আল ফাতিহা
৭ আয়াত
আল বাকারাহ
২৮৬ আয়াত
আলে ইমরান
২০০ আয়াত
আন্ নিসা
১৭৬ আয়াত
আল মায়েদাহ
১২০ আয়াত
আল আন'আম
১৬৫ আয়াত
আল আরাফ
২০৬ আয়াত
আল আনফাল
৭৫ আয়াত
আত তওবা
১২৯ আয়াত
১০
ইউনুস
১০৯ আয়াত
১১
হুদ
১২৩ আয়াত
১২
ইউসুফ
১১১ আয়াত
১৩
আর্ রাদ
৪৩ আয়াত
১৪
ইবরাহীম
৫২ আয়াত
১৫
আল হিজর
৯৯ আয়াত
১৬
আন্ নাহল
১২৮ আয়াত
১৭
বনী ইসরাঈল
১১১ আয়াত
১৮
আল কাহফ
১১০ আয়াত
১৯
মারয়াম
৯৮ আয়াত
২০
ত্বাহা
১৩৫ আয়াত
২১
আল আম্বিয়া
১১২ আয়াত
২২
আল হাজ্জ
৭৮ আয়াত
২৩
আল মুমিনূন
১১৮ আয়াত
২৪
আন্ নূর
৬৪ আয়াত
২৫
আল-ফুরকান
৭৭ আয়াত
২৬
আশ্-শু’আরা
২২৭ আয়াত
২৭
আন নামল
৯৩ আয়াত
২৮
আল কাসাস
৮৮ আয়াত
২৯
আল আনকাবূত
৬৯ আয়াত
৩০
আর রূম
৬০ আয়াত
৩১
লুকমান
৩৪ আয়াত
৩২
আস সাজদাহ
৩০ আয়াত
৩৩
আল আহযাব
৭৩ আয়াত
৩৪
আস সাবা
৫৪ আয়াত
৩৫
ফাতের
৪৫ আয়াত
৩৬
ইয়া-সীন
৮৩ আয়াত
৩৭
আস্ সা-ফফা-ত
১৮২ আয়াত
৩৮
সা-দ
৮৮ আয়াত
৩৯
আয যুমার
৭৫ আয়াত
৪০
আল মুমিন
৮৫ আয়াত
৪১
হা-মীম আস সাজদাহ
৫৪ আয়াত
৪২
আশ শূরা
৫৩ আয়াত
৪৩
আয্ যুখরুফ
৮৯ আয়াত
৪৪
আদ দুখান
৫৯ আয়াত
৪৫
আল জাসিয়াহ
৩৭ আয়াত
৪৬
আল আহক্বাফ
৩৫ আয়াত
৪৭
মুহাম্মদ
৩৮ আয়াত
৪৮
আল ফাতহ
২৯ আয়াত
৪৯
আল হুজুরাত
১৮ আয়াত
৫০
ক্বাফ
৪৫ আয়াত
৫১
আয যারিয়াত
৬০ আয়াত
৫২
আত তূর
৪৯ আয়াত
৫৩
আন নাজম
৬২ আয়াত
৫৪
আল ক্বামার
৫৫ আয়াত
৫৫
আর রহমান
৭৮ আয়াত
৫৬
আল ওয়াকি’আ
৯৬ আয়াত
৫৭
আল হাদীদ
২৯ আয়াত
৫৮
আল মুজাদালাহ
২২ আয়াত
৫৯
আল হাশর
২৪ আয়াত
৬০
আল মুমতাহিনা
১৩ আয়াত
৬১
আস সফ
১৪ আয়াত
৬২
আল জুমআ
১১ আয়াত
৬৩
আল মুনাফিকুন
১১ আয়াত
৬৪
আত তাগাবুন
১৮ আয়াত
৬৫
আত তালাক
১২ আয়াত
৬৬
আত তাহরীম
১২ আয়াত
৬৭
আল মুলক
৩০ আয়াত
৬৮
আল কলম
৫২ আয়াত
৬৯
আল হাককাহ
৫২ আয়াত
৭০
আল মাআরিজ
৪৪ আয়াত
৭১
নূহ
২৮ আয়াত
৭২
আল জিন
২৮ আয়াত
৭৩
আল মুযযাম্মিল
২০ আয়াত
৭৪
আল মুদ্দাস্সির
৫৬ আয়াত
৭৫
আল কিয়ামাহ
৪০ আয়াত
৭৬
আদ্ দাহর
৩১ আয়াত
৭৭
আল মুরসালাত
৫০ আয়াত
৭৮
আন নাবা
৪০ আয়াত
৭৯
আন নাযি’আত
৪৬ আয়াত
৮০
আবাসা
৪২ আয়াত
৮১
আত তাকবীর
২৯ আয়াত
৮২
আল ইনফিতার
১৯ আয়াত
৮৩
আল মুতাফফিফীন
৩৬ আয়াত
৮৪
আল ইনশিকাক
২৫ আয়াত
৮৫
আল বুরূজ
২২ আয়াত
৮৬
আত তারিক
১৭ আয়াত
৮৭
আল আ’লা
১৯ আয়াত
৮৮
আল গাশিয়াহ
২৬ আয়াত
৮৯
আল ফজর
৩০ আয়াত
৯০
আল বালাদ
২০ আয়াত
৯১
আশ শামস
১৫ আয়াত
৯২
আল লাইল
২১ আয়াত
৯৩
আদ দুহা
১১ আয়াত
৯৪
আলাম নাশরাহ
৮ আয়াত
৯৫
আত তীন
৮ আয়াত
৯৬
আল আলাক
১৯ আয়াত
৯৭
আল কাদ্‌র
৫ আয়াত
৯৮
আল বাইয়েনাহ
৮ আয়াত
৯৯
আল যিলযাল
৮ আয়াত
১০০
আল আদিয়াত
১১ আয়াত
১০১
আল কারি’আহ
১১ আয়াত
১০২
আত তাকাসুর
৮ আয়াত
১০৩
আল আসর
৩ আয়াত
১০৪
আল হুমাযা
৯ আয়াত
১০৫
আল ফীল
৫ আয়াত
১০৬
কুরাইশ
৪ আয়াত
১০৭
আল মাউন
৭ আয়াত
১০৮
আল কাউসার
৩ আয়াত
১০৯
আল কাফিরূন
৬ আয়াত
১১০
আন নসর
৩ আয়াত
১১১
আল লাহাব
৫ আয়াত
১১২
আল ইখলাস
৪ আয়াত
১১৩
আল ফালাক
৫ আয়াত
১১৪
আন নাস
৬ আয়াত

আল আরাফ

২০৬ আয়াত

৩১ ) হে বনী আদম! প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও। ২০ আর খাও ও পান করো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেয়ো না, আল্লাহ‌ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না। ২১
۞ يَـٰبَنِىٓ ءَادَمَ خُذُوا۟ زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍۢ وَكُلُوا۟ وَٱشْرَبُوا۟ وَلَا تُسْرِفُوٓا۟ ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلْمُسْرِفِينَ ٣١
৩২ ) হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ‌ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সৌন্দর্য সামগ্রী সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো কে হারাম করেছে? আর আল্লাহর দেয়া পবিত্র জিনিসগুলো কে নিষিদ্ধ করেছে? ২২ বলো, দুনিয়ার জীবনেও এ সমস্ত জিনিস ঈমানদারদের জন্য, আর কিয়ামতের দিনে এগুলো তো একান্তভাবে তাদেরই জন্য হবে। ২৩ এভাবে যারা জ্ঞানের অধিকারী তাদের জন্য আমার কথাগুলো আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণনা করে থাকি।
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِىٓ أَخْرَجَ لِعِبَادِهِۦ وَٱلطَّيِّبَـٰتِ مِنَ ٱلرِّزْقِ ۚ قُلْ هِىَ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا خَالِصَةًۭ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ ۗ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلْـَٔايَـٰتِ لِقَوْمٍۢ يَعْلَمُونَ ٣٢
৩৩ ) হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ‌ যেসব জিনিস হারাম করেছেন সেগুলো হচ্ছেঃ প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, ২৪ গোনাহ, ২৫ সত্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি, ২৬ আল্লাহর সাথে তোমাদের কাউকে শরীক করা, যার স্বপক্ষে তিনি কোন সনদ পাঠাননি এবং আল্লাহর নামে তোমাদের এমন কোন কথা বলা, যা মূলত তিনি বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই।
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّىَ ٱلْفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَٱلْإِثْمَ وَٱلْبَغْىَ بِغَيْرِ ٱلْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا۟ بِٱللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِۦ سُلْطَـٰنًۭا وَأَن تَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ٣٣
৩৪ ) প্রত্যেক জাতির জন্য অবকাশের একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। তারপর যখন কোন জাতির সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যও তাকে বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হবে না। ২৭
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌۭ ۖ فَإِذَا جَآءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةًۭ ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ ٣٤
৩৫ ) (আর সৃষ্টির সূচনাপর্বেই আল্লাহ‌ একথা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেনঃ) হে বনী আদম! মনে রেখো, যদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কোন রসূল এসে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে থাকে, তাহলে যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের কর্মনীতির সংশোধন করে নেবে, তার কোন ভয় এবং দুঃখের কারণ নেই।
يَـٰبَنِىٓ ءَادَمَ إِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ رُسُلٌۭ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ ءَايَـٰتِى ۙ فَمَنِ ٱتَّقَىٰ وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ٣٥
৩৬ ) আর যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা বলবে এবং তার সাথে বিদ্রোহাত্মাক আচরণ করবে, তারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল। ২৮
وَٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا وَٱسْتَكْبَرُوا۟ عَنْهَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلنَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَـٰلِدُونَ ٣٦
৩৭ ) একথা সুস্পষ্ট, যে ব্যক্তি ডাহা মিথ্যা কথা বানিয়ে আল্লাহর কথা হিসেবে প্রচার করে অথবা আল্লাহর সত্য আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে? এ ধরনের লোকেরা নিজেদের তকদীরের লিখন অনুযায়ী তাদের অংশ পেতে থাকবে, ২৯ অবশেষে সেই সময় উপস্থিত হবে যখন আমার পাঠানো ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করার জন্য তাদের কাছে এসে যাবে। সে সময় তারা (ফেরেশতারা) তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, বলো, এখন তোমাদের সেই মাবুদরা কোথায়, যাদেরকে তোমরা ডাকতে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে? তারা বলবে, “সবাই আমাদের কাছ থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে” এবং তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, বাস্তবিক পক্ষেই তারা সত্য অস্বীকারকারী ছিল।
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِـَٔايَـٰتِهِۦٓ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ يَنَالُهُمْ نَصِيبُهُم مِّنَ ٱلْكِتَـٰبِ ۖ حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءَتْهُمْ رُسُلُنَا يَتَوَفَّوْنَهُمْ قَالُوٓا۟ أَيْنَ مَا كُنتُمْ تَدْعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ ۖ قَالُوا۟ ضَلُّوا۟ عَنَّا وَشَهِدُوا۟ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا۟ كَـٰفِرِينَ ٣٧
৩৮ ) আল্লাহ বলবেনঃ যাও, তোমরাও সেই জাহান্নামে চলে যাও, যেখানে চলে গেছে তোমাদের পূর্বের অতিক্রান্ত জ্বীন ও মানবগোষ্ঠী। প্রত্যেকটি দলই নিজের পূর্ববর্তী দলের প্রতি অভিসম্পাত করতে করতে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অবশেষে যখন সবাই সেখানে একত্র হয়ে যাবে তখন পরবর্তী প্রত্যেকটি দল পূর্ববর্তী দলের ব্যাপারে বলবে, হে আমাদের রব! এরাই আমাদের গোমরাহ করেছে, কাজেই এদেরকে আগুনের দ্বিগুণ শাস্তি দাও। জওয়াবে বলা হবে, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ শাস্তিই রয়েছে কিন্তু তোমরা জানো না। ৩০
قَالَ ٱدْخُلُوا۟ فِىٓ أُمَمٍۢ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُم مِّنَ ٱلْجِنِّ وَٱلْإِنسِ فِى ٱلنَّارِ ۖ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌۭ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا ۖ حَتَّىٰٓ إِذَا ٱدَّارَكُوا۟ فِيهَا جَمِيعًۭا قَالَتْ أُخْرَىٰهُمْ لِأُولَىٰهُمْ رَبَّنَا هَـٰٓؤُلَآءِ أَضَلُّونَا فَـَٔاتِهِمْ عَذَابًۭا ضِعْفًۭا مِّنَ ٱلنَّارِ ۖ قَالَ لِكُلٍّۢ ضِعْفٌۭ وَلَـٰكِن لَّا تَعْلَمُونَ ٣٨
৩৯ ) প্রথম দলটি দ্বিতীয় দলকে বলবেঃ (যদি আমরা দোষী হয়ে থাকি) তাহলে তোমরা কোন দিক দিয়ে আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ ছিলে? এখন নিজেদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো। ৩১
وَقَالَتْ أُولَىٰهُمْ لِأُخْرَىٰهُمْ فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِن فَضْلٍۢ فَذُوقُوا۟ ٱلْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْسِبُونَ ٣٩
৪০ ) নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তাদের জন্য কখনো আকাশের দরজা খুলবে না। তাদের জান্নাতে প্রবেশ এমনই অসম্ভব ব্যাপার যেমন সূঁচের ছিদ্রে উট প্রবেশ করানো। অপরাধীরা আমার কাছে এভাবেই বদলা পেয়ে থাকে।
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا وَٱسْتَكْبَرُوا۟ عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَٰبُ ٱلسَّمَآءِ وَلَا يَدْخُلُونَ ٱلْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ ٱلْجَمَلُ فِى سَمِّ ٱلْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُجْرِمِينَ ٤٠
২০.
এখানে সুন্দর সাজ বলতে পূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য দাঁড়াবার সময় কেবল মাত্র লজ্জাস্থান ঢাকাই যথেষ্ট হবে না। বরং একই সঙ্গে সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের পূর্ণ পোশাক পরে নিতে হবে, যার মাধ্যমে লজ্জাস্থান আবৃত হবার সাথে সাথে সৌন্দর্যের প্রকাশও ঘটবে। মূর্খ ও অজ্ঞ লোকেরা নিজেদের ভ্রান্তনীতির ভিত্তিতে ইবাদতের ক্ষেত্রে যেসব কাজ করতো এবং এখনো করে চলছে, এ নির্দেশে তার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা মনে করতো উলংগ বা অর্ধ-উলংগ হয়ে এবং নিজেদের আকার, আকৃতিও বেশভূষা বিকৃত করে আল্লাহর ইবাদাত করা উচিত। আল্লাহ‌ বলেন, নিজেকে সুন্দর সাজে সজ্জিতকরে এমন আকার আকৃতি ধারণ করে ইবাদাত করতে হবে যার মধ্যে উলংগপনা তো দূরের কথা অশ্লীলতার লেশমাত্রও যেন না পাওয়া যায়।
২১.
অর্থাৎ তোমাদের দৈন্যদশা, অনাহারক্লিষ্ট জীবন এবং হালাল জীবিকা থেকে বঞ্চিত থাকা আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়। তাঁর বন্দেগী করার জন্য তোমাদের কোন পর্যায়ে এসবের শিকার হতে হোক-এটা তিনি চান না। বরং তোমরাতার দেয়া উত্তম পোশাক পরলে এবং পবিত্র ও হালাল খাবার খেলে তিনি খুশী। মানুষ যখন হালালকে হারাম করার বা হারামকে হালাল করার জন্য তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে তখনি সেটা তাঁরশরীয়াতে আসল গোনাহ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
২২.
এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ‌ তো তাঁর দুনিয়ার সমস্ত শোভা-সৌন্দর্য এবং সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস তাঁর বান্দাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কাজেই এগুলো বান্দাদের জন্য হারাম করে দেয়া কখনো তার উদ্দেশ্য হতে পারে না। এখন যদি কোন ধর্ম বা নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা এগুলোকেহারাম, ঘৃণ্য অথবা আত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক গণ্য করে তাহলে তার এ কাজটিই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। বাতিল ধর্মমতগুলোর বিরুদ্ধে কুরআন যেসব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছে এটি তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি। বস্তুত কুরআনের যুক্তি উপস্থাপন পদ্ধতি অনুধাবন করার জন্য এ যুক্তিটি অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য।
২৩.
অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সৃষ্ট সমস্ত জিনিস দুনিয়ার জীবনেও ঈমানদারদের জন্যই। কারণ তারাই আল্লাহর বিশ্বস্ত প্রজা। আর একমাত্র নিমকহালাল, বিশ্বস্ত ও অনুগত লোকেরাই অনুগ্রহলাভের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থাপনা যেহেতু পরীক্ষা ও অবকাশদানের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই এখানে অধিকাংশ সময় আল্লাহর অনুগ্রহগুলো নিমকহারাম ও অকৃতজ্ঞদের মধ্যেও বন্টিত হতে থাকে। আর অনেক সময় বিশ্বস্ত ও নিমক হালালদের তুলনায় তাদের ওপরই বেশী অনুগ্রহ বর্ষণ করা হয়ে থাকে। তবে আখেরাত (যেখানকার সমস্ত ব্যবস্থাপনা হক, সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে) জীবনের আরাম আয়েশের সমস্ত উপকরণ এবং সমস্ত পবিত্র খাদ্য ও পানীয় একমাত্র অনুগত, কৃতজ্ঞ ও নিমকহালাল বান্দাদের জন্যই নির্ধারিত থাকবে। যেসব নিমকহারাম বান্দা তাদের রবের দেয়া খাদ্য-পানীয়ে জীবন ধারণ করার পরও তাঁরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়েছে তারা এর থেকে কোন অংশই পাবে না।
২৪.
ব্যাখ্যার জন্য সূরা আন’আমের ১২৮ও ১৩১টীকা দেখুন।
২৫.
এখানে মূল শব্দ হচ্ছে,إِثْمَ (ইসম)। এর আসল অর্থ হচ্ছে, ত্রুটি-বিচ্যুতি। اثمةইসমাহ এমন এক ধরনের উটনীকে বলা হয়, যে দ্রুত চলতে পারে কিন্তু জেনে বুঝে অলসভাবে চলে। এ থেকেই এ শব্দের মধ্যে গোনাহের ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যখন নিজের রবের আনুগত্য করার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার ক্ষমতা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গড়িমসি ও গাফিলতি করে এবং জেনে বুঝে ভুল-ত্রুটি করে তার সন্তুষ্টি লাভেঅসমর্থ হয়, তখন সেই আচরণটিকেই গোনাহ বলা হয়।
২৬.
অর্থাৎ নিজের সীমানা অতিক্রম করে এমন একটি সীমানায় পদার্পণকরা যেখানে প্রবেশ করার অধিকার মানুষের নেই। এ সংজ্ঞার আলোকে বিচার করলে যারা বন্দেগীর সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর রাজ্যেস্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও আচরণ গ্রহণ করে, যারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে থেকেও নিজেদের অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের ডংকা বাজায় এবং যারা মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তারা সবাই বিদ্রোহী গণ্য হয়।
২৭.
অবকাশের সময় নির্দিষ্ট করার মানে এ নয় যে, প্রত্যেক জাতির জন্য বছর, মাস, দিন ধরে একটি আয়ুস্কাল নির্দিষ্ট করা হয় এবং এ সময়টি শেষ হয়ে যেতেই তাকে অবশ্যিই খতম করে দেয়া হয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক জাতিকে দুনিয়ায় কাজ করার যে সুযোগ দেয়া হয়, তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভাল ও মন্দের আনুপাতিক হার কমপক্ষে কতটুকু বরদাশত করা যেতে পারে, এ অর্থে তার কাজ করার একটি নৈতিক সীমানা চিহ্নিত করা হয়। যতদিন একটি জাতির মন্দ গুণগুলো তার ভাল গুণাবলীর তুলনায় ঐ আনুপাতিক হারের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অবস্থান করতে থাকে ততদিন তাকে তার সমস্ত অসৎকর্ম সত্ত্বেও অবকাশ দেয়া হয়, আর যখন তা ঐ সর্বশেষ সীমানা পার হয়ে যায় তখন এ ধরনের অসৎ বৃত্তিসম্পন্ন ও অসৎকর্মশীল জাতিকে আর কোন বাড়তি অবকাশ দেয়া হয়না। (সূরা নূহের ৪-১০-১২ আয়াত দ্রষ্টব্য)।
২৮.
কুরআন মজীদের যেখানেই আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামের জান্নাত থেকে নামিয়ে দেবার ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে (যেমন দেখুন সূরা আল বাকারার ৪ রুকূ ও সূরা তা-হা এর ৬ রুকূ) সেখানেই একথা বলা হয়েছে। কাজেই এখানেও এটিকে এই একই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত মনে করা হবে। অর্থাৎ যখন মানব জাতির জীবনের সূচনা হচ্ছিল ঠিক তখনই একথাটি পরিষ্কাভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। (দেখুন সূরা আলে ইমরান, ৬৯ টীকা)
২৯.
অর্থাৎ দুনিয়ায় যতদিন তাদের অবকাশের মেয়াদ নির্ধারিত থাকবে ততদিন তারা এখানে থাকবে এবং যে ধরনের ভাল বা মন্দ জীবন যাপন করার কথা তাদের নসীবে লেখা থাকবে, সেই ধরনের জীবন তারা যাপন করবে।
৩০.
অর্থাৎ সর্বাবস্থায় তোমাদের প্রত্যেকটি দল কোন না কোন দলের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী দল ছিল। কোন দলের পূর্ববর্তী দল উত্তরাধিকার হিসেবে যদি তার জন্য ভুল ও বিপথগামী চিন্তা ও কর্ম রেখে গিয়ে থাকে, তাহলে সে নিজেও তো তার পরবর্তীদের জন্য একই ধরনের উত্তরাধীকার রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। যদি একটি দলের পথভ্রষ্ট হবার কিছুটা দায়-দায়িত্ব তার পূর্ববর্তীদের ওপর বর্তায়, তাহলে তার পরবর্তীদের পথভ্রষ্ট হবার বেশ কিছু দায়-দায়িত্ব তার নিজের ওপরও বর্তায়। তাই বলা হয়েছে প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ শাস্তিই রয়েছে। একটি শাস্তি হচ্ছে, নিজের ভুল পথ অবলম্বনের এবং অন্য শাস্তিটি অন্যদেরকে ভুল পথ দেখাবার। একটি শাস্তি নিজের অপরাধের এবং অন্য শাস্তিটি অন্যদের জন্য পূর্বাহ্নের অপরাধের উত্তরাধিকার রেখে আসার।

এ বিষয়বস্তুটিকে হাদীসে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ

وَمَنِ ابْتَدَعَ بِدْعَةَ ضَلاَلَةٍ لاَ يَرْضَاهَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ كَانَعَلَيْهِ مِنَ الاثمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ عَمِلَ بِهَا لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أَوْزَارِهِم شَيْئًا-

“যে ব্যক্তি আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল অপছন্দ করেন এমন কোন নতুন বিভ্রান্তিকর কাজের সূচনা করে, তার ঘাড়ে সেই সমস্ত লোকের পথভ্রষ্টতার গোনাহও চেপে বসবে, যারা তার উদ্ভাবিত পথে চলেছে। তবে এ জন্য ঐ লোকেদের নিজেদের দায়-দায়িত্ব মোটেই লাঘব হবে না।”

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ

لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا لأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ-

“এই দুনিয়ায় যে ব্যক্তিকেই অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, সেই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের পাপের একটি অংশ হযরত আদমের সেই প্রথম সন্তানটির আমলনামায় লিখিত হয়, যে তার ভাইকে হত্যা করেছিল। কারণ মানুষ হত্যার পথ সে-ই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করেছিল।”

এ থেকে জানা যায়, যে ব্যক্তি বা দল কোন ভুল চিন্তা বা কর্মনীতির ভিত্ রচনা করে সে কেবল নিজের ভুলের ও গোনাহের জন্য দায়ী হয় না বরং দুনিয়ায় যতগুলো লোক তার দ্বারা প্রভাবিত হয় তাদের সবার গোনাহের দায়িত্বের একটি অংশও তার আমলনামায় লিখিত হতে থাকে। যতদিন তার এ গোনাহের প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে, ততদিন তার আমলনামায় গোনাহ লিখিত হতে থাকে। তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যে, প্রত্যেক ব্যক্তির নেকী বা গোনাহের দায়-দায়িত্ব কেবল তার নিজের ওপরই বর্তায় না বরং অন্যান্য লোকদের জীবনে তার নেকী ও গোনাহের কি প্রভাব পড়ে সেজন্য ও তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যভিচারীর কথাই ধরা যাক। যাদের শিক্ষা ও অনুশীলনের দোষে, যাদের সাহচর্যের প্রভাবে, যাদের খারাপ দৃষ্টান্ত দেখে এবং যাদের উৎসাহ দানের ফলে ঐ ব্যক্তির মধ্যে যিনা করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তারা সবাই তার যিনাকারী হয়ে গড়ে উঠার ব্যাপারে অংশীদার। আবার ঐ লোকগুলোও পূর্ববর্তী যেসব লোকদের কাছে থেকেই কুদৃষ্টি, কুচিন্তা, কুসংকল্প ও কুকর্মের প্ররোচনা উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করে তাদের কাঁধে পর্যন্তও তার দায়-দায়িত্ব গিয়ে পৌঁছায়। এমন কি এ ধারা অগ্রসর হতে হতে সেই প্রথম ব্যক্তিতে গিয়ে ঠেকে যে সর্বপ্রথম ভ্রান্ত পথে যৌন লালসা চরিতার্থ করে মানব জাতিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল। এ যিনাকারীর আমলনামার এ অংশটি তার সমকালীনদের ও পূর্ববর্তী লোকদের সাথে সম্পর্কিত। এছাড়া সে নিজেও নিজের যিনা ও ব্যভিচারের জন্য দায়ী। তাকে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তাকে যে বিবেকবোধ দান করা হয়েছিল, আত্মসংযমের যে শক্তি তার মধ্যে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল, সৎলোকদের কাছ থেকে সে ভাল-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের যে জ্ঞান লাভ করেছিল, তার সামনে সৎলোকদের যেসব দৃষ্টান্ত সমুজ্জ্বল ছিল, যৌন অসদাচারের অশুভ পরিণামের ব্যাপারে তার যেসব তথ্য জানা ছিল-সে সবের কোনটিকেও সে কাজে লাগায়নি। উপরন্তু সে নিজেকে কামনা বাসনার এমন একটি অন্ধ আবেগের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছিল যে কোন প্রকারে নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করাই ছিল যার অভিপ্রায়। তার আমলনামার এ অংশটি তার নিজের সাথে সম্পর্কিত। তারপর এ ব্যক্তি যে গোনাহ নিজে করেছে এবং যাকে স্বকীয় প্রচেষ্টায় লালন করে চলেছে, তাকে অন্য লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। কোথাও থেকে কোন যৌন রোগের জীবাণু নিজের মধ্যে বহন করে আনে, তারপর তাকে নিজের বংশধরদের মধ্যে এবং না জানি আরো যে কত শত বংশধরদের মধ্যে ছড়িয়ে কত শত লোকদের জীবন ধ্বংস করে তা একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। কোথাও নিজের শুক্রবীজ রেখে আসে। যে শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব তারই বহন করা উচিত ছিল, তাকে অন্য একজনের উপার্জনের অবৈধ অংশীদার, তার সন্তানদের অধিকার থেকে জোরপূর্বক হিস্সা গ্রহণকারী এবং তার উত্তরাধিকারে অবৈধ শরীক বানিয়ে দেয়। এ অধিকার হরণের ধারা চলতে থাকে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বহুদূর পর্যন্ত। কোন কুমারী মেয়েকে ফুসলিয়ে ব্যভিচারের পথে টেনে আনে এবং তার মধ্যে এমন অসৎ গুণাবলী সৃষ্টি করে যা তার থেকে অন্যদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে না জানি আরো কত দূর, কত পরিবার ও কত বংশধরদের মধ্যে পৌঁছে যায় এবং কত পরিবারে বিকৃতি আনে। নিজের সন্তান-সন্তুতি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের অন্যান্য লোকদের সামনে সে নিজের চরিত্রের একটি কুদৃষ্টান্ত পেশ করে এবং অসংখ্য লোকের চরিত্র নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এর প্রভাব চলতে থাকে দীর্ঘকালব্যাপী। ইনসাফের দাবী হচ্ছে, এ ব্যক্তি সমাজ দেহে যেসব বিকৃতি সৃষ্টি করলো সেগুলো তারই আমলনামায় লিখিত হওয়া উচিত এবং ততদিন পর্যন্ত লিখিত হওয়া উচিত যতদিন তার সরবরাহ করা অসৎ বৃত্তি ও অসৎকাজের ধারা দুনিয়ায় চলতে থাকে।

সৎকাজ ও পূর্ণকর্মের ব্যাপারটিও অনুরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আমরা নেকীর ও সৎকাজের যে উত্তরাধিকার লাভ করেছি তার প্রতিদান তাদের সবার পাওয়া উচিত, যারা সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়ে আমাদের যুগ পর্যন্ত ওগুলো আমাদের কাছে হস্তান্তর করার ব্যাপারে অংশ নিয়েছেন। এ উত্তরাধিকার নিয়ে তাকে সযত্নে হেফাজত করার ও তার উন্নতি বিধানের জন্য আমরা যেসব প্রচেষ্টা চালাবো ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবো তার প্রতিদান আমাদেরও পাওয়া উচিত। তারপর নিজেদের সৎ প্রচেষ্টার যেসব চিহ্ন ও প্রভাব আমরা দুনিয়ায় রেখে যাবো সেগুলোও আমাদের সৎকাজের হিসেবের খাতায় ততদিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লিখিত হওয়া উচিত যতদিন এ চিহ্ন ও প্রভাবগুলো দুনিয়ার বুকে অক্ষত থাকবে, মানব জাতির বংশধরদের মধ্যে এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকূল এর দ্বারা লাভবান হতে থাকবে।

প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তিই একথা স্বীকার করবেন যে, কুরআন মজীদ প্রতিদানের এই যে পদ্ধতি উপস্থাপন করেছে, একমাত্র এ পদ্ধতিতেই সঠিক ও পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ সত্যটি ভালভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হলে যারা প্রতিদানের জন্য এ দুনিয়ায় বর্তমান জীবনকেই যথেষ্ট মনে করেছে এবং যারা মনে করেছে যে, জন্মান্তরের মাধ্যমে মানুষকে তার কাজের পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া যেতে পারে তাদের সবার বিভ্রান্তিও সহজে দূর হয়ে যেতে পারে। আসলে এ উভয় দলই মানুষের কার্যকলাপ, তার প্রভাব, ফলাফল ও পরিণতির ব্যাপ্তি এবং ন্যায়সঙ্গত প্রতিদান ও তার দাবীসমূহ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। একজন লোকের বয়স এখন ষাট বছর। সে তার এ ষাট বছরের জীবনে ভাল-মন্দ যা কিছু করেছে না জানি উপরের দিকে কত দূর পর্যন্ত তার পূর্ব-পুরুষরা এ কাজের সাথে জড়িত এবং তাদের ওপর এর দায়িত্ব বর্তায়। আর তাদেরকে এর পুরস্কার বা শাস্তি দান করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তারপর এ ব্যক্তি আজ যে ভাল বা মন্দ কাজ করেছে তার মৃত্যু সাথে সাথেই তা বন্ধ হয়ে যাবে না বরং তার প্রভাব চলতে থাকবে আগামী শত শত বছর পর্যন্ত। হাজার হাজার, লাখো লাখো, বরং কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে। এর প্রভাব চলা ও বিস্তৃত হওয়া পর্যন্ত তার আমলনামার পাতা খোলা থাকবে। এ অবস্থায় আজই এ দুনিয়ার জীবনে এ ব্যক্তিকে তার উপার্জনের সম্পূর্ণ ফসল প্রদান করা কেমন করে সম্ভব? কারণ তার উপার্জনের এক লাখ ভাগের এক ভাগও এখনো অর্জিত হয়নি। তাছাড়া এ দুনিয়ার সীমিত জীবন ও এর সীমিত সম্ভাবনা আদতে এমন কোন অবকাশই রাখেনি যার ফলে এখানে কোন ব্যক্তি তার উপার্জনের পূর্ণ ফসল লাভ করতে পারে। মনে করুন, কোন ব্যক্তি দুনিয়ায় এক মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তার এ মারাত্মক অপকর্মের বিপুল বিষময় কুফল হাজার বছর পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যক্তির এ ধরনের অপরাধের কথা একবার কল্পনা করুন। এ দুনিয়ায় যত বড় ধরনের দৈহিক, নৈতিক, মানসিক অথবা বস্তুগত শাস্তি দেয়া সম্ভব, তার কোনটিও কি তার এ অপরাধের ন্যায়সঙ্গত পরিপূর্ণ শাস্তি হতে পারে? অনুরূপভাবে দুনিয়ার সবচাইতে বড় যে পুরস্কারের কথা কল্পনা করা যেতে পারে, তার কোনটিও কি এমন এক ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যে সারা জীবন মানবজাতির কল্যাণার্থে কাজ করে গেছে এবং হাজার হাজার বছর পর্যন্ত অসংখ্য মানব সন্তান যার প্রচেষ্টার ফসল থেকে লাভবান হয়ে চলেছে? যে ব্যক্তি কর্ম ও প্রতিদানের বিষয়টিকে এ দৃষ্টিতে বিচার করবে সে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করবে যে, কর্মফলের জন্য আসলে আর একটি জগতের প্রয়োজন, যেখানে পূর্বের ও পরের সমগ্র মানব গোষ্ঠি একত্র হবে, সকল মানুষের আমলনামা বন্ধ হয়ে যাবে, হিসেব গ্রহণ করার জন্য একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানময় আল্লাহ‌ বিচারের আসনে বসবেন এবং কর্মের পুরোপুরি প্রতিদান লাভ করার জন্য মানুষের কাছে সীমাহীন জীবন ও তার চারদিকে পুরস্কার ও শাস্তির অঢেল সম্ভাবনা বিরাজিত থাকবে।

আবার এই একই দিক সম্পর্কে চিন্তা করলে জন্মান্তরবাদীদের আর একটি মৌলিক ভ্রান্তির অপনোদনও হতে পারে। এ ভ্রান্তিটিই তাদের পুনর্জন্মের ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। তারা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি যে, মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত পঞ্চাশ বছরের জীবনের কর্মফল ভোগের জন্য তার চাইতে হাজার গুণ বেশী দীর্ঘ জীবনের প্রয়োজন হয়। অথচ পুনর্জন্মবাদের ধারণা মতে তার পরিবর্তে পঞ্চাশ বছরের জীবন শেষ হতেই দ্বিতীয় আর একটি দায়িত্বপূর্ণ জীবন, তারপর তৃতীয় জীবন এ দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায়। আবার এসব জীবনে পুনরায় শাস্তিযোগ্য বা পুরস্কারযোগ্য বহু কাজ করা হতে থাকে। এভাবে তো হিসেব চুকে যাওয়ার পরিবর্তে আরো বাড়তেই থাকবে এবং কোন দিন তা খতম হওয়া সম্ভব হবে না।

৩১.
জাহান্নামবাসীদের এ পারস্পরিক সংলাপ ও তর্ক-বিতর্ক কুরআন মজীদের আরো কয়েকটি স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা সাবা'র ৪ রুকূ’তে বলা হয়েছেঃ হায়! তোমরা যদি সেই সময়টি দেখতে পেতে যখন এ জালেমরা নিজেদের রবের সামনে দাঁড়াবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে থাকবে। যাদেরকে দুনিয়ায় দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তারা বড় ও শক্তিশালীর আসনে যারা বসেছিল তাদেরকে বলবেঃ তোমরা না থাকলে আমরা মু'মিন হতাম। বড় ও শক্তিশালীর আসনে যারা বসেছিল, তারা দুর্বল করে রাখা লোকদেরকে জবাব দেবেঃ তোমাদের কাছে যখন হেদায়াত এসেছিল তখন আমরা কি তা গ্রহণ করতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছিলাম? না, তা নয়, বরং তোমরা নিজেরাই অপরাধী ছিলে। এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা আবার কবে হেদায়াতের প্রত্যাশী ছিলে? আমরা যদি তোমাদেরকে দুনিয়ার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দাসে পরিণত করে থাকি, তাহলে তোমরা লোভী ছিলে বলেই তো আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছিলে। যদি আমরা তোমাদেরকে কিনে নিয়ে থাকি, তাহলে তোমরা নিজেরাই তো বিকোবার জন্য তৈরী ছিলে, তবেই না আমরা কিনতে পেরেছিলাম। যদি আমরা তোমাদেরকে বস্তুবাদ, বৈষয়িক লালসা, জাতিপূজা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন প্রকার গোমরাহী ও অসৎকাজে লিপ্ত করে থাকি, তাহলে তোমরা নিজেরাই তো আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দুনিয়ার পূজারী সেজেছিলে, তবেই না তোমরা আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বানকারীদেরকে ত্যাগ করে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। যদি আমরা তোমাদের ধর্মের আবরণে প্রতারিত করে থাকি, তাহলে যে জিনিসগুলো আমরা পেশ করছিলাম এবং তোমরা লুফে নিচ্ছিলে, সেগুলোর চাহিদা তো তোমাদের নিজেদের মধ্যেই ছিল। তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব প্রয়োজন পূরণকারী খুঁজে বেড়াচ্ছিলে, যারা তোমাদের কাছে কোন নৈতিক বিধানের আনুগত্যের দাবী না করেই কেবলমাত্র তোমাদের ইস্পিত কাজই করে যেতে থাকতো। আমরা সেই সব প্রয়োজন পুরণকারী তৈরী করে তোমাদেরকে দিয়েছিলাম। তোমরা আল্লাহর আদেশ নিষেধ থেকে বেপরোয়া হয়ে দুনিয়ার কুকুর হয়ে গিয়েছিলে এবং তোমাদের পাপ মোচনের জন্য এমন এক ধরনের সুপারিশকারী খুঁজে বেড়াচ্ছিলে যারা তোমাদের গোনাহ মাফ করিয়ে দেয়ার সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেবে। আমরা সেই সব সুপারিশকারী তৈরী করে তোমাদের কাছে সরবরাহ করেছিলাম। তোমরা নিরস ও স্বাদ-গন্ধহীন দ্বীনদারী, পরহেজগারী, কুরবানী এবং প্রচেষ্টা ও সাধনার পরিবর্তে নাজাত লাভের জন্য অন্য কোন পথের সন্ধান চাচ্ছিলে। তোমরা চাচ্ছিলে এ পথে তোমাদের প্রবৃত্তি ও লালসা চরিতার্থ করতে, নানা প্রকার স্বাদ আহরণ করতে কোন বাধা না থাকে এবং প্রবৃত্তি ও লালসা যেন সব রকমের বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত থাকে। আমরা এ ধরনের সুদৃশ্য ধর্ম উদ্ভাবন করে তোমাদের সামনে রেখেছিলাম। মোটকথা দায়-দায়িত্ব কেবল আমাদের একার নয়। তোমরাও এতে সমান অংশীদার। আমরা যদি গোমরাহী সরবরাহ করে থাকি, তাহলে তোমরা ছিলে তার খরিদ্দার।
অনুবাদ: