৮১ ) তারা মুখে বলে, আমরা অনুগত ফরমাবরদার। কিন্তু যখন তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায় তখন তাদের একটি দল রাত্রে সমবেত হয়ে তোমার কথার বিরুদ্ধে পরামর্শ করে। আল্লাহ তাদের এই সমস্ত কানকথা লিখে রাখছেন। তুমি তাদের পরোয়া করো না, আল্লাহর ওপর ভরসা করো, ভরসা করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
وَيَقُولُونَ طَاعَةٌ فَإِذَا بَرَزُوا۟ مِنْ عِندِكَ بَيَّتَ طَآئِفَةٌ مِّنْهُمْ غَيْرَ ٱلَّذِى تَقُولُ وَٱللَّهُ يَكْتُبُ مَا يُبَيِّتُونَ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلًا ٨١
৮২ ) তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? যদি এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এর মধ্যে বহু বর্ণনাগত অসঙ্গতি খুঁজে পেতো। ১১১
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلْقُرْءَانَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُوا۟ فِيهِ ٱخْتِلَٰفًا كَثِيرًا ٨٢
৮৩ ) তারা যখনই কোন সন্তোষজনক বা ভীতিপ্রদ খবর শুনতে পায় তখনই তা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। অথচ তারা যদি এটা রসূল ও তাদের জামায়াতের দায়িত্বশীল লোকদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়, তাহলে তা এমন লোকদের গোচরীভূত হয়, যারা তাদের মধ্যে কথা বলার যোগ্যতা রাখে এবং তা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ১১২ তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না হতো তাহলে (তোমাদের এমন সব দুর্বলতা ছিল যে) মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া তোমরা সবাই শয়তানের পেছনে চলতে থাকতে।
وَإِذَا جَآءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ ٱلْأَمْنِ أَوِ ٱلْخَوْفِ أَذَاعُوا۟ بِهِۦ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى ٱلرَّسُولِ وَإِلَىٰٓ أُو۟لِى ٱلْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ ٱلَّذِينَ يَسْتَنۢبِطُونَهُۥ مِنْهُمْ وَلَوْلَا فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُۥ لَٱتَّبَعْتُمُ ٱلشَّيْطَٰنَ إِلَّا قَلِيلًا ٨٣
৮৪ ) কাজেই হে নবী! তুমি আল্লাহর পথে লড়াই করো। তুমি নিজের সত্তা ছাড়া আর কারো জন্য দায়ী নও। অবশ্যি ঈমানদারদেরকে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করো। আল্লাহ শীঘ্রই কাফেরদের শক্তির মস্তক চূর্ণ করে দেবেন। আল্লাহর শক্তি সবচেয়ে জবরদস্ত এবং তাঁর শাস্তি সবচেয়ে বেশী কঠোর।
فَقَٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ ٱلْمُؤْمِنِينَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَكُفَّ بَأْسَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَٱللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنكِيلًا ٨٤
৮৫ ) যে ব্যক্তি কল্যাণ ও সৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি অকল্যাণ ও অসৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে। ১১৩ আর আল্লাহ সব জিনিসের প্রতি নজর রাখেন।
مَّن يَشْفَعْ شَفَٰعَةً حَسَنَةً يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٌ مِّنْهَا وَمَن يَشْفَعْ شَفَٰعَةً سَيِّئَةً يَكُن لَّهُۥ كِفْلٌ مِّنْهَا وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ مُّقِيتًا ٨٥
৮৬ ) আর যখনই কেউ মর্যাদা সহকারে তোমাকে সালাম করে তখন তাকে তার চাইতে ভালো পদ্ধতিতে জবাব দাও অথবা কমপক্ষে তেমনিভাবে। ১১৪ আল্লাহ সব জিনিসের হিসেব গ্রহণকারী।
وَإِذَا حُيِّيتُم بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا۟ بِأَحْسَنَ مِنْهَآ أَوْ رُدُّوهَآ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ حَسِيبًا ٨٦
৮৭ ) আল্লাহ তিনিই যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি তোমাদের সবাইকে সেই কিয়ামতের দিন একত্র করবেন, যার আসার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর আল্লাহর কথার চাইতে বেশী সত্য আর কার কথা হতে পারে? ১১৫
ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَٰمَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ ٱللَّهِ حَدِيثًا ٨٧
৮৮ ) তারপর তোমাদের কী হয়েছে, মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে দ্বিমত পাওয়া যাচ্ছে? ১১৬ অথচ যে দুষ্কৃতি তারা উপার্জন করেছে তার বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ১১৭ তোমরা কি চাও, আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করেননি তোমরা তাকে হিদায়াত করবে? অথচ আল্লাহ যাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তার জন্য তুমি কোন পথ পাবে না।
