আল আরাফ

২০৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১৬১ ) স্মরণ করো ১২০ সেই সময়ের কথা যখন তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, এ জনপদে গিয়ে বসবাস করো, সেখানে উৎপাদিত ফসল থেকে নিজেদের ইচ্ছামত আহার্য সংগ্রহ করো, ‘হিত্তাতুন’ ‘হিত্তাতুন’ বলতে বলতে যাও এবং শহরের দরজা দিয়ে সিজদাবনত হয়ে প্রবেশ করতে থাকো। তাহলে আমি তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবো এবং সৎকর্মপরায়ণদেরকে অতিরিক্ত অনুগ্রহ দান করবো।
وَإِذْ قِيلَ لَهُمُ ٱسْكُنُوا۟ هَٰذِهِ ٱلْقَرْيَةَ وَكُلُوا۟ مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ وَقُولُوا۟ حِطَّةٌ وَٱدْخُلُوا۟ ٱلْبَابَ سُجَّدًا نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطِيٓـَٰٔتِكُمْ سَنَزِيدُ ٱلْمُحْسِنِينَ ١٦١
১৬২ ) কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জালেম ছিল তারা তাদেরকে যে কথা বলা হয়েছিল তা পরিবর্তিত করে ফেললো। এর ফলে তাদের জুলুমের বদলায় আমি আকাশ থেকে তাদের প্রতি আযাব পাঠিয়ে দিলাম। ১২১
فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ مِنْهُمْ قَوْلًا غَيْرَ ٱلَّذِى قِيلَ لَهُمْ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِجْزًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُوا۟ يَظْلِمُونَ ١٦٢
১৬৩ ) আর সমুদ্রের তীরে যে জনপদটি অবস্থিত ছিল তার অবস্থা সম্পর্কেও তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করো। ১২২ তাদের সেই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দাও যে, সেখানকার লোকেরা শনিবারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করতো এবং শনিবারেই মাছেরা পানিতে ভেসে ভেসে তাদের সামনে আসতো। ১২৩ অথচ শনিবার ছাড়া অন্য দিন আসতো না। তাদের নাফরমানীর কারণে তাদেরকে আমি ক্রমাগত পরীক্ষার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছিলাম বলেই এমনটি হতো। ১২৪
وَسْـَٔلْهُمْ عَنِ ٱلْقَرْيَةِ ٱلَّتِى كَانَتْ حَاضِرَةَ ٱلْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِى ٱلسَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَٰلِكَ نَبْلُوهُم بِمَا كَانُوا۟ يَفْسُقُونَ ١٦٣
১৬৪ ) আর তাদের একথাও স্মরণ করিয়ে দাও, যখন তাদের একটি দল অন্য দলকে বলেছিল, “তোমরা এমন লোকদের উপদেশ দিচ্ছো কেন যাদেরকে আল্লাহ‌ ধ্বংস করবেন বা কঠোর শাস্তি দেবেন?” জবাবে তারা বলেছিল, “এসব কিছু এ জন্যই করছি যেন আমরা তোমাদের রবের সামনে নিজেদের ওযর পেশ করতে পারি এবং এ আশায় করছি যে, হয়তো এ লোকেরা তাঁর নাফরমানী করা ছেড়ে দেবে।”
وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِّنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا ٱللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا۟ مَعْذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ ١٦٤
১৬৫ ) শেষ পর্যন্ত তাদেরকে যে সমস্ত হেদায়াত স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল তারা যখন সেগুলো সম্পূর্ণ ভুলে গেলো, তখন যারা খারাপ কাজে বাধা দিতো তাদেরকে আমি বাঁচিয়ে নিলাম এবং বাকি সমস্ত লোক যারা দোষী ছিল তাদের নাফরমানীর জন্য তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিলাম। ১২৫
فَلَمَّا نَسُوا۟ مَا ذُكِّرُوا۟ بِهِۦٓ أَنجَيْنَا ٱلَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ ٱلسُّوٓءِ وَأَخَذْنَا ٱلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ بِعَذَابٍۭ بَـِٔيسٍۭ بِمَا كَانُوا۟ يَفْسُقُونَ ١٦٥
