নামকরণ
المجادلة এবং المجادلة উভয়টিই এ সূরার নাম। নামটি প্রথম আয়াতের تٌجَادِلُكَ শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। সূরার প্রারম্ভেই যেহেতু সে মহিলার কথা উল্লেখ আছে, যে তার স্বামীর ‘যিহারে’র ঘটনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করে পীড়াপীড়ি করেছিল যে, তিনি যেন এমন কোন উপায় বলে দেন যাতে তার এবং তার সন্তানদের জীবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহ তা’আলা তার এ পীড়াপীড়িকে مجادله শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। তাই এ শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। শব্দটিকে যদি مجادله পড়া হয় তাহলে তার অর্থ হবে “আলোচনা ও যুক্তি তর্ক” আর যদি مجادله পড়া হয় তাহলে অর্থ হবে “আলোচনা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকারিনী।”
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
মুজাদালার এ ঘটনাটি কখন সংঘটিত হয়েছিল তা কোন রেওয়ায়াতেই স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি। কিন্তু এ সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন একটি ইঙ্গিত আছে যার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, এ সূরা আহযাব যুদ্ধের (৫ম হিজরীর শাওয়াল মাস) পরে নাযিল হয়েছে। পালিত পুত্র যে প্রকৃতই পুত্র হয় না সে বিষয়ে বলতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা সূরা আহযাবে যিহার সম্পর্কে শুধু এতটুকু বলেছিলেনঃمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّائِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ
“তোমরা যেসব স্ত্রীর সাথে যিহার করো আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের মা বানিয়ে দেননি।” (আল আহযাবঃ ৪)
কিন্তু যিহার করা যে, একটি গোনাহ বা অপরাধ সেখানে তা বলা হয়নি। এ কাজের শরয়ী বিধান কি সেখানে তাও বলা হয়নি। পক্ষান্তরে এ সূরায় যিহারের সমস্ত বিধি-বিধান বলে দেয়া হয়েছে। এতে বুঝা যায় বিস্তারিত এ হুকুম আহকাম ঐ সংক্ষিপ্ত হিদায়াতের পরেই নাযিল হয়েছে।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
সেসময় মুসলমানগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন এ সূরায় সেসব সমস্যা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সূরার শুরু থেকে ৬ নং আয়াত পর্যন্ত যিহারের শরয়ী হুকুম আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে। সে সাথে মুসলমানদের কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণ করার পর জাহেলী রীতিনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমাসমূহ লংঘন করা অথবা তা মেনে চলতে অস্বীকার করা অথবা তার পরিবর্তে নিজের ইচ্ছা মাফিক অন্য নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন তৈরী করে নেয়া ঈমানের চরম পরিপন্থী কাজ ও আচরণ। এর শাস্তি হচ্ছে পার্থিব জীবনের লাঞ্ছনা। এ ব্যাপারে আখেরাতেও কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।৭ থেকে ১০ আয়াতে মুনাফিকদের আচরণের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। তারা পরস্পর গোপন সলা পরামর্শ করে নানারূপ ক্ষতি সাধনের পরিকল্পনা করতো। তাদের মনে যে গোপন হিংসা বিদ্বেষ ছিল তার কারণে তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইহুদীদের মত এমন কায়দায় সালাম দিতো যা দ্বারা দোয়ার পরিবর্তে বদ দোয়া প্রকাশ পেতো। এক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে এই বলে সান্তনা দেয়া হয়েছে যে, মুনাফিকদের ঐ সলা পরামর্শ তোমাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজেদের কাজ করতে থাক। সাথে সাথে তাদেরকে এই নৈতিক শিক্ষাও দেয়া হয়েছে যে, গোনাহ জুলুম বাড়াবাড়ি এবং নাফরমানীর কাজে সলা পরামর্শ করা ঈমানদারদের কাজ নয়। তারা গোপনে বসে কোন কিছু করলে তা নেকী ও পরহেজগারীর কাজ হওয়া উচিত।