فَمَا لَكُمْ فِى ٱلْمُنَٰفِقِينَ فِئَتَيْنِ وَٱللَّهُ أَرْكَسَهُم بِمَا كَسَبُوٓا۟ أَتُرِيدُونَ أَن تَهْدُوا۟ مَنْ أَضَلَّ ٱللَّهُ وَمَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلًا ٨٨
৮৯ ) তারা তো এটাই চায়, তারা নিজেরা যেমন কাফের হয়েছে তেমনি তোমরাও কাফের হয়ে যাও, যাতে তারা ও তোমরা সমান হয়ে যাও। কাজেই তাদের মধ্য থেকে কাউকেও নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে আসে। আর যদি তারা (হিজরত থেকে) বিরত থাকে, তাহলে তাদেরকে যেখানেই পাও ধরো এবং হত্যা করো ১১৮ এবং তাদের মধ্য থেকে কাউকেও নিজেদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না।
وَدُّوا۟ لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا۟ فَتَكُونُونَ سَوَآءً فَلَا تَتَّخِذُوا۟ مِنْهُمْ أَوْلِيَآءَ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَخُذُوهُمْ وَٱقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَلَا تَتَّخِذُوا۟ مِنْهُمْ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ٨٩
৯০ ) অবশ্যি সেই সব মুনাফিক এই নির্দেশের আওতাভুক্ত নয়, যারা এমন কোন জাতির সাথে মিলিত হয়, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ। ১১৯ এভাবে সেই সব মুনাফিকও এর আওতাভুক্ত নয়, যারা তোমাদের কাছে আসে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে অনুৎসাহিত, না তোমাদের বিরুদ্ধে লড়তে চায়, না নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে। আল্লাহ চাইলে তাদেরকে তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন এবং তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। কাজেই তারা যদি তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে আর তোমাদের দিকে সন্ধি ও সখ্যতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার কোন পথ রাখেননি।
إِلَّا ٱلَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَىٰ قَوْمٍۭ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَٰقٌ أَوْ جَآءُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَن يُقَٰتِلُوكُمْ أَوْ يُقَٰتِلُوا۟ قَوْمَهُمْ وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ لَسَلَّطَهُمْ عَلَيْكُمْ فَلَقَٰتَلُوكُمْ فَإِنِ ٱعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَٰتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْا۟ إِلَيْكُمُ ٱلسَّلَمَ فَمَا جَعَلَ ٱللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلًا ٩٠
১১১.
মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকদের যে আচরণ সম্পর্কে ওপরের আয়াতগুলোতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে তার প্রধান ও আসল কারণ ছিল এই যে, কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হবার ব্যাপারে তাদের মনে সন্দেহ ছিল। তারা একথা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সত্যি সত্যিই রসূলের ওপর অহী নাযিল হয় এবং এই যে হিদায়াতগুলো আসছে, এগুলো সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে আসছে। তাই তাদের মুনাফেকী আচরণের নিন্দা করার পর এখন বলা হচ্ছে, তারা কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাই করে না। কেননা এই গ্রন্থ নিজেই সাক্ষী দিচ্ছে যে, এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারও বাণী হতেই পারে না। কোন মানুষের ক্ষমতা নেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দিতে থাকবে এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত ভাষণ একটি সুসামঞ্জস্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও এক বর্ণের মোতির মালায় পরিণত হবে। এর কোন অংশ অন্য অংশের সাথে সংঘর্ষশীল হবে না। এর মধ্যে মত পরিবর্তনের কোথাও কোন নাম নিশানাও পাওয়া যাবে না। ভাষণদাতার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানসিক অবস্থার কোন প্রতিফলনও সেখানে দেখা যাবে না। এই ভাষণের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করার কোন প্রশ্নই কখনো উত্থাপিত হবে না। এই ধরনের ভাষণ দেয়া কোন মানুষের জন্য কোন কালেই সম্ভবপর নয়।
১১২.