১৬৬ ) তারপর যে কাজ থেকে তাদেরকে বাধা দেয়া হয়েছিল, তাই যখন তারা পূর্ণ ঔদ্ধত্যসহকারে করে যেতে লাগলো তখন আমি বললাম, তোমরা লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত বানর হয়ে যাও। ১২৬
فَلَمَّا عَتَوْا۟ عَن مَّا نُهُوا۟ عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا۟ قِرَدَةً خَٰسِـِٔينَ ١٦٦
১৬৭ ) আর স্মরণ করো যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন ১২৭ কিয়ামত পর্যন্ত তিনি সবসময় বনী ইসরাঈলীদের ওপর এমন সব লোককে চাপিয়ে দিয়ে যেতে থাকবেন যারা তাদেরকে দেবে কঠিনতম শাস্তি।” ১২৮ নিঃসন্দেহে তোমাদের রব দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়ও।
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَٰمَةِ مَن يَسُومُهُمْ سُوٓءَ ٱلْعَذَابِ إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيعُ ٱلْعِقَابِ وَإِنَّهُۥ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ ١٦٧
১৬৮ ) আমি তাদেরকে পৃথিবীতে খন্ড বিখন্ড করে বহু সংখ্যক জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিল সৎ এবং কিছু লোক অন্য রকম। আর আমি ভাল ও খারাপ অবস্থায় নিক্ষেপ করার মাধ্যমে তাদেরকে পরীক্ষা করতে থাকি, হয়তো তারা ফিরে আসবে।
وَقَطَّعْنَٰهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ أُمَمًا مِّنْهُمُ ٱلصَّٰلِحُونَ وَمِنْهُمْ دُونَ ذَٰلِكَ وَبَلَوْنَٰهُم بِٱلْحَسَنَٰتِ وَٱلسَّيِّـَٔاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ١٦٨
১৬৯ ) তারপর পরবর্তী বংশধরদের পর এমন কিছু অযোগ্য লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়, যারা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়ে এ তুচ্ছ দুনিয়ার স্বার্থ আহরণে লিপ্ত হয় এবং বলতে থাকে আশা করা যায়, আমাদের ক্ষমা করা হবে। পরক্ষনেই সেই ধরনের পার্থিব সামগ্রী যদি আবার তাদের সামনে এসে যায়, তাহলে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে তা লুফে নেয়। ১২৯ তাদের কাছ থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর নামে কেবলমাত্র সত্য ছাড়া আর কিছুই বলবে না? আর কিতাবে যা লেখা আছে তাতো তারা নিজেরাই পড়ে নিয়েছে। ১৩০ আখেরাতের আবাস তো আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদেরই জন্য ভাল ১৩১ -এতটুকু কথাও কি তোমরা বুঝো না?
فَخَلَفَ مِنۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا۟ ٱلْكِتَٰبَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَٰذَا ٱلْأَدْنَىٰ وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِن يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِّثْلُهُۥ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِم مِّيثَٰقُ ٱلْكِتَٰبِ أَن لَّا يَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلْحَقَّ وَدَرَسُوا۟ مَا فِيهِ وَٱلدَّارُ ٱلْءَاخِرَةُ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ١٦٩
১৭০ ) যারা কিতাবের বিধান যথাযথভাবে মেনে চলে এবং নামায কায়েম করে, নিঃসন্দেহে এহেন সৎকর্মশীল লোকদের কর্মফল আমি নষ্ট করবো না।
وَٱلَّذِينَ يُمَسِّكُونَ بِٱلْكِتَٰبِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ ٱلْمُصْلِحِينَ ١٧٠
১২০.
মহান আল্লাহর উপরোল্লিখিত অনুগ্রহসমূহের জবাবে বনী ইসরাঈল কি ধরনের অপরাধমূলক ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য দেখাতে থাকে এবং কিভাবে ক্রমাগত ধ্বংসের আবর্তে নেমে যেতে থাকে, তা তুলে ধরার জন্য এখানে এ জাতির সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বর্ণনা করা হচ্ছে।
১২১.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারা ৭৪ ও ৭৫ টীকা।
১২২.
বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে এ স্থানটি ছিল ‘আয়লা’, ‘আয়লাত’ বা ‘আয়লুত’। ইসরাঈলের ইহুদী রাষ্ট্র বর্তমানে এখানে এ নামে একটি বন্দর নির্মাণ করেছে। এর কাছেই রয়েছে জর্দানের বিখ্যাত বন্দর আকাবা। লোহিত সাগরের যে শাখাটি সিনাই উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল ও আরবের পশ্চিম উপকূলের মাঝখানে একটি লম্বা উপসাগরের মত দেখায়, তার ঠিক শেষ মাথায় এ স্থানটি অবস্থিত। বনী ইসরাঈলের উত্থানযুগে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এ শহরেই তাঁর লোহিত সাগরের সামরিক ও বাণিজ্যিক নৌবহরের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।

এখানে যে ঘটনাটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থসমূহে আমরা তার কোন উল্লেখ পাই না। তাদের ইতিহাসও এ প্রসঙ্গে নীরব। কিন্তু কুরআন মজীদে যেভাবে এ ঘটনাটিকে এখানে ও সূরা বাকারায় বর্ণনা করা হয়েছে, তা থেকে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন নাযিলের সময় বনী ইসরাঈলীরা সাধারণভাবে এ ঘটনাটি সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত ছিল। এটি একটি প্রমাণিত সত্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার প্রশ্নে যেখানে মদীনার ইহুদীরা কোন একটি সুযোগও হাতছাড়া হতে দিতো না সেখানে কুরআনের এ বর্ণনার বিরুদ্ধে তারা আদৌ কোন আপত্তিই তোলেনি।

১২৩.
কুরআনে ‘সাব্ত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 'সাব্ত' মানে শনিবার। বনী ইসরাঈলীদের জন্য এ দিনটিকে পবিত্র দিন গণ্য করা হয়েছিল। মহান আল্লাহ‌ এ দিনটিকে নিজের ও বনী ইসরাঈলীদের সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে সম্পাদিত পুরুষানুক্রমিক স্থায়ী অঙ্গীকার গণ্য করে তাকীদ করেছিলেন যে, এ দিন কোন পার্থিব কাজ করা যাবে না, ঘরে আগুন পর্যন্ত জ্বালানো যাবে না, গৃহপালিত পশু এমন কি চাকর-বাকর-দাসদাসীদের থেকেও কোন সেবা করা চলবে না এবং যে ব্যক্তি এ নিয়ম লংঘন করবে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু উত্তরকালে বনী ইসরাঈল প্রকাশ্যে এ আইনের বিরোধিতা করতে থাকে। ইয়ারমিয়াহ (যিরমিয়) নবীর আমলে (যিনি খৃষ্টপূর্ব ৬২৮ ও ৫৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বেঁচে ছিলেন)। লোকেরা খাস জেরুজালেমের সিংহ দরজাগুলো দিয়ে মালপত্র নিয়ে চলাফেরা করতো। এতে ঐ নবী ইহুদীদেকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তোমরা যদি এভাবে প্রকাশ্যে শরীয়াতের বিরুদ্ধাচারণ করা থেকে বিরত না হও তাহলে জেরুজালেমে আগুন লাগিয়ে দেয়া হবে। (যিরমিয় ১৭: ২১-২৭) হযরত হিযকিঈল (যিহিস্কেল) নবীও এ একই অভিযোগ করেন। তাঁর আমল ছিল খৃষ্টপূর্ব ৫৯৫ ও ৫৩৬ এর মধ্যবর্তী সময়ে। তাঁর গ্রন্থে শনিবারের অবমাননাকে ইহুদীদের একটি মস্তবড় জাতীয় অপরাধ গণ্য করা হযেছে। (যিহিস্কেল ২০: ১২-২৪) এসব উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করা যেতে পারে, কুরআন মজিদ এখানে যে ঘটনাটির কথা বলছে সেটিও সম্ভবত এ একই যুগের ঘটনা।
১২৪.
মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ‌ যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন তার মধ্যে এও একটি পদ্ধতি যে, যখন কোন ব্যক্তি বা দলের মধ্যে আনুগত্য বিচ্যুতি ও নাফরমানীর প্রবণতা বাড়তে থাকে, তখন তাকে আরো বেশী করে নাফরমানী করার সুযোগ দেয়া হয়। যেন তার যেসব প্রবণতা ভেতরে লুকিয়ে থাকে সেগুলো পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং যেসব অপরাধে সে নিজেকে কুলষিত করতে চায়, কেবলমাত্র সুযোগের অভাবে সে সেগুলো থেকে বিরত থেকে না যায়।
১২৫.
এ বর্ণনা থেকে জানা যায়, এ জনপদে তিন ধরনের লোক ছিল। এক, যারা প্রকাশ্যে ও পূর্ণ ঔদ্ধত্য সহকারে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করছিল। দুই, যারা নিজেরা বিরুদ্ধাচরণ করছিল না কিন্তু অন্যের বিরুদ্ধাচরণকে নীরবে হাত-পা গুটিয়ে বসে বসে দেখছিল এবং উপদেশ দানকারীদের বলছিল, এ হতভাগাদের উপদেশ দিয়ে কী লাভ? তিন, যারা ঈমানী সম্ভমবোধ ও মর্যাদাবোধের কারণে আল্লাহর আইনের এহেন প্রকাশ্য অমর্যাদা বরদাশত করতে পারেনি এবং তারা এ মনেকরে সৎকাজের আদেশ দিতে ও অসৎকাজ থেকে অপরাধীদের বিরত রাখতে তৎপর ছিল যে, হয়তো ঐ অপরাধীরা তাদের উপদেশের প্রভাবে সৎপথে এসে যাবে, আর যদি তারা সৎপথে নাও আসে তাহলে অন্তত নিজেদের সামর্থ্য মোতাবিক কর্তব্য পালন করে তারা আল্লাহর সামনে নিজেদের দায় মুক্তির প্রমাণ পেশ করতে পারবে। এ অবস্থায় এ জনপদের ওপর যখন আল্লাহর আযাব নেমে এলো, তখনকার অবস্থা বিশ্লেষণ করে কুরআন মজীদ বলছে, এ তিনটি দলের মধ্য থেকে একমাত্র তৃতীয় দলটিকেই বাঁচিয়ে নেয়া হয়েছিল। কারণ একমাত্র তারাই আল্লাহর সামনে নিজেদের ওযর পেশ করার চিন্তা করছিল এবং একমাত্র তারাই নিজেদের দায়িত্ব মুক্তির প্রমাণ সংগ্রহ করে রেখেছিল। বাকি দল দু’টিকে অপরাধীদের মধ্যে গণ্য করা হলো এবং নিজেদের অপরাধ অনুপাতে তারা শাস্তি ভোগ করলো। কোন কোন তাফসীরকার এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আল্লাহ‌ প্রথম দলটির শাস্তি ভোগ করার এবং দ্বিতীয় দলটির উদ্ধার প্রাপ্তির ব্যাপারে স্পষ্ট উক্তি করেছেন। কিন্তু তৃতীয় দলটির ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কাজেই তারা শাস্তি ভোগ করেছিল না উদ্ধার পেয়েছিল, এ ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না। আবার আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, তিনি প্রথমে দ্বিতীয় দলটি শাস্তি লাভ করেছিল বলে মত পোষণ করতেন। পরে তাঁর ছাত্র ইকরামা তাকে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করে দেন যে, দ্বিতীয় দলটি উদ্ধার পেয়েছিল। কিন্তু কুরআনের বর্ণনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে মনে হয়, হযরত ইবনে আব্বাসের প্রথম চিন্তাটিই সঠিক ছিল। একথা সুস্পষ্ট যে, কোন জনপদের ওপর আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হলে সমগ্র জনপদবাসীরা দু'ভাগেই বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এক ভাগে এমন সব লোকেরা থাকে যারা আযাব ভোগ করে এবং অন্য ভাগে থাকে তারা যারা আযাব থেকে বেঁচে যায়। এখন কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী উদ্ধারপ্রাপ্ত যদি কেবল তৃতীয় দলটিই হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যারা উদ্ধার পায়নি তাদের মধ্যে থাকবে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় দলই। এরই সমর্থন পাওয়া যায় مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ(অর্থাৎ এসব কিছুই করছি আমরা তোমাদের রবের সামনে নিজের ওযর পেশ করার উদ্দেশ্যে) বাক্যাংশটির মধ্যে। এ বাক্যাংশটিতে আল্লাহ‌ নিজেই একথা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আল্লাহর কাছে ওযর করার জন্য অবশ্যি নিজেদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে যেতে হবে। এভাবে দায়িত্ব মুক্তির প্রমাণ যারা সংগ্রহ করতে পারবে, একমাত্র তারাই আল্লাহর কাছে ওযর পেশ করতে পারবে। এ থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হচ্ছে, যে জনপদে প্রকাশ্যে আল্লাহর বিধান লংঘন করা চলতে থাকে, সেখানকার সবাই জবাবদিহির সম্মুখীন হয়। সেখানকার কোন অধিবাসী শুধু নিজেই আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেনি বলেই আল্লাহর সামনে জবাবদিহি থেকে বাঁচতে পারে না। বরং আল্লাহর সামনে নিজের সাফাই পেশ করার জন্য তাকে অবশ্যই এ মর্মে প্রমাণ পেশ করতে হবে যে, নিজের সামর্থ্য মোতাবিক মানুষের সংশোধন ও আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রতিষ্ঠার জন্য সে প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এছাড়া কুরআন হাদীসের অন্যান্য বক্তব্য থেকেও আমরা সামষ্টিক অপরাধের ক্ষেত্রে আল্লাহর এ একই ধরনের আইনের কথা জানতে পারি। তাই আমরা দেখি কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً

(সেই বিপর্যয় থেকে সাবধান হও, যার কবলে বিশেষভাবে কেবলমাত্র তোমাদের মধ্য থেকে যারা জুলুম করেছে তারাই পড়বে না) আর এর ব্যাখ্যায় নবী ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لاَ يُعَذِّبُ الْعَامَّةَ بِعَمَلِ الْخَاصَّةِ حَتَّى يَرَوُا الْمُنْكَرَ بَيْنَ ظَهْرَانَيْهِمْ وَهُمْ قَادِرُونَ عَلَىأَنْ يُنْكِرُوهُ فَلاَ يُنْكِرُوهُ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَذَّبَ اللَّهُ الْخَاصَّةَ وَالْعَامَّةَ-

“মহান আল্লাহ‌ বিশেষ লোকদের অপরাধের দরুন সর্বসাধারণকে শাস্তি দেন না, যতক্ষন সাধারণ লোকদের অবস্থা এমন পর্যায়ে না পৌঁছে যায় যে, তারা নিজেদের চোখের সামনে খারাপ কাজ হতে দেখে এবং তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশের ক্ষমতাও রাখে, এরপরও কোন অসন্তোষ প্রকাশ করে না। কাজেই লোকেরা যখন এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহ‌ সাধারণ ও অসাধারণ নির্বিবেশেষে সবাইকে আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করেন।”

এছাড়াও আলোচ্য আয়াত থেকে একথাও জানা যায় যে, এ জনপদের ওপর দুই পর্যায়ে আল্লাহর আযাব নাযিল হয়। প্রথম পর্যায়ে নাযিল হয় عَذَابٍ بَئِيسٍ(কঠিন শাস্তি) এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে নাফরমানী যারা অব্যাহত রেখেছিল তাদেরকে বানরে পরিণত করা হয়। আমার মতে প্রথম পর্যায়ের আযাবে উভয় দলই শামিল ছিল এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের আযাব দেয়া হয়েছিল কেবলমাত্র প্রথম দলকে।

এক্ষেত্রে অবশ্যি সঠিক ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। যদি আমার অভিমত সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। আর যদি আমি ভুল করে থাকি তাহলে সেজন্য আমিই দায়ী। আল্লাহ‌ অবশ্যি ক্ষমাশীল ও করুণাময়।

১২৬.
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারা ৮৩ টীকা।
১২৭.
এখানে মূল শব্দ হচ্ছে تَأَذَّنَ(তায়াজ্জানা) এর অর্থ হয় অনেকটা নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেবার মত।
১২৮.
প্রায় খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে বনী ইসরাঈলকে এভাবে ক্রমাগত সতর্ক করে দিয়ে আসা হচ্ছিল। তাই দেখা যায়, ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থ সমষ্টিতে ইয়াসইয়াহ (যিশাইয়) ও ইয়ারমিয়াহ (যিরমিয়) এবং তাদের পর আগমনকারী নবীদের সকল গ্রন্থে কেবল এ সতর্কবাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে। তারপর ঈসা আলাইহিস সালামও তাদেরকে এ একই সতর্কবাণী শুনান। বিভিন্ন ইনজীল গ্রন্থে তাঁর একাধিক ভাষণ থেকেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবশেষে কুরআন মজীদও একথটিকে দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছে। সে সময় থেকে নিয়ে আজো পর্যন্ত ইতিহাসের এমন একটি যুগও অতিক্রান্ত হয়নি, যখন ইহুদী জাতির ওপর দুনিয়ার কোথাও না কোথাও নিপীড়ন ও লাঞ্ছনা অব্যাহত থাকেনি। ইহুদী জাতির এ অবস্থা কুরআন ও তার পূর্বেকার আসমানী গ্রন্থাবলীর সত্যতারই সুস্পষ্ট সাক্ষ্যবহ।
১২৯.
অর্থাৎ গুনাহ করে। তারা জানে এ কাজটি করা গুনাহ তবুও এ আশায় তারা এ কাজটি করে যে, কোন না কোনভাবে তাদের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। কারণ তারা মনে করে, তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র এবং তারা যত কঠিন অপরাধই করুক না কেন তাদের ক্ষমালাভ অপরিহার্য। এ ভুল ধারণার ফলে কোন গুনাহ করার পর তারা লজ্জিত হয় না এবং তাওবাও করে না। বরং ঐ একই ধরনের গুনাহ করার সুযোগ এলে তারা আবার তাতে জড়িয়ে পড়ে। এ হতভাগ্য লোকেরা এমন একটি কিতাবের উত্তরাধীকারী ছিল, যা তাদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্বের পদে আসীন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের হীনমন্যতা ও নীচাশয়তার ফলে, তারা এ সৌভাগ্যের পরশমণিটির সাহায্যে তুচ্ছ পার্থিব সম্পদ আহরণ করার চাইতে বড় কোন জিনিস উপার্জনের হিম্মতই করলো না। তারা দুনিয়ার ন্যায়-ইনসাফ, সত্য-সততার পতাকাবাহী এবং কল্যাণ ও সুকৃতির অগ্রপথিক ও পদপ্রদর্শক হবার পরিবর্তে নিছক দুনিয়ার কুকুর হয়েই রইল।
১৩০.
অর্থাৎ তারা নিজেরাই জানে, তাওরাতের কোথাও বনী ইসরাঈলের জন্য শর্তহীন মুক্তি সনদ দেয়ার উল্লেখ নেই। আল্লাহ‌ কখনো তাদেরকে একথা বলেননি এবং তাদের নবীগণও কখনো তাদেরকে এ ধরনের নিশ্চয়তা দেননি যে, তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো, তোমাদের সকল গুনাহ অবশ্যি মাফ হয়ে যাবে। তাছাড়া আল্লাহ‌ নিজে যে কথা কখনো বলেননি, তাকে আল্লাহর কথা বলে প্রচার করার কি অধিকারই বা তাদের থাকতে পারে? অথচ তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল যে, আল্লাহর নামে কোন অসত্য কথা তারা বলবে না।
১৩১.
এ আয়াতটির দু’টি অনুবাদ হতে পারে। একটি অনুবাদ আমি এখানে করেছি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, “আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদের জন্য তো আখেরাতের আবাসই ভাল।” প্রথম অনুবাদের আলোকে আয়াতের তাৎপর্য হবে এই যে, মাগফেরাত কারোর একচেটিয়া ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অধিকার নয়। তুমি এমন কাজ করবে যা শাস্তি লাভের যোগ্য, কিন্তু আখেরাতে তুমি নিছক ইহুদী বা ইসরাঈলী হবার কারণে ভাল জায়গা পেয়ে যাবে, এটা কখনো হতে পারে না। তোমাদের মধ্যে সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধি থাকলেও তোমরা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে, আখেরাতের ভাল জয়গা একমাত্র তারাই পেতে পারে যারা দুনিয়ায় আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে কাজ করে। আর দ্বিতীয় অনুবাদটি গ্রহণ করলে মর্ম এ দাঁড়ায় যে, যেসব লোক আল্লাহর ভয়ে ভীত নয় একমাত্র তারাই দুনিয়াবী লাভ ও স্বার্থকে আখেরাতের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকেরা নিশ্চিতভাবে আখেরাতের স্বার্থকে দুনিয়ার স্বার্থের ওপর এবং আখেরাতের কল্যাণ ও লাভকে দুনিয়ার আয়েশ-আরামের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
অনুবাদ: