১৫১ ) তখন মূসা বললোঃ “হে আমার রব! আমাকে ও আমার ভাইকে ক্ষমা করো এবং তোমার অনুগ্রহের মধ্যে আমাদের দাখিল করে নাও, তুমি সবচাইতে বেশী অনুগ্রহকারী।”
قَالَ رَبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِأَخِى وَأَدْخِلْنَا فِى رَحْمَتِكَ ۖ وَأَنتَ أَرْحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ١٥١
১৫২ ) (জওয়াবে বলা হলো) “যারা বাছুরকে মাবুদ বানিয়েছে তারা নিশ্চয়ই নিজেদের রবের ক্রোধের শিকার হবেই এবং দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত হবে। মিথ্যা রচনাকারীদেরকে আমি এমনি ধরনের শাস্তিই দিয়ে থাকি।
إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ ٱلْعِجْلَ سَيَنَالُهُمْ غَضَبٌۭ مِّن رَّبِّهِمْ وَذِلَّةٌۭ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُفْتَرِينَ ١٥٢
১৫৩ ) আর যারা খারাপ কাজ করে তারপর তাওবা করে নেয় এবং ঈমান আনে, এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে এ তাওবা ও ঈমানের পর তোমার রব ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
وَٱلَّذِينَ عَمِلُوا۟ ٱلسَّيِّـَٔاتِ ثُمَّ تَابُوا۟ مِنۢ بَعْدِهَا وَءَامَنُوٓا۟ إِنَّ رَبَّكَ مِنۢ بَعْدِهَا لَغَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ١٥٣
১৫৪ ) তারপর মূসার ক্রোধ প্রশমিত হলে সে ফলকগুলি উঠিয়ে নিল। যারা নিজেদের রবকে ভয় করে তাদের জন্য ঐ সব ফলকে ছিল পথনির্দেশ ও রহমত।
وَلَمَّا سَكَتَ عَن مُّوسَى ٱلْغَضَبُ أَخَذَ ٱلْأَلْوَاحَ ۖ وَفِى نُسْخَتِهَا هُدًۭى وَرَحْمَةٌۭ لِّلَّذِينَ هُمْ لِرَبِّهِمْ يَرْهَبُونَ ١٥٤
১৫৫ ) আর মূসা (তার সাথে) আমার নির্ধারিত সময়ে হাযির হবার জন্য নিজের জাতির সত্তর জন লোককে নির্বাচিত করলো। ১০৯ যখন তারা একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো তখন মূসা বললোঃ “হে প্রভু! তুমি চাইলে আগেই এদেরকে ও আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্য থেকে কিছু নির্বোধ লোক যে অপরাধ করেছিল সেজন্য কি তুমি আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেবে? এটি তো ছিল তোমার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা, এর মাধ্যমে তুমি যাকে চাও পথভ্রষ্ট করো আবার যাকে চাও হেদায়াত দান করো। ১১০ তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ।
وَٱخْتَارَ مُوسَىٰ قَوْمَهُۥ سَبْعِينَ رَجُلًۭا لِّمِيقَـٰتِنَا ۖ فَلَمَّآ أَخَذَتْهُمُ ٱلرَّجْفَةُ قَالَ رَبِّ لَوْ شِئْتَ أَهْلَكْتَهُم مِّن قَبْلُ وَإِيَّـٰىَ ۖ أَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ ٱلسُّفَهَآءُ مِنَّآ ۖ إِنْ هِىَ إِلَّا فِتْنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَن تَشَآءُ وَتَهْدِى مَن تَشَآءُ ۖ أَنتَ وَلِيُّنَا فَٱغْفِرْ لَنَا وَٱرْحَمْنَا ۖ وَأَنتَ خَيْرُ ٱلْغَـٰفِرِينَ ١٥٥
১৫৬ ) আর আমাদের জন্য এ দুনিয়ার কল্যাণ লিখে দাও এবং আখেরাতেরও, আমরা তোমার দিকে ফিরেছি।” জওয়াবে বলা হলোঃ “শাস্তি তো আমি যাকে চাই তাকে দিয়ে থাকি, কিন্তু আমার অনুগ্রহ সব জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। ১১১ কাজেই তা আমি এমন লোকদের নামে লিখবো যারা নাফরমানী থেকে দূরে থাকবে, যাকাত দেবে এবং আমার আয়াতের প্রতি ঈমান আনবে।
