رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي
“হে আমার রব! আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমাকে মাফ করে দাও।”
আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মাফ করে দিয়েছিলেনঃ فغفرله আল্লাহ তাঁকে মাফ করে দিলেন। (আল কাসাস, ১৬) এখানে সেই ক্ষমার সুসংবাদ তাঁকে দেয়া হয়। অর্থাৎ এ ভাষণের মর্ম যেন এই দাঁড়ালোঃ হে মূসা! আমার সামনে তোমার ভয় পাওয়ার একটি কারণ তো অবশ্যই ছিল। কারণ তুমি একটি ভুল করেছিলে। কিন্তু তুমি যখন সেই দুষ্কৃতিকে সুকৃতিতে পরিবর্তিত করেছো তখন আমার কাছে তোমার জন্য মাগফিরাত ও রহমত ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন আমি তোমাকে কোন শাস্তি দেবার জন্য ডেকে পাঠাইনি বরং বড় বড় মু’জিযা সহকারে তোমাকে এখন আমি একটি মহান দায়িত্ব সম্পাদনে পাঠাবো।
لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنْزَلَ هَؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, এ নিদর্শনগুলো পৃথিবী ও আকাশের মালিক ছাড়া আর কেউ নাযিল করেনি।” (বনী ইসরাঈল, ১০২)
কিন্তু যে কারণে ফেরাউন ও তার জাতির সরদাররা জেনে বুঝে সেগুলো অস্বীকার করে তা এই ছিলঃ
أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ -
“আমরা কি আমাদের মতই দু’জন লোকের কথা মেনে নেবো, অথচ তাদের জাতি আমাদের গোলাম?” (আল মু’মিনূন, ৪৭)
إِنَّ النَّبِىَّ لاَ يُورَثُ وَإِنَّمَا مِيرَاثُهُ فِى فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِينَ وَالْمَسَاكِينِ
“নবীর কোন উত্তরাধিকারী হয় না। যা কিছু তিনি ত্যাগ করে যান তা মুসলমানদের গরীব ও মিসকীনদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।” (মুসনাদে আহমাদ, আবু বকর সিদ্দিক বর্ণিত ৬০ ও ৭৮ নং হাদীস)।
হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম ছিলেন হযরত দাউদের (আ) সবচেয়ে ছোট ছেলে। তাঁর আসল ইবরানী নাম ছিল সোলোমোন। এটি ছিল “সলীম” শব্দের সমার্থক। খৃস্টপূর্ব ৯৬৫ অব্দে তিনি হযরদ দাউদের স্থলাভিষিক্ত হন এবং খৃঃ পূর্ব ৯২৬ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। (তাঁর বিস্তারিত জীবন বৃত্তান্ত জানার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআন আল হিজর, ৭ টীকা, আল আম্বিয়া ৭৪-৭৫ টীকা।) তাঁর রাজ্যসীমা সম্পর্কে আমাদের মুফাসসিরগণ অতি বর্ণনের আশ্রয় নিয়েছেন অনেক বেশী। তারা তাঁকে দুনিয়ার অনেক বিরাট অংশের শাসক হিসাবে দেখিয়েছেন। অথচ তাঁর রাজ্য কেবলমাত্র বর্তমান ফিলিস্তিন ও জর্দান রাষ্ট্র সমন্বিত ছিল এবং সিরিয়ার একটি অংশ এর অর্ন্তভুক্ত ছিল। (দেখুন বাদশাহ সুলাইমানের রাজ্যের মানচিত্র, তাফহীমুল কুরআন সূরা বনী ইসরাঈল)।
বর্তমান যুগের কোন কোন ব্যক্তি একথা প্রমাণ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন যে, জিন ও পাখি বলে আসলে জিন ও পাখির কথা বুঝানো হয়নি বরং মানুষের কথা বুঝানো হয়েছে। মানুষরাই হযরত সুলাইমানের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিল। তারা বলেন, জিন মানে পার্বত্য উপজাতি। এদের উপর হযরত সুলাইমান বিজয় লাভ করেছিলেন। তাঁর অধীনে তারা বিস্ময়কর শক্তি প্রয়োগের ও মেহনতের কাজ করতো। আর পাখি মানে অশ্বারোহী সেনাবাহিনী। তারা পদাতিক বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী দ্রুততা সম্পন্ন ছিল। কিন্তু এটি কুরআন মজীদের শব্দের অযথা বিকৃত অর্থ করার নিকৃষ্টতম প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআন এখানে জিন, মানুষ ও পাখি তিনটি আলাদা আলাদা প্রজাতির সেনাদলের কথা বর্ণনা করছে এবং তিনের ওপর ال (আলিফ লাম) বসানো হয়েছে তাদের পৃথক পৃথক প্রজাতিকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। তাই আল জিন (জিন জাতি) ও আত্ তাইর (পাখি জাত) কোনক্রমেই আল ইনস (মানুষ জাতি)-এর অর্ন্তভূক্ত হতে পারে না। বরং তারা তার থেকে আলাদা দু’টি প্রজাতিই হতে পারে। তাছাড়া যে ব্যক্তি সামান্য আরবী জানে সে-ও কখনো এ কথা কল্পনা করতে পারে না যে, এ ভাষায় নিছক জিন শব্দ বলে তার মাধ্যমে মানুষদের কোন দল বা নিছক পাখি (তাইর) শব্দ বলে তার মাধ্যমে অশ্বারোহী বাহিনী অর্থ করা যেতে পারে এবং কোন আরব এ শব্দগুলো শুনে তার এ অর্থ বুঝতে পারে। নিছক প্রচলিত বাগধারা অনুযায়ী কোন মানুষকে তার অস্বাভাবিক কাজের কারণে জিন অথবা কোন মেয়েকে তার সৌন্দর্যের কারণে পরী কিংবা কোন দ্রুতগতি সম্পন্ন পুরুষকে পাখি বলা হয় বলেই এর অর্থ এই হয় না যে, এখন জিন মানে শক্তিশালী লোক, পরী মানে সুন্দরী মেয়ে এবং পাখি মানে দ্রুতগতি সম্পন্ন মানুষই হবে। এ শব্দগুলোর অসেব অর্থ তো তাদের রূপক অর্থ, প্রকৃত অর্থ নয়। আর কোন ব্যক্যের মধ্যে কোন শব্দকে তার প্রকৃত অর্থ বাদ দিয়ে রূপক অর্থে তখনই ব্যবহার করা হয় বা শ্রোতা তার রূপক অর্থ তখনই গ্রহণ করে যখন আশেপাশে এমন কোন সুস্পষ্ট প্রসঙ্গ বা পূর্বাপর সামঞ্জস্য পাওয়া যায় যার ভিত্তিতে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, জিন ও পাখি শব্দ দু’টি তাদের প্রকৃত অর্থে নয় বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? বরং সামনের দিকে ঐ দু’টি দলের প্রত্যেক ব্যক্তির যে অবস্থা ও কাজ বর্ণনা করা হয়েছে তা এ পেঁচালো ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ বিরোধী অর্থ প্রকাশ করছে। কুরআনের কথায় কোন ব্যক্তির মন যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পারে, তাহলে তার পরিষ্কার বলে দেয়া উচিত এ কথা আমি মানি না। কিন্তু মানুষ কুরআনের পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন শব্দগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে নিজের মনের মতো অর্থের ছাঁচে সেগুলো ঢালাই করবে এবং এ কথা প্রকাশ করতে থাকবে যে, সে কুরআনের বর্ণনা মানে, অথচ আসলে কুরআন যা কিছু বর্ণনা করেছে সে তাকে নয় বরং নিজের জোর করে তৈরী করা অর্থই মানে--- এটি মানুষের একটি মস্তবড় চারিত্রিক কাপুরুষতা ও তাত্ত্বিক খেয়ানত ছাড়া আর কী হতে পারে?
বনী ইসরাঈলের বর্ণনাসমূহেও এ কাহিনী পাওয়া যায়। কিন্তু তার শেষাংশ কুরআনের বর্ণনার বিপরীত এবং হযরত সুলাইমানের মর্যাদার বিরোধী। সেখানে বলা হয়েছে, হযরত সুলাইমান যখন এমন একটি উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন যেখানে খুব বেশী পিঁপড়ে ছিল তখন তিনি শুনলেন একটি পিঁপড়ে চিৎকার করে অন্য পিঁপড়েদেরকে বলছে, “নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়ো, নয়তো সুলাইমানের সৈন্যরা তোমাদের পিষে ফেলবে।” একথা শুনে হযরত সুলাইমান (আ) সেই পিঁপড়ের সামনে বড়ই আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করলেন। এর জবাবে পিঁপড়েটি তাঁকে বললো, তুমি কোথাকার কে? তুমি তো নগণ্য একটি ফোঁটা থেকে তৈরী হয়েছো। একথা শুনে হযরত সুলাইমান লজ্জিত হলেন। (জুয়িশ ইনসাইকোপিডিয়া ১১ খণ্ড, ৪৪০ পৃষ্ঠা) এ থেকে অনুমান করা যায়, কুরআন কিভাবে বনী ইসরাঈলের বর্ণনাসমূহ সংশোধন করেছে এবং তারা নিজেদের নবীদের চরিত্রে যেসব কলঙ্ক লেপন করেছিল কিভাবে সেগুলো দূর করেছে। এসব বর্ণনা থেকে কুরআন সবকিছু চুরি করেছে বলে পশ্চিমী প্রাচ্যবিদরা নির্লজ্জভাবে দাবী করে।
একটি পিঁপড়ের পক্ষে নিজের সমাজের সদস্যদেরকে কোন একটি আসন্ন বিপদ থেকে সতর্ক করে দেয়া এবং এজন্য তাদের নিজেদের গর্তে ঢুকে যেতে বলা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এখন হযরত সুলাইমান একথাটি কেমন করে শুনতে পেলেন এ প্রশ্ন থেকে যায়। এর জবাবে বলা যায়, যে ব্যক্তির শ্রবণেন্দ্রিয় আল্লাহর কালামের মতো সূক্ষ্মতর জিনিস আহরণ করতে পারে তার পক্ষে পিঁপড়ের কথার মতো স্থুল (Crude) জিনিস আহরণ করা কোন কঠিন ব্যাপার হতে যাবে কেন?
যদি ‘আন নামল, মানে হয় মানুষের একটি উপজাতি এবং ‘নামলাহ্’ মানে হয় নামল উপজাতির এক ব্যক্তি তাহলে সুলাইমান আলাইহিস সালামের এ দোয়া এ সময় একেবারেই নিরর্থক হয়ে যায়। এক বাদশাহর পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর ভয়ে কোন মানবিক গোত্রের এক ব্যক্তির নিজের গোত্রকে বিপদ সম্পর্কে সজাগ করা এমন কোন্ ধরণের অস্বাভাবিক কথা যে, এমন একজন সুমহান মর্যাদাশালী পরাক্রান্ত বাদশাহ এ জন্য আল্লাহর কাছে এ দোয়া চাইবেন। তবে এক ব্যক্তির দূর থেকে একটু পিঁপড়ের আওয়াজ শুনার এবং তার অর্থ বুঝার মতো জবরদস্ত শ্রবণ ও জ্ঞান শক্তির অধিকারী হওয়াটা অবশ্যই এমন একটি বিষয় যার ফলে মানুষের আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ ধরণের অবস্থায় হযরত সুলাইমানের এ দোয়া যথার্থ ও যথাযথ।