আশ্-শু’আরা

২২৭ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৭১ ) তারা বললো, “আমরা কতিপয় মূর্তির পূজা করি এবং তাদের সেবায় আমরা নিমগ্ন থাকি।” ৫২
قَالُوا۟ نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَٰكِفِينَ ٧١
৭২ ) সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা যখন তাদেরকে ডাকো তখন কি তারা তোমাদের কথা শোনে?
قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ ٧٢
৭৩ ) অথবা তোমাদের কি কিছু উপকার বা ক্ষতি করে?”
أَوْ يَنفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ ٧٣
৭৪ ) তারা জবাব দিল, “না, বরং আমরা নিজেদের বাপ-দাদাকে এমনটিই করতে দেখেছি।” ৫৩
قَالُوا۟ بَلْ وَجَدْنَآ ءَابَآءَنَا كَذَٰلِكَ يَفْعَلُونَ ٧٤
৭৫ ) এ কথায় ইবরাহীম বললো, “কখনো কি তোমরা (চোখ মেলে)
قَالَ أَفَرَءَيْتُم مَّا كُنتُمْ تَعْبُدُونَ ٧٥
৭৬ ) সেই জিনিসগুলো দেখেছো যাদের বন্দেগী তোমরা এবং তোমাদের অতীত পূর্বপুরুষেরা করতে অভ্যস্ত? ৫৪
أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُمُ ٱلْأَقْدَمُونَ ٧٦
৭৭ ) এরা তো সবাই আমার দুশমন ৫৫ একমাত্র রব্বুল আলামীন ছাড়া, ৫৬
فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّىٓ إِلَّا رَبَّ ٱلْعَٰلَمِينَ ٧٧
৭৮ ) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, ৫৭ তারপর তিনিই আমাকে পথ দেখিয়েছেন।
ٱلَّذِى خَلَقَنِى فَهُوَ يَهْدِينِ ٧٨
৭৯ ) তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান
وَٱلَّذِى هُوَ يُطْعِمُنِى وَيَسْقِينِ ٧٩
৮০ ) এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। ৫৮
وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ ٨٠
৫২.
আমরা কিছু মূর্তির পূজা করি, এ জবাবও নিছক একটা সংবাদ জানিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। কারণ প্রশ্নকর্তা ও জবাবদাতা উভয়ের সামনে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ছিল। নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি তাদের অবিচলতাই ছিল এ জবাবের আসল প্রাণসত্তা। অর্থাৎ তারা আসলে বলতে চাচ্ছিল, হ্যাঁ, আমরাও জানি এগুলো কাঠ ও পাথরের তৈরী প্রতিমা। আমরা এগুলোর পূজা করি। কিন্তু আমরা এগুলোরই পূজা ও সেবা করে যাবো, এটিই আমাদের ধর্ম ও বিশ্বাস।
৫৩.
অর্থাৎ এরা আমাদের প্রার্থনা, মুনাজাত ও ফরিয়াদ শোনে অথবা আমাদের উপকার বা ক্ষতি করে মনে করে আমরা এদের পূজা করতে শুরু করেছি তা নয়। আমাদের এ পূজা-অর্চনার কারণ এটা নয়। বরং আমাদের এ পূজা-অর্চনার আসল কারণ হচ্ছে, আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে তা এভাবেই চলে আসছে। এভাবে তারা নিজেরাই একথা স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাদের ধর্মের পেছনে তাদের পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কোন প্রমাণ নেই। অন্য কথায় তারা যেন বলছিল, তুমি আমাদের কি এমন নতুন কথা বলবে? আমরা নিজেরা দেখছি না এগুলো কাঠ ও পাথরের মূর্তি? আমরা কি জানি না, কাঠ শোনে না এবং পাথর কারো ইচ্ছা পূর্ণ করতে বা ব্যর্থ করে দিতে পারে না? কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধেয় পূবপুরুষরা শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এদের পূজা করে আসছে। তোমার মতে তারা সবাই কি বোকা ছিল? তারা এসব নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোর পূজা করতো, নিশ্চয়ই এর কোন কারণ থাকবে। কাজেই আমরাও তাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে এ কাজ করছি।
৫৪.
ব্যস, স্রেফ বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসছে বলেই তাকে সত্য ধর্ম বলে মেনে নিতে হবে, একটি ধর্মের সত্যতার জন্য শুধুমাত্র এতটুকু যুক্তিই যথেষ্ট? চোখ বন্ধ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাবে এবং কেউ একবার চোখ খুলে দেখবেও না যাদের বন্দেগী-পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে সত্যিই আল্লাহর গুণাবলী পাওয়া যায় কি না এবং আমাদের ভাগ্যের ভাংগা-গড়ার ক্ষেত্রে তারা কোন ক্ষমতা রাখে কি না?
৫৫.
অর্থাৎ চিন্তা করলে আমি দেখতে পাই, যদি আমি এদের পূজা করি তাহলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত দু’টোই বরবাদ হয়ে যাবে। আমি এদের ইবাদাত করাকে শুধুমাত্র অলাভজনক ও অক্ষতিকর মনে করি না বরং উল্টো ক্ষতিকর মনে করি। তাই আমার মতে তাদেরকে পূজা করা এবং শত্রুকে পূজা করা এক কথা। তাছাড়া হযরত ইব্রাহীমের এ উক্তির মধ্যে সূরা মারয়ামে যে কথা বলা হয়েছে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা মার‍য়ামে বলা হয়েছেঃ

وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لِيَكُونُوا لَهُمْ عِزًّا -كَلَّا سَيَكْفُرُونَ بِعِبَادَتِهِمْ وَيَكُونُونَ عَلَيْهِمْ ضِدًّا

“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, যাতে তারা তাদের জন্য শক্তির মাধ্যম হয়। কখখনো না, শিগগির সে সময় আসবে যখন তারা তাদের পূজা-ইবাদাত অস্বীকার করবে এবং উল্টো তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।” (৮১-৮২ আয়াত)

অর্থ্যাৎ কিয়ামতের দিন তারা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং পরিষ্কার বলে দেবে, আমরা কখনো তাদেরকে আমাদের পূজা করতে বলিনি এবং তারা আমাদের পূজা করতো এ কথা আমরা জানিও না।

এখানে প্রচারের কৌশলের একটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য। হযরত ইব্রাহীম এ কথা বলেননি যে, এরা তোমাদের শত্রু বরং বলেছেন এরা আমার শত্রু। যদি তিনি বলতেন এরা তোমাদের শত্রু, তাহলে প্রতিপক্ষের হঠকারী হয়ে ওঠার বেশী সুযোগ থাকতো। তারা তখন বিতর্ক শুরু করতো এরা কেমন করে আমাদের শত্রু হয় বলো। পক্ষান্তরে যখন তিনি বললেন তারা আমার শত্রু তখন প্রতিপক্ষের জন্যও চিন্তা করার সুযোগ হলো। তারাও ভাবতে পারলো, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যেমন নিজের ভাল-মন্দের চিন্তা করছেন তেমনি আমাদের নিজেদের ভাল-মন্দের চিন্তা করা উচিত। এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেন প্রত্যেক ব্যক্তির স্বভাবজাত আবেগ-অনুভূতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যার ভিত্তিতে তারা নিজেরাই হয় নিজেদের শুভাকাঙ্খী এবং জেনে শুনে কখনো নিজেদের মন্দ চায় না। তিনি তাদেরকে বললেন, আমি তো এদের ইবাদাত করার মধ্যে আগাগোড়াই ক্ষতি দেখি এবং জেনে বুঝে আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারতে পারি না। কাজেই দেখে নাও আমি নিজে তাদের ইবাদাত-পূজা-অর্চনা থেকে পুরোপুরি দূরে থাকছি। এরপর প্রতিপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই একথা চিন্তা করতে বাধ্য ছিল যে, তাদের লাভ কিসে এবং জেনে বুঝে তারা নিজেদের অমঙ্গল চাচ্ছে না তো।

৫৬.
অর্থাৎ পৃথিবীতে যেসব উপাস্যের বন্দেগী ও পূজা করা হয় তাদের মধ্যে একমাত্র আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনই আছেন যাঁর বন্দেগীর মধ্যে আমি নিজের কল্যাণ দেখতে পাই এবং যাঁর ইবাদাত আমার কাছে শত্রুর নয় বরং একজন প্রকৃত পৃষ্ঠপোষকের ইবাদাত বলে বিবেচিত হয়। এরপর হযরত ইব্রাহীম একমাত্র রব্বুল আলামীনই ইবাদাতের হকদার কেন, এর কারণগুলো কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করেছেন। এভাবে তিনি নিজের প্রতিপক্ষের মনে এ অনুভূতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন যে, তোমাদের কাছে তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যান্য উপাস্যদের পূজা করার স্বপক্ষে বাপ-দাদার অনুকরণ ছাড়া বর্ণনা করার মতো আর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই কিন্তু আমার কাছে একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, যা তোমরাও অস্বীকার করতে পারো না।
৫৭.
এটি প্রথম কারণ, যার ভিত্তিতে আল্লাহ‌ এবং একমাত্র আল্লাহই ইবাদাতের হকদার। প্রতিপক্ষও এ সত্যটি জানতো এবং মেনেও নিয়েছিল যে, আল্লাহ‌ তাদের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টিতে অন্য কারো কোন অংশ নেই, একথাও তারা স্বীকার করতো। এমন কি তাদের উপাস্যরা নিজেরাও যে আল্লাহর সৃষ্টি এ ব্যাপারে ইবরাহীমের জাতিসহ সকল মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল। নাস্তিকরা ছাড়া বাকি দুনিয়ার আর কোথাও কেউ একথা অস্বীকার করেনি। আল্লাহ‌ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা তাই হযরত ইবরাহীমের প্রথম যুক্তি ছিল, আমি একমাত্র তাঁর ইবাদাতকে সঠিক ও যথার্থ মনে করি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অন্য কোন সত্তা কেমন করে আমার ইবাদাতের হকদার হতে পারে, যেহেতু আমাকে সৃষ্টি করার ব্যাপারে তার কোন অংশ নেই। প্রত্যেক সৃষ্টি অবশ্যি তার নিজের স্রষ্টার বন্দেগী করবে। যে তার স্রষ্টা নয়, তার বন্দেগী করবে কেন?
৫৮.
একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করার স্বপক্ষে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় যুক্তি। যদি তিনি মানুষকে কেবল সৃষ্টি করেই ছেড়ে দিতেন এবং সামনের দিকে তার দুনিয়ার জীবন যাপনের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখতেন তাহলেও মানুষের তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সহায়তা চাওয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতো। কিন্তু তিনি তো সৃষ্টি করার সাথে সাথে পথনির্দেশনা, প্রতিপালন, দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। যে মুহূর্তে মানুষ দুনিয়ায় পদার্পণ করে তখনই তার মায়ের বুকে দুধের ধারা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে স্তন চোষার ও গলা দিয়ে দুধ নিচের দিকে নামিয়ে নেবার কায়দা শিখিয়ে দেয়। তারপর এ প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের কাজ প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বরাবর চালু থাকে। জীবনের প্রতি পর্যায়ে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, বিকাশ, উন্নয়ন ও স্থায়িত্বের জন্য যেসব ধরনের সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় তা সবই তার স্রষ্ট পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সর্বত্রই সঠিকভাবে যোগান দিয়ে রেখেছেন। এ সাজ-সরঞ্জাম থেকে লাভবান হবার এবং একে কাজে লাগাবার জন্য তার যে ধরনের শক্তি ও যোগ্যতার প্রয়োজন তা সবও তার আপন সত্তায় সমাহিত রাখা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি বিভাগে তার যে ধরনের পথনির্দেশনার প্রয়োজন হয় তা দেবার পূর্ণ ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন। এ সঙ্গে তিনি মানবিক অস্তিত্বের সংরক্ষণের এবং তাকে বিপদ-আপদ, রোগ-শোক, ধ্বংসকর জীবাণু ও বিষাক্ত প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তার নিজের শরীরের মধ্যে এমন শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন মানুষের জ্ঞান এখনো যার পুরোপুরি সন্ধান লাভ করতে পারেনি। আল্লাহর এ শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যদি না থাকতো, তাহলে সামান্য একটি কাঁটা শরীরের কোন অংশে ফুটে যাওয়াও মানুষের জন্য ধ্বংসকর প্রমাণিত হতো এবং নিজের চিকিৎসার জন্য মানুষের কোন প্রচেষ্টাই সফল হতো না। স্রষ্টার এ সর্বব্যাপী অনুগ্রহ ও প্রতিপালন কর্মকাণ্ড যখন প্রতি মুহূর্তে সকল দিক থেকে মানুষকে সাহায্য করছে তখন মানুষ তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন সত্তার সামনে মাথা নত করবে এবং প্রয়োজন পূরণ ও সংকট উত্তরণের জন্য অন্য কারো আশ্রয় গ্রহণ করবে, এর চেয়ে বড় মূর্খতা ও বোকামী এবং এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে?
অনুবাদ: