ইবনে হিশাম ও বাইহাকী এবং অন্যরা এ ঘটনাকে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বরাত দিয়ে নিন্মোক্তভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আবিসিনিয়ায় হিজরাতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তি এবং তার দাওয়াতের খবর যখন সেই দেশে ছড়িয়ে পড়লো তখন সেখান থেকে প্রায় ২০ জনের একটি খৃস্টান প্রতিনিধি দল প্রকৃত অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য মক্কা মু’আযযমায় এলো। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মসজিদে হারামে সাক্ষাৎ করলো। কুরাইশদের বহু লোকও এ ব্যাপার দেখে আশপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রতিনিধি দলের লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু প্রশ্ন করলেন। তিনি সেগুলোর জবাব দিলেন। তারপর তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআন মজীদের আয়াত তাদের সামনে পাঠ করলেন। কুরআন শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগলো। তারা একে আল্লাহর বাণী বলে অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করলেন এবং নবীর ﷺ প্রতি ঈমান আনলেন। মজলিস শেষ হবার পর আবু জেহেল ও তার কয়েকজন সাথী প্রতিনিধিদলের লোকদেরকে পথে ধরলো এবং তাদেরকে যাচ্ছেতাই বলে তিরস্কার করলো। তাদেরকে বললো, “তোমাদের সফরটাতো বৃথাই হলো। তোমাদের স্বধর্মীয়রা তোমাদেরকে এজন্য পাঠিয়েছিল যে, এ ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে তোমরা যথাযথ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকৃত ও যথার্থ ঘটনা তাদেরকে জানাবে। কিন্তু তোমরা সবেমাত্র তার কাছে বসেছিলে আর এরই মধ্যেই নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে তাঁর প্রতি ঈমান আনলে? তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কখনো আমরা দেখিনি।” একথায় তারা জবাব দিল, “ভাইয়েরা, তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা তোমাদের সাথে জাহেলী বিতর্ক করতে চাই না। আমাদের পথে আমাদের চলতে দাও এবং তোমার তোমাদের পথে চলতে থাকো। আমরা জেনে বুঝে কল্যাণ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করতে পারি না।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা এবং আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩ খণ্ড, ৮২ পৃষ্ঠা। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা শূ’আরা, ১২৩ টীকা)
একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ ﷺ যে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন কেবলমাত্র তার নামই ইসলাম নয় এবং “মুসলিম” পরিভাষাটি শুধুমাত্র নবী করীমের ﷺ অনুসারীগণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিল সকল নবীর দ্বীন এবং সব জামানায় তাঁদের সবার অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। এ মুসলমানরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোন সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং আগত নবীকে মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোন ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিল, পরেও তেমনি থেকেছে।
আশ্চর্যের কথা, বড় বড় জ্ঞানী গুণী ও আলেমদের মধ্যেও কেউ কেউ এ সত্যটি অনুধাবন করতে অক্ষম হয়েছেন। এমনকি এ সুস্পষ্ট আয়াতটি দেখেও তাঁরা নিশ্চিন হননি। আল্লামা সুয়ুতী “মুসলিম” পরিভাষাটি কেবলমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের সাথেই বিশেষভাবে জড়িত এ মর্মে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত একটি বই লিখেছেন। তারপর যখন এ আয়াতটি সামনে এসেছে তখন নিজেই বলেছেন, এখন তো আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম এ মর্মে যে, এ ব্যাপারে আমার হৃদয় প্রসারিত করে দাও। শেষে নিজের অভিমত প্রত্যাহার করার পরিবর্তে তিনি তারই ওপর জোর দিয়েছেন এবং আয়াতটির কয়েকটি ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। এ ব্যাখ্যাগুলোর একটি অন্যটির চেয়ে বেশি ওজনহীন। যেমন তাঁর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমরা কুরআন আসার আগেই মুসলিম হয়ে যাবার সংকল্প পোষণ করতাম। কারণ আমাদের কিতাবসমূহ থেকে আমরা এর আসার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম এবং আমাদের সংকল্প ছিল, তিনি আসলেই আমরা ইসলাম গ্রহণ করে নেব। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ বাক্যাংশে مُسْلِمِينَ শব্দের পরে به শব্দ উহ্য রয়েছে। অর্থ্যাৎ আগে থেকেই আমরা কুরআন মানতাম। কারণ আমরা তার আগমনের আশা পোষণ করতাম এবং পূর্বাহ্ণেই তাঁর প্রতি ঈমান এনে বসেছিলাম। তাই তাওরাত ও ইন্জিল মানার ভিত্তিতে নয় বরং কুরআনকে তাঁর নাযিল হবার পূর্বে যথার্থ সত্য বলে মেনে নেবার জন্যই আমরা মুসলিম ছিলাম। তৃতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ আল্লাহর তকদীরে পূর্বেই আমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের আগমনে আমরা ইসলাম গ্রহণ করে নেবো। তাই আসলে আমরা আগে থেকেই মুসলিম ছিলাম। এই ব্যাখ্যাগুলোর মধ্য থেকে কোনটি দেখে আল্লাহ প্রদত্ত হৃদয়ের প্রশস্ততার কোন প্রভাব সেখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কুরআন কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয় বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্য বর্ণনা করেছে। কুরআন বলছে, আসল দ্বীন হচ্ছে একমাত্র “ইসলাম” (আল্লাহর আনুগত্য) এবং আল্লাহর বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সৃষ্টির জন্য এছাড়া দ্বিতীয় কোন দ্বীন হতে পারে না। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথ নির্দেশ দেবার জন্য এসেছেন তিনি এ দ্বীন নিয়েই এসেছেন। আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম হয়ে থাকার তাগিদ করেছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহর ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতি যুগে মুসলিমই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র গুটিকয় আয়াত পেশ করছিঃ
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
“আসলে আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন।” (আল ইমরানঃ ১৯)
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ
“আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অবলম্বন করে তা কখনো গৃহীত হবে না।” (আল ইমরানঃ ৮৫)
হযরত নূহ আলাইহিস সালাম বলেনঃ
إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِين
“আমার প্রতিদান দেবার দায়িত্ব তো আল্লাহর এবং আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি যেন মুসলিমদের মধ্যে শামিল হয়ে যাই।” (ইউনুসঃ ৭২)
হযরত ইবরাহীম আলাহহিস সালাম এবং তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে বলা হয়
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ - وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ - أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَهَكَ وَإِلَهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
“যখন রব তাঁকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো আমি মুসলিম হয়ে গেলাম রব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই অসিয়াত করে ইবরাহীম তাঁর সন্তানদেরকে এবং ইয়াকুবওঃ হে আমার সন্তানরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলিম না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়াকূবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিল, যখন সে তাঁর পুত্রদের জিজ্ঞেস করেছিল, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার বন্দেগী করবে? তারা জবাব দিয়েছিল আমরা বন্দেগী করবো আপনার মাবুদের এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের মাবুদের, তাঁকে একক মাবুদ হিসেবে মেনে নিয়ে। আর আমরা তাঁরই অনুগত মুসলিম।” (আল বাকারাহঃ ১৩১-১৩৩)
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا
“ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃস্টানও ছিল না বরং একনিষ্ট মুসলিম।” (আলে ইমরানঃ ৬৭)
হযরত ইবরাহীম (আ) ও ইসমাইল (আ) নিজেই দোয়া করেনঃ
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ
“হে আমাদের রব! আমাকে তোমার মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম।” (আল বাকারাহঃ ১২৮)
হযরত লূতের কাহিনীতে বলা হচ্ছে
فَمَا وَجَدْنَا فِيهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“আমরা লূতের জাতির জনপদে একটি ঘর ছাড়া মুসলমানদের আর কোন ঘর পাইনি।” (আয-যারিয়াতঃ ৩৬)
হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেন
تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
“আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।” (ইউসুফঃ ১০১)
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর নিজের জাতিকে বলেনঃ
يَا قَوْمِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِينَ
“হে আমার জাতি! যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁরই ওপর ভরসা করো যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো।” (ইউনূসঃ ৮৪)
বনী ইসরাঈলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয় বরং ইসলাম ছিল। বন্ধু ও শত্রু সবাই একথা জানতো। কাজেই ফেরাউন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছেঃ
آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“আমি মেনে নিলাম বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।” (ইউনূসঃ ৯০)
বনী ইসরাঈলের সকল নবীর দ্বীনও ছিল এ ইসলাম
إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا
“আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যাতে ছিল হিদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগণ যারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফায়সালা করতো যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছিল।” (আল মায়েদাহঃ ৪৪)
এটিই ছিল হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের দ্বীন। সেজন্য সাবার রাণী তাঁর প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে বলেছেন
أَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মুসলিম হয়ে গেলাম।” (আন্ নাম্লঃ ৪৪)
আর এটিই ছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর হাওয়ারীদের (সহযোগী) দ্বীনঃ وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ
“আর যখন আমি হাওয়ারীদের কাছে ওহী পাঠালাম এ মর্মে যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম।” (আল মায়েদাহঃ ১১১)
যদি সন্দেহ পোষণ করা হয় যে, আরবী ভাষায় “ইসলাম” ও “মুসলিম” শব্দ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন ভাষায় কেমন করে ব্যবহৃত হতে পারতো, তাহলে বলতে হয় যে, এটা নিছক একটা অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। কারণ এ আরবী শব্দগুলো আসল বিবেচ্য নয়, আরবী ভাষায় এ শব্দগুলো যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সেটিই মূল বিবেচ্য বিষয়। আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে প্রকৃত দ্বীনটি এসেছে তা খৃস্টবাদ, মূসাবাদ বা মুহাম্মাদবাদ নয় বরং তা হচ্ছে নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহর ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহর যে বান্দা যেখানেই যে যুগে অবলম্বন করেছে সে হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও সত্য চিরন্তন সত্য দ্বীনের অনুসারী। যারা এ দ্বীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন্তরিকতা সহকারে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য মূসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে মুহাম্মাদ সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেনে নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না বরং হতে হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী। পক্ষান্তরে যারা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের উম্মতের মধ্যে না জেনে বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা তাদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বার্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তারা ইহুদী ও খৃস্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনে তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারণ তারা আল্লাহর শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয় বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও “মুসলিম” ছিল না নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে রেখেছিল।”
ثَلاَثَةٌ لَهُمْ أَجْرَانِ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمَنَ بِنَبِيِّهِ ، وَآمَنَ بِمُحَمَّدٍ..............
“তিন ব্যক্তি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবে। তাদের একজন হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে আহলি কিতাবের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং নিজের নবীর প্রতি ঈমান রাখতো, তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিও ঈমান আনে।”
বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে এ আয়াতটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালেবের প্রসঙ্গে নাযিল হয়। তাঁর শেষ সময় উপস্থিত হলে নবী ﷺ নিজের সামর্থ্য মোতাবেক কালেমা লা-ইলাহা ইল্লালাহু-এর প্রতি তাঁর ঈমান আনবার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালান। তিনি চাচ্ছিলেন তাঁর চাচা ঈমানের মধ্য দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন। কিন্তু চাচা তা গ্রহণ না করে আব্দুল মুত্তালিবের অনুসৃত ধর্মের মধ্যে অবস্থান করে জীবন দেয়াকে অগ্রাধিকার দেন। এ ঘটনায় আল্লাহ বলেন إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ “তুমি যাকে ভালবাসো তাকে হিদায়াত করতে পারো না” কিন্তু মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণের পরিচিত পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, একটি আয়াত নবীর জামানায় যে বিশেষ ঘটনা বা ব্যাপারের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয় তাকে তাঁরা আয়াতটির শানে নুযুল বা নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্য ও কার্যকারণ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাই এ হাদীসটি এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদ ইত্যাদিতে আবু হুরাইরা (রাঃ) ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে উমর (রা.) প্রমূখ সাহাবীগণ বর্ণিত অন্যান্য হাদীসগুলো থেকে অনিবার্যভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না যে, সূরা আল কাসাসের এ আয়াতটি আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় নাযিল হয়েছিল। বরং এ থেকে শুধুমাত্র এতটুকু জানা যায় যে, এ আয়াতের বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বাস্তবতা এ ঘটনার সময়ই সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়। যদিও আল্লাহর প্রত্যেকটি বান্দাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা ছিল নবী করীমের ﷺ আন্তরিক ইচ্ছা, তথাপি কোন ব্যক্তির কুফরীর ওপর মৃত্যুবরণ করা যদি তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হতো এবং ব্যক্তিগত ভালবাসা ও সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির হিদায়াত লাভ করার তিনি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন তাহলে তিনি ছিলেন আবু তালেব। কিন্তু তাঁকেই হিদায়াত দান করার শক্তি যখন তিনি লাভ করলেন না তখন একথা একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কাউকে হিদায়াত দান করা বা কাউকে হিদায়াত বঞ্চিত করা নবীর কাজ নয়। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। আর আল্লাহর কাছ থেকে এ সম্পদটি কোন আত্নীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষের সত্যানুরাগ, সত্যপ্রীতি ও সত্যাগ্রহী মানসিকতার ভিত্তিতেই দান করা হয়।
শুরুতে আরবে যে জিনিসটির জন্য কুরাইশ গোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে, সেটি হচ্ছে তাদের হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর হওয়ার বিষয়টি আরবীয় বংশধারার দিক দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ছিল। এ কারণে তাদের বংশটি ছিল আরবদের দৃষ্টিতে পীরজাদার বংশ। তারপর যখন কুশাই ইবনে কিলাবের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে তারা কাবা গৃহের মুতাওয়াল্লী ও পরিচালকে পরিণত হলো এবং মক্কায় তাদের আবাস গড়ে উঠলো তখন তাদের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশী বেড়ে গেল। কারণ এখন তারা ছিল আরবের সবচেয়ে বড় তীর্থ স্থানের পরিচালক। আরবের সকল গোত্রের মধ্যে তারা ধর্মীয় পুরোহিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর হজ্জের কারণে আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না যারা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতো না। এ কেন্দ্রীয় মর্যাদাকে পুঁজি করে কুরাইশরা ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ করতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদেরকে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করে। সে সময় রোম, গ্রীস, মিশর ও সিরিয়ার যত প্রকার বাণিজ্য চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার সাথে চলতো তার সমস্ত পথই ইরান বন্ধ করে দিয়েছিল। লোহিত সাগরের পথটিই ছিল সর্বশেষ পথ। একমাত্র এ পথটিই খোলা ছিল। পরে ইরান যখন ইয়ামেন দখল করে নিল, তখন সে এ পথটিও বন্ধ করে দিল। এখন আরব বণিকরা একদিকে রোম অধিকৃত এলাকার পণ্য সম্ভার আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের বন্দরসমূহে পৌঁছিয়ে দিতে লাগলো এবং অন্যদিকে একই বন্দরসমূহ থেকে পূর্বদেশীয় বাণিজ্যপণ্য নিয়ে রোম সাম্রাজের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে থাকলো। এ ছাড়া এ বাণিজ্যটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হলো। এ সময় কুরাইশরাই বলতে গেলে এ ব্যবসায়ের ইজারাদারী লাভ করে বসেছিল। কিন্তু যেসব উপজাতীয় এলাকার মধ্য দিয়ে এ বাণিয়জ্য পথগুলো গিয়েছিল তাদের সাথে তাদের সাথে আরবদের গভীর বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছাড়া আরবের রাজনৈতিক অরাজকতার পরিবেশে এ ব্যবসায়িক আদান প্রদান সম্ভবপর ছিল না। এ উদ্দেশ্যে কুরাইশ সরদাররা শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর করতে পারতো না। এ জন্য তারা সকল উপজাতির সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে রেখেছিল। ব্যবসায়িক মুনাফায়ও তাদেরকে অংশীদার করতো। উপজাতীয় শেখ ও প্রভাবশালী সরদারদেরকে মূল্যবান তোহ্ফা দিয়ে তুষ্ট করতো। এই সঙ্গে পাতা ছিল সূদী ব্যবসায়ের জাল। এতে জড়িয়ে পড়েছিল প্রায় সকল প্রতিবেশী উপজাতীয় ব্যবসায়ী ও সরদারবৃন্দ।
এ অবস্থায় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওহীদের দাওয়াত সম্প্রসারিত হতে লাগলো তখন বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি অন্ধপ্রীতির চাইতে বড় হয়ে যে জিনিসটি কুরাইশদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠার কারণ হয়ে দেখা দিল সেটি ছিল এই যে, এ দাওয়াতের ফলে তারা নিজেদের স্বার্থহানির আশংকা করছিল। তারা মনে করছিল, যুক্তিপূর্ণ দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে শিরক ও মূর্তিপূজা মিথ্যা এবং তাওহীদ সঠিক প্রমাণিত হয়ে গেলেও তো তাকে পরিত্যাগ করে একে গ্রহণ করে নেয়া আমাদের জন্য ধ্বংসকর হবে। এমনটি করার সাথে সাথেই সমগ্র আরবের অধিবাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কাবাগৃহের পরিচালনায় দায়িত্ব থেকে আমাদের সরিয়ে দেবে। সন্ধি চুক্তির ফলে মূর্তিপূজক উপজাতিগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যার ভিত্তিতে আমাদের বাণিজ্য কাফেলা দিন-রাত আরবের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা সবই ছিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে এ দ্বীনটি আমাদের ধর্মীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং এই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও অবসান ঘটাবে। বরং বিচিত্র নয় যে, আরবের সমস্ত উপজতি মিলে আমাদের মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করবে।
এখানে এসে দুনিয়া পূজারীদের প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির অভাবের এক বিষ্ময়কর চিত্র মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করেছিলেন যে, তোমাদের সমানে আমি যে কালেমা পেশ করছি তা মেনে নাও, আরব ও আজম তোমাদের পদাবনত হয়ে যাবে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা সা’দ, ভূমিকা : ঐতিহাসিক পটভূমি) কিন্তু তারা এর মধ্যে নিজেদের মৃত্যু দেখছিল। তারা মনে করছিল, আমরা আজ যে সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করেছি এও খতম হয়ে যাবে। তারা আশংকা করছিল, এ কালেমা গ্রহণ করার সাথে সাথেই আমরা সরেজমিনে এমনই বন্ধু-বান্ধব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়বো যে, চিল-কাকেরা আমাদের গায়ের গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল না যে, মাত্র কয়েক বছর পরেই সমগ্র আরব ভূ-খন্ড মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাভূক্ত হতে যাচ্ছিল। তারপর এ একই প্রজন্মের জীবনকালেই ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর সব দেশই এক এক করে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাধীন হতে চলছিল। আর এ উক্তির পরে এক শতক অতিক্রান্ত হবার আগেই কুরাইশ বংশীয় খলিফাগণই সিন্ধু থেকে স্পেন এবং কাফ্ফাজ থেকে ইয়ামেনের উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত দুনিয়ার একটি বৃহত্তম অংশের শাসন পরিচালনা করতে যাচ্ছিল।