۞ وَٱكْتُبْ لَنَا فِى هَـٰذِهِ ٱلدُّنْيَا حَسَنَةًۭ وَفِى ٱلْـَٔاخِرَةِ إِنَّا هُدْنَآ إِلَيْكَ ۚ قَالَ عَذَابِىٓ أُصِيبُ بِهِۦ مَنْ أَشَآءُ ۖ وَرَحْمَتِى وَسِعَتْ كُلَّ شَىْءٍۢ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِينَ هُم بِـَٔايَـٰتِنَا يُؤْمِنُونَ ١٥٦
১৫৭ ) (আজ তারাই এ রহমতের অংশীদার) যারা এ প্রেরিত উম্মী নবীর আনুগত্য করে, ১১২ যার উল্লেখ নিকট এখানে তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়। ১১৩ সে তাদের সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য পাক পবিত্র জিনিসগুলো হালাল ও নাপাক জিনিসগুলো হারাম করে ১১৪ এবং তাদের ওপর থেকে এমন সব বোঝা নামিয়ে দেয়। যা তাদের ওপর চাপানো ছিল আর এমন সব বাঁধন থেকে তাদেরকে মুক্ত করে যাতে তারা আবদ্ধ ছিল। ১১৫ কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য সহায়তা দান করে এবং তার সাথে অবতীর্ণ আলোক রশ্মির অনুসরণ করে তারাই সফলতা লাভের অধিকারী।
ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِىَّ ٱلْأُمِّىَّ ٱلَّذِى يَجِدُونَهُۥ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِى ٱلتَّوْرَىٰةِ وَٱلْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَىٰهُمْ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَـٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ ٱلْخَبَـٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَٱلْأَغْلَـٰلَ ٱلَّتِى كَانَتْ عَلَيْهِمْ ۚ فَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُوا۟ ٱلنُّورَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ مَعَهُۥٓ ۙ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ ١٥٧
১৫৮ ) হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, “হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য সেই আল্লাহর রসূল হিসেবে এসেছি, যিনি পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলীর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। কাজেই ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তার প্রেরিত সেই নিরক্ষর নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান আনে এবং তার আনুগত্য করে। আশা করা যায়, এভাবে তোমরা সঠিক পথ পেয়ে যাবে।
قُلْ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّى رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ٱلَّذِى لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۖ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ يُحْىِۦ وَيُمِيتُ ۖ فَـَٔامِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِىِّ ٱلْأُمِّىِّ ٱلَّذِى يُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَـٰتِهِۦ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ١٥٨
১৫৯ ) মূসার ১১৬ জাতির মধ্যে এমন একটি দলও ছিল, যারা সত্য অনুযায়ী পথনির্দেশ দিতো এবং সত্য অনুযায়ী ইনসাফ করতো। ১১৭
وَمِن قَوْمِ مُوسَىٰٓ أُمَّةٌۭ يَهْدُونَ بِٱلْحَقِّ وَبِهِۦ يَعْدِلُونَ ١٥٩
১৬০ ) আর তার জাতিকে আমি বারোটি পরিবারে বিভক্ত করে তাদেরকে স্বতন্ত্র গোত্রের রূপ দিয়েছিলাম। ১১৮ আর যখন মূসার কাছে তার জাতি পানি চাইলো তখন আমি তাকে ইঙ্গিত করলাম, অমুক পাথরে তোমরা লাঠি দিয়ে আঘাত করো। ফলে সেই পাথরটি থেকে অকস্মাত বারোটি ঝরণাধারা প্রবাহিত হলো এবং প্রত্যেকটি দল তাদের পানি গ্রহণ করার জায়গা নির্দিষ্ট করে নিল। আমি তাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করলাম এবং তাদের ওপর অবতীর্ণ করলাম মান্না ও সালওয়া ১১৯ -যেসব ভাল ও পাক জিনিস তোমাদের দিয়েছি সেগুলো খাও। কিন্তু এরপর তারা যা কিছু করেছে তাতে আমার ওপর জুলুম করেনি বরং নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে।
وَقَطَّعْنَـٰهُمُ ٱثْنَتَىْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًۭا ۚ وَأَوْحَيْنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ إِذِ ٱسْتَسْقَىٰهُ قَوْمُهُۥٓ أَنِ ٱضْرِب بِّعَصَاكَ ٱلْحَجَرَ ۖ فَٱنۢبَجَسَتْ مِنْهُ ٱثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًۭا ۖ قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍۢ مَّشْرَبَهُمْ ۚ وَظَلَّلْنَا عَلَيْهِمُ ٱلْغَمَـٰمَ وَأَنزَلْنَا عَلَيْهِمُ ٱلْمَنَّ وَٱلسَّلْوَىٰ ۖ كُلُوا۟ مِن طَيِّبَـٰتِ مَا رَزَقْنَـٰكُمْ ۚ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَـٰكِن كَانُوٓا۟ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ ١٦٠
১০৯.
জাতীয় প্রতিনিধিদের তলব করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। জাতির ৭০ জন প্রতিনিধি সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর সমীপে হাযির হয়ে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গো-বৎস পূজার অপরাধের ক্ষমা চাইবে এবং নতুন করে আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীকার করবে, এই ছিল এর উদ্দেশ্য। বাইবেল ও তালমুদে এ বিষয়টির উল্লেখ নেই। তবে হযরত মূসা যে ফলকগুলি ছুঁড়ে দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলেন সেগুলোর বদলে অন্য ফলক দেবার জন্য তাঁকে সিনাই পাহাড়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল একথা অবশ্যি সেখানে উল্লেখিত হয়েছে। (যাত্রা পুস্তক ৩৪ অধ্যায়)।
১১০.
এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেকটি পরীক্ষাকাল মানুষের জন্য চূড়ান্তই হয়ে থাকে। এ পরীক্ষা চালুনীর মত একটি মিশ্রিত দল থেকে কর্মঠ লোকগুলোকে বাছাই করে নিয়ে অকর্মন্য লোকগুলোকে দূরে নিক্ষেপ করে দল থেকে আলাদা করে দেয়। এই ধরনের পরীক্ষা মাঝে মাঝে আসতে থাকে, এটা আল্লাহর একটি কর্ম কৌশল। এসব পরীক্ষায় যারা সফলকাম হয় তারা মূলত আল্লাহর সাহায্য ও পথনির্দেশেই সাফল্য লাভ করে থাকে। আর যারা ব্যর্থ হয় তারা আল্লাহর সাহায্য ও পথনির্দেশ থেকে বঞ্চিত হবার কারণেই ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। যদিও আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও পথনির্দেশনা লাভ করার ও একটি নিয়ম আছে এবং এ নিয়মটি সম্পূর্ণরূপে প্রজ্ঞা ও ইনসাফের ওপর নির্ভরশীল। তবুও এটি একটি প্রমাণিত সত্য যে, পরীক্ষায় কারোর সফলকাম বা অসফল হওয়া আসলে আল্লাহরই সাহায্য, অনুগ্রহ ও পথনির্দেশনার ওপর নির্ভর করে।
১১১.
অর্থাৎ মহান আল্লাহ যে পদ্ধতিতে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন, সেখানে ক্রোধ মুখ্য নয় এবং অনুগ্রহ ও মেহেরবানী সেখানে মাঝে মধ্যে দেখা যায় এমন নয়। বরং অনুগ্রহই সেখানে মূখ্য এবং সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা তারই ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেখানে ক্রোধের প্রকাশ কেবল তখনই ঘটে যখন মানুষের দম্ভ ও অহংকার সীমা ছাড়িয়ে যায়।
১১২.
