আশ্-শু’আরা

২২৭ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
২২১ ) হে লোকেরা! আমি তোমাদের জানাবো শয়তানরা কার ওপর অবতীর্ণ হয়?
هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ ٱلشَّيَٰطِينُ ٢٢١
২২২ ) তারা তো প্রত্যেক জালিয়াত বদকারের উপর অবতীর্ণ হয়। ১৪০
تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ ٢٢٢
২২৩ ) শোনা কথা কানে ঢুকিয়ে দেয় এবং এর বেশির ভাগই হয় মিথ্যা। ১৪১
يُلْقُونَ ٱلسَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَٰذِبُونَ ٢٢٣
২২৪ ) আর কবিরা! তাদের পেছনে চলে পথভ্রান্ত যারা। ১৪২
وَٱلشُّعَرَآءُ يَتَّبِعُهُمُ ٱلْغَاوُۥنَ ٢٢٤
২২৫ ) তুমি কি দেখো না তারা উপত্যকায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় ১৪৩
أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِى كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ ٢٢٥
২২৬ ) এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না? ১৪৪
وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ ٢٢٦
২২৭ ) তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরন করে আর তাদের প্রতি জুলুম করা হলে শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়। ১৪৫ ---আর জুলুমকারীরা শীঘ্রই জানবে তাদের পরিণাম কি! ১৪৬
إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَذَكَرُوا۟ ٱللَّهَ كَثِيرًا وَٱنتَصَرُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا۟ وَسَيَعْلَمُ ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓا۟ أَىَّ مُنقَلَبٍ يَنقَلِبُونَ ٢٢٧
১৪০.
এখানে গণৎকার, জ্যোতিষী, ভবিষ্যত বক্তা, “আমলকারী” ইত্যাদি লোক, যারা ভবিষ্যতের খবর জানে বলে ভণ্ড প্রতারকের অভিনয় করে অথবা যারা দ্ব্যর্থবোধক শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করে মানুষের ভাগ্য গণনা করে কিংবা ধড়িবাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জিন, আত্মা ও মক্কেলদের সহায়তায় মানুষের সংকট নিরসনের ব্যবসায় করে থাকে তাদের কথা বলা হয়েছে।
১৪১.
এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, শয়তানরা কিছু শুনেটুনে নিয়ে নিজেদের চেলাদেরকে জানিয়ে দেয় এবং তাতে সামান্যতম সত্যের সাথে বিপুল পরিমাণ মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায়। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, মির্থুক-প্রতারক গণৎকাররা শয়তানের কাছ থেকে কিছু শুনে নেয় এবং তারপর তার সাথে নিজের পক্ষ থেকে অনেকটা মিথ্যা মিশিয়ে মানুষের কানে ফুঁকে দিতে থাকে। একটি হাদীসে এর আলোচনা এসেছে। হাদীসটি বুখারী শরীফে আয়েশার (রা.) বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে আয়েশা (রা.) বলেনঃ কোন কোন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গণকদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। জবাবে তিনি বলেন ওসব কিছুই নয়। তারা বলে, হে আল্লাহর রসূল! কখনো কখনো তারা তো আবার ঠিক সত্যি কথাই বলে দেয়। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, সত্যি কথাটা কখনো কখনো জিনেরা নিয়ে আসে এবং তাদের বন্ধুদের কানে ফুঁকে দেয় তারপর তারা তার সাথে নানা রকম মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি কাহিনী তৈরী করে।
১৪২.
অর্থাৎ কবিদের সাথে যারা থাকে ও চলাফেরা করে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যাদেরকে চলাফেরা করতে তোমরা দেখছো তাদের থেকে স্বভাবে-চরিত্রে, চলনে-বলনে, অভ্যাসে-মেজাজে সম্পূর্ণ আলাদা। উভয় দলের ফারাকটা এতই সুস্পষ্ট যে, এক নজর দেখার পর যে কোন ব্যক্তি উভয় দলের কোনটি কেমন তা চিহ্নিত করতে পারে। একদিকে আছে একান্ত ধীর-স্থির ও শান্ত-শিষ্ঠ আচরণ, ভদ্র ও মার্জিত রুচি এবং সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহভীতি। প্রতিটি কথায় ও কাজে আছে দায়িত্বশীলতার অনুভূতি। আচার-ব্যবহারে মানুষের অধিকারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি। লেনদেনে চূড়ান্ত পর্যায়ের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা। কথা যখনই বলা হয় শুধুমাত্র কল্যাণ ও ন্যায়ের জন্যই বলা হয়, অকল্যাণ বা অন্যায়ের একটি শব্দও কখনো উচ্চারিত হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, এদেরকে দেখে পরিষ্কার জানা যায়, এদের সামনে রয়েছে একটি উন্নত ও পবিত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের নেশায় এরা রাতদিন সংগ্রাম করে চলছে এবং এদের সমগ্র জীবন একটি উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত হয়েছে। অন্যদিকে অবস্থা হচ্ছে এই যে, সেখানে কোথাও প্রেম চর্চা ও শরাব পানের বিষয় আলোচিত হচ্ছে এবং শ্রোতৃবর্গ লাফিয়ে লাফিয়ে তাতে বাহবা দিচ্ছে। কোথাও কোন দেহপশারিণী অথবা কোন পুরনারী বা গৃহ-ললনার সৌন্দর্যের আলোচনা চলছে এবং শ্রোতারা খুব স্বাদ নিয়ে নিয়ে তা শুনছে “কোথাও অশ্লীল কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে এবং সমগ্র সমাবেশের উপর যৌন কামনার প্রেত চড়াও হয়ে বসেছে। কোথাও মিথ্যা ও ভাঁড়ামির আসর বসেছে এবং সমগ্র মাহফিল ঠাট্টা-তামাশায় মশগুল হয়ে গেছে। কোথাও কারোর দুর্নাম গাওয়া ও নিন্দাবাদ করা হচ্ছে এবং লোকেরা তাতে বেশ মজা পাচ্ছে। কোথাও কারো অযথা প্রশংসা করা হচ্ছে এবং শাবাশ ও বাহবা দিয়ে তাকে আরো উসকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তা শুনে মানুষের মনে আগুন লেগে যাচ্ছে। এসব মজলিসে কবির কবিতা শোনার জন্য যে বিপুল সংখ্যক লোক জমায়েত হয় এবং বড় বড় কবিদের পেছনে যেসব লোক ঘুরে বেড়ায় তাদেরকে দেখে কোন ব্যক্তি একথা অনুভব না করে থাকতে পারে না যে, এরা হচ্ছে নৈতিকতার বন্ধনমুক্ত, আবেগ ও কামনার স্রোতে ভেসে চলা এবং ভোগ ও পাপ-পংকিলতার পূজারী অর্ধ-পাশবিক একটি নরগোষ্ঠি দুনিয়ায় মানুষের যে কোন উন্নত জীবনাদর্শ ও লক্ষ্যও থাকতে পারে এ চিন্তা কখনো এদের মন-মগজ স্পর্শও করতে পারে না। এ দু’দলের সুস্পষ্ট পার্থক্য ও ফারাক যদি কারো নজরে না পড়ে তাহলে সে অন্ধ। আর যদি সবকিছু দেখার পরও কোন ব্যক্তি নিছক সত্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ঈমানকে বেমালুম হজম করে একথা বলতে থাকে যে মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর আশেপাশে যারা সমবেত হয়েছে তারা কবি ও কবিদের সাংগোপাংগদের মতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছে।
১৪৩.
“অর্থাৎ তাদের নিজস্ব চিন্তার ও বাকশক্তি ব্যবহার করার কোন একটি নির্ধারিত পথ নেই। বরং চিন্তার পাগলা ঘোড়া বল্গাহারা অশ্বের মতো পথে-বিপথে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ায়। আবেগ, কামনা-বাসনা বা স্বার্থের প্রতিটি নতুন ধারা তাদের কণ্ঠ থেকে একটি নতুন বিষয়ের রূপে আবির্ভূত হয়। চিন্তা ও বর্ণনা করার সময় এগুলো সত্য ও ন্যায়সঙ্গত কিনা সেদিকে দৃষ্টি রাখার কোন প্রয়োজনই অনুভব করা হয় না। কখনো একটি তরংগ জাগে, তখন তার স্বপক্ষে জ্ঞান ও নীতিকথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দেয়া হয়। আবার কখনো দ্বিতীয় তরংগ জাগে, সেই একই কণ্ঠ থেকে এবার একেবারেই পুতিগন্ধময় নীচ, হীন ও নিম্নমুখী আবেগ উৎসারিত হতে থাকে। কখনো কারোর প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাকে আকাশে চড়িয়ে দেয়া হয় আবার কখনো নারাজ হলে সেই একই ব্যক্তিকেই পাতালের গভীর গর্ভে ঠেলে দেয়া হয়। কোন কুঞ্জুশকে হাতেম এবং কোন পুরুষকে বীর রুস্তম গণ্য করতে তাদের বিবেকে একটুও বাধে না যদি তার সাথে তাদের কোন স্বার্থ জড়িত থাকে। পক্ষান্তরে কেউ যদি তাদেরকে কোন দুঃখ দিয়ে থাকে তার পবিত্র জীবনকে কলঙ্কিত করার এবং তার ইজ্জত-আবরু ধূলায় মিশিয়ে দেবার বরং তার বংশধারার নিন্দা করার ব্যাপারে তারা একটুও লজ্জা অনুভব করে না। আল্লাহ‌ বিশ্বাস ও নাস্তিক্যবাদ, বস্তুবাদিতা ও আধ্যাত্মিকতা, সদাচার ও অসদাচার, পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা ও অপবিত্রতা-অপরিচ্ছন্নতা, গাম্ভীর্য ও হাস্য-কৌতুক এবং প্রশংসা ও নিন্দাবাদ সবকিছু একই কবির একই কাব্যে পাশাপাশি দেখা যাবে। কবিদের এ পরিচিত বৈশিষ্ট্য যারা জানে তারা কেমন করে এ কুরআনের বাহককে কবিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে? কারণ তাঁর ভাষণ মাপাজোকা, তাঁর বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন, তাঁর পথ একেবারে সুস্পষ্ট ও নির্ধারিত এবং সত্য, সততা ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহ্বান করা ছাড়া তাঁর কণ্ঠ থেকে অন্য কোন কথাই বের হয়নি। কুরআন মজীদের অন্য এক জায়গায় নবী ﷺ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কবিত্বের সাথে তাঁর প্রকৃতি ও মেজাজের আদৌ কোন সম্পর্ক নেইঃ

وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ

“আমি তাঁকে কবিতা শিখাইনি এবং এটা তাঁর করার মতো কাজও নয়।” (ইয়াসিন, ৬৯)

এটি এমন একটি সত্য ছিল, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন তাঁরা সবাই একথা জানতেন। নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ কোন একটি কবিতাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুরোপুরি মুখস্থ ছিল না। কথাবার্তার মাঝখানে কোন কবির ভালো কবিতার চরণ তাঁর মুখে এলেও তা অনুপযোগীভাবে পড়ে যেতেন অথবা তার মধ্যে শব্দের হেরফের হয়ে যেতো। হযরত হাসান বাসরী বলেন, একবার ভাষণের মাঝখানে তিনি এক কবিতার চরণ এভাবে পড়লেনঃ

كفى بالاسلام والشيب للمرء ناهيا-

হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! চরণটি হবে এ রকম,

كفى الشيب والاسلام للمرء ناهيا-

একবার তিনি আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামীকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কবিতাটা কি তোমার?

أَتَجْعَلُ نَهْبِى وَنَهْبَ الْعُبَيْدِ وبَيْنَ وَالأَقْرَعِ وعُيَيْنَةَ আব্বাস বললেন, শেষ বাক্যাংশটি ওভাবে নয়, বরং এভাবে হবেঃ بَيْنَ عُيَيْنَةَ وَالأَقْرَعِ একথায় রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, কিন্তু অর্থ তো উভয়ের এক।

হযরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করা হয়, নবী ﷺ কি কখনো নিজের ভাষণের মধ্যে কবিতা ব্যবহার করতেন? তিনি বলেন, কবিতার চেয়ে বেশী তিনি কোন জিনিসকে ঘৃণা করতেন না। তবে কখনো কখনো তিনি বনী কায়েসের কবিতা পড়তেন। কিন্তু প্রথমটা শেষে এবং শেষেরটা প্রথম দিকে পড়ে ফেলতেন। হযরত আবু বকর (রা.) বলতেন, হে আল্লাহর রসূল! এভাবে নয় বরং এভাবে। তখন তিনি বলতেন, “আমি কবি নই এবং কবিতা পাঠ করা আমার কাজ নয়।” আরবের কবিতা অঙ্গনে যে ধরনের বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছিল তা ছিল যৌন আবেদন ও অবৈধ প্রেমচর্চা অথবা শরাব পান কিংবা গোত্রীয় ঘৃণা, বিদ্বেষ ও যুদ্ধবিগ্রহ বা বংশীয় ও বর্ণগত অহংকার। কল্যাণ ও সুকৃতির কথার স্থান সেখানে অতি অল্পই ছিল। এছাড়া মিথ্যা, অতিরঞ্জন, অপবাদ, নিন্দাবাদ, অযথা প্রশংসা, আত্মগর্ব, তিরস্কার, দোষারোপ, পরিহাস ও মুশরিকী অশ্লীল পৌরানিকতা তো এ কাব্যধারার শিরায় শিরায় প্রবাহিত ছিল। তাই এ কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রায় ছিলঃ

لَأَنْ يَمْتَلِئَ جَوْفُ أَحَدِكُمْ قَيْحًا , خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمْتَلِئَ شِعْرًا

“তোমাদের কারো পেট পুঁজে ভরা থাকা কবিতায় ভরা থাকার চেয়ে ভালো। তবুও যে কবিতায় কোন ভালো কথা থাকতো তিনি তার প্রশংসা করতেন।” তাঁর উক্তি ছিলঃ امن شعره وكفر قلبه “তার কবিতা মু’মিন কিন্তু অন্তর কাফের।” একবার একজন সাহাবী একশোটা ভালো ভালো কবিতা তাঁকে শুনান এবং তিনি চলে যেতে থাকলে বলেনঃ هيه অর্থাৎ “আরো শুনাও।”

১৪৪.
এটি হচ্ছে কবিদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। নবী (সা.) সম্পর্কে তাঁর প্রত্যেক পরিচিত জন জানতেন, তিনি যা বলতেন তাই করতেন এবং যা করতেন তাই বলতেন। তাঁর কথা ও কর্মের সামঞ্জস্য এমনই একটি জাজ্বল্যমান সত্য ছিল যা তাঁর আশেপাশের সমাজের কেউ অস্বীকার করতে পারতো না। অথচ সাধারণ কবিদের সম্পর্কে সবাই জানতো যে, তারা বলতেন এক কথা এবং করতেন অন্য কিছু। তাদের কবিতায় দানশীলতার মাহাত্ম এমন উচ্চ কণ্ঠে প্রচারিত হবে যেন মনে হবে তাদের চেয়ে বড় আর কোন দাতা নেই। কিন্তু তাদের কাজ দেখলে বুঝা যাবে তারা বড়ই কৃপণ। বীরত্বের কথা তারা বলবেন কিন্তু নিজেরা হবেন কাপুরুষ। অমুখাপেক্ষিতা, অল্পে তুষ্টি ও আত্মমর্যাদাবোধ হবে তাদের কবিতার বিষয়বস্তু কিন্তু নিজেরা লোভ, লালসা ও আত্ম বিক্রয়ের শেষ সীমানাও পার হয়ে যাবেন। অন্যের সামান্যতম দুর্বলতাকেও কঠোরভাবে পাকড়াও করবেন কিন্তু নিজেরা চরম দুর্বলতার মধ্যে হাবুডুবু খাবেন।
১৪৫.
ওপরে সাধারণভাবে কবিদের প্রতি যে নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয়েছে তা থেকে এমন সব কবিদেরকে এখানে আলাদা করা হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে চারটি বৈশিষ্ট্য।

একঃ যারা মু’মিন অর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর কিতাবগুলো যারা মানেন এবং আখেরাত বিশ্বাস করেন।

দুইঃ নিজেদের কর্মজীবনে যারা সৎ, যারা ফাসেক, দুষ্কৃতিকারী ও বদকার নন। নৈতিকতার বাঁধন মুক্ত হয়ে যারা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় না দেন।

তিনঃ আল্লাহকে যারা বেশী বেশী করে স্মরণ করেন নিজেদের সাধারণ অবস্থায়, সাধারণ সময়ে এবং নিজেদের রচনায়ও। তাদের ব্যক্তি জীবনে আল্লাহভীতি ও আল্লাহর আনুগত্য রয়েছে কিন্তু তাদের কবিতা পাপ-পংকিলতা, লালসা, কামনা রসে পরিপূর্ণ, এমন যেন না হয়। আবার এমনও যেন না হয়, কবিতায় বড়ই প্রজ্ঞা ও গভীর তত্ত্বকথা আওড়ানো হচ্ছে কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর স্মরণের কোন চিহ্ন নেই। আসলে এ দু’টি অবস্থা সমানভাবে নিন্দনীয়। তিনিই একজন পছন্দনীয় কবি যার ব্যক্তিজীবন যেমন আল্লাহর স্মরণে পরিপূর্ণ তেমনি নিজের সমগ্র কাব্য প্রতিভাও এমন পথে উৎসর্গীকৃত যা আল্লাহ‌ থেকে গাফিল লোকদের নয় বরং যারা আল্লাহকে জানে, আল্লাহকে ভালোবাসে ও আল্লাহর আনুগত্য করে তাদের পথ।

চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটি বর্ণনা করা হয়েছে এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী কবিদের যারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কারোর নিন্দা করে না এবং ব্যক্তিগত, বংশীয় বা গোত্রীয় বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বালায় না। কিন্তু যখন জালেমের মোকাবিলায় সত্যের প্রতি সমর্থন দানের প্রয়োজন দেখা দেয় তখন তার কণ্ঠকে সেই একই কাজে ব্যবহার করে যে কাজে একজন মুজাহিদ তার তীর ও তরবারিকে ব্যবহার করে। সবসময় আবেদন নিবেদন করতেই থাকা এবং বিনীতভাবে আর্জি পেশ করেই যাওয়া মু’মিনের রীতি নয়। এ সম্পর্কেই হাদীসে বলা হয়েছে, কাফের ও মুশরিক কবিরা ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দোষারোপ, অপবাদের যে তাণ্ডব সৃষ্টি করতো এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে বিষ ছড়াতো তার জবাব দেবার জন্য নবী (সা.) নিজে ইসলামী কবিদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ও সাহস যোগাতেন। তাই তিনি কা’ব ইবনে মালেককে (রা.) বলেনঃ

اهْجُهُمْ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَهُو أَشَدُّ عليهم مِنَ النَّبْلِ

“ওদের নিন্দা করো, কারণ সেই আল্লাহর কসম, যার হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ আবদ্ধ, তোমার কবিতা ওদের জন্য তীরের চেয়েও বেশী তীক্ষ্ন ও ধারালো।”

হাসসান ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেনঃ

قل وروح القدس معك এবং اهْجُهُمْ وَجِبْرِيلُ مَعَكَ

“তাদের মিথ্যাচারের জবাব দাও এবং জিব্রীল তোমার সঙ্গে আছে।” এবং “বলো এবং পবিত্র আত্মা তোমার সঙ্গে আছে।”

তাঁর উক্তি ছিলঃ

إِنَّ الْمُؤْمِنَ يُجَاهِدُ بِسَيْفِهِ وَلِسَانِهِ

“মু’মিন তলোয়ার দিয়েও লড়াই করে এবং কণ্ঠ দিয়েও।”

১৪৬.
জুলুমকারী বলতে এখানে এমনসব লোকদের কথা বুঝানো হয়েছে যারা সত্যকে খাটো ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সম্পূর্ণ হঠকারিতার পথ অবলম্বন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কবি, গণক, যাদুকর ও পাগল হবার অপবাদ দিয়ে বেড়াতো। এ ধরনের অপবাদ দেবার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যারা তাঁর সম্পর্কে জানে না তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে তাদের মনে কু-ধারণা সৃষ্টি করা এবং তাঁর শিক্ষার প্রতি যাতে তারা আকৃষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করা।
অনুবাদ: