নামকরণ
সূরার নামই শুধু الطلاق নয়, বরং এটি এর বিষয়বস্তুর শিরোনামও। কারণ এর মধ্যে কেবল তালাকের হুকুম আহকামই বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস একে সূরা النساء القصرى অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত সূরা নিসা বলে অভিহিত করেছেন।নাযিল হওয়ার সময়-কাল
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন যে, সূরা বাকারার যেসব আয়াতে সর্ব প্রথম তালাক সম্পর্কিত হুকুম আহকাম দেয়া হয়েছে সেসব আয়াত নাযিল হওয়ার পর এ সূরাটি নাযিল হয়েছে। সূরার বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যও তা প্রমাণ করে। সূরাটি নাযিল হওয়ার সঠিক সময়-কাল কোনটি তা নির্ণয় করা যদিও কঠিন, কিন্তু বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে এতটুকু অন্তত জানা যায় যে, লোকজন সূরা বাকারার বিধি-নিষেধগুলো বুঝতে যখন ভুল করতে লাগলো এবং কার্যতও তাদের থেকে ভুল-ত্রুটি হতে থাকলো তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের সংশোধনের জন্য এসব নির্দেশ নাযিল করলেন।বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
তালাক ও ইদ্দত সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইতিপূর্বে যেসব বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে এ সূরার নির্দেশাবলী বুঝার জন্য পুনরায় তা স্মৃতিতে তাজা করে নেয়া প্রয়োজন।الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ (البقرة : 229)
“তালাক দুইবার। এরপর স্ত্রীকে হয় উত্তমরূপে রাখবে নয় ভালভাবে বিদায় করে দেবে।”
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ................. وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَلِكَ إِنْ أَرَادُوا إِصْلَاحًا (البقرة : 228)
“তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোকেরা (তিন তালাকের পর) তিন হায়েজ পর্যন্ত নিজেদের বিরত রাখবে………………. যদি তারা সংশোধনের আগ্রহী হয় তাহলে এই সময়ের মধ্যে তাদের স্বামীরা তাদেরকে (স্ত্রী হিসেবে) ফিরিয়ে নেয়ার অধিকারী।”
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ...................
“এরপর সে যদি তৃতীয়বারের মত তালাক দিয়ে দেয় তাহলে অন্য কারো সাথে সেই স্ত্রীর বিয়ে হওয়ার আগে সে আর তার জন্য হালাল হবে না … ।” (আল বাকারাহ ২৩০)
إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّونَهَا (الاحزاب : 49)
“তোমরা ঈমানদার নারীদের বিয়ে করে স্পর্শ করার পূর্বেই যদি তালাক দিয়ে দাও তাহলে তোমরা তাদের কাছে ইদ্দত পালন করার দাবি করতে পার না। কারণ তোমাদের জন্য ইদ্দত পালন জরুরী নয়।” (আল আহযাবঃ ৪৯)
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا (البقرة : 234)
“তোমাদের মধ্যে কেউ স্ত্রী রেখে মারা গেলে স্ত্রীরা চার মাস দশদিন পর্যন্ত নিজেদের বিরত রাখবে বা অপেক্ষা করবে।” (আল বাকারাহঃ ৩৪)
উল্লেখিত আয়াতসমূহে যেসব নীতি নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে তা হচ্ছেঃ
একঃ স্বামী তার স্ত্রীকে সর্বাধিক তিন তালাক দিতে পারে।
দুইঃ এক বা দুই তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার স্বামীর থাকে এবং ইদ্দতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে করতে পারবে। এজন্য তাহলীলের কোন শর্ত প্রযুক্ত হবে না। কিন্তু স্বামী যদি স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ইদ্দতের সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার আর স্বামীর থাকে না, বরং তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর ঐ স্ত্রীর অপর কোন পুরুষের সাথে বিয়ে হওয়া এবং ঐ স্বামী স্বেচ্ছায় তাকে তালাক না দেয়া পর্যন্ত পূর্বোক্ত স্বামীর সাথে পুনরায় তার বিয়ে হতে পারে না।
তিনঃ ঋতুস্রাব চালু আছে এবং স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন হয়েছে এমন স্ত্রীলোকের ‘ইদ্দত’ হলো তালাক প্রাপ্তির পর তিনবার মাসিক হওয়া। এক তালাক বা দুই তালাক হওয়ার ক্ষেত্রে এ ইদ্দত পালনের অর্থ হলো, স্ত্রীলোকটি এখনও তার দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ আছে এবং ইদ্দতকালের মধ্যে সে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু স্বামী যদি তিন তালাক দিয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর এই ইদ্দত পালন তাকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য নয়, বরং শুধু এজন্য যে, ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে সে অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না।
চারঃ দৈহিক মিলন হয়নি এমন কোন স্ত্রীকে (স্পর্শ করার পূর্বে) যদি তালাক দেয়া হয়, তাকে কোন ইদ্দত পালন করতে হবে না। সে চাইলে তালাক প্রাপ্তির পরপরই বিয়ে করতে পারে।
পাঁচঃ যে স্ত্রীলোকের স্বামী মারা গিয়েছে তাকে চার মাস দশদিন সময় কালের জন্য ইদ্দত পালন করতে হবে।
এখন এ কথাটি ভাল করে বুঝে নিতে হবে যে, এসব বিধি-বিধানের কোনটি বাতিল করা বা সংশোধন করার জন্য সূরা তালাক নাযিল হয়নি। বরং দু’টি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এ সূরা নাযিল হয়েছে।
প্রথম উদ্দেশ্যটি হলো, পুরুষকে তালাক দেয়ার যে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে তা প্রয়োগের জন্য এমন কিছু বিজ্ঞোচিত পন্থা বলে দেয়া, যার সাহায্য নিলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিস্থিতি না আসতে পারে। আর বিচ্ছিন্ন হলেও যেন শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থায় তা হয় যখন পারস্পরিক সমঝোতা ও বুঝাপড়ার সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। কারণ আল্লাহর শরীয়াতে তালাকের অবকাশ রাখা হয়েছে শুধু একটি অনিবার্য প্রয়োজন হিসেবে। অন্যথায়, একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে যে দাম্পত্য বন্ধন একবার কায়েম হয়েছে তা আবার ছিন্ন হয়ে যাক তা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مَا أَحَلَّ اللَّهُ شَيْئًا أَبْغَضَ إِلَيْهِ مِنَ الطَّلاَقِ (ابو داؤد)
“তালাকের চেয়ে অপছন্দনীয় আর কোন জিনিসকে আল্লাহ তা’আলা হালাল করেননি।” (আবু দাউদ)
তিনি আরো বলেছেনঃ
أَبْغَضُ الْحَلاَلِ إِلَى اللَّهِ عز وجل الطَّلاَقُ (ابو داؤد)
“সমস্ত হালাল জিনিসের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হচ্ছে তালাক।” (আবু দাউদ)
দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হলো, সূরা বাকারায় নাযিলকৃত বিধি-বিধান ছাড়া আরো যেসব বিষয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষে ছিল তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে ইসলামের পারিবারিক আইনের এ দিক ও বিভাগটিকে পূর্ণতা দান করা। সুতরাং এক্ষেত্রে স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন হয়েছে, মাসিক বন্ধ হওয়া এমন স্ত্রীলোক কিংবা যাদের এখনো মাসিক আসেনি, তারা তালাকপ্রাপ্তা হলে তাদের ইদ্দত কি হবে, তাছাড়া যেসব নারী গর্ভবর্তী হয়েছে তারা যদি তালাকপ্রাপ্তা হয় কিংবা স্বামী মারা যায় তাদের ইদ্দত কি হবে তা বলা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন রকম তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোকের খোরপোষ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা কিভাবে হবে এবং যেসব ছেলেমেয়ের পিতামাতা তালাকের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে তাদের দুধ পানের ব্যবস্থা কিভাবে করা হবে তা এই সূরাতে বলা হয়েছে।