আল ফাতিহা
৭ আয়াত
আল বাকারাহ
২৮৬ আয়াত
আলে ইমরান
২০০ আয়াত
আন্ নিসা
১৭৬ আয়াত
আল মায়েদাহ
১২০ আয়াত
আল আন'আম
১৬৫ আয়াত
আল আরাফ
২০৬ আয়াত
আল আনফাল
৭৫ আয়াত
আত তওবা
১২৯ আয়াত
১০
ইউনুস
১০৯ আয়াত
১১
হুদ
১২৩ আয়াত
১২
ইউসুফ
১১১ আয়াত
১৩
আর্ রাদ
৪৩ আয়াত
১৪
ইবরাহীম
৫২ আয়াত
১৫
আল হিজর
৯৯ আয়াত
১৬
আন্ নাহল
১২৮ আয়াত
১৭
বনী ইসরাঈল
১১১ আয়াত
১৮
আল কাহফ
১১০ আয়াত
১৯
মারয়াম
৯৮ আয়াত
২০
ত্বাহা
১৩৫ আয়াত
২১
আল আম্বিয়া
১১২ আয়াত
২২
আল হাজ্জ
৭৮ আয়াত
২৩
আল মুমিনূন
১১৮ আয়াত
২৪
আন্ নূর
৬৪ আয়াত
২৫
আল-ফুরকান
৭৭ আয়াত
২৬
আশ্-শু’আরা
২২৭ আয়াত
২৭
আন নামল
৯৩ আয়াত
২৮
আল কাসাস
৮৮ আয়াত
২৯
আল আনকাবূত
৬৯ আয়াত
৩০
আর রূম
৬০ আয়াত
৩১
লুকমান
৩৪ আয়াত
৩২
আস সাজদাহ
৩০ আয়াত
৩৩
আল আহযাব
৭৩ আয়াত
৩৪
আস সাবা
৫৪ আয়াত
৩৫
ফাতের
৪৫ আয়াত
৩৬
ইয়া-সীন
৮৩ আয়াত
৩৭
আস্ সা-ফফা-ত
১৮২ আয়াত
৩৮
সা-দ
৮৮ আয়াত
৩৯
আয যুমার
৭৫ আয়াত
৪০
আল মুমিন
৮৫ আয়াত
৪১
হা-মীম আস সাজদাহ
৫৪ আয়াত
৪২
আশ শূরা
৫৩ আয়াত
৪৩
আয্ যুখরুফ
৮৯ আয়াত
৪৪
আদ দুখান
৫৯ আয়াত
৪৫
আল জাসিয়াহ
৩৭ আয়াত
৪৬
আল আহক্বাফ
৩৫ আয়াত
৪৭
মুহাম্মদ
৩৮ আয়াত
৪৮
আল ফাতহ
২৯ আয়াত
৪৯
আল হুজুরাত
১৮ আয়াত
৫০
ক্বাফ
৪৫ আয়াত
৫১
আয যারিয়াত
৬০ আয়াত
৫২
আত তূর
৪৯ আয়াত
৫৩
আন নাজম
৬২ আয়াত
৫৪
আল ক্বামার
৫৫ আয়াত
৫৫
আর রহমান
৭৮ আয়াত
৫৬
আল ওয়াকি’আ
৯৬ আয়াত
৫৭
আল হাদীদ
২৯ আয়াত
৫৮
আল মুজাদালাহ
