নিরেট সত্যের আলোকে বিচার করলে বলা যায় মানুষের ধন-প্রাণের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। কারণ তিনিই তার কাছে যা কিছু আছে সব জিনিসের স্রষ্টা। সে যা কিছু ভোগ ও ব্যবহার করেছে তাও তিনিই তাকে দিয়েছেন। কাজেই এদিক দিয়ে তো কেনাবেচার কোন প্রশ্নেই ওঠে না। মানুষের এমন কিছু নেই, যা সে বিক্রি করবে। আবার কোন জিনিস আল্লাহর মালিকানার বাইরেও নেই, যা তিনি কিনবেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন একটি জিনিস আছে, যা আল্লাহ পুরোপুরি মানুষের হাতে সোর্পদ করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে তার ইখতিয়ার অর্থাৎ নিজের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (Free will and freedom of choice)। এ ইখতিয়ারের কারণে অবশ্যই প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মানুষ এ মর্মে স্বাধীনতা লাভ করে যে, সে চাইলে প্রকৃত সত্যকে মেনে নিতে পারে এবং চাইলে তা অস্বীকার করতে পারে। অন্য কথায় এ ইখতিয়ারের মানে এ নয় যে মানুষ প্রকৃত পক্ষে তার নিজের প্রাণের নিজের বুদ্ধিবৃত্তি ও শারীরিক শক্তির এবং দুনিয়ায় সে যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেছে, তার মালিক হয়ে গেছে। এ সঙ্গে এ জিনিসগুলো সে যেভাবে চাইবে সেভাবে ব্যবহার করার অধিকার লাভ করেছে, একথাও ঠিক নয়। বরং এর অর্থ কেবল এতটুকুই যে, তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, আল্লাহর পক্ষে থেকে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি ছাড়াই সে নিজেরই নিজের সত্তার ও নিজের প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর আল্লাহর মালিকানা ইচ্ছা করলে স্বীকার করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে নিজেই নিজের মালিক হয়ে যেতে পারে এবং নিজেই একথা মনে করতে পারে যে, সে আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে নিজের ইখতিয়ার তথা স্বাধীন কর্মক্ষমতার সীমানার মধ্যে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার অধিকার রাখে। এখানেই কেনা-বেচার প্রশ্নটা দেখা দেয়। আসলে এ কেনা-বেচা এ অর্থে নয় যে, মানুষের একটি জিনিস আল্লাহ কিনতে চান, বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি আল্লাহর মালিকানাধীন যাকে তিনি আমানত হিসেবে মানুষের হাতে সোর্পদ করেছেন এবং যে ব্যাপারে বিশ্বস্ত থাকার বা অবিশ্বস্ত হবার স্বাধীনতা তিনি মানুষকে দিয়ে রেখেছেন সে ব্যাপারে তিনি মানুষের দাবী করেন, আমার জিনিসকে তুমি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে (বাধ্য হয়ে নাও)। এ সঙ্গে খেয়ানত করার যে স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছি তা তুমি নিজেই প্রত্যাহার করো। এভাবে যদি তুমি দুনিয়ার বর্তমান অস্থায়ী জীবনে নিজের স্বাধীনতাকে (যা তোমার অর্জিত নয় বরং আমার দেয়া) আমার হাতে বিক্রি করে দাও তাহলে আমি পরবর্তী চিরন্তন জীবনে এর মূল্য জান্নাতের আকারে তোমাকে দান করবো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কেনা-বেচার এ চুক্তি সম্পাদন করে সে মু’মিন। ঈমান আসলে এ কেনা-বেচার আর এক নাম। আর যে ব্যক্তি এটা অস্বীকার করবে অথবা অঙ্গীকার করার পরও এমন আচরণ করবে যা কেবলমাত্র কেনা-বেচা না করার অবস্থায় করা যেতে পারে সে কাফের। আসলে এ কেনা-বেচাকে পাস কাটিয়ে চলার পারিভাষিক নাম কুফরী। কেনা-বেচার এ তাৎপর্য ও স্বরূপটি অনুধাবন করার পর এবার তার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা যাকঃ
এক এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মানুষকে দু’টি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবার পর সে মালিকাকে মালিক মনে করার এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের পর্যায়ের নেমে না আসার মতো সৎ আচরণ করে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নিজের প্রভু ও মালিক আল্লাহর কাছ থেকে আজ নগদ যে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, না বরং মরার পর পরকালীন জীবনে যে মূল্য আদায় করার ওয়াদা তার পক্ষ থেকে করা হয়েছে তার বিনিময়ে নিজের আজকের স্বাধীনতা ও তার যাবতীয় স্বাদ বিক্রি করতে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাজী হয়ে যাবার মত আস্থা তার প্রতি আছে কিনা।
দুইঃ যে ফিকাহর আইনের ভিত্তিতে দুনিয়ার ইসলামী সমাজ গঠিত হয় তার দৃষ্টিতে ঈমান শুধুমাত্র কতিপয় বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। এ স্বীকৃতির পর নিজের স্বীকৃতি ও অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে মিথ্যুক হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত শরীয়াতের কোন বিচারক কাউকে অমু’মিন বা ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত ঘোষণা করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ঈমানের তাৎপর্য ও স্বরূপ হচ্ছে, বান্দা তার চিন্তা ও কর্ম উভয়ের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ক্ষমতা আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দিবে এবং নিজের মালিকানার দাবী পুরোপুরি তার সপক্ষে প্রত্যাহার করবে। কাজেই যদি কোন ব্যক্তি ইসলামের কালেমার স্বীকৃতি দেয় এবং নামায-রোযা ইত্যাদির বিধানও মেনে চলে, কিন্তু নিজেকে নিজের দেহ ও প্রাণের নিজের মন, মস্তিষ্ক ও শারীরিক শক্তির নিজের ধন-সম্পদ, উপায়, উপকরণ ইত্যাদির এবং নিজের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত জিনিসের মালিক মনে করে এবং সেগুলোকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করার স্বাধীনতা নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখে, তাহলে হয়তো দুনিয়ায় তাকে মু’মিন মনে করা হবে কিন্তু আল্লাহর কাছে সে অবশ্যই অমু’মিন হিসেবে গণ্য হবে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে কেনা-বেচার ব্যাপারে ইমানের আসল তাৎপর্য ও স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সে আল্লাহর সাথে আদতে কোন কেনা-বেচার কাজই করেননি। যেখানে আল্লাহ চান সেখানে ধন প্রাণ নিয়োগ না করা এবং যেখানে তিনি চান না সেখানে ধন প্রাণ নিয়োগ ও ব্যবহার করা-এ দু’টি কার্য ধারাই চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করে দেয় যে, ইমানের দাবীদার ব্যক্তি তার ধন প্রাণ আল্লাহর হাতে বিক্রি করেইনি অথবা বিক্রির চুক্তি করার পরও সে বিক্রি করা জিনিসকে যথারীতি নিজের মনে করেছে।
তিনঃ ঈমানের এ তাৎপর্য ও স্বরূপ ইসলামী জীবনাচরণকে কাফেরী জীবনাচরণ থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে মুসলিম ব্যক্তি সঠিক অর্থে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে সে জীবনের সকল বিভাগে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে কাজ করে। তার আচরণে কোথাও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটতে পারে না। তবে কোন সময় সাময়িকভাবে সে গাফলতির শিকার হতে পারে এবং আল্লাহর সাথে নিজের কেনা-বেচার চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা অবলম্বন করাও তার পক্ষে সম্ভব। এটা অবশ্যই ভিন্ন ব্যাপার। অনুরূপভাবে ঈমানদারদের সমন্বয়ে গঠিত কোন দল বা সমাজ সমষ্টিগতভাবেও আল্লাহর ইচ্ছা ও তার শরয়ী আইনের বিধিনিষেধ মুক্ত হয়ে কোন নীতি পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় নীতি, তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতি এবং কোন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক আচরণ অবলম্বন করতে পারে না। কোন সাময়িক গাফলতির কারণে যদি সেটা অবলম্বন করেও থাকে তাহলে যখনই সে এ ব্যাপারে জানতে পারবে তখনই স্বাধীন ও স্বৈরাচারী আচরণ ত্যাগ করে পুনরায় বন্দেগীর আচরণ করতে থাকবে। আল্লাহর আনুগত্য মুক্ত হয়ে কাজ করা এবং নিজের ও নিজের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নিজে নিজেই কি করবোনা করবো, সিদ্ধান্ত নেয়া অবশ্যই একটি কুফরী জীবনাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের জীবন যাপন পদ্ধতি এ রকম তারা মুসলমান নামে আখ্যায়িত হোক বা অমুসলিম নামে তাতে কিছু যায় আসে না।
চারঃ এ কেনা-বেচার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর যে ইচ্ছার আনুগত্য মানুষের জন্য অপরিহার্য হয় তা মানুষের নিজের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত নয় বরং আল্লাহ নিজে যেমন ব্যক্ত করেন তেমন। নিজে নিজেই কোন জিনিসকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে ধরে নেয়া এবং তার আনুগত্য করতে থাকা মূলত আল্লাহর ইচ্ছা নয় বরং নিজেরই ইচ্ছার আনুগত্য করার শামিল। এটি এ কেনাবেচার চুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধী। যে ব্যক্তি ও দল আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর হেদায়াত থেকে নিজের সমগ্র জীবনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে একমাত্র তাকেই আল্লাহর সাথে কৃত নিজের কেনা-বেচার চুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হবে।
এ হচ্ছে এ কেনা-বেচার অন্তনিহিত বিষয়। এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর এ কেনা-বেচার ক্ষেত্রে বর্তমান পার্থিব জীবনের অবসানের পর মূল্য (অর্থাৎ জান্নাত।) দেবার কথা বলা হয়েছে কেন তাও আপনা আপনিই বুঝে আসে। বিক্রেতা নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেবে কেবলমাত্র এ অঙ্গীকারের বিনিময়েই যে জান্নাত পাওয়া যাবে তা নয়। বরং বিক্রেতা নিজের পার্থিব জীবনে এ বিক্রি করা জিনিসের ওপর নিজের স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রত্যাহার করবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের রক্ষক হয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করবে। এরূপ বাস্তব ও সক্রিয় তৎপরতার বিনিময়েই জান্নাত প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারে। সুতরাং বিক্রেতার পার্থিব জীবনকাল ও শেষ হবার পর যখন প্রমাণিত হবে যে, কেনা-বেচার চুক্তি করার পর সে নিজের পার্থিব জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তির শর্তসমূহ পুরোপুরি মেনে চলেছে একমাত্র তখনই এ বিক্রি সম্পূর্ণ হবে। এর আগে পর্যন্ত ইনসাফের দৃষ্টিতে সে মূল্য পাওয়ার অধিকারী হতে পারে না।
এ বিষয় গুলো পরিষ্কারভাবে বুঝে নেবার সাথে সাথে এ বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কোন প্রেক্ষাপটে এ বিষয়বস্তুটির অবতারণা হয়েছে তাও জেনে নেয়া উচিত। ওপর থেকে যে ধারাবাহিক ভাষণ চলে আসছিল তাতে এমন সব লোকের কথা ছিল যারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করেছিল ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার কঠিন সময় সমুপস্থিত হলে তাদের অনেকে গাফলতির কারণে, অনেকে আন্তরিকতার অভাবে এবং অনেকে চূড়ান্ত মুনাফিকীর পথ অবলম্বন করার ফলে আল্লাহর ও তার দ্বীনের জন্য নিজের সময় ধন সম্পদ স্বার্থ ও প্রাণ দিতে ইতস্তত করেছিল। কাজেই এ বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণীর আচরণের সমালোচনা করার পর এখন তাদেরকে পরিষ্কার বলে দেয়া হচ্ছে, তোমরা যে ঈমান গ্রহণ করার অঙ্গীকার করেছো তা নিছক আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব মেনে নেবার নাম নয়। বরং একমাত্র আল্লাহই যে তোমাদের জান ও তোমাদের ধন-সম্পদের মালিক ও অকাট্য ও নিগূঢ় তত্ত্ব মেনে নেয়া ও এর স্বীকৃতি দেয়ার নামই ঈমান। কাজেই এ অঙ্গীকার করার পর যদি তোমরা এ প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হুকুমে কুরবানী করতে ইতস্তত করো এবং অন্যদিকে নিজের দৈহিক ও আত্মিক শক্তিসমূহ এবং নিজের উপায়-উপকরণ সমূহ আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকো তাহলে এ থেকে একথাই প্রমাণিত হবে যে, তোমাদের অঙ্গীকার মিথ্যা। সাচ্চা ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা যথার্থই নিজেদের জান-মাল আল্লাহর হাতে বিকিয়ে দিয়েছে এবং তাকেই এ সবের মালিক মনে করেছে। তিনি এগুলো যেখানে ব্যয় করার নির্দেশ দেন সেখানে নির্দ্বিধায় এগুলো ব্যয় করে এবং যেখানে তিনি নিষেধ করেন সেখানে দেহ ও আত্মার সামান্যতম শক্তিও এবং আর্থিক উপকরণের নগন্যতম অংশও ব্যয় করতে রাজী হয় না।
ধন্য যাহারা ধার্মিকতার জন্য তাড়িত হইয়াছে, কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই। (মথি ৫: ১০)
যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করে, সে তাহা হারাইবে এবং যে কেহ আমার নিমিত্ত আপন প্রাণ হারায়, সে তাহা রক্ষা করিবে। (মথি ১০: ৩৯)
আর যে কোন ব্যক্তি আমার নামের জন্য বাটী কি ভ্রাতা, কি ভাগিনী কি পিতা ও মাতা, কি সন্তান, কি ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়াছে, সে তাহার শতগুণ পাইবে এবং অনন্ত জীবনের অধিকারী হইবে। (মথি ১৯: ২৯)
তবে তাওরাত বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যায় তাতে অবশ্যই এ বিষয়বস্তুটি পাওয়া যায় না। শুধু এটি কেন, সেখানে তো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, শেষ বিচারের দিন ও পরকালীন পুরস্কার ও শাস্তির ধারণাই অনুপস্থিত। অথচ এ আকীদা সবসময় আল্লাহর সত্য দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বর্তমান তাওরাতে এ বিষয়টির অস্তিত্ব না থাকার ফলে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও ঠিক নয় যে, যথার্থই তাওরাতের এ অস্তিত্ব ছিল না। আসলে ইহুদীরা তাদের অবনতির যুগে এতই বস্তুবাদী ও দুনিয়াবি সমৃদ্ধির মোহে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের কাছে নিয়ামত ও পুরস্কার এ দুনিয়ায় লাভ করা ছাড়া তার আর কোন অর্থই ছিলো না। এ কারণে আল্লাহর কিতাবে বন্দেগী ও আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে যেসব পুরস্কার দেবার ওয়াদা করা হয়েছিল সে সবকে তারা দুনিয়ার এ মাটিতেই নামিয়ে এনেছিল এবং জান্নাতের প্রতিটি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যকে তারা তাদের আকাংঙ্খিত ফিলিস্তিনের ওপর প্রয়োগ করেছিল। তাওরাতের বিভিন্ন স্থানে আমরা এ ধরনের বিষয়বস্তু দেখতে পাই। যেমনঃ
হে ইসরায়েল শুন, আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু একই সদা প্রভু, তুমি তোমার সমস্ত হৃদয়, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া আপন ঈশ্বর সদা প্রভুকে প্রেম করিবে। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬: ৪, ৫)
আরো দেখিঃ
তিনি কি তোমার পিতা নহেন, যিনি তোমাকে লাভ করিলেন। তিনিই তোমার নির্মাতা ও স্থিতি কর্তা। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২: ৬)
কিন্তু আল্লাহর সাথে এ সম্পর্কের যে পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তোমরা এমন একটি দেশের মালিক হয়ে যাবে যেখানে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হচ্ছে অর্থাৎ ফিলিস্তিন। এর আসল কারণ হচ্ছে, তাওরাত বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে তা প্রথমত সম্পূর্ণ নয়, তাছাড়া নির্ভেজাল আল্লাহর বাণী সম্বলিত ও নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহর বানীর সাথে অনেক ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য ও সংযোজিত করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ইহুদীদের জাতীয় ঐতিহ্য, বংশ প্রীতি, কুসংস্কার আশা-আকাঙ্ক্ষা ভুল ধারণাও ফিকাহ ভিত্তিক ইজতিহাদের একটি বিরাট অংশ একই ভাষণ ও বানী পরস্পরার মধ্যে এমন ভাবে মিশ্রিত হয়ে গেছে যে, অধিকাংশ স্থানে আল্লাহর আসল কালামকে তার মধ্যে থেকে পৃথক করে বের করে নিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। (এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন সূরা আলে ইমরানের ২ টীকা।)
আবার এ প্রসঙ্গে মু’মিনের গুণাবলীর মধ্যে সবার আগে তাওবার কথা বলার আর একটি উপযোগিতাও রয়েছে। আগে থেকে যে ধারাবাহিক বক্তব্য চলে আসছে তাতে এমনসব লোকের উদ্দেশ্যে কথা বলা হয়েছে যাদের থেকে ঈমান বিরোধী কার্যকলাপের প্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই তাদেরকে ঈমানের তাৎপর্য ও তার মৌলিক দাবী জানিয়ে দেবার পর এবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, মু’মিনের যে অপরিহার্য গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান গুণ হচ্ছেঃ যখনই বন্দেগীর পথ থেকে তাদের পা পিছলে যায় তারা যেন সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেদিকে ফিরে আসে। নিজেদের সত্য বিচ্যুতির ওপর যেন অবিচল হয়ে দাড়িয়ে না থাকে এবং পিছনের দিকে বেশী দূরে চলে না যায়।
এখানে আরো এতটুকু বুঝে নিতে হবে যে, আল্লাহ দ্রোহীদের প্রতি যে সহানুভূতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা কেবলমাত্র এমন পর্যায়ের সহানুভূতি যা দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মানবিক সহানুভূতি এবং পার্থিব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা ও রক্ত সম্পর্ক এবং স্নেহ-সম্প্রীতি পূর্ণ ব্যবহার এসব নিষিদ্ধ নয় বরং প্রশংসনীয়। আত্মীয় কাফের হোক বা মু’মিন, তার সামাজিক অধিকার অবশ্যই প্রদান করতে হবে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সকল অবস্থায় সাহায্য দিতে হবে। অভাবীকে যে কোন সময় সহায়তা দন করতে হবে। রুগ্ন ও আহতের সেবা ও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন ত্রুটি দেখানো যাবে না। ইয়াতীমের মাথায় অবশ্যই স্নেহের হত বুলাতে হবে। এসব ব্যাপারে কখনো মুসলিম ও অমুসলিমের বাচবিচার করা চলবে না।
سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا
আপনার প্রতি সালাম, আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে দোয়া করবো যেন তিনি আপনাকে মাফ করে দেন। তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান। (মারয়ামঃ ৪৭)
তিনি আরো বলেছিলেনঃ
لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ
আমি আপনার জন্য অবশই ক্ষমা চাইবো। তবে আপনাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। (আল মুমতাহিনাঃ ৪)
উপরোক্ত ওয়াদার ভিত্তিতে তিনি নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করেছিলেনঃ
وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ - وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ - يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ - إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
আর আমার পিতাকে মাফ করে দাও, তিনি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর যেদিন সকল মানুষকে উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না। যেদিন ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি কারোর কোন কাজে লাগবে না। একমাত্র সেই নাজাত পাবে, যে আল্লাহর সামনে হাযির হবে বিদ্রোহ মুক্ত হৃদয় নিয়ে। (আশ শুআরাঃ ৮৬-৮৯)
এ দোয়া তো প্রথমত অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত ভাষায় করা হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই হযরত ইবরাহীম চিন্তা করলেন যে, তিনি যে ব্যক্তির জন্য দোয়া করেছেন সে তো ছিল প্রকাশ্য আল্লাহ দ্রোহী এবং আল্লাহর দ্বীনের ঘোরতর শত্রু তখন তিনি এ থেকে বিরত হলেন এবং একজন যথার্থ বিশ্বস্ত মু’মিনের মত বিদ্রোহীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো থেকে পরিষ্কারভাবে সরে দাঁড়লেন। অথচ এ বিদ্রোহী ছিল তার পিতা, যে এক সময় স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন পালন করেছিল।
এ বক্তব্যটি থেকে একটি মূলনীতি অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় হেদায়াত দেয়া ও গোমরাহ করাকে তার নিজের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো এ মূলনীতিটির মাধ্যমে ভালভাবে বুঝে যেতে পারে। আল্লাহর হেদায়াত দেয়ার মানে হচ্ছে, তিনি নিজের নবী ও কিতাসমূহের সাহায্যে লোকদের সামনে সঠিক চিন্তা ও কর্মধারা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তারপর যারা স্বেচ্ছায় এ পথে চলতে উদ্যোগী হয় তাদের চলার সুযোগ ও সামর্থ্য দান করেন। আর আল্লাহর গোমরাহীতে লিপ্ত করার মানে হচ্ছে তিনি যে সঠিক চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন যদি তার বিপরীত পথে চলার জন্য কেউ জোর প্রচেষ্টা চালায় এবং সোজা পথে চলতে না চায় তাহলে আল্লাহ জোর করে তাকে সত্য পথ দেখান না এবং সত্যের দিকে চালিত ও করেন না বরং যেদিকে সে নিজে যেতে চায় সেদিকে যাবার সুযোগ ও সামর্থ্য তাকে দান করেন।
আলোচ্য ভাষণটি একথাটি কোন প্রসঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে, আগের ও পরের ভাষণ গুলো গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলে তা সহজেই বুঝা যেতে পারে। এটা এক ধরনের সতর্কবাণী। একে অত্যন্ত সঙ্গত ভাবে আগের বর্ণনার সমাপ্তি হিসাবেও গণ্য করা যেতে পারে। আবার পরে যে আলোচনা আসছে তার ভূমিকা ও বলা যেতে পারে।
তিনি সাধারণ মুসলমানদের হুকুম দিলেন, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন প্রকার সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ বিষয়টির ফয়সালা করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়। (এখানে একথাটি অবশ্যই) সামনে রাখতে হবে যে, ৯৯ টীকায় যে সাতজন সাহাবীর আলোচনা এসেছে তাদের ব্যাপারটি কিন্তু এদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা তো জবাবদিহির আগেই নিজেরাই নিজেদের শাস্তি দিয়েছিলেন।
এ তিন জনের মধ্য থেকে হযরত কাব ইবনে মালেক অত্যন্ত বিস্তারিত ভাবে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনা বড়ই শিক্ষাপ্রদ। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় তার ছেলে আবদুল্লাহ তাকে হাত ধরে নিয়ে চলাফেরা করতেন। আবদুল্লাহকে তিনি নিজেই এ ঘটনা এভাবে শুনানঃ
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নবী (সা.) যখনই মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার আবেদন জানাতেন তখনই আমি মনে মনে সংকল্প করে নিতাম যে, যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেবো। কিন্তু ফিরে এসে আমাকে অলসতায় পেয়ে বসতো এবং আমি বলতাম, এখনই এতো তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা দেবার সময় যখন আসবে তখন তৈরী হতে কতটুকু সময়ই বা লাগবে। এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে যেতে থাকলো। তারপর একদিন সেনাবাহিনীর রওয়ানা দেবার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরী ছিলাম না। আমি মনে মনে বললাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি এক দুদিন পরে পথে তাদের সাথে যোগ দেবো। কিন্তু তখনো একই অলসতা আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে সময় পার হয়ে গেলো।
এ সময় যখন আমি মদীনায় থেকে গিয়েছিলাম আমার মন ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছিল। কারণ আমি দেখছিলাম যাদের সাথে এ শহরে আমি রয়েছি তার হয়, মুনাফিক, নয়তো দুর্বল, বৃদ্ধ ও অক্ষম লোক, যাদেরকে আল্লাহ অব্যাহতি দিয়েছেন।
নবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে এসে যথারীতি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লেন। তারপর তিনি লোকদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য বসলেন। মুনাফিকরা এ মজলিসে এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের ওযর পেশ করতে লাগলো। এদের সংখ্যা ছিল ৮০ এর চাইতেও বেশী। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেকের বনোয়াট ও সাজানো কথা শুনলেন। তাদের লোক দেখানো ওযর মেনে নিলেন এবং তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন। তারপর আমার পালা এলো। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আসুন! আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাযির হতাম তাহলে অবশ্যই কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম। কথা বানিয়ে বলার কৌশল আমিও জানি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এখন কোন মিথ্যা ওযর পেশ করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। তবে যদি আমি সত্য বলি তাহলে আপনি নারাজ হয়ে গেলেও আমি আশা রাখি আল্লাহ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন। আসলে পেশ করার মতো, কোন ওযরই আমার নেই। যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম। একথা শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এ ব্যক্তি সত্য কথা বলেছে। ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কোন ফয়সালা না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো। আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। এখানে সবাই আমার পিছনে লাগলো। তারা আমাকে এ বলে তিরস্কার করতে লাগলো যে, তুমি ও কোন মিথ্যা ওযর পেশ করলে না কেন এসব কথা শুনে আবার রসূলের কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওযর পেশ করার জন্য আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু যখন শুনলাম আরো দুজন সৎ লোক (মুরারাহ ইবনে রুবাই ও হেলাল ইবনে উমাইয়াহ) আমার মতো একই সত্য কথা বলেছেন তখন আমি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করলাম এবং আমার সত্য কথার ওপর অটল থাকলাম।
এরপর নবী (সা.) সাধারণ হুকুম জারি করলেন, আমাদের তিন জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। অন্য দুজন তো ঘরের মধ্যে বসে রইলো কিন্তু আমি বাইরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হয়তো, এ দেশটি একদম বদলে গেছে। আমি যেন এখানে একজন অপরিচিত আগন্তুক। এ জনপদের কেউ আমাকে জানে না, চেনা না। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যথারীতি নবী (সা.) কে সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু শুধু অপেক্ষা করাই সার হতো। তার নজর আমার ওপর কিভাবে পড়ছে তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে তার প্রতি তাকাতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে, যতক্ষণ আমি নামায পড়তাম ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন এবং যেই আমি নামায শেষ করতাম অমনি আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন। একদিন ঘাবড়ে গিয়ে আমার চাচাত ভাই ও ছেলে বেলার বন্ধু আবু কাতাদার কাছে গেলাম। তার বাগানের পাঁচিলের ওপর উঠে তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দাটি আমার সালামের জবাবও দিলো না। আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আমি কি আল্লাহ ও তার রসূলকে ভালবাসি না? সে নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সে নীরব রইলো। তৃতীয়বার যখন আমি কসম দিয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম তখন সে শুধুমাত্র এতটুকু বললোঃ আল্লাহ ও তার রসূলই ভাল জানেন। একথায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি পাঁচিল থেকে নেমে এলাম। এ সময় আমি একদিন বাজার দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সিরিয়ার নাবতী বংশীয় এক লোকের সাথে দেয়া হলো। সে রেশমে মোড়া গাসসান রাজার একটি পত্র আমার হাতে দিল। আমি পত্রটি খুলে পড়লাম। তাতে লেখা ছিল, আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার ওপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগণ্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো। আমি বললাম, এ দেখি আর এক আপদ! তখনই চিঠিটাকে চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।
চল্লিশটা দিন এভাবে কেটে যাবার পর রসূলুল্লাহ ﷺ কাছে থেকে তার দূত এই হুকুম নিয়ে এলেন, যে নিজের স্ত্রী থেকে ও আলাদা হয়ে যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে কি তালাক দিয়ে দিবো? জবাব এলো, না, তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো। কাজেই আমি স্ত্রীকে বলে দিলাম, তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো।
এভাবে উনপঞ্চাশ দিন পার হয়ে পঞ্চাশ দিন পড়লো। সেদিন সকালে নামাযের পরে আমি নিজের ঘরের ছাদের ওপর বসে ছিলাম। নিজের জীবনের প্রতি আমার ধিক্কার জাগছিল হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে বললোঃ কাব ইবনে মালিককে অভিনন্দন। একথা শুনেই আমি সিজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার ক্ষমার ঘোষণা জারি হয়েছে। এরপর লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। তারা প্রত্যেকে পাল্লা দিয়ে আমাকে মুবারকবাদ দিচ্ছিল। তারা বলছিল তোমার তওবা কবুল হয়েছে। আমি উঠে সোজা মসজিদে নববীর দিকে গেলাম। দেখলাম, নবী (সা.) এর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ! আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং এ সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট আয়াত শুনিয়ে দিলেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সদকা করে দিতে চাই। এটাও আমার তাওবার অংশ বিশেষ। বললেনঃ কিছু রেখে দাও, এটাই তোমার জন্য ভাল। এ বক্তব্য অনুযায়ী আমি নিজের খয়বরের সম্পত্তির অংশটুকু রেখে দিলাম। বাদবাকি সব সাদকা করে দিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তার ওপর আমি সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি এবং আশা করি আল্লাহ আগামীতেও তা থেকে আমাকে বাঁচাবেন।
এ ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। প্রত্যেক মু’মিনের মনে তা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিত।
এ থেকে প্রথম যে শিক্ষাটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে, কুফর ও ইসলামের সংঘাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক। এ সংঘাতে কুফরের সাথে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, যে ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে নয়, সৎ উদ্দেশ্যে এবং সারা জীবনও নয় বরং কোন একসময় ভুল করে বসে, তারও সারা জীবনের ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনদারী ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এমনকি এমন উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকও পাকড়াও হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না যে, বদর ওহোদ আহযাব ও হুনাইনের ভয়াবহ যুদ্ধ ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিল এবং যার ঈমানও আন্তরিকতার মধ্যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিলো না।
দ্বিতীয় শিক্ষাটিও এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হচ্ছে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করা কোন মামুলি ব্যাপার নয়। বরং অনেক সময় শুধুমাত্র গড়িমসি করতে করতে মানুষ এমন কোন ভুল করে বসে যা বড় বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। তখন একথা বলে সে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। সে অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজটি করেনি।
নবী (সা.) এর নেতৃত্বে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল। এ ঘটনা খুবই চমৎকারভাবে তার প্রাণসত্তা উন্মোচন করে দেয়। একদিকে রয়েছে মুনাফিকদের দল। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সবার কাছে সুস্পষ্ট ছিল। এরপরও তাদের বাহ্যিক ওযরসমূহ শোনা হয় এবং সেগুলোর সত্যাসত্য এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ তাদের কাছ থেকে তো আন্তরিকতার আশাই করা হয়নি কোন দিন। কাজেই এখন আন্তরিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ তোলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে রয়েছেন একজন পরীক্ষিত মু’মিন। তার উৎসর্গীত প্রাণ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কারো মনে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশই নেই। তিনি মিথ্যা ও বলেন না। দ্ব্যর্থ হীন ভাষায় নিজের ভুল স্বীকার করে নেন। কিন্তু তার ওপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। এ ক্রোধের কারণ এ নয় যে, তার মু’মিন হবার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বরং এর কারণ হচ্ছে, মু’মিন হওয়া সত্ত্বেও সে মুনাফিক সুলভ কাজ করলো কেন? আসলে এভাবে তাকে একথাই বলা হচ্ছে, যে, তোমরাই পৃথিবীর সার বস্তু। তোমাদের থেকে যদি মৃত্তিকা উর্বরতা লাভ করতে না পারে তাহলে উর্বরতা কোথা থেকে আসবে? তারপর মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পুরো ঘটনায় নেতা যেভাবে শাস্তি দিচ্ছেন এবং ভক্ত যেভাবে তা মাথা পেতে নিচ্ছেন আর এ সাথে সমগ্র দলটি যেভাবে এ শাস্তি কার্যকর করছে তার প্রত্যেকটি দিকই তুলনাবিহীন। এক্ষেত্রে কে বেশী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তা স্থির করাই কঠিন। নেতা অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে ক্রোধ বা ঘৃণার লেশমাত্র নেই। বরং গভীর স্নেহ ও প্রীতি সহকারে তিনি শাস্তি দিচ্ছেন। ক্রুদ্ধ পিতার ন্যায় তার দৃষ্টি একদিকে অনল বর্ষণ করে চলেছে ঠিকই কিন্তু অন্য দিকে আবার তাকে প্রতি মুহূর্তে একথা জনিয়ে দিচ্ছে যে, তোমার সাথে কোন শত্রুতা নেই বরং তোমার ভুলের কারণে আমার অন্তরটা ব্যাথায় টনটন করছে। তুমি নিজের ভুল শুধরে নিলে তোমাকে এ বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি। ভক্ত শাস্তির তীব্রতায় অস্থির হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার পদযুগল আনুগত্যের রাজপথ থেকে এক চুল পরিমাণও টলছে না। সে আত্মম্ভরিতা ও জাহেলী দাম্ভিকতারও শিকার হচ্ছে না এবং প্রকাশ্যে অহংকার করে বেড়ানোর তো দূরের কথা, এমনকি নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে মনের গভীরে সামান্যতম অভিযোগও সৃষ্টি হতে দিচ্ছে না। বরং নেতার প্রতি ভালবাসায় তার মন আরো ভরে উঠেছে। শাস্তির পুরো পঞ্চাশ দিন তার দৃষ্টি সবচেয়ে বেশী অধীর হয়ে যে জিনিসটি খুজে বেড়িয়েছে, সেটি হচ্ছে, নেতার চোখে তার প্রতি আগের সেই মমত্ব পূর্ণ দৃষ্টি বহাল আছে কিনা, যা তার সমস্ত আশা আকাংখার শেষ আশ্রয় স্থল। সে যেন একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। আকাশের এক কিনারে যে ছোট্ট এক টুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছে। সেটিই তার সমস্ত আশার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। তারপর দলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, তার অভূতপূর্ব শৃংখলা বিরাজিত যে, নেতার মুখ থেকে বয়কটের নির্দেশ উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই অপরাধীর ওপর থেকে দলের সমস্ত লোক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা গোপনেও কোন নিকটতম আত্মীয় এবং সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুও তার সাথে কথা বলছে না। স্ত্রীও তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দোহাই দিয়ে সে জিজ্ঞেস করছে, আমার আন্তরিকতায় কি তোমাদের কোন সন্দেহ জেগেছে? কিন্তু যারা দীর্ঘকাল তাকে আন্তরিক দেখে আসছিল তারা পরিষ্কার বলে দিচ্ছেঃ আমাদের কাছ থেকে নয়, আল্লাহ ও তার রসূলের কাছ থেকে নিজের আন্তরিকতার সনদ নাও। অন্যদিকে দলের নৈতিক প্রাণসত্তা এত বেশী উন্নত ও পবিত্র যে, এক ব্যক্তির উচু মাথা নীচু হবার সাথে সাথেই নিন্দুকদের কোন দল তার নিন্দায় সোচ্চার হয়ে উঠে না। বরং শাস্তির এ পুরো সময়টায় দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের এ সাজাপ্রাপ্ত ভাইয়ের বিপদে মর্মবেদনা অনুভব করে এবং পুনরায় তাকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যকুল থাকে। ক্ষমার কথা ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা অতি দ্রুত তার কাছে পৌঁছে তার সাথে সাক্ষাত করার এবং তাকে সুসংবাদ দেবার জন্য দৌড়াতে থাকে। কুরআন যে ধরনের সত্যনিষ্ঠা দল দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এটি হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সাহাবীগণ আল্লাহর দরবার থেকে যে ক্ষমা লাভ করেছিলেন এবং সেই ক্ষমার কথা বর্ণনা করার ভাষায় মধ্যে যে স্নেহ ও করুণা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে তাদের আন্তরিকতা। পঞ্চাশ দিনের কঠোর শাস্তি ভোগকালে তারা এ আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ভুল করার পর যদি তারা অহংকার করতেন, নিজেদের নেতার অসন্তোষের জবাবে ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতেন, শাস্তি লাভের ফলে এমনই বিক্ষুদ্ধ হতেন যেমন স্বার্থবাদী লোকদের আত্মাভিমানে আঘাত লাগলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সামাজিক বয়কট কালে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে রাজি। কিন্তু নিজের আত্মাভিমানকে আহত করতে রাজি নই-এ নীতি অবলম্বন করতেন এবং যদি এ সমগ্র শাস্তি কালে দলের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে বেড়াতেন এবং অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ লোকদের খুঁজে বের করে এক সাথে মিলিয়ে জোটবদ্ধ করতেন, তাহলে তাদের ক্ষমা করা তো দূরের কথা বরং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দল থেকে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হতো এবং এ শাস্তির মেয়াদ শেষ হবার পর তাদের যোগ্য শাস্তিই তাদেরকে দেয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো, যাও তোমরা নিজেদের অহম পূজায় লিপ্ত থাকো। সত্যের কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রামে অংশ নেবার সৌভাগ্য তোমাদের আর কখনো হবে না।
কিন্তু এ কঠিন পরীক্ষায় ঐ তিনজন সাহাবী এ পথ অবলম্বন করেননি, যদিও এ পথটি তাদের জন্য খোলা ছিল। তারা বরঞ্চ আমাদের আলোচিত পূর্বোক্ত পথ অবলম্বন করেছিলেন। এ পথ অবলম্বন করে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর আনুগত্যের নীতি তাদের হৃদয় থেকে পূজা ও বন্দনা করার মতো সকল মূর্তি অপসারিত করেছে। নিজেদের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে তারা আল্লাহর পথে সাধনা করার জন্য নিয়োজিত করে দিয়েছে। নিজেদের ফিরে যাবার নৌকা গুলোকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দিয়ে ইসলামী জামায়াতে প্রবেশ করেছিলেন যে, পেছনে ফিরে যেতে চাইলেও আর ফেরার কোন জায়গা ছিল না। এখানেই মার খাবেন এবং এখানেই মরবেন। অন্য কোথাও কোন বৃহত্তম সম্মান ও মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পেলেও এখানকার লাঞ্ছনা ত্যাগ করে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে যাবেন না। এরপর তাদেরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে না ধরে আর কী করা যেতো? এ কারণেই আল্লাহ তাদের ক্ষমার কথা বলেছেন অত্যন্ত স্নেহ মাখা ভাষায়। তিনি বলেছেনঃ আমি তাদের দিকে ফিরলাম যাতে তারা আমার দিকে ফিরে আসে। এ কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে এমন একটি অবস্থার ছবি আঁকা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, প্রভু আগে এ বান্দাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা পালিয়ে না গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তারই দোরগাড়ায় বসে পড়লো তখন তাদের বিশ্বস্ততার চিত্র দেখে প্রভু নিজে আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রেমের আবেগে অধীর হয়ে তাকে দরজা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তিনি নিজেই বের হয়ে এলেন।