ওপরের বাক্যটি পর্যন্ত হযরত মূসার দোয়ার জওয়াব শেষ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর সুযোগ বুঝে এবার সাথে সাথেই বনী ইসরাঈলকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। এ ভাষণটির মূল বক্তব্য হচ্ছে, তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হবার জন্য হযরত মূসা (আ) এর যুগে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছিল আজো সেগুলোই বহাল রয়ে গেছে। আর তোমাদের এ নবীর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারটি আসলে সেই শর্তগুলোরই দাবী। তোমারদের বলা হয়েছিল, যারা আল্লাহর নাফরমানী থেকে দূরে থাকে আল্লাহর রহমত তাদেরই প্রাপ্য। তাইতো যে নবীকে আল্লাহ নিযুক্ত করেছেন, তার নেতৃত্ব গ্রহণকরতে অস্বীকার করাই হচ্ছে আজকের সবচেয়ে বড় মৌলিক নাফরমানী। কাজেই যতদিন তোমরা এ নাফরমানী থেকে বিরত হবে না, ততদিন তোমরা খুটিনাটি ও ছোটখাটো তাকওয়ার বিষয় নিয়ে যতই মাতামাতি কর না কেন তাকওয়ার ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠিত হবে না। তোমাদের বলা হয়েছিল যাকাতও আল্লাহর রহমতের অংশ পাওয়ার একটি শর্ত। তাইতো আজ এ নবীর নেতৃত্বে দ্বীন প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম চলছে, যতদিন তার সাথে সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা হবে না ততদিন কোন প্রকার অর্থ ব্যয় যাকাতের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে না। কাজেই তোমরা যতই দান-খয়রাত করো এবং নজর-নিয়াজ দাও না কোন, এ পথে অর্থ ব্যয় না করা পর্যন্ত যাকাতের মৌলিক ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হবে না। তোমাদের বলা হয়েছিল, যারা আল্লাহর আয়াতের প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহর নিজের রহমত কেবল তাদের জন্যই লিখে রেখেছেন। তাইতো আজ এ নবীর ওপর যেসব আয়াত নাযিল হচ্ছে সেগুলো অস্বীকার করে তোমরা কোনক্রমেই আল্লাহর আয়াত মান্যকারী হিসেবে স্বিকৃতি পেতে পারনা। কাজেই তোমরা তাওরাতের প্রতি ঈমান রাখার যতই দাবী কর না কেন যতদিন তোমরা এ নবীর প্রতি ঈমান আনবে না ততদিন এ শেষ শর্তটিও পূর্ণ হবে না।
এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য “উম্মী” শব্দটি ব্যবহারও বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। বনী ইসরাঈলীরা নিজেদের ছাড়া দুনিয়ার অন্য জাতিদেরকে উম্মী (Gentiles) বলতো। কোন উম্মীর নেতৃত্ব গ্রহণ করা তো দূরের কথা উম্মীদের জন্য নিজেদের সমান মানবিক অধিকার স্বীকার করাও ছিল তাদের জাতীয় মর্যাদা ও অহংকারের পরিপন্থী। তাই কুরআনেই বলা হয়েছেঃ لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ(উম্মীদের ধন-সম্পদ ভোগ দখল করার জন্য আমাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না। (আলে ইমরান ৭৫ আয়াত) কাজেই আল্লাহ এক্ষেত্রে তাদেরই পরিভাষা ব্যবহার করে বলছেন, এখন তো এ উম্মীর সাথে তোমাদের ভাগ্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর আনুগত্য স্বীকার করলে তোমরা আমার অনুগ্রহের অংশ লাভ করবে, নয়তো শত শত বছর থেকে তোমরা আমার যে ক্রোধের শিকার হয়ে আসছো এখনো তাই তোমাদের কপালে লেখা হবে।
১১৩.
দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাওরাত ও ইনজীলের নিম্নোক্ত স্থানগুলো দেখুন। এসব স্থানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮: ১৫-১৯, মথি ২১: ৩৩-৪৬, যোহন ১: ১৯-২১, যোহন ১৪: ১৫-১৭ এবং ২৫-৩০, যোহন ১৫: ২৫-২৬, যোহন ১৬: ৭-১৫)
১১৪.
অর্থাৎ যে পাক-পবিত্র জিনিসগুলো তারা হারাম করে রেখেছে, সেগুলো তিনি হালাল করে দেন এবং যেসব নাপাক ও অপবিত্র জিনিস তারা হালাল করে নিয়েছে, সেগুলো তিনি হারাম গণ্য করেন।
১১৫.
অর্থাৎ তাদের ফকীহরা নিজেদের আইনগত সূক্ষ্মতম বিশ্লেষণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক নেতৃবর্গ নিজেদের ধার্মিকতা ও পরহেজগারীর অতি বাড়াবাড়ির সাহায্যে এবং মূর্খ সাধারণ মানুষ নিজেদের কল্প কুসংস্কার ও মনগড়া নীতি-নিয়মের বেড়াজালে আটকে তাদের জীবনকে যেসব বোঝার নীচে দাবিয়ে রাখে এবং যেসব বাঁধনে তাদেরকে বেঁধে রাখে, এ নবী সেই সমস্ত বোঝা নামিয়ে দেন এবং সমস্ত বাঁধন খুলে দেন।
১১৬.
মূল আলোচনা চলছিল বনী ইসরাঈল সম্পর্কে। মাঝখানে প্রসঙ্গক্রমে আলোচ্য বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। এখান থেকে আবার বক্তৃতার ধারা পরিবর্তন করে আগের আলোচনায় ফিরে আসা হয়েছে।
১১৭.
অধিকাংশ অনুবাদক এ আয়াতের অনুবাদ এভাবে করেছেন-“মূসার জাতির মধ্যে এমন একটি দল আছে যারা সত্য অনুযায়ী পথনির্দেশ দেয় ও ইনসাফ করে।” অর্থাৎ তাদের মতে কুরআন নাযিল হবার সময় বনী ইসরাঈলীদের যে নৈতিক ও মানসিক অবস্থা বিরাজমান ছিল তারই কথা এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু পূর্বাপর আলোচনা বিশ্লেষণ করে আমরা এ মতটিকেই অগ্রাধিকার দিতে চাই যে, এখানে হযরত মূসার সময় বনী ইসরাঈলীদের যে অবস্থা ছিল তারই কথা বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে এ বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ জাতির মধ্যে যখন বাছুর পূজার অপরাধ অনুষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ওপর পাকড়াও করা হয়, তখন সমগ্র জাতি গোমরাহ ছিল না। বরং তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তখনো সৎ ছিল।
১১৮.
সূরা মায়েদার ১২ আয়াতে বনী ইসরাঈলের সমাজ কাঠামো পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে যে কথা বলা হয়েছে এবং বাইবেলের গণনা পুস্তকে যে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেদিকেই এ আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর আদেশে হযরত মূসা সিনাই পাহাড়ের জনবসতিহীন এলাকায় অবস্থানকালে বনী ইসরাঈল জাতির আদমশুমারী সম্পন্ন করেন। হযরত ইয়াকূবের দশ ছেলে এবং হযরত ইউসুফের দুই ছেলের বংশের ভিত্তিতে ১২ টি পরিবারকে পৃথকভাবে ১২টি গোত্র বা গোষ্ঠীতে বিন্যস্ত ও সংগঠিত করেন। প্রত্যেকটি দলে একজন সরদার নিযুক্ত করেন। তাদের দায়িত্ব ছিল, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক দিক দিয়ে দলের মধ্যে নিয়ম-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং তাদের মধ্যে শরীয়াতের বিধান জারী করা। এছাড়া হযরত ইয়াকুবের যে দ্বাদশতম পুত্র লাবীর বংশে হযরত মূসা ও হযরত হারুনের জন্ম হয়েছিল, সেই শাখাটিকে বাদবাকী সব ক'টি গোত্রের মধ্যে সত্যের আলোক শিখা সমুজ্জ্বল রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য একটি পৃথক দলের আকারে সংগঠিত করেন।
১১৯.
ওপরে যে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে, সেটি ছিল মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলীদের ওপর যেসব অনুগ্রহ করেছিলেন তার অন্যতম। এরপর এখানে আরো তিনটি অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
একঃ সিনাই উপদ্বীপের জনমানবহীন এলাকায় তাদের জন্য অলৌকিক উপায়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। দুই, রৌদ্র তাপ থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের ওপর আকাশে মেঘমালার ছায়া রচনা করা হয়। তিন, মান্না ও সালওয়ার আকারে তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহের অস্বাভাবিক ব্যবস্থা করা হয়। তাদের জীবন ধারণের জন্য এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা না করা হলে কয়েক লাখ জনসংখ্যা সম্বলিত এ জাতিটি এ খাদ্য-পানীয় বিহীন পাহাড়-মরু-প্রান্তরে ক্ষুধা পিপাসায় একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। আজো কোন ব্যক্তি সেই এলাকায় গেলে সেখানকার পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে যাবে। অকস্মাৎ পনের-বিশ লাখ মানুষ যদি সেই এলাকায় গিয়ে ওঠে তাহলে তাদের জন্য খাদ্য পানীয় ও ছায়াদানের কি ব্যবস্থা করা যেতে পারে, তা তার মাথায়ই আসবে না। বর্তমানে সমগ্র সিনাই উপদ্বীপের জনসংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশী নয়। আর আজ এই বিশ শতকেও যদি কোন দেশের শাসক সেখানে ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাদের জন্য খাদ্য পানীয় সরবরাহের ব্যবস্থাপনা তার বিশেষজ্ঞদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে আল্লাহর কিতাব অমান্যকারী ও মুজিযা অস্বীকারকারী বহু আধুনিক পুরাতত্ত্ববিদ ও গবেষকগণ একথা মানতেই চান না যে, বনী ইসরাঈলীরা সিনাই উপদ্বীপের কুরআনে ও বাইবেলে উল্লেখিত অংশ অতিক্রম করেছিল। তাদের ধারণা, সম্ভবত এ ঘটনাগুলো ফিলিস্তিনের দক্ষিণে ও আরবের উত্তরের এলাকায় কোথাও সংঘটিত হয়ে থাকবে। সিনাই উপদ্বীপের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবেশ যে রকম, তা দেখে তারা কল্পনাও করতে পারেন না যে এত বড় একটা জাতির পক্ষে এখানে বছরের পর বছর এক একটি এলাকায় তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করতে করতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে যখন মিসরের দিক থেকেও তাদের খাদ্য সরবরাহের পথ রুদ্ধ ছিল এবং অন্যদিকে পূর্ব ও উত্তরে আমালিকা গোত্রগুলো তাদের বিরোধিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এসব বিষয় বিবেচনা করলে সঠিকভাবে অনুমান করা যেতে পারে যে, এ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বনি ইসরাঈলীদের প্রতি নিজের যে সমস্ত অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন, তা আসলে কত বড় অনুগ্রহ ছিল। এরপর আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের এ ধরনের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিদর্শনাবলী দেখার পরও আল্লাহর সাথে এ জাতির নাফরমানী ও বিশ্বাসঘাতকতার যে ধারাবাহিক ঘটনাবলীতে ইতিহাসের পাতা পরিপূর্ণ, তা থেকে বুঝা যায় যে তারা কত বড় অকৃতজ্ঞ ছিল। (তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা বাকারা ৭২, ৭৩ ও ৭৬ টীকা)