২২ আয়াত
৫৯
আল হাশর
২৪ আয়াত
৬০
আল মুমতাহিনা
১৩ আয়াত
৬১
আস সফ
১৪ আয়াত
৬২
আল জুমআ
১১ আয়াত
৬৩
আল মুনাফিকুন
১১ আয়াত
৬৪
আত তাগাবুন
১৮ আয়াত
৬৫
আত তালাক
১২ আয়াত
৬৬
আত তাহরীম
১২ আয়াত
৬৭
আল মুলক
৩০ আয়াত
৬৮
আল কলম
৫২ আয়াত
৬৯
আল হাককাহ
৫২ আয়াত
৭০
আল মাআরিজ
৪৪ আয়াত
৭১
নূহ
২৮ আয়াত
৭২
আল জিন
২৮ আয়াত
৭৩
আল মুযযাম্মিল
২০ আয়াত
৭৪
আল মুদ্দাস্সির
৫৬ আয়াত
৭৫
আল কিয়ামাহ
৪০ আয়াত
৭৬
আদ্ দাহর
৩১ আয়াত
৭৭
আল মুরসালাত
৫০ আয়াত
৭৮
আন নাবা
৪০ আয়াত
৭৯
আন নাযি’আত
৪৬ আয়াত
৮০
আবাসা
৪২ আয়াত
৮১
আত তাকবীর
২৯ আয়াত
৮২
আল ইনফিতার
১৯ আয়াত
৮৩
আল মুতাফফিফীন
৩৬ আয়াত
৮৪
আল ইনশিকাক
২৫ আয়াত
৮৫
আল বুরূজ
২২ আয়াত
৮৬
আত তারিক
১৭ আয়াত
৮৭
আল আ’লা
১৯ আয়াত
৮৮
আল গাশিয়াহ
২৬ আয়াত
৮৯
আল ফজর
৩০ আয়াত
৯০
আল বালাদ
২০ আয়াত
৯১
আশ শামস
১৫ আয়াত
৯২
আল লাইল
২১ আয়াত
৯৩
আদ দুহা
১১ আয়াত
৯৪
আলাম নাশরাহ
৮ আয়াত
৯৫
আত তীন
৮ আয়াত
৯৬
আল আলাক
১৯ আয়াত
৯৭
আল কাদ্‌র
৫ আয়াত
৯৮
আল বাইয়েনাহ
৮ আয়াত
৯৯
আল যিলযাল
৮ আয়াত
১০০
আল আদিয়াত
১১ আয়াত
১০১
আল কারি’আহ
১১ আয়াত
১০২
আত তাকাসুর
৮ আয়াত
১০৩
আল আসর
৩ আয়াত
১০৪
আল হুমাযা
৯ আয়াত
১০৫
আল ফীল
৫ আয়াত
১০৬
কুরাইশ
৪ আয়াত
১০৭
আল মাউন
৭ আয়াত
১০৮
আল কাউসার
৩ আয়াত
১০৯
আল কাফিরূন
৬ আয়াত
১১০
আন নসর
৩ আয়াত
১১১
আল লাহাব
৫ আয়াত
১১২
আল ইখলাস
৪ আয়াত
১১৩
আল ফালাক
৫ আয়াত
১১৪
আন নাস
৬ আয়াত