এ সময় সারাদেশে জরুরী অবস্থা বিরাজ করছিল। তাই চারদিকে নানান ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। কখনো ভিত্তিহীন অতিরঞ্জিতআশঙ্কার খবর এসে পৌঁছতো। এর ফলে হঠাৎ মদীনা ও তার আশেপাশে ভীতি ছড়িয়ে পড়তো। কখনো ধূর্ত শত্রু কোন যথার্থ বিপদকে গোপন করার জন্য সন্তোষজনক খবর পাঠাতো এবং তা শুনে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত ও গাফেল হয়ে পড়তো। এই গুজব ছড়াবার ব্যাপারে নিছক হাংগামাবাজ লোকেরা বড়ই উৎসাহ বোধ করতো। তাদের কাছে ইসলাম ও জাহেলীয়াতের এই সংঘাত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। এই ধরনের দায়িত্বহীন গুজব রটানোর পরিণতি কত সূদুর প্রসারী হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। তাদের কানে কোন কথা পড়লেই হলো, তারা তাই নিয়ে জায়গায় ফুঁকে দিতে থাকতো। এই আয়াতে এই ধরনের লোকদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে এবং তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়ে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকার এবং কোন কিছু শুনলে তা সঙ্গে সঙ্গেই দায়িত্বশীলদের কানে পৌঁছিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ নীরবতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১১৩.
অর্থাৎ এটা যার যেমন পছন্দ এবং যেমন ভাগ্য। কেউ আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালাবার এবং সত্যের শির উঁচু রাখার জন্য লোকদের উৎসাহিত করে-এর পুরস্কারও সে পায়। আবার কেউ মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলার, তাদেরকে নির্বীর্য ও সাহসহীন করার এবং তাদেরকে আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার জন্য নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে- এর শাস্তিও সে পায়।
১১৪.
সে সময় মুসলিম ও অমুসলিমদের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আর সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলে অবস্থা যেমন দাঁড়ায় অর্থাৎ কোথাও মুসলমানরা যেন অন্যদের সাথে অসদ্ব্যবহার না করে, এরআশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তাই তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যারা তোমাদের সাথে সম্মানজনক ব্যবহার করবে তোমরাও তাদের সাথে তেমনি সম্মানজনক বা তার চাইতেও বেশী সম্মানজনক ব্যবহার করবে। ভদ্রতা ও রুচিশীলতার জবাব ভদ্রতা ও রুচিশীলতার মাধ্যমে দাও। বরং তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে তোমরা অন্যদের চাইতেও বেশী ভদ্রতা রুচিশীলতার পরিচয় দেবে। দুনিয়াকে ন্যায় ও সত্যের সরল পথের দিকে আহবান জানানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যে আহবায়ক দলটির যাত্রা শুরু হয়েছে, তার জন্য প্রতিপক্ষের প্রতি বিকৃত মুখভংগী করা এবং রূঢ় ব্যবহার ও তিক্ত বাক্যবাণে তাদেরকে বিদ্ধ করা শোভা পায় না। এতে নফস পরিতৃপ্ত হয় ঠিকই কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তাদের অভিযাত্রা তা পুরোপুরি নিষ্ফল হয়ে যায়।
১১৫.
