঠিক তা’বীর দিতে না পারে। কাজেই রাজ কর্মচারীরা হযরত ইউসুফকে কারাগার থেকে বের করলো। তাঁর ক্ষৌরকর্ম সম্পন্ন করলো, পোশাক বদলালো এবং দরবারে নিয়ে এলো। বাদশাহ নিজের সিংহাসনে বসেছিলেন। সেখানে হীরা, মুক্তা, মনি-মাণিক্যের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ও দরবারের শান-শওকত দেখে ইউসুফ হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং তাঁর দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেলো। বাদশাহর সিংহাসনের সাতটি সিঁড়ি ছিল। নিয়ম ছিল, যখন কোন সম্মানিত ও মর্যাদাশালী ব্যক্তি কিছু বলতে চাইতেন তখন ছয়টি সিঁড়ি চড়ে ওপরে যেতেন এবং বাদশাহর সাথে কথা বলতেন। আর যখন নিম্ন শ্রেণীর কোন ব্যক্তিকে বাদশাহর সাথে কথা বলার জন্য ডাকা হতো তখন সে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং বাদশাহ তৃতীয় সিঁড়িতে নেমে এসে তার সাথে কথা বলতেন। এ নিয়ম মোতাবেক ইউসুফ নীচে দাঁড়িয়ে ভূমি চুম্বন করে বাদশাহকে সালামী দিলেন এবং বাদশাহ তৃতীয় সিঁড়িতে নেমে এসে তাঁর সাথে কথা বললেন।” এ চিত্রে বনী ইসরাঈল তার মহান মর্যাদাশালী পয়গম্বরকে যেভাবে হেয় করে পেশ করেছে তা চোখের সামনে রেখে কুরআন তাঁর কারাগার থেকে বের হওয়া এবং বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করার ঘটনাকে যে মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবময় ভংগীতে পেশ করেছে তা একবার পর্যালোচনা করে দেখুন। এখন একজন বিবেকবান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এ ফায়সালা করতে পারেন যে, এ দু’টি চিত্রের মধ্যে কোন্ চিত্রটি নবুওয়াতের মর্যাদার সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল। তাছাড়া সাধারণ বিচার বুদ্ধির দৃষ্টিতেও একথাটি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয় যে, বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করা পর্যন্ত যদি হযরত ইউসুফ এতই নিকৃষ্ট মর্যাদার অধিকারী থেকে থাকেন যেমন তালমূদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাহলে স্বপ্নের তা’বীর শুনার পর অকস্মাৎ তাঁকে একেবারে সমগ্র রাজ্যের সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী করে দেয়া হলো কেমন করে? একটি উন্নত ও সুসভ্য দেশে এতবড় মর্যাদা মানুষ তখনই লাভ করে যখন সে লোকদের কাছে নিজের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দেয়। কাজেই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়েও বাইবেল ও তালমূদের তুলনায় কুরআনের বর্ণনাই বাস্তবতার সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল মনে হয়।
৪৩.
অর্থাৎ আমার রব আল্লাহ তো আগে থেকেই জানেন যে, আমি নিরপরাধ। কিন্তু তোমাদের রব অর্থাৎ বাদশাহের ও আমার মুক্তির পূর্বে যে কারণে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে সে ব্যাপারটির পুরোপুরি অনুসন্ধান করে নেয়া উচিত। কারণ আমি কোন সন্দেহ ও অপবাদের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মানুষের সামনে যেতে চাই না। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে আগে আমি যে নিরপরাধ ছিলাম একথাটি সর্বসমক্ষে প্রমাণিত হওয়া উচিত। আসল অপরাধী ছিল তোমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। তারা নিজেরদের স্ত্রীদের অসচ্চরিত্রতার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে আমার নিরপরাধ সত্তা ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের ওপর।

হযরত ইউসুফ (আ) তাঁর এ দাবীকে যে ভাষায় পেশ করেছেন তা থেকে সুস্পষ্টভাবে একথা প্রকাশিত হয় যে, আযীযের স্ত্রীর ভোজের মজলিসে যে ঘটনা ঘটেছিল সে সম্পর্কে মিসরের বাদশাহ পুরাপুরি অবগত ছিলেন। বরং সেটি এমনি একটি বহুল প্রচারিত ঘটনা ছিল যে, সেদিকে কেবলমাত্র একটি ইঙ্গিতই যথেষ্টে ছিল।

