আয়াত
১০১ ) (এ দোয়ার জবাবে) আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। ৫৭
فَبَشَّرْنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٍ ١٠١ ▶ ⏸︎
১০২ ) সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাঁকে বললো, “হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যাবেহ করছি, ৫৮ এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো?” ৫৯ সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে ৬০ তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।”
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعْىَ قَالَ يَٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرَىٰ فِى ٱلْمَنَامِ أَنِّىٓ أَذْبَحُكَ فَٱنظُرْ مَاذَا تَرَىٰ قَالَ يَٰٓأَبَتِ ٱفْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٠٢ ▶ ⏸︎
১০৩ ) শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। ৬১
فَلَمَّآ أَسْلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلْجَبِينِ ١٠٣ ▶ ⏸︎
১০৪ ) এবং আমি আওয়াজ দিলাম, ৬২ “হে ইবরাহীম!
وَنَٰدَيْنَٰهُ أَن يَٰٓإِبْرَٰهِيمُ ١٠٤ ▶ ⏸︎
১০৫ ) তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। ৬৩ আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। ৬৪
قَدْ صَدَّقْتَ ٱلرُّءْيَآ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُحْسِنِينَ ١٠٥ ▶ ⏸︎
১০৬ ) নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা।” ৬৫
إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلْبَلَٰٓؤُا۟ ٱلْمُبِينُ ١٠٦ ▶ ⏸︎
১০৭ ) একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম ৬৬
وَفَدَيْنَٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ ١٠٧ ▶ ⏸︎
১০৮ ) এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى ٱلْءَاخِرِينَ ١٠٨ ▶ ⏸︎
১০৯ ) শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীমের প্রতি।
سَلَٰمٌ عَلَىٰٓ إِبْرَٰهِيمَ ١٠٩ ▶ ⏸︎
১১০ ) আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।
كَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُحْسِنِينَ ١١٠ ▶ ⏸︎
৫৭.
দোয়া করতে করতেই সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, এ থেকে একথা মনে করার কোন কারণ নেই। কুরআন মজীদেরই অন্যস্থানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ
“আল্লাহর শোকর, তিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাইল ও ইসহাক দান করেছেন। (ইবরাহীম, ৩৯)
এ থেকে প্রমাণ হয়, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দেয়া এবং এ সুসংবাদের মধ্যে বহু বছরের ব্যবধান ছিল। বাইবেল বর্ণনা করছে, হযরত ইসমাঈলের (আ) জন্মের সময় হযরত ইবরাহীমের (আ) বয়স ছিল ৮৬ বছর। (আদি পুস্তক ১৬: ১৬) অন্যদিকে হযরত ইসহাকের জন্মের সময় তাঁর বয়স ছিল একশত বছর (৫: ২১)
৫৮.
একথা মনে রাখতে হবে, হযরত ইবরাহীম (আ) স্বপ্ন দেখেননি যে, তিনি পুত্রকে যবেহ করে ফেলেছেন। বরং তিনি দেখেছিলেন, তিনি তাকে যবেহ করছেন। যদিও তিনি তখন স্বপ্নের এ অর্থই নিয়েছিলেন যে, তিনি পুত্রকে যবেহ করবেন। এ কারণে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় পুত্রকে কুরবানী করে দেবার জন্য একেবারেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখাবার মধ্যে মহান আল্লাহ যে সূক্ষ্ম বিষয় সামনে রেখেছিলেন তা সামনের ১০৫ আয়াতে তিনি নিজেই সুস্পষ্ট করে দিয়েছিল।
৫৯.
পুত্রকে একথা জিজ্ঞেস করার এ অর্থ ছিল না যে, তুমি রাজি হয়ে গেলে আল্লাহর হুকুম তামিল করবো অন্যথায় করবো না। বরং হযরত ইবরাহীম আসলে দেখতে চাচ্ছিলেন, তিনি যে সৎ সন্তানের জন্য দোয়া করেছিলেন সে যথার্থই কতটুকু সৎ। যদি সে নিজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে এর অর্থ হয় দোয়া পুরোপুরি কবুল হয়েছে এবং পুত্র নিছক শারীরিক দিক দিয়েই তাঁর সন্তান নয় বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও তাঁর সুসন্তান।
৬০.
এ শব্দগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, নবী-পিতার স্বপ্নকে পুত্র নিছক স্বপ্ন নয় বরং আল্লাহর হুকুম মনে করেছিলেন। এখন যদি যথার্থই এটি আল্লাহর হুকুম না হতো তাহলে অবশ্যই আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলে দিতেন যে, ইবরাহীম পুত্র ভুলে একে হুকুম মনে করে নিয়েছে। কিন্তু পূর্বাপর আলোচনায় এর কোন ইঙ্গিত নেই। এ কারণে নবীদের স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন নয় বরং তাও হয় এক ধরনের অহী, মুসলমানরা এ বিশ্বাস পোষণ করে। একথা সুস্পষ্ট, যে কথার মাধ্যমে এতবড় একটি নিয়ম আল্লাহর শরীয়াতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তা যদি সত্য ভিত্তিক না হতো বরং নিছক একটি বিভ্রান্তি হতো তাহলে আল্লাহ তার প্রতিবাদ করতেন না, এটা হতো একটি অসম্ভব ব্যাপার। কুরআনকে যারা আল্লাহর কালাম বলে মানে তাদের পক্ষে আল্লাহর এ ধরনের ভুল হয়ে যেতে পারে একথা মেনে নেয়া একেবারেই অসম্ভব।
৬১.
অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আ) যবেহ করার জন্য পুত্রকে চিৎ করে শোয়াননি বরং উপুড় করে শুইয়ে দিয়েছেন, যাতে যবেহ করার সময় পুত্রের মুখ দেখে কোন প্রকার স্নেহ-মমতার বসে তাঁর হাত কেঁপে না যায়। তাই তিনি নিচের দিক থেকে হাত রেখে ছুরি চালাতে চাচ্ছিলেন।
৬২.
ব্যাকরণবিদদের একটি দল বলেন, এখানে “এবং” শব্দটি “তখন” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ বাক্যটি হবে---“যখন এরা দু’জনে আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল তখন আমি আওয়াজ দিলাম।” কিন্তু অন্য একটি দল বলেন, এখানে “যখন” শব্দটির জওয়াব উহ্য রয়ে গেছে এবং তাকে শ্রোতার মনের কল্পনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ কথা এত বড় ছিল যে, তাকে শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করার পরিবর্তে কল্পনারই জন্য ছেড়ে দেয়া বেশী সঙ্গত ছিল। আল্লাহ যখন দেখে থাকবেন বুড়ো বাপ তার বুড়ো বয়সের আকাংখায় চেয়ে পাওয়া পুত্রকে নিছক তাঁর সন্তুষ্টিলাভের জন্য কুরবানী করে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেছেন এবং পুত্রও নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে, তখন এ দৃশ্য দেখে রহমতের দরিয়া কেমন নাজানি উথলে উঠে থাকবে এবং দুই পিতা-পুত্রের প্রতি মালিকের প্রেম কেমন নাজানি বাঁধনহারা হয়ে গিয়ে থাকবে, তা কেবল কল্পনাই করা যেতে পারে। কথায় তার অবস্থা যতই বর্ণনা করা হোক না কেন তা ব্যক্ত করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। বরং বর্ণনায় তার আসল দৃশ্যের অতি অল্পই ফুটে উঠবে।
৬৩.
অর্থাৎ তুমি পুত্রকে যবেহ করে দিয়েছো এবং তার প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে, এটা তো আমি তোমাকে দেখাইনি। বরং আমি দেখিয়েছিলাম, তুমি যবেহ করছো। তুমি সে স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিলে। কাজেই এখন তোমার সন্তানের প্রাণবায়ু বের করে নেয়া আমার লক্ষ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য যা কিছু তা তোমার সংকল্প, উদ্যোগ ও প্রস্তুতিতেই সফল হয়ে গেছে।
৬৪.
অর্থাৎ যারা সংকর্মের পথ অবলম্বন করে তাদেরকে আমি খামখা কষ্টের মধ্যে ফেলে দেবার এবং দুঃখ ও ক্লেশের মুখোমুখি করার জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন করি না। বরং তাদের উন্নত গুণাবলী বিকশিত করার এবং তাদেরক উচ্চ মর্যাদা দান করার জন্যই তাদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করি। তারপর পরীক্ষার খাতিরে তাদেরকে যে সংকট সাগরে নিক্ষেপ করি তা থেকে নিরাপদে উদ্ধারও করি। তাই দেখো, পুত্রের কুরবানীর জন্য তোমার উদ্যোগ প্রবণতা ও প্রস্তুতিই এমন মর্যাদা দানের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে, যা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্য যথার্থই পুত্র উৎসর্গকারী লাভ করতে পারতো। এভাবে আমি তোমার পুত্রের প্রাণও রক্ষা করলাম এবং তোমাকের এ উচ্চ মর্যাদাও দান করলাম।
৬৫.
অর্থাৎ তোমার হাতে তোমার পুত্রকে যবেহ করা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং দুনিয়ার কোন জিনিসকে তুমি আমার মোকাবিলায় বেশী প্রিয় মনে করো কিনা, সে পরীক্ষা নেয়াই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
৬৬.
“বড় কুরবানী” বলতে বাইবেল ও ইসলামী বর্ণনা অনুসারে একটি ভেড়া। সে সময় আল্লাহর ফেরেশতা হযরত ইবরাহীমের সামনে এটি পেশ করেন পুত্রের পরিবর্তে একে যবেহ করার জন্য। একে “বড় কুরবানী” বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এটি ইবরাহীমের ন্যায় আল্লাহর বিশ্বস্ত বান্দার জন্য ইবরাহীম পুত্রের ন্যায় ধৈর্যশীল ও প্রাণ উৎসর্গকারী পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে ছিল এবং আল্লাহ একে একটি নজীর বিহীন কুরবানীর নিয়ত পুরা করার অসিলায় পরিণত করেছিলেন। এছাড়াও একে “বড় কুরবানী” গণ্য করার আর একটি বড় কারণ দিয়েছেন যে, এ তারিখে সারা দুনিয়ায় সমস্ত মু’মিন পশু কুরবানী করবে এবং বিশ্বস্ততা ও প্রাণ উসৎর্গকারী এ মহান ঘটনার স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে থাকবে।