আল আরাফ

২০৬ আয়াত

২১ ) আর সে কসম খেয়ে তাদেরকে বললো, আমি তোমাদের যথার্থ কল্যাণকামী।
وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّى لَكُمَا لَمِنَ ٱلنَّـٰصِحِينَ ٢١
২২ ) এভাবে প্রতারণা করে সে তাদের দু'জনকে ধীরে ধীরে নিজের পথে নিয়ে এলো। অবশেষে যখন তারা সেই গাছের ফল আস্বাদন করলো, তাদের লজ্জা স্থান পরস্পরের সামনে খুলে গেলো এবং তারা নিজেদের শরীর ঢাকতে লাগলো জান্নাতের পাতা দিয়ে। তখন তাদের রব তাদেরকে ডেকে বললোঃ “আমি কি তোমাদের এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদের বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?”
فَدَلَّىٰهُمَا بِغُرُورٍۢ ۚ فَلَمَّا ذَاقَا ٱلشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْءَٰتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ ٱلْجَنَّةِ ۖ وَنَادَىٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَن تِلْكُمَا ٱلشَّجَرَةِ وَأَقُل لَّكُمَآ إِنَّ ٱلشَّيْطَـٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّۭ مُّبِينٌۭ ٢٢
২৩ ) তারা দু'জন বলে উঠলোঃ “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।” ১৩
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلْخَـٰسِرِينَ ٢٣
২৪ ) তিনি বললেনঃ “নেমে যাও, ১৪ তোমরা পরস্পরের শত্রু এবং তোমাদের জন্য একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত পৃথিবীতেই রয়েছে বসবাসের জায়গা ও জীবন যাপনের উপকরণ।”
قَالَ ٱهْبِطُوا۟ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّۭ ۖ وَلَكُمْ فِى ٱلْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّۭ وَمَتَـٰعٌ إِلَىٰ حِينٍۢ ٢٤
২৫ ) আর বললেনঃ “সেখানেই তোমাদের জীবনযাপন করতে এবং সেখানেই মরতে হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের সবশেষে আবার বের করে আনা হবে।”
قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ ٢٥
২৬ ) হে বনী আদম! ১৫ তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি। আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম, সম্ভবত লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।
يَـٰبَنِىٓ ءَادَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًۭا يُوَٰرِى سَوْءَٰتِكُمْ وَرِيشًۭا ۖ وَلِبَاسُ ٱلتَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌۭ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ ءَايَـٰتِ ٱللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ ٢٦
২৭ ) হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্য তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি। ১৬
يَـٰبَنِىٓ ءَادَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ ٱلشَّيْطَـٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ ٱلْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْءَٰتِهِمَآ ۗ إِنَّهُۥ يَرَىٰكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُۥ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا ٱلشَّيَـٰطِينَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ ٢٧
২৮ ) তারা যখন কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন। ১৭ তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ‌ কখনো নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না। ১৮ তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না?
وَإِذَا فَعَلُوا۟ فَـٰحِشَةًۭ قَالُوا۟ وَجَدْنَا عَلَيْهَآ ءَابَآءَنَا وَٱللَّهُ أَمَرَنَا بِهَا ۗ قُلْ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَأْمُرُ بِٱلْفَحْشَآءِ ۖ أَتَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ٢٨
২৯ ) হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আমার রব তো সততা ও ইনসাফের হুকুম দিয়েছেন। তাঁর হুকুম হচ্ছে, প্রত্যেক ইবাদতে নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখো এবং নিজের দ্বীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্য করে নিয়ে তাঁকেই ডাকো। যেভাবে তিনি এখন তোমাদের সৃষ্টি করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তোমাদের আবার সৃষ্টি করা হবে। ১৯
قُلْ أَمَرَ رَبِّى بِٱلْقِسْطِ ۖ وَأَقِيمُوا۟ وُجُوهَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍۢ وَٱدْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ ۚ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ ٢٩
৩০ ) একটি দলকে তিনি সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্য দলটির ওপর গোমরাহী সত্য হয়ে চেপেই বসেছে। কারণ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানদেরকে নিজেদের অভিভাবকে পরিণত করেছে এবং তারা মনে করছে, আমরা সঠিক পথেই আছি।
فَرِيقًا هَدَىٰ وَفَرِيقًا حَقَّ عَلَيْهِمُ ٱلضَّلَـٰلَةُ ۗ إِنَّهُمُ ٱتَّخَذُوا۟ ٱلشَّيَـٰطِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُم مُّهْتَدُونَ ٣٠
১৩.
এ কাহিনীটি থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়ঃ

একঃ লজ্জা মানুষের একটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক অনুভূতি। মানুষ নিজের শরীরের বিশেষ স্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে প্রকৃতিগতভাবে যে লজ্জা অনুভব করে সেটি ঐ স্বাভাবিক অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ। কুরআন আমাদের জানায়, সভ্যতার ক্রমোন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এ লজ্জার সৃষ্টি হয়নি বা এটি বাইরের থেকে অর্জিত কোন জিনিসও নয়, যেমন শয়তানের কোন কোন সুচতুর শিষ্য ও অনুসারী অনুমান করে থাকে। বরং জন্মের প্রথমদিন থেকেই এ প্রকৃতিগত গুণটি মানুষের মধ্যে রয়েছে।

দুইঃ মানুষকে তার স্বভাব সুলভ সোজা-সরল পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য শয়তানের প্রথম কৌশলটি ছিল তার এ লজ্জার অনুভূতিতে আঘাত করা, উলংগতার পথ দিয়ে তার জন্য নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার দরজা খুলে দেয়া এবং যৌন বিষয়ে তাকে খারাপ পথে পরিচালিত করা। অন্য কথায়বলা যায়, প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্য তার যে দুর্বলতম স্থানটিকে সে বেছে নিয়েছিল সেটি ছিল তার জীবনের যৌন বিষয়ক দিক। যে লজ্জাকে মানবীয় প্রকৃতির দুর্গ রক্ষক হিসেবে মহান আল্লাহ‌ নিযুক্ত করেছিলেন তারই ওপর হেনেছে সে প্রথম আঘাতটি। শয়তান ও তার শিষ্যবর্গের এ কর্মনীতি আজো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেয়েদেরকে উলংগ করে প্রকাশ্য বাজারে না দাঁড় করানো পর্যন্ত তাদের “প্রগতির” কোন কার্যক্রম শুরুই হতে পারে না।