অর্থাৎ কাফের, মুশরিক ও নাস্তিকরা যা কিছু করছে তাতে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বে কোন পরিবর্তন সূচিত হয় না। তাঁর এক আল্লাহ এবং নিরংকুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা-সম্পন্ন ইলাহ হওয়া এমন একটি বাস্তব সত্য, যাকে উল্টে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তারপর একদিন তিনি সমগ্র মানব জাতিকে একত্রে সমবেত করে তাদের প্রত্যেককে তার কর্মফল দেখিয়ে দেবেন। তাঁর ক্ষমতার সীমানা পেরিয়ে কেউ পালিয়ে যেতে পারবে না। কাজেই আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহাত্মক আচরণকারীদের বিরুদ্ধে কেউ তাঁর পক্ষ থেকে বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করবে এবং তাদের সাথে অসদাচরণ করে ও তিক্ত বাক্য শেলে তাদেরকে বিদ্ধ করে আহত হৃদয়ে প্রলেপ লাগাবে, আল্লাহর এর কোন প্রয়োজন নেই।
এটা হচ্ছে এই আয়াতটির সাথে উপরের আয়াতের সম্পর্কের বিষয়। কিন্তু পেছনের দু’-তিন রুকূ’ থেকে যে বর্ণনার ধারাবাহিকতা চলে আসছে এই আয়াতটিতে তার বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটেছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে আয়াতটির অর্থ এই দাঁড়ায়, দুনিয়ার জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তি তার ইচ্ছেমতো পথে চলতে পারে এবং যে পথে ইচ্ছে সে তার প্রচেষ্টা ও কর্মশক্তি নিয়োগ করতে পারে। এ ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সবশেষে একদিন সবাইকে আল্লাহর সামনে হাযির হতে হবে। সেদিন আল্লাহর ছাড়া আর কোন প্রভূ থাকবে না। সেখানে সবাই নিজের প্রচেষ্টা ও কাজের ফল স্বচক্ষে দেখে নেবে।
১১৬.
এখানে এমন সব মুনাফিক মুসলমানদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা মক্কায় ও আরবের অন্যান্য এলাকায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে না এসে যথারীতি নিজেদের কাফের গোত্রের মধ্যে অবস্থান করছিল। তাদের কাফের গোত্র ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব কাজ করতো তারাও তাদের সাথে কমবেশী এসব কাজে কার্যত অংশ নিতো। তাদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা যায়, এ বিষয়টি মুসলমানদের জন্য আসলে অত্যন্ত জটিল ছিল। কেউ কেউ বলছিল, যাই হোক না কেন, তারা তো মুসলমান, কালেমা পড়ে, নামায পড়ে, রোযা রাখে, কুরআন তেলাওয়াত করে। তাদের সাথে কাফেরদের মতো ব্যবহার কেমন করে করা যেতে পারে? এই রুকূ’তে মহান আল্লাহ মুসলমানদের মতবিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা করে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে। অন্যথায় কুরআনের কেবল এই জায়গায় নয় আরো বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে হিজরত না করার কারণে মুসলমানদেরকে মুনাফিকদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, সেখানে কুরআন মজীদের আসল বক্তব্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। আসলে নবী ﷺ যখন মদীনা তাইয়েবায় হিজরত করে আসেন এবং যখন আরব দেশে এমন একটি ছোট্ট ভূখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একজন মু’মিন বান্দার জন্য তার দ্বীন ও ঈমানের দাবী পুরণ করা সম্ভবপর ছিল তখন যেখানে, যে এলাকায় ও যেসব গোত্রের মধ্যে ঈমানদারগণ কাফেরদের অধীনে ইসলামী জীবন যাপনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল, সেখান থেকে তাদের জন্য হিজরত করার ও মদীনার দারুল ইসলামে চলে আসার সাধারণ হুকুমনামা জারী করে দেয়া হয়েছিল। সে সময় তাদের হিজরত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র এজন্য হিজরত করছিল না যে, তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ তাদের কাছে ইসলামের তুলনায় বেশী প্রিয় ছিল, তাদের সবাইকে মুনাফিক গণ্য করা হয়। আর যারা যথার্থই একেবারে অক্ষম ছিল তাদেরকে ‘মুসতাদআফীন’ (দুর্বল) গণ্য করা হয়। যেমন পরবর্তী ১৪ রুকূ’তে বলা হয়েছে।
এখন একথা সুস্পষ্ট যে, দারুল কুফরে অবস্থানকারী কোন মুসলমানকে নিছক হিজরত না করার কারণে মুনাফিক কেবলমাত্র তখনি বলা যেতে পারে যখন দারুল ইসলামের পক্ষ থেকে এ ধরনের মুসলমানদেরকে সেখানে বসবাস করার আহবান জানানো হবে অথবা কমপক্ষে তাদের জন্য দারুল ইসলামের দরজা উন্মুক্ত থাকবে। এ অবস্থায় অবশ্যি যেসব মুসলমান দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে না আবার অন্য দিকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হিজরাতও করবে না তারা সবাই মুনাফিক বলে গণ্য হবে। কিন্তু দারুল ইসলামের পক্ষ থেকে যদি আমন্ত্রণই না জানানো হয় এবং মুহাজিরদের জন্য তাদের দরজা যদি উন্মুক্তই না থাকে, তাহলে এ অবস্থায় শুধুমাত্র হিজরত না করলে কোন মুসলমান মুনাফিক হয়ে যাবে না। বরং এ অবস্থায় যখন সে কোন মুনাফিক সুলভ কাজ করবে কেবলমাত্র তখনই মুনাফিক গণ্য হবে।
১১৭.
অর্থাৎ যে দ্বিমুখী নীতি, সুবিধাবাদিতা এবং আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেবার কর্মনীতি তারা অবলম্বন করেছে, তার বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে আবার সেদিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন যেদিক থেকে তারা এসেছিল। তারা কুফরী থেকে বের হয়ে ইসলামের দিকে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই কিন্তু এই এলাকায় এসে অবস্থান করার এবং একমুখী ও একাগ্র হবার প্রয়োজন ছিল, ঈমান ও ইসলামের স্বার্থের সাথে সংঘর্ষশীল প্রতিটি স্বার্থ পরিহার করার প্রয়োজন ছিল এবং আখেরাতের ওপর এমন দৃঢ় বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল যার ভিত্তিতে মানুষ নিশ্চিন্তে নিজের দুনিয়ার স্বার্থ পরিহার করতে পারে। কিন্তু তা তারা অর্জন করতে পারেনি। তাই তারা যেদিক থেকে এসেছিল পেছন ফিরে আবার সেদিকেই চলে গেছে। কাজেই এখন তাদের ব্যাপারে মতবিরোধ করার আর কোন অবকাশ নেই।
১১৮.
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের জাতিদের সাথে যেসব মুনাফিক মুসলমান সম্পর্ক রাখে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও শত্রুতামূলক কার্যকলাপে কার্যত অংশগ্রহণ করে, তাদের সম্পর্কে এই নির্দেশটি দেয়া হয়েছে।
১১৯.
এখানে আওতাভুক্ত না করার যে নির্দেশটি জারি করা হয়েছে তার সম্পর্ক “তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজেদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না” বাক্যটির সাথে নয়। বরং এর সম্পর্ক হচ্ছে “তাদেরকে যেখানেই পাও ধরো এবং হত্যা কারো” বাক্যটির সাথে। এর অর্থ হচ্ছে, যেসব মুনফিককে হত্যা করা ওয়াজিব, তারা যদি এমন কোন জাতির এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয় যাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের সীমানায় প্রবেশ করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা যাবে না। আর দারুল ইসলামের কোন মুসলমান কোন নিরপেক্ষ দেশের এলাকায় যদি এমন কোন মুনাফিককে পায় যাকে হত্যা করা ওয়াজিব এবং তাকে হত্যাও করে ফেলে, তাহলে এটাও কোনক্রমে বৈধ হবে না। এখানে আসলে মুনাফিকদের রক্তের প্রতি নয় বরং চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনই লক্ষ্য।