একঃ এ বাণী এমন ব্যক্তি পেশ করেছিলেন যার মার্জিত ও ভদ্র স্বভাবের বিষয়টি মক্কা শহরের কারোই অজানা ছিল না। সমাজের সবাই একথা জানতো যে, নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে তিনি তাদের জাতির মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। এরূপ লোক আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করবে এবং নিজে কোন কথা বানিয়ে মহান আল্লাহর কথা বলে তা চালিয়ে দেবে, এত বড় মিথ্যার বেসাতি এ লোকের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
দুইঃ তারা আরো দেখছিল যে, এ ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে এ বাণী পেশ করছে না। বরং এ কাজ করতে গিয়ে সে নিজের স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে সে নিজের ব্যবসায়-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেছে, যে সমাজে তাকে অভাবনীয় সম্মান দেখানো হতো সেখানেই তাকে গালিগালিজের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আর এসব করে নিজেই যে শুধু দুঃখ-দুর্দশার মুখে ঠেলে দিয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থের পূজারী হলে সে নিজেকে এ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে টেনে আনবে কেন?
তিনঃ তারা নিজের চোখে এও দেখেছিলো যে, তাদের সমাজের যেসব লোক ঐ ব্যক্তির প্রতি ঈমান আনছিলো তাদের জীবনে হঠাৎ একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে যাচ্ছে। কোন কবি অথবা গণকের কথার এতটা প্রভাব কি কখনো দেখা গিয়েছে যে তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক নৈতিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে আর তার অনুসারীরা এ জন্য সব রকমের বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে?
চারঃ কবিদের ভাষা কেমন হয়ে থাকে এবং গণকদের কথাবার্তা কিরূপ হয় তাও তাদের অজানা ছিল না। কুরআনের ভাষা, সাহিত্য ও বিষয়বস্তুকে কবির কাব্য এবং গণকের গণনা সদৃশ বলা একমাত্র হঠকারী ব্যক্তি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। (আমি এ বিষয়ে তাফহীমুল কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৭নং টীকায় সূরা শু'আরার ১৪২ থেকে ১৪৫ নং টীকায় এবং সূরা আত্ তূরের ২২ নং টীকায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি)।
পাঁচঃ সমগ্র আরব ভূমিতে উন্নত ভাষাশৈলীর অধিকারী এমন কোন ব্যক্তি ছিল না যার চমকপ্রদ ও অলংকারময় ভাষাকে কুরআনের মোকাবিলায় পেশ করা যেতো। কুরআনের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা কারো ভাষার বিশুদ্ধতা ও শ্রুতিমাধুর্য কুরআনের উন্নত ভাষাশৈলীর ধারে কাছে ঘেঁষারও যোগ্যতা রাখতো না। এ বিষয়টিও তাদের জানা ছিল।
ছয়ঃ মুহাম্মাদ ﷺ নিজের কথাবার্তা ও ভাষার সাহিত্যিক উৎকর্ষ ও কুরআনের সাহিত্যিক মান ও উৎকর্ষ থেকে যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল তাও তাদের অগোচরে ছিল না। আরবী ভাষাভাষী কোন ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তৃতা এবং কুরআন শোনার পর বলতে পারতো না যে, এ দু’টি একই ব্যক্তির মুখের কথা।
সাতঃ যেসব বিষয়বস্তু ও জ্ঞান-বিজ্ঞান কুরআনে পেশ করা হয়েছে নবুওয়াত দাবী করার একদিন আগেও মক্কার লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে তা শোনেনি। তারা এও জানতো যে তাঁর কাছে এসব তথ্য ও বিষয়বস্তু জানার কোন উপায়-উপকরণ ও নেই। তাই নবী ﷺ কোন গোপনীয় সূত্র থেকে এসব তথ্য ও জ্ঞান লাভ করেছেন বলে তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেও মক্কার কেউ-ই তা বিশ্বাস করতো না। (আমি তাফহীমুল কোরআনের সূরা আন নাহলের ১০৭ নং টীকা এবং সূরা আল ফুরকানের ১২ নং টীকায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছি।)
আটঃ এ পৃথিবী থেকে সুদূর আসমান তথা মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত এ বিরাট-বিশাল বিশ্ব-জাহানকে তারা নিজ চোখে সুচারু রূপে পরিচালিত হতে দেখছিল। তারা এও দেখছিলো যে, এ বিশাল বিশ্বলোক একটি জ্ঞানগর্ভ আইন-বিধান এবং সর্বব্যাপী নিয়ম-শৃংখলা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আরবের লোকেরা শিরকে লিপ্ত ছিল এবং আখেরাত অস্বীকার করতো। এটা ছিল তাদের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্গত। কিন্তু এ বিশাল বিশ্বলোকের পরিচালনা ও নিয়ম-শৃংখলার কোন ক্ষেত্রেই তারা শিরক ও আখেরাত অস্বীকৃতির পক্ষে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজে পেতো না। বরং কুরআন তাওহীদ ও আখেরাতের যে ধারণা পেশ করছে সর্বত্র তারই সত্যতার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
এসবই তারা দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু যেসব জিনিস তারা দেখতে পাচ্ছিল না তাহলো, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলাই এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, মালিক এবং শাসক, বিশ্ব-জাহানের সবাই তাঁর বান্দা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ ইলাহ নয়, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, আল্লাহ তাআলাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল করে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাঁর ওপর কুরআন নাযিল হচ্ছে। পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে যা বলা হয়েছে তা বলা হয়েছে এ দু'ধরনের সত্যের কসম খেয়ে।