তিনঃ অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করে, এটাও মানুষের স্বভাবসুলভ প্রবণতা। সাধারণত তাকে নিজের জালে আবদ্ধ করার জন্য তাই প্রত্যেক অসৎকর্মের আহবায়ককে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে আসতে হয়।

চারঃ মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিষয়াবলী যেমন মানবিক পর্যায় থেকে উন্নতি করে উচ্চতর মার্গে পৌঁছার বা চিরন্তন জীবনলাভের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা থাকে। আর শয়তান তাকে ধোঁকা দেবার ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য অর্জন করে এ পথেই। সে মানুষের এ আকাংখাটির কাছে আবেদন জানায়। শয়তানের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হচ্ছে, সে মানুষের সামনে তাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার এবং বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থায় পৌঁছিয়ে দেবার টোপ ফেলে, তারপর তাকে এমন পথের সন্ধান দেয়, যা তাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

পাঁচঃ সাধারণভাবে একথাটির প্রচলিত হয়ে গেছে যে, শয়তান প্রথমে হযরত হাওয়াকে তার প্রতারণা জালে আবদ্ধ করে, তারপর হযরত আদমকে জালে আটকাবার জন্য তাকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু কুরআন এ ধারণা খণ্ডন করে। কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, শয়তান তাদের উভয়কেই ধোঁকা দেয় এবং তারা উভয়েই শয়তানের ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি মামুলী কথা বলে মনে হয়। কিন্তু যারা জানেন, হযরত হওয়া সম্পর্কিত এ সাধারণ্যে প্রচলিত বক্তব্যটি সারা দুনিয়ায় নারীর নৈতিক সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কত বড় ভূমিকা পালন করেছে একমাত্র তারাই কুরআনের এ বর্ণনার যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।

ছয়ঃ এরূপ ধারণা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই যে, নিষিদ্ধ গাছের এমন কোন বিশেষ গুণ ছিল, যেকারণে তার ফল মুখ দেবার সাথে সাথেই হযরত আদম ও হাওয়ার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল। আসলে এটি কেবল আল্লাহর নাফরমানিরই ফলশ্রুতি ছিল। আল্লাহ‌ ইতিপূর্বে নিজের ব্যবস্থাপনায় তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করেছিলেন। তারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাথে সাথেই তিনি তাদের ওপর থেকে নিজের হেফাজত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে নিয়েছিলেন, তাদের আবরণ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তারা যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে নিজেরাই নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ব্যবস্থা করুক। এ কাজের দায়িত্ব তাদের নিজেদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর যদি তারা প্রয়োজন মনে না করে অথবা এ জন্য প্রচেষ্টা না চালায় তাহলে তারা যেভাবেই বিচরণ করুক না কেন, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। এভাবে যেন চিরকালের জন্য এ সত্যটি প্রকাশ করে দেয়া হলো যে, মানুষ আল্লাহর নাফরমানী করলে একদিন না একদিনতার আবরণ উন্মুক্ত হয়ে যাবেই এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা ততদিন থাকবে যতদিন সে থাকবে আল্লাহর হুকুমের অনুগত। আনুগত্যের সীমানার বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে না। বরং তখন তাকে তার নিজের হাতেই সঁপে দেয়া হবে। বিভিন্ন হাদীসে নবী ﷺ এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং এ সম্পর্কে তিনি দোয়া করেছেন।

اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلاَ تَكِلْنِى إِلَى نَفْسِى طَرْفَةَ عَيْنٍ

“হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করি। কাজেই এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করে দিয়ো না।”

