একটি অর্থ হচ্ছে, ইদ্দত শুরু করার জন্য তালাক দাও। অন্য কথায় এমন সময় তালাক দাও যে সময় থেকে তাদের ইদ্দত শুরু হয়ে থাকে। সূরা বাকারার ২২৮ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যেসব স্ত্রীলোকের স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন হয়েছে এবং মাসিকও হয়ে থাকে তালাক প্রাপ্তির পর তিনবার মাসিক হওয়ার সময়-কালই তাদের ইদ্দত। এই নির্দেশের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিচার করলে ইদ্দত শুরু করার জন্য তালাক দেয়ার অপরিহার্য যে অর্থ হতে পারে তা হচ্ছে স্ত্রীকে ঋতুস্রাবকালে তালাক দেয়া যাবে না। কারণ, যে ঋতুস্রাবকালে তাকে তালাক দেয়া হয়েছে তার ইদ্দত সেই ঋতুস্রাব থেকে গণনা করা যাবে না। তাই এ অবস্থায় তালাক দেয়ার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে নারীর ইদ্দতের সময়-কাল তিন হায়েজের পরিবর্তে চার হয়েয হয়ে যায়। তাছাড়া এ নির্দেশের আরো একটি দাবী হলো যে ‘তুহুরে’ (স্ত্রী ঋতু থেকে পবিত্র থাকার অবস্থা) স্বামী-স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন করেছে সেই ‘তুহুরে’ তালাক দেয়া যাবে না। কারণ এক্ষেত্রে তালাক দেয়ার সময় স্বামী ও স্ত্রীর মিলনের ফলে গর্ভসঞ্চার হয়েছে কি না তা তাদের দু’জনের কেউই জানতে পারে না। এ কারণে অনুমানের ওপর নির্ভর করে যেমন ইদ্দত গণনা শুরু হতে পারে না তেমনি মহিলাকে গর্ভবর্তী ধরে নিয়েও ইদ্দত গণনা হতে পারে না। সুতরাং এই নির্দেশটি একই সাথে দু’টি বিষয় দাবী করে। একটি হলো, হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়টি হলো, তালাক দিতে হবে এমন ‘তুহুরে’, যে ‘তুহুরে’ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়নি কিংবা যখন স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি জানা আছে। তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে এসব বাধ্যবাধকতার মধ্যে যে অনেক কল্যাণ নিহিত আছে তা একটু চিন্তা-ভাবনা করলেই বুঝা যায়। ঋতু অবস্থায় তালাক না দেয়ার কল্যাণকর দিক হলো, এটি এমন এক অবস্থা যখন স্বামী ও স্ত্রীর দৈহিক মিলন নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরণের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা প্রমাণিত যে, এই অবস্থায় নারীর মেজাজ স্বাভাবিক থাকে না। তাই সেই সময় যদি তাদের মধ্যে কোন ঝগড়া-বিবাদ হয় তাহলে তা মিটমাট করার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়েই অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে। আর পরিস্থিতিকে ঝগড়া-বিবাদ থেকে তালাক পর্যন্ত না গড়িয়ে যদি স্ত্রীর ঋতু থেকে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয় তাহলে স্ত্রীর মেজাজ প্রকৃতি স্বাভাবিক হওয়া এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে আল্লাহ যে স্বাভাবিক আকর্ষণ দিয়েছেন তা তৎপর ও কার্যকর হয়ে পুনরায় দু’জনের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। যে ‘তুহুরে’ দৈহিক মিলন হয়েছে সেই ‘তুহুরে’ই তালাক নিষিদ্ধ হওয়ার কল্যাণকর দিক হচ্ছে, সেই সময় যদি গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকে তাহলে স্বামী ও স্ত্রী কারো পক্ষেই তা জানা সম্ভব হয় না। তাই তা তালাক দেয়ার উপযুক্ত সময় নয়। আর গর্ভসঞ্চার হয়েছে এ বিষয়ে জানার পর যে নারীর গর্ভে তার সন্তান বেড়ে উঠেছে তাকে তালাক দেবে কি দেবে না সে সম্পর্কে পুরুষটি অন্তত দশবার ভেবে দেখবে। অপরদিকে নারীও তার নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে স্বামীর অসন্তুষ্টির কারণ দূর করার জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করবে। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা না করে অন্ধকারে তীর নিক্ষেপ করার পর যদি একথা জানতে পারে যে, গর্ভসঞ্চার হয়েছিল তাহলে উভয়কেই পরে অনুশোচনা করতে হবে।
এটা হচ্ছে ইদ্দতের জন্য তালাক দেয়ার প্রথম তাৎপর্য। দৈহিক মিলন হয়েছে এমন ঋতুবর্তী এবং গর্ভধারণে সক্ষম নারীদের জন্য এটি প্রযোজ্য। এখন থাকলো এর দ্বিতীয় তাৎপর্যটি। এ তাৎপর্যটি হলো, তালাক দিতে হলে ইদ্দত পর্যন্ত সময়ের জন্য তালাক দাও। অর্থাৎ একসাথে তিন তালাক দিয়ে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তালাক দিয়ে ফেল না। বরং এক বা বড় জোর দুই তালাক দিয়ে ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা করো যাতে এই সময়-কালের মধ্যে যেকোন সময় ‘রুজু’ করার বা ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ তোমার থাকে। এই তাৎপর্য অনুসারে এই নির্দেশটি দৈহিক মিলন হয়েছে এমন ঋতুবতী মহিলাদের জন্য যেমন কল্যাণকর তেমনি যাদের ঋতু বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বা এখনো যাদের ঋতু আসেনি অথবা তালাক দেয়ার সময় যাদের গর্ভসঞ্চার হয়েছে বলে জানা গেছে তাদের সবার জন্য সমানভাবে কল্যাণকর। আল্লাহর এই নির্দেশের অনুসরণ করলে তালাক দেয়ার পর কাউকেই পস্তাতে হবে না। কারণ এভাবে তালাক দিলে ইদ্দতের মধ্যে ‘রুজু’ করা বা ফিরিয়ে নেয়া যায় এবং ইদ্দত শেষ হওয়ার পরেও পূর্বতন স্বামী-স্ত্রী যদি পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় তাহলে পুনরায় বিয়ের মাধ্যমে তা করা সম্ভব।
বড় বড় মুফাস্সির طَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ আয়াতাংশের যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তা এই। এর তাফসীর করতে গিয়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ ঋতু অবস্থায় তালাক দেবে না এবং যে ‘তুহুরে’ স্বামী দৈহিক মিলন করেছে সে ‘তুহুরে’ও দেবে না। বরং তাকে ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র হওয়ার সুযোগ দেবে। অতঃপর তাকে এক তালাক দেবে। এক্ষেত্রে স্বামী যদি রুজু নাও করে এবং এমতাবস্থায় ইদ্দতের সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তাহলে স্ত্রী কেবল এক তালাক দ্বারা বিচ্ছিন্ন হবে (ইবনে জারীর)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “ইদ্দতের জন্য তালাক দেয়ার অর্থ হলো, ‘তুহুরে’ তথা পবিত্রাবস্থায় দৈহিক মিলন না করেই তালাক দেবে।” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, ‘আতা, মুজাহিদ, মায়মুন ইবনে মাহরান, মুকাতিল ইবনে হাইয়ান এবং দাহহাক রাহিমাহুমুল্লাহ থেকে এ তাফসীর বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাসীর)। ইকরিমা এর অর্থ বর্ণনা করে বলেছেনঃ “নারীর গর্ভসঞ্চার হয়েছে এ বিষয়ে জেনে তালাক দেবে। দৈহিক মিলন হয়েছে এ অবস্থায় নারীর গর্ভসঞ্চার হয়েছে কি হয়নি সে বিষয়ে না জেনে তালাক দেবে না” (ইবনে কাসীর)। হযরত হাসান বসরী ও ইবনে সিরীন বলেনঃ ‘তুহুর’ অবস্থায় দৈহিক মিলন না করে তালাক দেবে কিংবা গর্ভ যখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন তালাক দেবে (ইবনে জারীর)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে মাসিক চলাকালে তালাক দিলে রসূলুল্লাহ ﷺ অত্যন্ত স্পষ্ট করে এ আয়াতের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রায় সবগুলো হাদীস গ্রন্থেই এ ঘটনা বিস্তারিতরূপে বর্ণিত হয়েছে। এসব বিষয়ে আইনের উৎস মূলতঃ এটিই। ঘটনাটা হলো, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর তাঁর স্ত্রীকে ঋতুবতী অবস্থায় তালাক দিলে হযরত উমর (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তা বর্ণনা করলেন। এ কথা শুনে নবী ﷺ খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেনঃ “স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তাকে নির্দেশ দাও। পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত সে যেন তাকে স্ত্রী হিসেবেই রাখে। এরপর যখন তার মাসিক হবে এবং তা থেকেও পবিত্র হবে তখন যদি সে তাকে তালাক দিতে চায় তাহলে সেই পবিত্রাবস্থায় দৈহিক মিলন না করে তালাক দেবে। মহান আল্লাহ যে ইদ্দতের জন্য তালাক দিতে বলেছেন এটিই সেই ইদ্দত।” একটি হাদীসের ভাষ্য হলো, “পবিত্রাবস্থায় দৈহিক মিলন না করে তালাক দেবে অথবা এমন অবস্থায় তালাক দেবে যখন তার গর্ভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।”
বড় বড় সাহাবী কর্তৃক রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত আরো কতিপয় হাদীসও এ আয়াতের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের ওপর অধিক আলোকপাত করে। নাসায়ী হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলো যে, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছে। একথা শুনে নবী ﷺ ক্রোধে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং বললেনঃ
أَيُلْعَبُ بِكِتَابِ اللَّهِ وَأَنَا بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ؟
“আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান থাকতেই আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে?”
এ ধরণের আচরণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্রোধের মাত্রা দেখে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ আমি কি তাকে হত্যা করবো না? আব্দুর রাযযাক হযরত উবাদা ইবনে সামেত সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর পিতা নিজের স্ত্রীকে হাজার তালাক দিয়ে ফেললে তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ
بَانَتْ مِنْهُ بِثَلاَثٍ فِى مَعْصِيَةِ اللَّهِ تَعَالَى وَبَقِيَ, تِسْعَ مِأَةٍ وَسَيْعَ وَتِسْعُونَ ظُلْمًا وَعُدْوَاناً- إنْ شَاءَ اللهُ عَذَّيه وإنْ شَاءَ غَفْرَلَه-
“সে আল্লাহর নাফরমানি করেছে আর ঐ স্ত্রী তিন তালাক দ্বারা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন নয় শত সাতানব্বই তালাক জুলুম ও সীমালঙ্ঘন হিসেবে অবশিষ্ট আছে। আল্লাহ চাইলে এজন্য তাকে আযাব দিতে পারেন কিংবা ক্ষমাও করতে পারেন।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর সম্পর্কিত ঘটনার বিস্তারিত যে বিবরণ দারুকুতনী ও ইবনে আবী শায়বা হাদীস গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে তাতে এ কথাটিও আছে যে, নবী ﷺ আবদুল্লাহ ইবনে উমরকে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলে আবদুল্লাহ ইবনে উমর জিজ্ঞেস করলেন, আমি যদি তাকে তিন তালাক দিতাম তাহলেও কি ফিরিয়ে নিতে পারতাম? নবী ﷺ জবাব দিলেনঃ كانت تبين منك وكانت معصية “না, এ অবস্থায় সে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। তবে এটি হতো একটি গোনাহের কাজ।” একটি হাদীসে নবীর ﷺ বক্তব্যের ভাষা বর্ণিত হয়েছে এভাবেঃ اذا قد عصيت ربك وبانت منك امرتك “এরূপ করলে তুমি তোমার রবের নাফরমানি করতে। কিন্তু তোমার স্ত্রী তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।”
এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম থেকে যেসব ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে তাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী ও নির্দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুয়াত্তা হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি এসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রাঃ) বললঃ আমি আমার স্ত্রীকে আট তালাক দিয়ে ফেলেছি। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এ বিষয়ে তোমাকে কি ফতোয়া দেয়া হয়েছে? সে বললঃ “আমাকে বলা হয়েছে যে, স্ত্রী আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেনঃ صدقوا , هو مثل ما يقولون “তারা ঠিকই বলেছে। তারা মাসায়ালার যে সমাধান দিয়েছে তাই ঠিক।” আবদুর রাযযাক ইবনে মাসউদকে (রাঃ) বললঃ আমি আমার স্ত্রীকে ৯৯ তালাক দিয়ে ফেলেছি। তিনি বললেনঃ ثلاث بينها وسائر هن عدوان “তিনটি তালাক তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অবশিষ্ট সবগুলোই বাড়াবাড়ি।” ওয়াকী ইবনুল জাররাহ তাঁর সুনান গ্রন্থে এটি হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত উসমানের মত বলে উল্লেখ করেছেন। এক ব্যক্তি এসে হযরত উসমানকে বলল যে, সে তার স্ত্রীকে এক হাজার তালাক দিয়ে ফেলেছে। হযরত উসমান (রাঃ) বললেনঃ بانت منك بثلاث “সে তিন তালাক দ্বারা তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।” হযরত আলীর (রাঃ) সামনে অনুরূপ ঘটনা উপস্থাপিত হলে তিনি বলেছিলেনঃ بَانَتْ مِنْك بِثَلاَثٍ وَاَقْسِمْ سَائِرَ هُنَّ عَلَى نِسَائِكَ “সে তো তিন তালাক দ্বারা তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন অবশিষ্ট তালাকগুলো তোমার অন্যসব স্ত্রীদের জন্য বণ্টন করে দাও।” আবু দাউদ ও ইবনে জারীর কিছুটা শাব্দিক তারতম্যসহ এ মর্মে মুজাহিদের একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি ইবনে আব্বাসের কাছে বসেছিলেন। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি এসে বললঃ আমি আমার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছি। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস নীরব থাকলেন। এতে আমার ধারণা জন্মালো যে, হয়তো তিনি তার স্ত্রীকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এরপর তিনি বললেনঃ “তোমরা একেকটি লোক তালাক দেয়ার ব্যাপারে প্রথমে বোকামি করে বসো এবং পরে এসে হে ইবনে আব্বাস, হে ইবনে আব্বাস বলতে থাক। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, যে ব্যক্তিই আল্লাহর ভয় মনে রেখে কাজ করবে আল্লাহর তার জন্য সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার উপায় করে দেবেন। তুমি তো আল্লাহকে ভয় করো নাই। এখন আমি তোমার জন্য কোন উপায় দেখছি না। তুমি তোমার রবের নাফরমানি করেছো এবং তোমার স্ত্রী তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।” মুয়াত্তা হাদীসগ্রন্থে এবং তাফসীরে ইবনে জারীরে মুজাহিদ থেকেই আরো একটি হাদীস কিছুটা শাব্দিক তারতম্যসহ বর্ণিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একশত তালাক দেয়ার পর ইবনে আব্বাসের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “তিন তালাক দ্বারা সে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। অবশিষ্ট ৯৭ তালাক দ্বারা তুমি আল্লাহর আয়াতকে খেলার বস্তু বানিয়েছ।” এটি মুয়াত্তার ভাষা। ইবনে জারীর, ইবনে আব্বাসের বক্তব্যের যে ভাষা উদ্ধৃত করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ “তুমি আল্লাহকে ভয় কর নাই। আল্লাহকে ভয় করলে এই কঠিন অবস্থা থেকে বাঁচার কোন উপায় আল্লাহ সৃষ্টি করতেন।” ইমাম তাহাবী একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাসের কাছে এসে তাঁকে বলল, আমার চাচা তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছেন। ইবনে আব্বাস বললেনঃ
اِنَّ عَمَّكَ عَصَى الله فَاثِمَ وَاَطَاعَ الشَّيْطَانُ فَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا –
“তোমার চাচা আল্লাহর নাফরমানি করে গোনায় লিপ্ত হয়েছে এবং শয়তানের আনুগত্য করেছে। তাই আল্লাহ তার জন্য এই কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথ রাখেননি।”
আবু দাউদ ও মুয়াত্তা হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি নির্জনবাসের আগেই তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়ার পর আবার তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হলো এ উদ্দেশ্য সে ফতোয়া জানতে বের হলো। হাদীসের রাবী মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াস ইবনে বুকাইর বলেনঃ আমি তার সাথে ইবনে আব্বাসের ও আবু হুরাইরা (রাঃ) এর কাছে গেলাম। তাঁরা উভয়েই যে জবাব দিয়েছিলেন তাহলো إِنَّكَ أَرْسَلَتْ مِنْ يَدِكَ , مَا كَانَ مِنْ فَضْلٍ “তোমার জন্য যে সুযোগ ছিল তা তুমি হাতছাড়া করে ফেলেছো।” জামাখশারী তাঁর কাশশাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদানকারী যে ব্যক্তিই হযরত উমরের (রাঃ) কাছে আসত তিনি তাকে প্রহার করতেন এবং তার প্রদত্ত তালাক কার্যকরী বলে গণ্য করতেন। সাঈদ ইবনে মনসূর হযরত আনাসের বর্ণনা থেকে সহীহ সনদে এ কথাটি উদ্ধৃত করেছেন। এ ব্যাপারে সাহাবা কিরাম যে সাধারণ মত পোষণ করতেন তা ইবনে আবী শায়বা ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবরাহীম নাখায়ী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি থেকে উদ্ধৃত করেছেন। মতটি হলোঃ
اِنَّ الصِّحَابَةِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ كَانُوا يَسْتَحِبُّونَ أَنْ يُطَلِّقَهَا وَاحِدَةً ثُمَّ يَتْرُكَهَا حَتَّى تَحِيْضُ ثَلاَثَةَ حِيْضٍ-
“সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম চাইতেন, স্বামী স্ত্রীকে প্রথমে এক তালাক দিক এবং তারপর তিনটি ঋতুকাল অতিবাহিত হোক।”
এটি ইবনে আবী শায়বার বক্তব্যের ভাষা। ইমাম মুহাম্মাদের বক্তব্যের ভাষা হলোঃ
كَانُوا يَسْتَحِبُّونَ اَنْ لاَ تَزِيْدُوا فِي الطَّلَاقِ عَلَى وَاحِدَةٍ حَتَّى تَنْقَضِيَ الْعِدَّةُ- “একসাথে এক তালাকের বেশী না দেয়া এবং এভাবে ইদ্দত পূর্ণ হতে দেয়া ছিল সাহাবায়ে কিরামের পছন্দনীয় পন্থা।”
এসব হাদীস সাহাবায়ে কেরামের মতামত ও বক্তব্যের আলোকে কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে ইসলামী ফিকাহবিদগণ বিস্তারিত যে বিধান তৈরী করেছেন আমরা তা নীচে বর্ণনা করছি।
একঃ হানাফী ফিকাহবিদগণের মতে তালাক তিন প্রকার, আহসান, হাসান এবং বেদয়ী। আহসান তালাক হলো, যে ‘তুহরে’ স্বামী-স্ত্রীর সাথে সহবাস করেনি সেই ‘তুহরে’ শুধু এক তালাক দিয়ে ‘ইদ্দত’ পূর্ণ হতে দেবে। হাসান তালাক হলো, প্রত্যেক ‘তুহরে’ একটি করে তালাক দেবে। এই নিয়মে তিন ‘তুহুর’-এ তিন তালাক দেয়াও সুন্নাতের পরিপন্থী নয়। যদিও একটি তালাক দিয়ে ‘ইদ্দত’ পূর্ণ হতে দেয়াটাই সর্বোত্তম। বিদআত তালাক হলো, ব্যক্তির এক সাথে তিন তালাক দিয়ে দেয়া কিংবা একই ‘তুহুরে’ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিন তালাক দিয়ে দেয়া বা হায়েয অবস্থায় তিন তালাক দেয়া অথবা যে ‘তুহুরে’ সহবাস করেছে সেই ‘তুহুরে’ তিন তালাক দেয়া। সে এর যেটিই করুক না কেন গোনাহগার হবে। ঋতুবতী ও দৈহিক মিলন হয়েছে এমন স্ত্রীলোকের জন্য এ বিধানটি প্রযোজ্য। এখন বাকী থাকে দৈহিক মিলন হয়নি এমন স্ত্রীকে তালাকের ব্যাপারটি। এরূপ স্ত্রীকে ‘তুহুর’ ও ‘হায়েয’ উভয় অবস্থায় সুন্নাত অনুসারে তালাক দেয়া যেতে পারে। কিন্তু স্ত্রী যদি এমন হয় যে, তার সাথে দৈহিক মিলন হয়েছে কিন্তু তার ঋতুস্রাব হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা এখনো ঋতুস্রাব হয়নি তাহলে মিলনের পরেও তাকে তালাক দেয়া যেতে পারে। কেননা, তার গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর স্ত্রী গর্ভবতী হলে সহবাসের পরেও তাকে তালাক দেয়া যেতে পারে। কারণ, তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই জানা আছে। কিন্তু এই তিন শ্রেণীর স্ত্রীলোককে তালাক দেয়ার সুন্নাত পন্থা হলো এক মাস পর পর তালাক দেয়া। আর আহসান তালাক হলো, এক তালাক দিয়ে ‘ইদ্দত’ অতিবাহিত হতে দেয়া” (হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, আহকামুল কুরআন-জাসসাস, উমদাতুল কারী)।
ইমাম মালেকের (রঃ) মতেও তালাক তিন প্রকারঃ সুন্নী, বিদয়ী মাকরূহ এবং বিদয়ী হারাম। সুন্নাত অনুসারে তালাক হলো, নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় এমন সহবাসকৃত স্ত্রীকে ‘তুহুর’ অবস্থায় সহবাস না করে এক তালাক দিয়ে ইদ্দত অতিবাহিত হতে দেয়া। বিদয়ী মাকরূহ তালাক হলো, যে ‘তুহুরে’ সহবাস করা হয়েছে সেই তুহুরে তালাক দেয়া, কিংবা সহবাস না করে এক ‘তুহুরে’ একাধিক তালাক দেয়া বা ইদ্দত পালনকালে ভিন্ন ভিন্ন তুহুরে তিন তালাক দেয়া অথবা একসাথে তিন তালাক দিয়ে দেয়া। আর বিদয়ী হারাম, তালাক হলো, ঋতুস্রাবকালে তালাক দেয়া। (হাশিয়াতুদ দাসূকী আলাশশারহিল কাবীর, আহকামূল কুরআন--- ইবনুল আরাবী)।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রঃ) নির্ভরযোগ্য মত হাম্বলী মাযহাবের অধিকাংশ ফিকাহবিদ যে বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন--- তা হলো নিয়মিত মাসিক স্রাব হয় এবং স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন হয়েছে এমন স্ত্রীলোককে সুন্নাত অনুসারে তালাক দেয়ার নিয়ম হচ্ছে ‘তুহুর’ অবস্থায় তার সাথে সহবাস না করে তালাক দিতে হবে এবং ‘ইদ্দত’ অতিবাহিত হওয়ার জন্য এই অবস্থায়ই রেখে দিতে হবে। তবে তাকে যদি তিন ‘তুহুরে’ আলাদাভাবে তিন তালাক দেয়া হয় কিংবা একই ‘তুহুরে’ তিন তালাক দেয়া হয় বা একই সাথে তিন তালাক দেয়া হয় অথবা ঋতুস্রাবকালে তালাক দেয়া হয় অথবা যে ‘তুহুরে’ সহবাস করা হয়েছে সেই ‘তুহুরেই’ তালাক দেয়া, কিন্তু তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয় প্রকাশ না পায় তাহলে এসব তালাক বিদআত ও হারাম। তবে নারী যদি এমন হয় যার সাথে সহবাস করা হয়নি অথবা সহবাস করা হয়েছে কিন্তু তার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা ঋতুস্রাব এখনো শুরু হয়নি অথবা গর্ভবতী, তাহলে তার ক্ষেত্রে না সময়ের বিবেচনায় সুন্নাত ও বিদআত বলে কোন পার্থক্য আছে, না তালাকের সংখ্যার বিবেচনায় কোন পার্থক্য আছে। (আল ইনসাফ ফী মা’রিফাতির রাজেহ মিনাল খেলাফ আলা মাযাহাবি আহমাদ ইবনে হাম্বল)।
ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ----এর মতে তালাককে সুন্নাত ও বিদআত হিসেবে পৃথক করা যেতে পারে কেবল সময়ের বিচারে, সংখ্যার বিচারে নয়। অর্থাৎ নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় এবং দৈহিক মিলন হয়েছে এমন নারীকে ঋতুস্রাবকালে তালাক দেয়া অথবা গর্ভধারণে সক্ষম নারীকে যে তুহুরে সহবাস হয়েছে সেই তুহুরে তালাক দেয়া কিন্তু তার গর্ভবস্থা প্রকাশ পায়নি, বিদআত ও হারাম। এরপর থাকে তালাকের সংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়টি। এক্ষেত্রে একই সাথে তিন তালাক দেয়া হোক অথবা একই তুহুরে বা ভিন্ন ভিন্ন ‘তুহুরে’ দেয়া হোক কোন অবস্থায়ই তা সুন্নাতের পরিপন্থী নয়। আর দৈহিক মিলন হয়নি এমন নারী অথবা এমন নারী যার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা এখনো শুরু হয়নি অথবা গর্ভবতী হওয়া প্রকাশ পেয়েছে তাকে দেয়া তালাকের ক্ষেত্রে সুন্নাত বিদআতের প্রার্থক্য প্রযোজ্য নয়। (মুগনিউল মুহতাজ)
দুইঃ কোন তালাক বিদআত, মাকরূহ, হারাম বা গোনাহের কাজ হওয়ার অর্থ চার ইমামের নিকট এই নয় যে, তা কার্যকর হবে না। তালাক মাসিক অবস্থায় দেয়া হয়ে থাকুক অথবা একসাথে তিন তালাক দেয়া হয়ে থাকুক, অথবা যে তুহুরে দৈহিক মিলন হয়েছে সেই তুহুরে দেয়া হয়ে থাকুক, কিন্তু গর্ভ প্রকাশ পায়নি অথবা কোন ইমামের দৃষ্টিতে বিদআত এমন কোন পন্থায় দেয়া হয়ে থাকুক সর্বাবস্থায় তা কার্যকরী হবে। আর তালাকদাতা ব্যক্তি গোনাহগার হবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক মুজতাহিদ এ ব্যাপারে চার ইমামের সাথে মতানৈক্য পোষণ করেছেন।
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব এবং আরো কিছু সংখ্যক তাবেয়ীর মতে যে ব্যক্তি সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ করে ঋতু অবস্থায় তালাক দেবে অথবা একই সাথে তিন তালাক দেবে তার তালাক আদৌ কার্যকর হয় না। ইমামিয়া মাযহাবের অনুসারীরাও এমত পোষণ করেন। এ মতের ভিত্তি হলো, এরূপ করা যেহেতু নিষিদ্ধ এবং হারাম বিদআত তাই তা কার্যকর নয়। অথবা আমরা ওপরে যেসব হাদীস উদ্ধৃত করেছি তাতে বলা হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর মাসিক অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিলে নবী ﷺ তাকে রুজু করার বা ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ তালাক যদি আদৌ কার্যকর না হয়ে থাকবে তাহলে রুজু করার নির্দেশ দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? তাছাড়া বহু সংখ্যক হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত যে, নবী ﷺ এবং বড় বড় সাহাবী একের অধিক তালাক দানকারীকে গোনাহগার বললেও তার দেয়া তালাককে অকার্যকর বলেননি।
তাউস ও ইকরিমা বলেন, একসাথে তিন তালাক দিলে সেক্ষেত্রে শুধু এক তালাক কার্যকর হবে। ঈমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ)-ও এ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছেন। একটি রেওয়ায়াত তাদের এ মতের উৎস ও ভিত্তি। রেওয়ায়াতটি হলো, আবুস সাহবা ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি জানেন না রসূলুল্লাহ ﷺ ও হযরত আবু বকরের (রাঃ) সময়ে এবং হযরত উমরের (রাঃ) যুগের প্রথম ভাগে তিন তালাককে এক তালাক বলে গণ্য করা হতো?” তিনি জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ (বুখারী ও মুসলিম)। তাছাড়া মুসলিম, আবু দাউদ এবং মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাসের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ ও হযরত আবু বকরের (রাঃ) যুগে এবং হযরত উমরের (রাঃ) যুগে প্রথম দুই বছরে তিন তালাককে এক তালাক বলে গণ্য করা হতো। পরবর্তী সময়ে হযরত উমর (রাঃ) বললেন যে, মানুষ এমন এমন একটি বিষয়ে তাড়াহুড়া করতে শুরু করেছে, যে বিষয়ে ভেবে চিন্তে ও বুঝে-সুঝে কাজ করার অবকাশ দেয়া হয়েছিল। এখন আমরা তাদের এ কাজকে কার্যকর করবো না কেন? সুতরাং তিনি তা কার্যকর বলে ঘোষণা করলেন।
কিন্তু কয়েকটি কারণে এ মতটি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, কয়েকটি রেওয়ায়াত অনুসারে ইবনে আব্বাসের নিজের ফতোয়াই এর পরিপন্থী ছিল। এ কথা আমরা ওপরে উদ্ধৃত করেছি। দ্বিতীয়ত, এ মতটি নবী ﷺ এবং বড় বড় সাহাবী থেকে বর্ণিত যেসব হাদীসে তিন তালাক দানকারী সম্পর্কে ফতোয়া দেয়া হয়েছে যে, তার দেয়া তিন তালাকই কার্যকর হবে তার পরিপন্থী। আমরা ওপরে ঐ হাদীসগুলো উদ্ধৃত করেছি। তৃতীয়ত, ইবনে আব্বাসের নিজের রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত উমর (রাঃ) সাহাবায়ে কিরামের (রাঃ) সমাবেশে তিন তালাক কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সে সময় বা পরবর্তীকালে কোন সময়ই সাহাবীদের মধ্যে থেকে কেউ এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেননি। এখন কথা হলো, হযরত উমর (রাঃ) সুন্নাতের পরিপন্থী কোন কাজ করেছেন এ কথা কি মেনে নেয়া যেতে পারে? আর সে বিষয়ে সমস্ত সাহাবী নিশ্চুপ থাকবেন এ কথাও কি মেনে নেয়া যেতে পারে? তাছাড়া রুকানা ইবনে আবদে ইয়াযীদের ঘটনা সম্পর্কে আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, ইমাম শাফেয়ী (রঃ), দারেমী এবং হাকেম বর্ণনা করেছেন যে, রুকান তার স্ত্রীকে একই সাথে তিন তালাক দিলে রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে হলফ করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে, সত্যিই কি তার এক তালাক দেয়ার নিয়ত ছিল? (অর্থাৎ অন্য দু’টি তালাক প্রথম তালাকটির ওপর জোর দেয়া এবং গুরুত্ব আরোপ করার জন্য তার মুখ থেকে বেরিয়ে ছিল এবং তিন তালাক দিয়ে চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দেয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না) তিনি হলফ করে এ বর্ণনা দিলে নবী ﷺ তাকে রুজু করার বা ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার দিয়েছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোন্ প্রকারের তালাকসমূহকে এক তালাক হিসেবে গণ্য করা হতো তার প্রকৃতি এসব ঘটনা থেকে জানা যায়। এ কারণে হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতের এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, যেহেতু প্রাথমিক যুগে দ্বীনি ব্যাপারে মানুষের মধ্যে খিয়ানত প্রায় ছিল না বললেই চলে তাই তিন তালাক দানকারীর এ বক্তব্য মেনে নেয়া হতো, যে তার প্রকৃত নিয়ত ছিল এক তালাক দেয়ার। অন্য দু’টি তালাক প্রথম তালাকের ওপর জোর দেয়ার জন্যই তার মুখ থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু হযরত উমর দেখলেন যে, মানুষ তাড়াহুড়া করে প্রথমে তিন তালাক দিয়ে বসে এবং পরে প্রথম তালাকের ওপর জোর দেয়ার বা গুরুত্ব আরোপ করার বাহানা করে। তাই তিনি এ বাহানা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। ইমাম নববী ও ইমাম সুবকী এ ব্যাখ্যাটিকে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতের উত্তম ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করেছেন। শেষ কথা হলো, ইবনে আব্বাসের বক্তব্য সম্পর্কে আবুস সাহবা কর্তৃক যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতেও অসামঞ্জস্য রয়েছে। মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ী, আবুস সাহবা থেকে অপর যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি জিজ্ঞেস করায় ইবনে আব্বাস বললেনঃ “নির্জন বাসের পূর্বেই কেউ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে রসূলুল্লাহ ﷺ ও হযরত আবু বকরের (রাঃ) যুগে এবং হযরত উমরের (রাঃ) যুগের প্রথম দিকে তাকে এক তালাক বলে গণ্য করা হতো।” এভাবে একই বর্ণনাকারী ইবনে আব্বাস থেকে দু’টি পরস্পর বিরোধী রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। এই পরস্পর বিরোধিতা দু’টি রেওয়ায়াতকেই দুর্বল করে দেয়।
তিনঃ স্ত্রীর ঋতুস্রাব চলাকালে তালাকদাতাকে যেহেতু রসূলুল্লাহ ﷺ ‘রুজু’ করার আদেশ দিয়েছিলেন তাই এ নির্দেশকে কোন্ অর্থে গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ, ইমাম আওযায়ী, ইবনে আবী লায়লা, ইসহাক ইবনে রাহাবিয়া এবং আবু সাওর বলেনঃ “ঐ ব্যক্তিকে ‘রুজু’ করার নির্দেশ দেয়া হবে তবে ‘রুজু’ করতে বাধ্য করা হবে না।” (উমদাতুল কারী)। হিদায়া গ্রন্থে হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের যে মত বর্ণনা করা হয়েছে সে অনুসারে ‘রুজু’ করা শুধু মুস্তাহাব নয় বরং ওয়াজিব। মুগনিউল মুহতাজ গ্রন্থে শাফেয়ী মাযহাবের যে মত বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে, যে ব্যক্তি মাসিক চলাকালে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে কিন্তু তিন তালাক দেয়নি তার জন্য সুন্নাত পন্থা হলো, সে রুজু করবে এবং এর পরবর্তী তুহুরেই তালাক না দিয়ে তা অতিবাহিত হতে দেবে এবং তা অতিবাহিত হওয়ার পর স্ত্রী পুনরায় যখন মাসিক থেকে পবিত্র হবে তখন চাইলে তালাক দেবে, যাতে ঋতুকালে প্রদত্ত তালাক থেকে ‘রুজু’ করা খেলার বস্তুতে পরিণত না হয়। আল ইনসাফ গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের যে মত বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে, এ অবস্থায় তালাক দানকারীর জন্য ‘রুজু’ করা মুস্তাহাব। কিন্তু ইমাম মালেক ও তাঁর সঙ্গীদের মতে ঋতু চলাকালে তালাক দেয়া পুলিশের হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ। স্ত্রী দাবী করুক বা না করুক সর্বাবস্থায় শাসকের অবশ্য কর্তব্য হলো যখন কোন ব্যক্তির এ ধরণের কাজ সম্পর্কে তিনি জানতে পারবেন তখনই তাকে ‘রুজু’ করতে বাধ্য করবেন এবং ইদ্দতের শেষ সময় পর্যন্ত তাকে চাপ দিতে থাকবেন। সে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বন্দী করবেন। এরপরও অস্বীকৃতি জানালে প্রহার করবেন। তারপরও সে যদি না মানে তাহলে শাসক নিজেই সিদ্ধান্ত দেবেন যে, তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শাসক বা বিচারকের এই সিদ্ধান্ত ‘রুজু’ বলে গণ্য হবে। এরপর স্বামীর রুজু করার নিয়ত থাক বা না থাক তার জন্য ঐ স্ত্রীর সাথে সহবাস বৈধ হবে। কারণ শাসক বা বিচারকের নিয়ত তার নিয়তের বিকল্প (হাশিয়াতুদ দুসুকী)। মালেকীরা এ কথাও বলেন যে, যে ব্যক্তি ঋতুস্রাবকালে প্রদত্ত তালাক থেকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় রুজু করেছে সে যদি তালাক দিতেই চায় তাহলে তার জন্য মুস্তাহাব পন্থা হলো, সে যে হায়েজে তালাক দিয়েছে তার পরের ‘তুহুরেই’ তালাক দেবে না। বরং পুনরায় হায়েজ আসার পর যখন পবিত্র হবে তখন তালাক দেবে। তালাকের পরবর্তী তুহুরেই তালাক না দেয়ার নির্দেশ মূলত এজন্য দেয়া হয়েছে যে, হায়েজ অবস্থায় তালাক দানকারীর ‘রুজু’ করা যেন কেবল মৌখিক না হয়। বরং স্ত্রীর পবিত্রতার সময় তার স্ত্রীর সাথে দৈহিকভাবে মিলিত হওয়া উচিত। তারপর যে ‘তুহুরে’ দৈহিক মিলন হয়েছে সেই ‘তুহুরে’ তালাক দেয়া যেহেতু নিষিদ্ধ তাই তালাক দেয়ার সঠিক সময় তার পরবর্তী ‘তুহুরে’। (হাশিয়াতুদ দুসুকী)।
চারঃ রিজয়ী তালাকদাতার জন্য ‘রুজু’ করার সুযোগ কতক্ষণ? এ বিষয়েও ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সূরা বাকারার ২২৮ আয়াতের ثلثة قروء অর্থ তিন হায়েজ না তিন ‘তুহুর’ এ প্রশ্নের ভিত্তিতেই এ মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম শাফীঈ (রঃ) এবং ইমাম মালেকের (রঃ) মতে قرء শব্দের অর্থ ‘তুহুর’। হযরত আয়েশা, ইবনে উমর এবং যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও এ মতটিই বর্ণিত হয়েছে। হানাফীদের মত হলো, قرء শব্দের অর্থ হায়েজ। এটিই ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের নির্ভরযোগ্য মত। খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলীফা ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), উবাই ইবনে কা’ব, মু’য়ায ইবনে জাবাল আবুদ দারদা, উবাদা ইবনে সামেত এবং আবু মূসা আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে এ মতটি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে শা’বীর উক্তির উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ১৩ জন সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরাও সবাই এ মত পোষণ করেছেন। তাছাড়া বহু সংখ্যক তাবেয়ীও এ মত পোষণ করেছেন।
এ মতভেদের ওপর ভিত্তি করে শাফেয়ী এবং মালেকীদের মতে তৃতীয় হায়েজ শুরু হওয়া মাত্রই স্ত্রীর ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায় এবং স্বামীর রুজু করার অধিকার বাতিল হয়ে যায়। তবে যদি হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া হয়ে থাকে তাহলে ঐ হায়েজ ইদ্দতের মধ্যে গণ্য হবে না, বরং চতুর্থ হায়েজ শুরু হওয়া মাত্র ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যাবে (মুগনিউল মুহতাজ, হাশিয়াতুদ দুসুকী)। হানাফীদের মত হলো তৃতীয় হায়েজের দশদিন অতিবাহিত হওয়ার পর যদি রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যায় তবে নারী গোসল করুক বা না করুক তার ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যাবে। আর যদি দশদিনের কম সময়ের মধ্যে রক্তস্রাব বন্ধ হয় তাহলে গোসল না করা পর্যন্ত অথবা এক ওয়াক্ত নামাযের পুরো সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ইদ্দতকাল শেষ হবে না। পানি না থাকার পরিস্থিতিতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ও ইমাম আবু ইউসুফের (রঃ) মতে নারী যখন তায়াম্মুম করে নামায পড়ে নিবে তখন স্বামীর রুজু করার অধিকার শেষ হয়ে যাবে। আর ইমাম মুহাম্মাদের মতে তায়াম্মুম করা মাত্রই রুজু করার অধিকার শেষ হয়ে যাবে (হিদায়া)। ইমাম আহমাদের নির্ভরযোগ্য যে মতটি সম্পর্কে হাম্বলী মাযহাবের অধিকাংশ অনুসারী একমত তা হচ্ছে, স্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত তৃতীয় হায়েজ থেকে মুক্ত হয়ে গোসল না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বামীর রুজু করার অধিকার থাকবে (আল ইনসাফ)।
পাঁচঃ রুজু কিভাবে হয় আর কিভাবে হয় না? এ মাসায়ালার ক্ষেত্রে ফিকাহবিদদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য আছে যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রিজয়ী তালাক দিয়েছে স্ত্রী সম্মত হোক বা না হোক ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে সে যখন ইচ্ছা ‘রুজু’ করতে পারে। কেননা কুরআন মজীদে (সূরা বাকারাহ আয়াত ২২৮) বলা হয়েছেঃ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَلِكَ “এই সময়ের মধ্যে তাদের স্বামী তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে।” এ থেকে স্বতঃই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ‘ইদ্দত’ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের বিবাহ বন্ধন বহাল থাকে এবং চূড়ান্তভাবে ছেড়ে দেয়ার পূর্বে সে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। অন্য কথায় ‘রুজু’ করা বিবাহ নবায়ন করা নয় যে, সেজন্য স্ত্রীর সম্মতি প্রয়োজন হবে। এতটুকু পর্যন্ত ঐকমত্য পোষণ করার পর ফিকাহবিদগণ ‘রুজু’ করার পন্থা ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন ।
শাফেয়ী মাযহাবের মতে, ‘রুজু’ করা শুধু কথার দ্বারাই হতে পারে, কাজ দ্বারা নয়। ‘আমি তোমাকে রুজু করলাম অর্থাৎ ফিরিয়ে নিলাম’ এ কথা যদি তালাকদাতা না বলে তাহলে দৈহিক মিলন বা মেলামেশার মত কোন কাজ ‘রুজু’ করার নিয়তে করা হলেও তাকে ‘রুজু’ বলে গণ্য করা হবে না। বরং এক্ষেত্রে নারীকে যে কোন পন্থায় উপভোগ করা এবং তার থেকে তৃপ্তি লাভ করা হারাম, এমনকি তা যৌন উত্তেজনা ছাড়া হয়ে থাকলেও। কিন্তু রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে সেজন্য কোন হদ বা শাস্তি হবে না। কারণ, রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে সহবাস হারাম হওয়ার ব্যাপারে সকল উলামা একমত নন। তবে যে ব্যক্তি এক্ষেত্রে সহবাস হারাম বলে মনে করে তাকে তাযীর করা হবে। তাছাড়া শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে সহবাস করার কারণে সর্বাবস্থায় ‘মহরে মিসল’ বা সমতুল্য মোহরানা পরিশোধ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । সহবাস করার পর স্বামী মৌখিকভাবে ‘রুজু’ করুক বা না করুক তাতে কিছু এসে যায় না। (মুগরিউল মুহতাজ)।
মালেকী মাযহাবের অনুসারীদের মতে ‘রুজু’ কথা ও কাজ উভয়ভাবেই হতে পারে। কথার দ্বারা রুজু করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি স্পষ্ট ভাষা প্রয়োগ করে তাহলে রুজু করার নিয়ত তার থাক বা না থাক ‘রুজু’ হয়ে যাবে। এমনকি স্পষ্টভাবে রুজু করা বুঝায় এমন শব্দ যদি সে তামাসাচ্ছলেও বলে তবুও তা ‘রুজু’ বলে গণ্য হবে । তবে কথা যদি সুস্পষ্ট না হয় তাহলে কেবল রুজুর নিয়তে বলা হয়ে থাকে তবেই তা রুজু বলে গণ্য হবে । এরপর থাকে কোন কাজ দ্বারা ‘রুজু’ করার বিষয়টি। এক্ষেত্রে মেলামেশা হোক বা সহবাস হোক ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কাজকে ‘রুজু’ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না যতক্ষণ না তা ‘রুজুর’ নিয়তে করা হবে। (হাশিয়াতুদ দুসুকী, আহকামুল কুরআন--- ইবনুল আরাবী)।
কথা দ্বারা বা মৌখিকভাবে রুজু করার বেলায় হানাফী ও হাম্বলী মাযহাবের মতামত মালেকী মাযহাবের অনুরূপ। কিন্তু কাজ দ্বারা রুজু করার ক্ষেত্রে তাদের মতামত মালেকীদের বিপরীত । এক্ষেত্রে হানাফী ও হাম্বলী উভয় মাযহাবের ফতোয়া হলো স্বামী যদি ইদ্দতের মধ্যেই রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তাহলে এক্ষেত্রে সে ‘রুজু’ করার নিয়তে করুক বা না করুক তার এই কাজ আপনা থেকেই রুজু বলে গণ্য হবে। তবে উভয় মাযহাবের সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু যে, হানাফীদের মতে, মেলামেশার যে কোন কাজই ‘রুজু’ বলে গণ্য হবে এমনকি যদি তা সহবাসের চেয়ে নিম্নস্তরের কোন কাজও হয়। কিন্তু হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণ শুধু মেলামেশাকে রুজু বলে স্বীকার করেন না।” (হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, উমদাতুল কারী, আল ইনসাফ)।