১১ থেকে ১৩ আয়াতে মুসলমানদের কিছু মজলিসী সভ্যতা ও বৈঠকী আদব-কায়দা শেখানো হয়েছে। তাছাড়া এমন কিছু সামাজিক দোষ-ত্রুটি দূর করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যা মানুষের মধ্যে আগেও ছিল এবং এখনো আছে। কোন মজলিসে যদি বহু সংখ্যক লোক বসে থাকে এমতাবস্থায় যদি বাইরে থেকে কিছু লোক আসে তাহলে মজলিসে পূর্ব থেকে বসে থাকা ব্যক্তিগণ নিজেরা কিছুটা গুটিয়ে বসে তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার কষ্টটুকু স্বীকার করতেও রাজী হয় না। ফলে পরে আগমনকারীগণ দাঁড়িয়ে থাকেন, অথবা দহলিজে বসতে বাধ্য হয় অথবা ফিরে চলে যায় অথবা মজলিসে এখনো যথেষ্ট স্থান আছে দেখে উপস্থিত লোকজনকে ডিঙ্গিয়ে ভিতরে চলে আসেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে প্রায়ই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। তাই আল্লাহ তা’আলা সবাইকে হিদায়াত বা নির্দেশনা দিয়েছেন যে, মজলিসে আত্মস্বার্থ এবং সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিও না। বরং খোলা মনে পরবর্তী আগমনকারীদের জন্য স্থান করে দাও।
অনুরূপ আরো একটি ত্রুটি মানুষের মধ্যে দেখা যায়। কেউ কারো কাছে গেলে বিশেষ করে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে গেলে জেঁকে বসে থাকে এবং এদিকে মোটেই লক্ষ্য করে না যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় নেয়া তার কষ্টের কারণ হবে। তিনি যদি বলেন, জনাব এখন যান তাহলে সে খারাপ মনে করবে। তাকে ছেড়ে উঠে গেলে অভদ্র আচরণের অভিযোগ করবে। ইশারা ইঙ্গিতে যদি বুঝাতে চান যে, অন্য কিছু জরুরী কাজের জন্য তার এখন কিছু সময় পাওয়া দরকার তাহলে শুনেও শুনবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মানুষের এ আচরণের সম্মুখীন হতেন আর তাঁর সাহচর্য থেকে উপকৃত হওয়ার আকাঙ্খায় আল্লাহর বান্দারা মোটেই খেয়াল করতেন না যে, তারা অতি মূল্যবান কাজের সময় নষ্ট করছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা এ কষ্টদায়ক বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দিলেন যে, যখন বৈঠক শেষ করার জন্য উঠে যাওয়ার কথা বলা হবে তখন উঠে চলে যাবে।
মানুষের মধ্যে আরো একটি বদ অভ্যাস ছিল। তা হচ্ছে, কেউ হয়তো নবীর (সা.) সাথে অযথা নির্জনে কথা বলতে চাইতো অথবা বড় মজলিসে তাঁর নিকটে গিয়ে গোপনীয় কথা বলার ঢংয়ে কথা বলতে চাইতো। এটি নবীর (সা.) জন্য যেমন কষ্টদায়ক ছিল তেমনি মজলিসে উপস্থিত লোকজনের কাছে অপছন্দনীয় ছিল। তাই যে ব্যক্তিই নির্জনে একাকী তাঁর কথা বলতে চায়, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য কথা বলার আগে সাদকা দেয়া বাধ্যতামূলক করে দিলেন। লোকজনকে তাদের এ বদ অভ্যাস সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। যাতে তারা এ বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করে।
সুতরাং এ বাধ্যবাধকতা মাত্র অল্প দিন কার্যকর রাখা হয়েছিল। মানুষ তাদের কার্যধারা ও অভ্যাস সংশোধন করে নিলে এ নির্দেশ বাতিল করে দেয়া হলো।
মুসলিম সমাজের মানুষের মধ্যে নিস্বার্থ ঈমানদার, মুনাফিক এবং দোদুল্যমান তথা সিদ্ধান্তহীনতার রোগে আক্রান্ত মানুষ সবাই মিলে মিশে একাকার হয়েছিল। তাই কারো সত্যিকার ও নিস্বার্থ ঈমানদার হওয়ার মানদণ্ড কি তা ১৪ আয়াত থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত তা স্পষ্টভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। এক শ্রেণীর মুসলমান ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, সে যে দ্বীনের ওপর ঈমান আনার দাবি করে নিজের স্বার্থের খাতিরে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নানারকম সন্দেহ-সংশয় এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে আল্লাহর পথে আসতে বাঁধা দেয়। তবে যেহেতু তারা মুসলমানদের দলে অন্তর্ভুক্ত তাই ঈমান গ্রহণের মিথ্যা স্বীকৃতি তাদের জন্য ঢালের কাজ করে। আরেক শ্রেণীর মুসলমান তাদের দ্বীনের ব্যাপারে অন্য কারো পরোয়া করা তো দূরের কথা নিজের বাপ, ভাই, সন্তান-সন্তুতি এবং গোষ্ঠীকে পর্যন্ত পরোয়া করে না। তাদের অবস্থা হলো, যে আল্লাহ, রসূল এবং তাঁর দ্বীনের শত্রু তার জন্য তার মনে কোন ভালবাসা নেই। এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন প্রথম শ্রেণীর এই মুসলমানরা যতই শপথ করে তাদের মুসলমান হওয়ার নিশ্চয়তা দিক না কেন প্রকৃতপক্ষে তারা শয়তানের দলের লোক। সুতরাং শুধু দ্বিতীয় প্রকার মুসলমানগণই আল্লাহর দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে। তারাই খাঁটি মুসলমান। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই লাভ করবে সফলতা।