তারপর এ দাবীতে হযরত ইউসুফ (আ) আযীযের স্ত্রীকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যে মহিলাগুলো আংগুল কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটি উত্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এটি তাঁর চরম ভদ্রতা ও উন্নত হৃদয়বৃত্তির আর একটি প্রমাণ। আযীযের স্ত্রী তাঁর সাথে যে পর্যায়ের অসদ্ব্যবহার করে থাকুক না কেন তবুও তার স্বামী তাঁর উপকার করেছিলেন। তাই তার ইজ্জত-আবরুর ওপর হামলা করে কোন কথা তিনি বলতে চাননি।

৪৪.
সম্ভবত শাহীমহলে এ মহিলাদের কে ডেকে এনে এ জবানবন্দী নেয়া হয়েছিল। আবার এও হতে পারে যে, বাদশাহ নিজের কোন বিশেষ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এ স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন।
৪৫.
অনুমান করা যেতে পারে, এ স্বীকারোক্তিগুলো কিভাবে আট নয় বছর আগের ঘটনাবলীকে আবার নতুন করে তরতাজা করে দিয়েছিল, কিভাবে হযরত ইউসুফের ব্যক্তিত্ব কারাজীবনের দীর্ঘকালীন বিস্মৃতির পর আবার অকস্মাৎ বিপুলভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, কিভাবে মিসরের সমস্ত অভিজাত, মর্যাদাশালী ও মধ্যবিত্ত সমাজে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁর নৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ওপরে বাইবেল ও তালমূদের বরাত দিয়ে একথা বলা হয়েছে যে, বাদশাহ সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে সারা দেশের জ্ঞানীগুণী, আলেম ও পীরদের একত্র করেছিলেন এবং তারা সবাই তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয়েছিল। এরপর হযরত ইউসুফ (আ) এর ব্যাখ্যা করেছিলেন। এ ঘটনার ফলে সারা দেশের জনতার দৃষ্টি আগে থেকেই তাঁর প্রতি নিবদ্ধ হয়েছিল। তারপর বাদশাহর তলবনামা পেয়ে যখন তিনি জেলখানা থেকে বাইরে আসতে অস্বীকার করলেন তখন সমগ্র দেশবাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, এ আবার কেমন অদ্ভূত প্রকৃতির উচ্চ মনোবল সম্পন্ন মানুষ, যাকে আট নয় বছরের কারাবাসের পর বাদশাহ নিজেই মেহেরবানী করে ডাকছেন এবং তারপরও তিনি ব্যাকুল চিত্তে দৌঁড়ে আসছেন না! তারপর যখন তারা ইউসুফের নিজের কারামুক্তির এবং বাদশাহর সাথে দেখা করতে আসার জন্য পেশকৃত শর্তাবলী শুনালো তখন সবার দৃষ্টি এ অনুসন্ধান ও তদন্তের ফলাফলের প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়ে রইল। এরপর যখন লোকেরা এর ফলাফল শুনলো তখন দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এই বলে বাহবা দিল যে, আহা! এ ব্যক্তি কেমন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবন ও চরিত্রের অধিকারী! কাল যারা নিজেদের সমবেত প্রচেষ্টায় তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছিল আজ তাঁর চারিত্রিক নিষ্কলুষতার পক্ষে তারাই সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে একথা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, সে সময় হযরত ইউসুফের উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠার জন্য কেমন অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাদশাহর সাথে সাক্ষাতের সময় হযরত ইউসুফ হঠাৎ কেমন করে তাকে দেশের অর্থ-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দান করার দাবী জানিয়েছিলেন এবং বাদশাহ কেন নির্দ্ধিধায় তা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন একথা আর মোটেই বিস্ময়কর ঠেকে না। ব্যাপার যদি শুধু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো যে কারাগারের একজন বন্দী বাদশাহর একটি স্বপ্নের তা’বীর বলে দিয়েছিলেন তাহলে এজন্য তিনি বড়জোর কোন পুরস্কারের এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের অধিকারী হতে পারতেন। কিন্তু শুধুমাত্র এতটুকুন কথায় তিনি বাদশাহকে বলবেন, “আমাকে দেশের যাবতীয় অর্থ-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দান করো” এবং বাদশাহ বলে দেবেন “নাও, সবকিছু তোমার জন্য হাযির” ---এটা যথেষ্ট হতে পারতো না।
৪৬.
একথা সম্ভবত হযরত ইউসুফ তখনই বলে থাকবেন যখন কারাগারে তাঁকে তদন্তের ফলাফল জানিয়ে দেয়া হয়ে থাকবে। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসীরের মতো বড় বড় মুফাস্সিরসহ আরো কোন কোন তাফসীরকার এ বাক্যটিতে হযরত ইউসুফের নয় বরং আযীযের স্ত্রীর বক্তব্যের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এ বাক্যটি আযীযের স্ত্রীর উক্তির সাথে সংযুক্ত এবং মাঝখানে এমন কোন শব্দ নেই যা থেকে একথা মনে করা যেতে পারে যে, إِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ এ এসে আযীযের স্ত্রীর কথা শেষ হয়ে গেছে এবং পরবর্তী কথা হযরত ইউসুফ বলেছেন। তাঁরা বলেন, দু’টি লোকের কথা যদি পরস্পরের সাথে সংলগ্ন থাকে এবং এটা অমুকের কথা ও ওটা অমুকের কথা--- এ বিষয়টি যদি সুস্পষ্ট না থাকে তাহলে এ অবস্থায় অবশ্যি এমন কোন চিহ্ন থাকা উচিত যা উভয় কথার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। কিন্তু এখানে এ ধরনের কোন পার্থক্য চিহ্ন নেই। কাজেই একথা মেনে নিতে হবে যে, الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ থেকে শুরু করে إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَحِيمٌ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বক্তব্যটি আযীযের স্ত্রীর। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এ বিষয়টি কেমন করে ইবনে তাইমিয়ার মতো সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিরও দৃষ্টির অগোচরে থেকে গেলো যে, কথা বলার ধরণ ও ভংগী নিজেই একটি বড় পার্থক্য চিহ্ন এবং এর উপস্থিতিতে আর কোন পার্থক্য চিহ্নের প্রয়োজনই হয় না। প্রথম বাক্যটি অবশ্যি আযীযের স্ত্রীর মুখে সাজে কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটিও কি তার মুখে খাপ খায়? দ্বিতীয় বাক্যের প্রকাশভংগী তো পরিষ্কার জানাচ্ছে যে, আযীযের স্ত্রী নয় হযরত ইউসুফই তার প্রবক্তা। এ বাক্যে যে সৎহৃদয়বৃত্তি, উচ্চ মনোভাব, বিনয় ও আল্লাহভীতি সোচ্চার তা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তা এমন এক নারীর কন্ঠে উচ্চারিত হতে পারে না যে কন্ঠে ইতিপূর্বে هَيْتَ لَكَ (এসে যাও) উচ্চারিত হয়েছিল, যে কন্ঠ থেকে ইতিপূর্বে বের হয়েছিল مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا (যে ব্যক্তি তোমার স্ত্রীকে কুকর্মে লিপ্ত করতে চায় তার শাস্তি কি?)

