২১ ) (তাদের মুখে) আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি এবং ভাল ভাল কথা। কিন্তু যখন অলংঘনীয় নির্দেশ দেয়া হলো তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে কৃত নিজেদের অঙ্গীকারের ব্যাপারে সত্যবাদী প্রমাণিত হতো তাহলে তা তাদের জন্যই কল্যাণকর হতো।
طَاعَةٌۭ وَقَوْلٌۭ مَّعْرُوفٌۭ ۚ فَإِذَا عَزَمَ ٱلْأَمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا۟ ٱللَّهَ لَكَانَ خَيْرًۭا لَّهُمْ ٢١
২২ ) এখন তোমাদের থেকে এছাড়া অন্য কিছুর কি আশা করা যায় যে, তোমরা যদি ইসলাম থেকে ফিরে যাও ৩৩ তাহলে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং একে অপরের গলা কাটবে? ৩৪
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوٓا۟ أَرْحَامَكُمْ ٢٢
২৩ ) আল্লাহ তা’আলা এসব লোকের ওপর লা’নত করেছেন এবং তাদেরকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দিয়েছেন।
أُو۟لَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَىٰٓ أَبْصَـٰرَهُمْ ٢٣
২৪ ) তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি, নাকি তাদের মনের ওপর তালা লাগানো আছে? ৩৫
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلْقُرْءَانَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَآ ٢٤
২৫ ) প্রকৃত ব্যাপার হলো, হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পরও যারা তা থেকে ফিরে গেল শয়তান তাদের জন্য এরূপ আচরণ সহজ বানিয়ে দিয়েছে এবং মিথ্যা আশাবাদকে দীর্ঘায়িত করে রেখেছেন।
إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱرْتَدُّوا۟ عَلَىٰٓ أَدْبَـٰرِهِم مِّنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلْهُدَى ۙ ٱلشَّيْطَـٰنُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ ٢٥
২৬ ) এ কারণেই তারা আল্লাহর নাযিলকৃত দ্বীনকে যারা পছন্দ করে না তাদের বলেছে, কিছু ব্যাপারে আমরা তোমাদের অনুসরণ করবো। ৩৬ আল্লাহ তাদের এ সলা-পরামর্শ ভাল করেই জানেন।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا۟ لِلَّذِينَ كَرِهُوا۟ مَا نَزَّلَ ٱللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِى بَعْضِ ٱلْأَمْرِ ۖ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ ٢٦
২৭ ) সে সময় কী অবস্থা হবে যখন ফেরেশতারা তাদের রূহ কবজ করবে এবং তাদের মুখ ও ফিটের ওপর আঘাত করতে করতে নিয়ে যাবে। ৩৭ এসব হওয়ার কারণ হচ্ছে,
فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَـٰرَهُمْ ٢٧
২৮ ) তারা এমন পন্থার অনুসরণ করেছে যা আল্লাহর অসন্তুষ্টি উৎপাদন করে এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা পছন্দ করেনি। এ কারণে তিনি তাদের সব কাজ-কর্ম নষ্ট করে দিয়েছেন। ৩৮
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱتَّبَعُوا۟ مَآ أَسْخَطَ ٱللَّهَ وَكَرِهُوا۟ رِضْوَٰنَهُۥ فَأَحْبَطَ أَعْمَـٰلَهُمْ ٢٨
২৯ ) যেসব লোকের মনে রোগ আছে তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, আল্লাহ তাদের মনের ঈর্ষা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করবেন না?
أَمْ حَسِبَ ٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌ أَن لَّن يُخْرِجَ ٱللَّهُ أَضْغَـٰنَهُمْ ٢٩
৩০ ) আমি চাইলে তাদেরকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দিতাম আর তুমি তাদের চেহারা দেখেই চিনতে পারতে। তবে তাদের বাচনভঙ্গি থেকে তুমি তাদেরকে অবশ্যই চিনে ফেলবে। আল্লাহ তোমাদের সব আমল ভাল করেই জানেন।
وَلَوْ نَشَآءُ لَأَرَيْنَـٰكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُم بِسِيمَـٰهُمْ ۚ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِى لَحْنِ ٱلْقَوْلِ ۚ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَـٰلَكُمْ ٣٠
৩৩.
মূল কথাটি হলো إِنْ تَوَلَّيْتُمْ । এ বাক্যাংশের একটি অনুবাদ আমরা ওপরে করেছি। এর দ্বিতীয় অনুবাদ হচ্ছে, “যদি তোমরা মানুষের শাসক হয়ে যাও।”
৩৪.
এ কথাটির একটি অর্থ হলো মুহাম্মাদ ﷺ এবং ঈমানদারগণ যে মহান সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য চেষ্টা-সাধনা করেছেন এ সময় তোমরা যদি ইসলামের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে টালবাহানা করো এবং সে মহান সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য প্রাণ ও সম্পদের বাজি ধরা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে শেষ পর্যন্ত তার পরিণাম এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তোমরা আবার সেই জাহেলী জীবন ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাবে যার ব্যবস্থাধীনে তোমরা শত শত বছর ধরে একে অপরের গলা কেটেছো, নিজেদের সন্তানদের পর্যন্ত জীবন্ত দাফন করেছো এবং আল্লাহর দুনিয়াকে জুলুম ও ফাসাদে ভরে তুলেছো। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমাদের জীবনাচার ও কর্মকাণ্ডের অবস্থা যখন এই যে, যে দ্বীনের প্রতি ঈমান পোষণের কথা তোমরা স্বীকার করেছিলে তার জন্য তোমাদের মধ্য কোন আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা নেই এবং তার জন্য কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতেও তোমরা প্রস্তুত নও। তাহলে এ নৈতিক অবস্থার মধ্যে আল্লাহ তা’আলা যদি তোমাদেরকে ক্ষমতা দান করেন এবং পার্থিব সব কাজ-কর্মের দায়-দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পিত হয় তাহলে জুলুম-ফাসাদ এবং ভ্রাতৃঘাতি কাজ ছাড়া তোমাদের থেকে আর কী আশা করা যেতে পারে?
এ আয়াতটি এ কথাও স্পষ্ট করে দেয় যে, আয়াত ইসলামে ‘আত্মীয়তার বন্ধন’ ছিন্ন করা হারাম। অপরদিকে ইতিবাচক পন্থায় কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহারের বড় নেকীর কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আল বাকারা, ৮৩; ১৭৭; আন নিসা, ৮-৩৬; আন নাহল, ৯০; বনী ইসরাঈল, ২৬ এবং আন নূর, ২২ আয়াত। رحم শব্দটি আরবী ভাষায় রূপক অর্থে নৈকট্য ও আত্মীয়তা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কোন ব্যক্তির দূর ও নিকট সম্পর্কীয় সব আত্মীয়ই তার
نوى الارحام তাদের যার সাথে যত নিকট আত্মীয়তার সম্পর্ক তার অধিকার তত বেশী এবং তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা তত বড় গোনাহ। অত্মীয়তা রক্ষা করার অর্থ হলো, আত্মীয়ের উপকার করার যতটুকু সামর্থ্য ব্যক্তির আছে, তা করতে দ্বিধা না করা। আর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তির তার সাথে খারাপ ব্যবহার বা আচরণ করা, অথবা যে উপকার করা তার পক্ষে সম্ভব তা না করে পাশ কাটিয়ে চলা। হযরত উমর (রা.) এ আয়াত থেকে প্রমাণ প্রশ করে “উম্মে ওয়ালাদ” বা সন্তানদের মা ক্রীতদাসকে বিক্রি করা হারাম ঘোষণা করেছিলেন এবং সাহাবা কিরামের সবাই এতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছিলেন। হাকেম মুসতাদরিক গ্রন্থে হযরত বুরাইদা থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, একদিন তিনি হযরত উমরের (রা.) মজলিসে বসেছিলেন। হঠাৎ মহল্লার মধ্যে চেঁচামেচি শুরু হলো। জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে, এক ক্রীতদাসীকে বিক্রি করা হচ্ছে তাই তাঁর মেয়ে কাঁদছে। হযরত উমর (রা.) সে মুহূর্তেই আনসার ও মুহাজিরদের একত্র করে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ যে জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন তার মধ্যে আত্মীয়তা বা রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন বৈধতা কি আপনারা পেয়েছেন? সবাই জবাব দিলেন, ‘না’। হযরত উমর (রা.) বললেনঃ তাহলে এটা কেমন কথা যে, আপনাদের এ সমাজেই মাকে তার মেয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে? এর চেয়ে বড় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নের কাজ আর কী হতে পারে? তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। সবাই বললো ত্রুটি রোধ করার জন্য আপনার মতে যে ব্যবস্থা উপযুক্ত মনে করেন তাই গ্রহণ করুন। সুতরাং হযরত উমর (রা.) গোটা ইসলামী অঞ্চলে এই সাধারণ নির্দেশ জারী করে দিলেন যে, যে দাসীর গর্ভে তার মালিকের ঔরসজাত সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে তাকে বিক্রি করা যাবে না। কারণ, এটা আত্মীয়তা বা রক্তের বন্ধন ছিন্ন করা। সুতরাং এ কাজ হালাল নয়।
৩৫.
অর্থাৎ হয় এসব লোক কুরআন মজীদ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করে না। কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার চেষ্টা করে কিন্তু তার শিক্ষা এবং অর্থ ও তাৎপর্য তাদের মনের গভীরে প্রবেশ করে না। কেননা, তাদের হৃদয়-মনে তালা লাগানো আছে। বলা হয়েছে, “মনের ওপরে তাদের তালা লাগানো আছে” একথাটির অর্থ হচ্ছে, তাদের মনে এমন তালা লাগানো আছে যা ন্যায় ও সত্যকে চিনে না এমন লোকেদের জন্যই নির্দিষ্ট।
৩৬.
অর্থাৎ ঈমান গ্রহণ করে মুসলমানদের দলে শামিল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভিতরে ভিতরে তারা ইসলামের শত্রুদের সাথে ষড়যন্ত্র করে এসেছে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে যে, কিছু কিছু ব্যাপারে আমরা তোমাদের সাহায্য সহযোগিতা করবো।
৩৭.
অর্থাৎ পৃথিবীতে তারা এ কর্মপন্থা অবলম্বন করেছে এজন্য যাতে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে এবং কুফর ও ইসলামের যুদ্ধের বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর পরে আল্লাহর পাকড়াও থেকে কোথায় গিয়ে রক্ষা পাবে? সে সময় তাদের কোন কৌশলই তাদেরকে ফেরেশতাদের মারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
যেসব আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে ‘বরযখ’ অর্থাৎ কবরের আযাব প্রমাণিত হয় এটি তার একটি। এ আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মৃত্যুর সময় থেকেই কাফের ও মুনাফিকদের আযাব শুরু হয়ে যায়। কিয়ামতে তাদের মোকাদ্দমার ফয়সালা হওয়ার পর যে শাস্তি দেয়া হবে এ আযাব তা থেকে ভিন্ন জিনিস। আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আন নিসা, ৯৭ আয়াত; আল আনআম, ৯৩-৯৪; আল আনফাল, ৫০; আন নাহল, ২৮-৩২; আল মু’মিনূন। ৯৯-১০০; ইয়াসীন, ২৬-২৭ এবং টীকা ২২-২৩ এবং আল মু’মিন, ৪৬, টীকা ৬২ সহ।
৩৮.
কাজ-কর্ম সেসব কাজ যা তারা মুসলমান সেজে করেছে। তাদের নামায, রোযা, যাকাত, মোটকথা সেসব ইবাদাত-বন্দেগী ও নেকীর কাজসমূহ যা বাহ্যিকভাবে নেকীর কাজ বলে গণ্য হতো। এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে তারা মুসলমান হয়েও আল্লাহ, তার দ্বীন এবং ইসলামী মিল্লাতের সাথে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার আচরণ করেনি বরং শুধু নিজের পার্থিব স্বার্থের জন্য দ্বীনের দুশমনদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদের সুযোগ আসা মাত্রই নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কুফর ও ইসলামের যুদ্ধে যে ব্যক্তির সমবেদনা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে নয়। কিংবা কুফরী ব্যবস্থা ও কাফেরদের পক্ষে আল্লাহর কাছে তার কোন আমল গ্রহণযোগ্য হওয়া তো দূরের কথা তার ঈমানই আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।