ছয়ঃ ফলাফলের দিক দিয়ে সুন্নাত তালাক ও বিদআত তালাকের মধ্যে পার্থক্য এই যে, এক তালাক বা দুই তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে ইদ্দকাল শেষ হয়ে গেলেও তালাকাপ্রাপ্তা স্ত্রী এবং তার পূর্ব স্বামীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পুনরায় বিয়ে হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি তিন তালাক দিয়ে ফেলে তাহলে ইদ্দতের মধ্যে যেমন ‘রুজু’ করা সম্ভব নয় তেমনি ইদ্দত শেষে পুনরায় বিয়ে হওয়াও সম্ভব নয়। তবে উক্ত মহিলার যদি অন্য কোন পুরুষের সাথে যথাযথভাবে বিয়ে হয়ে থাকে আর সে তার সাথে সহবাস করে এবং পরে তালাক দেয় কিংবা মরে যায় এবং তারপর এই মহিলা ও তার পূর্ব স্বামী পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় তাহলে তা করতে পারবে। অধিকাংশ হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। এরপর সেই মহিলা অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার নির্জনবাসও হয়েছে কিন্তু সহবাস হয়নি। এমতাবস্থায় সে তাকে তালাক দিয়েছে। এখন এই মহিলার কি তার পূর্ব স্বামীর সাথে পুনরায় বিয়ে হতে পারে? নবী ﷺ জবাব দিলেনঃ
لاَ حَتَّى يَذُوقَ الآخِرُ مِنْ عُسَيْلَتِهَا مَا ذَاقَ الأَوَّلُ
“না, ততক্ষণ পর্যন্ত হতে পারে না যতক্ষণ তার দ্বিতীয় স্বামী প্রথম স্বামীর মত দৈহিক মিলন না করবে।”
এরপর থাকে পাতানো বিয়ে সম্পর্কে কথা। এ ধরণের বিয়েতে আগে থেকেই শর্ত থাকে যে, নারীকে তার পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল করার নিমিত্তে এক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে এবং সহবাস করার পর তালাক দেবে। ইমাম আবু ইউসুফের (রঃ) মতে এ ধরণের শর্তযুক্ত বিয়ে আদৌ বৈধ হয় না। ইমাম আবু হানিফার (রঃ) মতে, এভাবে তাহলীল হয়ে যাবে, তবে কাজটি মাকরূহ তাহরিমী বা হারাম পর্যায়ের মাকরূহ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
لَعَنَ اللَّهُ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ(ترمذى , نسائى)
“যে তাহলীল করে এবং যে তাহলীল করায় তাদের উভয়কে আল্লাহ তা’আলা লা’নত করেছেন।” (তিরমিযী , নাসায়ী)।
হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ الا اخبركم بالتيس المستعار؟ “আমি কি তোমাদেরকে ভাড়াটে ষাঁড় সম্পর্কে অবহিত করবো না? সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল, অবশ্যই করবেন। তিনি বললেনঃ
هُوَ الْمُحَلِّلُ لَعَنَ اللَّهُ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ(ابن ماجه , دار قطنى)
“ভাড়াটে ষাঁড় হচ্ছে তাহলীলকারী। যে তাহলীল করে এবং যে তাহলীল করায় আল্লাহ তাদের উভয়কে লা’নত করেছেন। (ইবনে মাজা, দারু কুতনী)।
সমস্ত ফিকাহবিদ এ ব্যাপারে একমত যে, ইদ্দতকালে রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর বাসগৃহ এবং খোরপোষ পাওয়ার অধিকার আছে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া এই সময় বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া স্ত্রীর জন্য জায়েজ নয় এবং স্বামীর জন্য স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়াও জায়েজ নয়। স্বামী তাকে বের করে দিলে গোনাহগার হবে। আর স্ত্রী নিজেই যদি বের হয়ে যায় তাহলে সেও গোনাহগার হবে এবং খোরপোষ ও বাসগৃহ পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
এখানে পুনরায় সূরা বাকারার ২২৮ থেকে ২৩০ আয়াত এবং সূরা তালাকের আলোচ্য আয়াতগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার। সূরা বাকারায় তালাকের হিসাব বা নির্দিষ্ট সীমা বলা হয়েছে তিন। এর মধ্যে দুই তালাকের পর রুজু করার অধিকার এবং ‘ইদ্দত’ পূরণ হওয়ার পর ‘তাহলীল’ ছাড়াই পুনরায় বিয়ে করার অধিকার থাকে। কিন্তু তৃতীয় তালাক দেয়ার পর এই দু’টি অধিকারই নষ্ট হয়ে যায়। এই নির্দেশটিকে বাতিল বা এর মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধনের জন্য সূরা তালাকের এ আয়াতগুলো নাযিল হয়নি, বরং নাযিল হয়েছে এ কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, স্ত্রীদের তালাক দেয়ার যে অধিকার ও ইখতিয়ার স্বামীদের দেয়া হয়েছে তা প্রয়োগ করার বিজ্ঞোচিত পন্থা কি, যা অনুসরণ করলে দাম্পত্য বন্ধন ছিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তালাক দিয়ে অনুশোচনা করার মত পরিস্থিতি আসতে পারে না। সমঝোতা ও আপোষরফা হওয়ার সর্বাধিক সুযোগ থাকে এবং শেষ পর্যন্ত যদি বিচ্ছেদ হয়েও যায় তাহলে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আবার মিলিত হওয়ার শেষ পথটি খোলা থাকে। কিন্তু অজ্ঞতা বশত কেউ যদি তার ইখতিয়ারসমূহ ভুল পন্থায় প্রয়োগ করে বসে তাহলে সে নিজের ওপর জুলুম করবে এবং ক্ষতিপূরণ ও সংশোধনের সমস্ত সুযোগ হারিয়ে ফেলবে। এর উপমা দেয়া যায় এভাবে যে, কোন এক পিতা তার ছেলেকে তিন শত টাকা দিয়ে বললেনঃ তুমিই এ টাকার মালিক, যেভাবে ইচ্ছা তুমি এ টাকা খরচ করতে পারো। এরপর তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেনঃ যে অর্থ আমি তোমাকে দিলাম তা তুমি সতর্কতার সাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে খরচ করবে যাতে তা থেকে যথাযথ উপকার পেতে পার। আমার উপদেশের তোয়াক্কা না করে তুমি যদি অসতর্কভাবে অন্যায় ক্ষেত্রে তা খরচ করো কিংবা সমস্ত অর্থ একসাথে খরচ করে ফেল তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি খরচ করার জন্য আর কোন টাকা পয়সা তোমাকে দিব না। এখন পিতা যদি এই অর্থের পুরোটা ছেলেকে আদৌ না দেয় তাহলে সেক্ষেত্রে এসব উপদেশের কোন অর্থই হয় না। যদি এমন হয় যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র ছাড়াই ছেলে তা খরচ করতে চাচ্ছে, কিন্তু টাকা তার পকেট থেকে বেরই হচ্ছে না, অথবা পুরো তিন শত টাকা খরচ করে ফেলা সত্ত্বেও মাত্র একশত টাকাই তার পকেট থেকে বের হচ্ছে এবং সর্বাবস্থায় দুইশত টাকা তার পকেটেই থেকে যাচ্ছে, তাহলে এই উপদেশের আদৌ কোন প্রয়োজন থাকে কি?