এর মতো মিথ্যা ভাষণ এবং যে কন্ঠে প্রকাশ্য মাহফিলে لئن لم يفعلما امره ليسجنن (যদি সে আমার কথা মতো কাজ না করে তাহলে তাকে কারাগারে পাঠানো হবে) –এর মতো হুমকি উচ্চারিত হয়েছিল। এমন ধরনের পবিত্র বাক্য কেবলমাত্র এমনি এক কন্ঠে উচ্চারিত হতে পারতো যে কন্ঠে ইতিপূর্বে معاذ الله انه ربى احسن مثواى (আল্লাহর পানাহ চাই, তিনি আমার রব, তিনি আমাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন) এ ধরনের সকৃতজ্ঞ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, যে কন্ঠে ইতিপূর্বে رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ (হে আমার রব! এরা আমাকে যে পথে চলার জন্য ডাকছে তার চেয়ে কারাগার আমার কাছে ভালো।)--- এর মতো সৎপথে অটল থাকার দৃঢ় মনোবৃত্তির ঘোষণা দিয়েছিল এবং যে কণ্ঠ ইতিপূর্বে إِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ (হে আল্লাহ! যদি তুমি আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার না করো তাহলে আমি তাদের জালে আটকে যাবো) এর মতো সমর্পিত প্রাণ বান্দার আকুতি ধ্বনিত হয়েছিল। এ ধরনের পবিত্র বাণীকে সত্যনিষ্ঠ-সত্যবাদী ইউসুফের পরিবর্তে আযীযের স্ত্রীর উক্তি বলে মেনে নেয়া ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কোন আলামত বা চিহ্ন না পাওয়া যায় যা থেকে প্রমাণ হয় এ পর্যায়ে পৌঁছে আযীযের স্ত্রী তাওবা করে ঈমান এনেছিল এবং নিজের প্রবৃত্তি ও আচরণ সংশোধন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন কোন আলামত ও নিদর্শন পাওয়া যায় না।

.
অনুবাদ: