একঃ পৃথিবী ও তার পরিবেশের অসংখ্য জিনিস তার বশীভূত করে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার করার ব্যাপক ক্ষমতা তাকে দান করা হয়েছে।
দুইঃ নিজের জীবনের পথ বেছে নেবার জন্য তাকে স্বাধীন ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। ঈমান ও কুফরী, আনুগত্য ও বিদ্রোহ এবং সুকৃতি ও দুষ্কৃতির পথের মধ্য থেকে যে কোনো পথেই নিজের ইচ্ছামত সে চলতে পারে। সত্য ও মিথ্যা এবং সঠিক ও বেঠিক যে কোন পথই সে অবলম্বন করতে পারে। প্রত্যেকটি পথে চলার সুযোগ তাকে দেয়া হয়েছে এবং এ চলার জন্য সে আল্লাহর সরবরাহকৃত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে পারে তা আল্লাহর আনুগত্যের বা তাঁর নাফরমানির যে কোন পথই হোক না কেন।
তিনঃ তার মধ্যে জন্মগতভাবে নৈতিকতার অনুভূতি রেখে দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে সে ইচ্ছাকৃত কাজ ও অনিচ্ছাকৃত কাজের মধ্যে ফারাক করে, ইচ্ছাকৃত কাজকে সৎকাজ ও অসৎকাজ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে এই মত অবলম্বন করে যে, সৎকাজ পুরস্কার লাভের এবং অসৎকাজ শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া উচিত।
মানুষের নিজের সত্তার মধ্যে এই যে তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় এগুলো একথাই প্রমাণ করে যে, এমন কোন সময় আসা উচিত যখন মানুষের সমস্ত কাজের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তাকে দুনিয়ায় যা কিছু দেয়া হয়েছিল তা ব্যবহার করার ক্ষমতাকে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে? যখন দেখা যাবে, নিজের নির্বাচনের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে সে সঠিক পথ অবলম্বন করেছে, না ভুল পথ? যখন তাঁর ঐচ্ছিক কার্যাবলী যাচাই করা হবে এবং সৎকাজে পুরস্কার ও অসৎকাজে শাস্তি দেয়া হবে। একথা সুনিশ্চিত যে, মানুষের জীবনের কার্যাবলী শেষ হবার এবং তার কর্মদপ্তর বন্ধ হয়ে যাবার পরই এ সময়টি আসতে পারে, তার আগে আসতে পারে না। আর এ সময়টি অবশ্যই এমন সময় আসা উচিত যখন এক ব্যক্তি বা একটি বা জাতির নিজের কার্যাবলীর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে যেসব প্রভাব বিস্তার করে যায় উক্ত ব্যক্তি বা জাতির মৃত্যুতে তার ধারাবাহিকতা খতম হয়ে যায় না। তার রেখে যাওয়া ভালো বা মন্দ প্রভাবও তো তার আমলনামায় লিখিত হওয়া উচিত। এ প্রভাবগুলো যে পর্যন্ত না পুরোপুরি প্রকাশ হয়ে যায় সে পর্যন্ত ইনসাফ অনুযায়ী পুরোপুরি হিসেব-নিকেশ করা এবং পুরোপুরি পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া কেমন করে সম্ভব? এভাবে মানুষের নিজের অস্তিত্ব একথার সাক্ষ্য পেশ করে এবং পৃথিবীতে মানুষকে যে মর্যাদা দান করা হয়েছে তা স্বতঃস্ফুর্তভাবেএ দাবী করে যে, দুনিয়ার বর্তমান জীবনের পরে আর একটি জীবন এমন হতে হবে যেখানে আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনসাফ সহকারে মানুষের জীবনের সমস্ত কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ করা হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কৃতকর্ম অনুসারে প্রতিদান দেয়া হবে।
একঃ এ বিশ্ব-জাহানকে যথার্থ সত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা কোন শিশুর খেলা নয়। নিছক মন ভুলাবার জন্য নিজের খেয়ালখুশি মতো সে উল্টা পাল্টা ধরনের যে কোন রকমের একটা ঘর তৈরি করেনি যা তৈরি করা ও ভেঙ্গে ফেলা দুটোই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং এটি একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা। এর প্রতিটি অণু ও পরমাণু এ কথারই সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, একে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে তৈরি করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে একটি আইন সক্রিয় রয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসই উদ্দেশ্যমুখি। মানুষের সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থ ব্যবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান একথারই সাক্ষ্যবহ। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের পেছনে সক্রিয় নিয়ম-নীতি উদ্ভাবন করে এবং প্রত্যেকটি বস্তু যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তা অনুসন্ধান করেই মানুষ এখানে এ সবকিছু তৈরি করতে পেরেছে। অন্যথায় যদি একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যহীন খেলনার মধ্যে একটি পুতুলের মতো তাকে রেখে দেয়া হতো, তাহলে কোনো প্রকার বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা কল্পনাই করা যেতে না। এখন যে জ্ঞানবান সত্ত্বা এহেন প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্যমুখিতা সহকারে এ দুনিয়া তৈরি করেছেন এবং এর মধ্যে মানুষের মতো একটি সৃষ্টিকে সর্ব পর্যায়ের বৃদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক শক্তি, ক্ষমতা ও ইখতিয়ার, স্বাধীন নির্বাচনক্ষমতা ও নৈতিক অনুভূতি দিয়ে নিজের দুনিয়ার অসংখ্য সাজ-সরঞ্জাম তার হাতে সঁপে দিয়েছেন, তিনি মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি করেছেন একথা কেমন করে তোমাদের বোধগম্য হলোঃ তোমরা কি দুনিয়ার ভাঙ্গা ও গড়া, সুকৃতি ও দুষ্কৃতি, জুলুম ও ইনসাফ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের যাবতীয় কাজ কারবার করার পর এমনিই মরে মাটিতে মিশে যাবে এবং তোমাদের কোন ভালো বা মন্দ কাজের কোন ফলাফল দেখা যাবে না? তোমরা কি নিজেদের এক একটি কাজের মাধ্যমে তোমাদের ও তোমাদের মতো হাজার হাজার মানুষের জীবনের ওপর এবং দুনিয়ার অসংখ্য জিনিসের ওপর বহুতর শুভ ও অশুভ প্রভাব বিস্তার করে চলে যাবে এবং তোমাদের মৃত্যুর পর পরই এই সমগ্র কর্মদপ্তরকে এমনি গুটিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করে দেয়া হবে?
এ বিশ্ব ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণ করার পর দ্বিতীয় সত্যটি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে সেটি হচ্ছে, এখানে কোন জিনিসই চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের একটি নির্ধারিত জীবনকাল রয়েছে। সেখানে পৌঁছে যাবার পর তা শেষ হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যাপারেও একথাই সত্য। এখানে যতগুলো শক্তিই কাজ করছে তারা সবই সীমাবদ্ধ। একটি সময় পর্যন্ত তারা কাজ করছে। কোনো এক সময় তারা অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং এ ব্যবস্থাটি খতম হয়ে যাবে। প্রাচীনকালে যেসব দার্শনিক ও বিজ্ঞানী দুনিয়াকে আদি ও চিরন্তন বলে প্রচার করতো তাদের বক্তব্যও তবুও তো সর্বব্যাপী অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করতো কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যাপী নাস্তিক্যবাদী ও আল্লাহ বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্ব-জগতের নশ্বরতা ও অবিনশ্বরতা নিয়ে যে বিতর্ক চলে আসছিল, আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় চূড়ান্তভাবেই সে ক্ষেত্রে নিজের ভোটটি আল্লাহ বিশ্বাসীদের পক্ষে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই বর্তমানে নাস্তিক্যবাদীদের পক্ষে বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নাম নিয়ে এ দাবী উত্থাপন করার কোনো অবকাশই নেই যে, এ দুনিয়া চিরকাল আছে, চিরকাল থাকবে এবং কিয়ামত কোনো দিন আসবে না। পুরাতন বস্তুবাদীতার যাবতীয় ভিত্তি এ চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, বস্তুর বিনাশ নেই, কেবলমাত্র রূপান্তর ঘটতে পারে। তখনকার চিন্তা ছিল, প্রত্যেক পরিবর্তনের পর বস্তু বস্তুই থেকে যায় এবং তার পরিমাণ কোনো কম বেশি হয় না। এরই ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত শোনানো হতো যে, এ বস্তুজগতের কোন আদি অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে আণবিক শক্তি (Atomic Energy) আবিষ্কারের ফলে এ সমগ্র চিন্তার ধারাই উলটে গেছে। এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শক্তি বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে এবং বস্তু আবার শক্তিরূপে আত্নপ্রকাশ করে, এমন কি শেষ পর্যন্ত তার আকৃতিও থাকে না। ভৌতিক অবস্থানও থাকে না। এখন তাপের গতির দ্বিতীয় আইন (second law of thermo-Dynamics) একথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ বস্তুজগত না অনাদি হতে পারে, না অনন্ত। অবশ্যই এক সময় এর শুরু এবং এক সময় শেষ হতে হবে। তাই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বর্তমানে কিয়ামত অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর একথা সুস্পষ্ট যে, বিজ্ঞান যদি আত্মসমর্পণ করে তবে দর্শন কিসের ভিত্তিতে কিয়ামত অস্বীকার করবে?