সাতঃ শয়তান একথা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে, তার মোকাবিলায় মানুষকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে সে তার যোগ্য নয়। কিন্তু প্রথম মোকাবিলায় সে পরাজিত হলো। সন্দেহ নেই, এ মোকাবিলায় মানুষ তার রবের নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে পূর্ণ সফলকাম হতে পারেনি এবং তার এ দুর্বলতাটিও প্রকাশ হয়ে পড়লো যে, তার পক্ষে নিজের প্রতিপক্ষের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হয়ে তার আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া সম্ভব। কিন্তু এ প্রথম মোকাবিলায় একথাও চূড়ান্ত ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মানুষ তার নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে একটি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। প্রথমত শয়তান নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিল। আর মানুষ নিজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করেনি বরং শ্রেষ্ঠত্ব তাকে দান করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত শয়তান নির্জলা অহংকার ও আত্মাম্ভরিতার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। অন্যদিকে মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেনি। বরং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এতে প্রবৃত্ত হয়। অসৎকাজের প্রকাশ্য আহবানে সে সাড়া দেয়নি। বরং অসৎকাজের আহবায়ককে সৎকাজের আহবায়ক সেজে তার সামনে আসতে হয়েছিল। সে নীচের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নীচের দিকে যায়নি বরং এ পথটি তাকে উপরের দিকে নিয়ে যাবে এ ধোকায় পড়ে সে নীচের দিকে যায়। তৃতীয়ত শয়তানকে সতর্ক করার পর সে নিজের ভুল স্বীকার করে বন্দেগীর দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে নাফরমানীর ওপর আরো বেশী অবিচল হয়ে যায়। অন্যদিকে মানুষকে তার ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেবার পর সে শয়তানের মত বিদ্রোহ করেনি বরং নিজের ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথেই লজ্জিত হয়ে পড়ে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে, বিদ্রোহ থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের রবের রহমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় খুঁজতে থাকে।

আটঃ এভাবে শয়তানের পথ ও মানুষের উপযোগী পথ দু’টি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করা, সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও সগর্বে নিজের বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতির ওপর অটল হয়ে থাকা এবং যারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলে তাদেরকেও বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে গোনাহ ও নাফরমানীর পথে টেনে আনার চেষ্টা করাই হচ্ছে নির্ভেজাল শয়তানের পথ। বিপরীত পক্ষে মানুষের উপযোগী পথটি হচ্ছেঃ প্রথমত শয়তানের প্ররোচনা ও অপহরণ প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হবে। তার এ প্রচেষ্টায় বাধা দিতে হবে। নিজের শত্রুর চাল ও কৌশল বুঝতে হবে এবং তার হাত থেকে বাঁচার জন্য সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু এরপর যদি কখনো তার পা বন্দেগী ও আনুগত্যের পথ থেকে সরেও যায় তাহলে নিজের ভুল উপলব্ধি করার সাথে সাথেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে তাকে নিজের রবের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং নিজের অপরাধ ও ভুলের প্রতিকার ও সংশোধন করতে হবে। এ কাহিনী থেকে মহান আল্লাহ‌ এ মৌল শিক্ষাটিই দিতে চান। এখানে মানুষের মনে তিনি একথাগুলো বদ্ধমূল করে দিতে চান যে, তোমরা যে পথে চলছো সেটি শয়তানের পথ। এভাবে আল্লাহর হেদায়াতের পরোয়া না করে জ্বীন ও মানুষের মধ্যকার শয়তানদেরকে নিজেদের বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করা এবং ক্রমাগত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার পরও তোমাদের এভাবে নিজেদের ভুলের ওপর অবিচল থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মূলত নির্ভেজাল শয়তানী কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা নিজেদের আদি ও চিরন্তন দুশমনের ফাঁদে আটকা পড়েছো এবং তার কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করছো। শয়তান যে পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে, তোমাদের এ বিভ্রান্তির পরিণামও তাই হবে। যদি তোমরা সত্যিই নিজেরা নিজেদের শত্রু না হয়ে গিয়ে থাকো এবং তোমাদের মধ্যে সামান্যতম চেতনাও থেকে থাকে, তাহলে তোমরা নিজেদের ভুল শুধরিয়ে নাও, সতর্ক হয়ে যাও এবং তোমাদের বাপ আদম ও মা হাওয়া পরিশেষে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তোমরাও সেই একই পথ অবলম্বন করো।

১৪.
হযরত আদম ও হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার এ হুকুম দেয়া হয়েছিল শাস্তি হিসেবে-এরূপ ধারণা পোষণ করার কোন কারণ নেই। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তাঁদের তাওবা কবুল করেন এবং তাদেরকে মাফ করে দেন। কাজেই এ নির্দেশের মধ্যে শাস্তির কোন ব্যাপার থাকতে পারে না। বরং যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এর মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যটিই পূর্ণ হয়েছে। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারার ৪৮ ও ৫৩ নম্বর টীকা)
১৫.
এবার আদম ও হাওয়ার ঘটনার একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরববাসীদের সামনে তাদের নিজেদের জীবনে শয়তানী ভ্রষ্টতা-প্রতারণার একই অত্যন্ত সুস্পষ্ট প্রভাবের প্রতি অংগুলী নির্দেশ করা হয়েছে। তারা কেবলমাত্র সৌন্দর্য সামগ্রী হিসেবে ও বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব থেকে শারীরিকভাবে আত্মরক্ষা করার জন্য পোশাক ব্যবহার করতো। কিন্তু এর যে প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্য শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে আবৃত করা, সেটি তাদের কাছে কোন গুরুত্ব লাভ করেনি। নিজেদের লজ্জাস্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে তারা মোটেই ইতস্তত করতো না। প্রকাশ্য স্থানে উলংগ হয়ে গোসল করা, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে প্রকাশ্য জায়গায় প্রকৃতির ডাকে উদোম হয়ে বসে পড়া, পরণের কাপড়খুলে পড়ে যেতে এবং লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যেতে থাকলেও তার পরোয়া না করা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল হজ্জের সময় তাদের অসংখ্য লোকের কাবার চারদিকে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করা। এ ব্যাপারে তাদের পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই ছিল কিছু বেশী নির্লজ্জ। তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি ধর্মীয় কাজ এবং সৎকাজ মনে করেই তারা এটি করতো। আর যেহেতু এটি কেবল আরবদেরই বৈশিষ্ট্য ছিল না বরং দুনিয়ার অধিকাংশ জাতি এ নির্লজ্জ বেহায়াপনায় লিপ্ত ছিল এবং আজো আছে, তাই এখানে কেবলমাত্র আরববাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়নি বরং ব্যাপকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে সমগ্র মানব জাতিকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, দেখো শয়তানী প্রতারণার একটি সুস্পষ্ট আলামত তোমাদের নিজেদের জীবনেই রয়েছে। তোমরা নিজেদের রবের পথনির্দেশনার তোয়াক্কা না করে এবং নিজেদের নবী-রসূলের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছো। আর সে তোমাদেরকে মানবিক প্রকৃতির পথ থেকে বিচ্যুত করে সেই একই নির্লজ্জতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে যার মধ্যে ইতিপূর্বে সে তোমাদের প্রথম পিতা-মাতাকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। এ ব্যাপারে চিন্তা করলে প্রকৃত সত্য তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। অর্থাৎ রসূলদের নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনা ছাড়া তোমরা নিজেদের প্রকৃতির প্রাথমিক দাবীগুলো পর্যন্তও বুঝতে এবং তা পূর্ণ করতে অক্ষম।
১৬.
এ আয়াতগুলোতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে সামনে ভেসে উঠেছেঃ

একঃ পোশাক মানুষের জন্য কোন কৃত্রিম জিনিস নয়। বরং এটি মানব প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী। আল্লাহ‌ মানুষের দেহের বহির্ভাগে পশুদের মত কোন লোমশ আচ্ছাদন জন্মগতভাবে তৈরী করে দেননি। বরং লজ্জার অনুভূতি তার প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন। তিনি মানুষের যৌন অংগগুলোকে কেবলমাত্র যৌনাংগ হিসেবেই তৈরী করেননি বরং এগুলোকে “সাওআত”ও বানিয়েছেন। আরবী ভাষায় “সাওআত” এমন জিনিসকে বলা হয় যার প্রকাশকে মানুষ খারাপ মনে করে। আবার এ প্রকৃতিগত লজ্জার দাবী পূরণ করার জন্য তিনি মানুষকে কোন তৈরি করা পোষাক দেননি। বরং তার প্রকৃতিকে পোশাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন,(أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا) যাতে নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে সে প্রকৃতির এ দাবীটি উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান ও উপকরণসমূহ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য পোশাক তৈরী করতে সক্ষম হয়।

দুইঃ এ প্রাকৃতিক ও জন্মগত উপলব্ধির প্রেক্ষিতে মানুষের জন্য পোশাকের নৈতিক প্রয়োজনই অগ্রগণ্য। অর্থাৎ প্রথমে সে “সাওআত” তথা নিজের লজ্জাস্থান আবৃত করবে। আর তার স্বভাবগত চাহিদা ও প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ তারপর তার পোশাক তার জন্য “রীশ”, অর্থাৎ তার দৈহিক সৌন্দর্য বিধান করবে এবং আবহাওয়ার প্রভাব থেকে তার দেহ সৌষ্ঠবকে রক্ষা করবে। এ পর্যায়েও মানুষ ও পশুর ব্যাপার স্বভাবতই সম্পূর্ণ ভিন্ন। পশুর শরীরের লোমশ আচ্ছাদন মূলত তার জন্য 'রীশ' অর্থাৎ তার শরীরের শোভা বর্ধন ও ঋতুর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা করে। তার লোমশ আচ্ছাদন তার লজ্জাস্থান ঢাকার কাজ করে না। কারণ তার যৌনাংগ আদতে তার 'সাওআত' বা লজ্জাস্থান নয়। কাজেই তাকে আবৃত করার জন্য পশুর স্বভাবও প্রকৃতিতে কোন অনুভূতি ও চাহিদা থাকে না এবং তার চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে তার জন্য কোন পোশাকও সৃষ্টি করা হয় না। কিন্তু মানুষ যখন শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো তখন ব্যাপারটি আবার উল্টে গেলো। শয়তান তার এ শিষ্যদেরকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো যে, তোমাদের জন্য পোশাকের প্রয়োজন পশুদের জন্য পোশাকের প্রয়োজনের সমপর্যায়ভুক্ত, আর পোশাক দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মোটেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বরং পশুদের অংগ-প্রত্যংগ যেমন তাদের লজ্জাস্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না, ঠিক তেমনি তোমাদের এ অংগ-প্রত্যংগ গুলোও লজ্জাস্থান নয় বরং এগুলো নিছক যৌনাংগ।

তিনঃ মানুষের পোশাক কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান আবৃত করার এবং তার শারীরিক শোভাবর্ধন ও দেহ সংরক্ষণের উপায় হবে, এতটুকুই যথেষ্ট নয়। বরং আসলে এ ব্যাপারে তাকে অন্তত এতটুকু মহত্তর মানে পৌঁছতে হবে, যার ফলে তার পোশাক তাকওয়ার পোশাকে পরিণত হয়। অর্থাৎ তার পোশাক দিয়ে সে পুরোপুরি “সতর” তথা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলবে। সৌন্দর্য চর্চা ও সাজসজ্জার মাধ্যমে শরীরের শোভা বর্ধন করার ক্ষেত্রে তা সীমা অতিক্রম করে যাবে না বা ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে নিম্ন মানেরও হবে না। তার মধ্যে গর্ব, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কোন প্রদর্শনী থাকবে না। আবার এমন কোন মানসিক রোগের প্রতিফলনও তাতে থাকবে না। যার আক্রমণের ফলে পুরুষ নারীসুলভ আচরণ করতে থাকে, নারী করতে থাকে পুরুষসুলভ আচরণ এবং এক জাতি নিজেকে অন্য এক জাতির সদৃশ বানাবার প্রচেষ্টায় নিজেই নিজের হীনতা ও লাঞ্ছনার জীবন্ত প্রতীকে পরিণত হয়। যেসব লোক নবীদের প্রতি ঈমান এনে নিজেদেরকে পুরোপুরি আল্লাহর পথনির্দেশনার আওতাধীন করে দেয়নি, তাদের পক্ষে পোশাকের ব্যাপারে এ কাংখিত মহত্তর মানে উপনীত হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। যখন তারা আল্লাহর পথনির্দেশনা গ্রহণে অসম্মতি জানায় তখন শয়তানদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে দেয়া হয় এবং এ শয়তানরা তাদেরকে কোন না কোনভাবে ভুল-ভ্রান্তি ও অসৎকাজে লিপ্ত করেই ছাড়ে।

চারঃ দুনিয়ার চারদিকে আল্লাহর যেসব অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এবং যেগুলো মহাসত্যের সন্ধান লাভের ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করে, পোশাকের ব্যাপারটিও তার অন্যতম। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, মানুষের নিজের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ওপরে আমি যেসব সত্যের দিকে ইঙ্গিত করেছি সেগুলোকে একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে পোশাক কোন্ দৃষ্টিতে আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে।

১৭.
এখানে আরবাসীদের উলংগ অবস্থায় কাবা শরীফ তাওয়াফ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে আমি এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। একটি ধর্মীয় কাজ মনে করেই তারা এটা করতো। তারা মনে করতো, আল্লাহ‌ তাদেরকে এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন।
১৮.
আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি অতি সংক্ষিপ্ত বাক্য। কিন্তু আসলে এর মধ্যে কুরআন মজীদ উলংগ তাওয়াফকারীদের জাহেলী আকীদার বিরুদ্ধে একটি মস্তবড় যুক্তি পেশ করেছে। এ যুক্তি উপস্থাপন পদ্ধতিটি অনুধাবন করতে হলে ভূমিকা স্বরূপ দু’টি কথা অবশ্যি বুঝে নিতে হবেঃ

একঃ আরববাসীরা যদিও নিজেদের কোন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সময় উলংগ হতো এবং একে একটি পবিত্র ধর্মীয় কাজ মনে করতো। কিন্তু উলংগ হওয়াটাকে তারা এমনিতে একটি লজ্জাজনক কাজ বলে মনে করতো এবং এটি তাদের নিকট স্বীকৃতি ছিল। তাই কোন সম্ভ্রান্ত ভদ্র ও অভিজাত আরব কোন সংস্কৃতিবান মজলিসে বা কোন বাজারে অথবা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে উলংগ হওয়াটাকে কোনক্রমেই পছন্দ করতো না।

দুইঃ উলংগপনাকে লজ্জাজনক জানা সত্ত্বেও তারা একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নিজেদের ইবাদতের সময় উলংগ হতো। আর যেহেতু নিজেদের ধর্মকে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ধর্ম বলে মনে করতো তাই তারা মনে করতো এ আনুষ্ঠানিকতাটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। এরই ভিত্তিতে কুরআন মজীদ এখানে এ যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে, যে কাজটি অশ্লীল এবং যাকে তোমরা নিজেরাও অশ্লীল বলে জানো ও স্বীকার করো সে সম্পর্কে তোমরা কেমন করে একথা বিশ্বাস করো যে, আল্লাহর এর হুকুম দিয়ে থাকবেন? আল্লাহর পক্ষ থেকে কখনো কোন অশ্লীল কাজের হুকুম আসতে পারে না। আর যদি তোমাদের ধর্মে এমন কোন হুকুম পাওয়া যায় তাহলে তোমাদের ধর্ম যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়, এটিই তার অকাট্য প্রমাণ।

১৯.
এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের এসব অর্থহীন রীতি-আনুষ্ঠানিকতার সাথে আল্লাহর দ্বীনের কি সম্পর্ক? তিনি যে দ্বীনের শিক্ষা দিয়েছেন তার মূলনীতিগুলো নিম্নরূপঃ

একঃ মানুষের নিজের জীবনকে সত্য, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

দুইঃ ইবাদতের ক্ষেত্রে সঠিক লক্ষ্যের ওপর অবিচল থাকতে হবে অর্থাৎ তার ইবাদতে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারোর বন্দেগীর সামান্যতম স্পর্শও থাকবে না। আসল মাবুদ আল্লাহর দিকে ফিরা ছাড়া আর কোন দিকে ফিরে তার আনুগত্য, দাসত্ব, হীনতা ও দ্বীনতার সামান্যতম প্রকাশও ঘটতে পারবে না।

তিনঃ পথনির্দেশনা, সাহায্য, সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, হেফাজত ও সংরক্ষণের জন্য একমাত্র আল্লাহরই কাছে দোয়া চাইতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, এসব বিষয়ের জন্য দোয়া প্রার্থীকে পূর্বাহ্ণেই নিজের দ্বীনকে একান্তভাবে আল্লাহ‌ জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। জীবনের সমগ্র ব্যবস্থা, কুফরী, শিরক, গোনাহ ও অন্যের বন্দেগীর ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু সাহায্য চাওয়া হবে আল্লাহর কাছে এ বলে, হে আল্লাহ! তোমার বিরুদ্ধে আমার এ বিদ্রোহে আমাকে সাহায্য করো', এমনটি যেন না হয়।

চারঃ এ মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, এ দুনিয়ায় সে যেভাবে জন্ম নিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে অন্য একটি জগতেও তার জনম হবে এবং সেখানে আল্লাহর কাছে তার সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে।

অনুবাদ: