আশ্-শু’আরা

২২৭ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
২১১ ) এ কাজটি তাদের শোভাও পায় না। ১৩১ এবং তারা এমনটি করতেই পারে না। ১৩২
وَمَا يَنۢبَغِى لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ ٢١١
২১২ ) তাদেরকে তো এর শ্রবণ থেকেও দূরে রাখা হয়েছে। ১৩৩
إِنَّهُمْ عَنِ ٱلسَّمْعِ لَمَعْزُولُونَ ٢١٢
২১৩ ) কাজেই হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডেকো না, নয়তো তুমিও শাস্তি লাভকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। ১৩৪
فَلَا تَدْعُ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ فَتَكُونَ مِنَ ٱلْمُعَذَّبِينَ ٢١٣
২১৪ ) নিজের নিকটতম আত্নীয়-পরিজনদেরকে ভয় দেখাও ১৩৫
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ ٱلْأَقْرَبِينَ ٢١٤
২১৫ ) এবং মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করো।
وَٱخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٢١٥
২১৬ ) কিন্তু যদি তারা তোমার নাফরমানী করে তাহলে তাদেরকে বলে দাও, তোমরা যা কিছু করো আমি তা থেকে দায়মুক্ত। ১৩৬
فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّى بَرِىٓءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ ٢١٦
২১৭ ) আর সেই পরাক্রান্ত ও দয়াময়ের উপর নির্ভর করো ১৩৭
وَتَوَكَّلْ عَلَى ٱلْعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ ٢١٧
২১৮ ) যিনি তোমাকে দেখতে থাকেন যখন তুমি ওঠো ১৩৮
ٱلَّذِى يَرَىٰكَ حِينَ تَقُومُ ٢١٨
২১৯ ) এবং সিজ্‌দাকারীদের মধ্যে তোমার ওঠা-বসা ও নড়া-চড়ার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। ১৩৯
وَتَقَلُّبَكَ فِى ٱلسَّٰجِدِينَ ٢١٩
২২০ ) তিনি সব কিছুই শোনেন ও জানেন।
إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ ٢٢٠
১৩১.
অর্থাৎ এ বাণী এবং এ বিষয়বস্তু শয়তানের মুখে তো সাজেই না। যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারে, কুরআনে যেসব কথা বর্ণনা করা হচ্ছে সেগুলো কি শয়তানের পক্ষ থেকে হতে পারে? তোমাদের জনপদগুলোতে কি গণৎকার নেই এবং শয়তানদের সাথে যোগসাজস করে যেসব কথা এ ব্যক্তি বলছেন তা কখনো তোমরা কোথাও শুনেছো? তোমরা কি কখনো শুনেছো, কোন শয়তান কোন গণৎকারের মাধ্যমে লোকদেরকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা দিয়েছে? শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত রেখেছে? পরকালে জিজ্ঞাসাবাদ করার ভয় দেখিয়েছে? জুলুম-নিপীড়ন, অসৎ-অশ্লীল কাজ ও নৈতিকতা বিগর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে? সৎ পথে চলা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন এবং আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সদাচার করার উপদেশ দিয়েছে? শয়তানরা এ প্রকৃতি কোথায় পাবে? তাদের স্বভাব হচ্ছে তারা মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে অসৎকাজে উৎসাহিত করে। তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী গণকদের কাছে লোকেরা যে কথা জিজ্ঞেস করতে যায় তা হচ্ছে এই যে, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পাবে কি না? জুয়ায় কোন্ দাঁওটা মারলে লাভ হবে? শত্রুকে হেয় করার জন্য কোন চালটা চালতে হবে? অমুক ব্যক্তির উট কে চুরি করেছে? এসব সমস্যা ও বিষয় বাদ দিয়ে গণক ও তার পৃষ্ঠপোষক শয়তানরা আবার কবে থেকে আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ ও সংস্কারের শিক্ষা এবং অসৎ কাজে বাঁধা দেবার ও সেগুলো উৎখাত করার চিন্তা-ভাবনা করেছে?
১৩২.
অর্থাৎ শয়তানরা করতে চাইলেও একাজ করার ক্ষমতাই তাদের নেই। সামান্য সময়ের জন্যও নিজেদেরকে মানুষের যথার্থ শিক্ষক ও প্রকৃত আত্মশুদ্ধিকারীর স্থানে বসিয়ে কুরআন যে নির্ভেজাল সত্য ও নির্ভেজাল কল্যাণের শিক্ষা দিচ্ছে সে শিক্ষা দিতে তারা সক্ষম নয়। প্রতারণা করার জন্যও যদি তারা এ কৃত্রিম রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তাদের কাজ এমন মিশ্রণমুক্ত হতে পারে না, যাতে তাদের মূর্খতা ও তাদের মধ্যে লুকানো শয়তানী স্বভাবের প্রকাশ হবে না। যে ব্যক্তি শয়তানদের ‘ইলহাম’ তথা আসমানী প্রেরণা লাভ করে নেতা হয়ে বসে তার জীবনেও তার শিক্ষার মধ্যে অনিবার্যভাবে নিয়তের ত্রুটি, সংকল্পের অপবিত্রতা ও উদ্দেশ্যের মালিন্য দেখা দেবেই। নির্ভেজাল সততা ও নির্ভেজাল সৎকর্মশীলতা কোন শয়তান মানুষের মনে সঞ্চার করতে পারে না এবং শয়তানের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী কখনো এর ধারক হতে পারে না। এরপর আছে শিক্ষার উন্নত মান ও পবিত্রতা এবং এর উপর বাড়তি সুনিপুন বাগধারা ও সাহিত্য-অলংকার এবং গভীর তত্ত্বজ্ঞান, যা কুরআনে পাওয়া যায়। এরই ভিত্তিতে কুরআনে বারবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, মানুষ ও জিনেরা মিলে চেষ্টা করলেও এ কিতাবের মতো কিছু একটা রচনা করে আনতে পারবে নাঃ

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوابِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍظَهِيرًا-(بنى اسرائيل-88)

قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ-(يونس-38) (সূরা ইউনূসঃ ৩৮)

১৩৩.
অর্থাৎ কুরআনের বাণী হৃদয়ে সঞ্চার করার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহুল আমীন তা নিয়ে চলতে থাকেন এবং যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোরাজ্যে তিনি তা নাযিল করেন তখন এ সমগ্র ধারাবাহিক কার্যক্রমের কোন এক জায়গায়ও শয়তানদের কান লাগিয়ে শোনারও কোন সুযোগ মেলে না। আশেপাশে কোথাও তাদের ঘুরে বেড়াবার কোন অবকাশই দেয়া হয় না। কোথাও থেকে কোনভাবে কিছু শুনে টুনে দু’একটি কথা চুরি করে নিয়ে গিয়ে তারা নিজেদের বন্ধু বান্ধবদের বলতে পারতো না যে, আজ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বাণী শুনাবেন অথবা তাঁর ভাষণে অমুক কথা বলা হবে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল হিজর ৮-১২ ও আস্ সাফফাত ৫-৭ টীকা, সূরা আল জিন ৮-৯ ও ২৭ আয়াত)
১৩৪.
এর অর্থ এ নয়, নাউযুবিল্লাহ নবী ﷺ থেকে শিরকের অপরাধ সংঘটিত হবার ভয় ছিল এবং এজন্য তাঁকে ধমক দিয়ে এ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। আসলে কাফের ও মুশরিকদেরকে সতর্ক করাই এর উদ্দেশ্য। বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, কুরআন মজীদে যে শিক্ষা পেশ করা হচ্ছে তা যেহেতু বিশ্ব-জাহানের শাসনকর্তার পক্ষ থেকে নির্ভেজাল সত্য এবং তার মধ্যে শয়তানী মিশ্রণের সামান্যও দখল নেই, তাই এখানে সত্যের ব্যাপারে কাউকে কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেবার কোন প্রশ্নই দেখা দেয় না। সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় যদি কেউ হতে পারেন তবে তিনি হচ্ছেন তাঁর রসূল। কিন্তু ধরে নেয়া যাক যদি তিনিও বন্দেগীর পথ থেকে এক তিল পরিমাণ সরে যান এবং এক আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ হিসেবে ডাকেন তাহলে পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবেন না। এক্ষেত্রে অন্যরা তো ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়। এ ব্যাপারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই যখন কোন সুবিধা দেয়া হয়নি তখন আর কোন্ ব্যক্তি আছে যে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় কাউকে শরীক করার পর আবার এ আশা করতে পারে যে, সে রক্ষা পেয়ে যাবে অথবা কেউ তাকে রক্ষা পেতে সাহায্য করবে।
১৩৫.
অর্থাৎ আল্লাহর এ পবিত্র পরিচ্ছন্ন দ্বীনের মধ্যে যেমন নবীকে কোন সুবিধা দেয়া হয়নি ঠিক তেমনি নবীর পরিবার ও তাঁর নিকটতম আত্মীয়-বান্ধবদের জন্যও কোন সুবিধার অবকাশ রাখা হয়নি। এখানে যার সাথেই কিছু করা হয়েছে তার গুণাগুণের (Merits) প্রেক্ষিতেই করা হয়েছে। কারো বংশ মর্যাদা বা কারো সাথে কোন ব্যক্তির সম্পর্ক কোন উপকার করতে পারে না। পথ ভ্রষ্টতা ও অসৎকর্মের জন্য আল্লাহর আযাবের ভয় সবার জন্য সমান। এমন নয় যে, অন্য সবাই তো এসব জিনিসের জন্য পাকড়াও হবে কিন্তু নবীর আত্মীয়রা রক্ষা পেয়ে যাবে। তাই হুকুম দেয়া হয়েছে, নিজের নিকটতম আত্মীয়দেরকেও পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দাও। যদি তারা নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যকলাপ পরিচ্ছন্ন না রাখে তাহলে তারা যে নবীর আত্মীয় একথা তাদের কোন কাজে লাগবেনা।

নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে, এ আয়াত নাযিল হবার পর নবী ﷺ সবার আগে নিজের দাদার সন্তানদের ডাকলেন এবং তাদের একেক জনকে সম্বোধন করে বললেনঃ

يَا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ, يَا عَبَّاس,يَا صَفِيَّةُ عَمَّة رَسُول الله, يَا فَاطِمَةَ بنَت مُحَمَّدٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ , فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ مِنَ اللهِ شَيْئًا سَلُونِى مِنْ مَالِى مَا شِئْتُمْ-

“হে বনী আবদুল মুত্তালিব, হে আব্বাস, হে আল্লাহর রসূলের ফুফী সফীয়াহ, হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা, তোমরা আগুনের আযাব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার চিন্তা করো। আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারবো না। তবে হ্যাঁ আমার ধন-সম্পত্তি থেকে তোমরা যা চাও চাইতে পারো।”

তারপর তিনি অতি প্রত্যুষে সাফা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেনঃ يا صباحاه (হায়, সকালের বিপদ!) হে কুরাইশের লোকেরা! হে বনী কা’ব ইবনে লুআই! হে বনী মুররা! হে কুসাইর সন্তান-সন্ততিরা! হে বনী আবদে মান্নাফ! হে বনী আবদে শামস! হে বনী হাশেম, হে বনী আবদুল মুত্তালিব! এভাবে কুরাইশদের প্রত্যেকটি গোত্র ও পরিবারের নাম ধরে তিনি আওয়াজ দেন। আরবে একটি প্রচলিত নিয়ম ছিল, অতি প্রত্যুষে যখন কোন বহিশত্রুর হামলার আশঙ্কা দেখা দিতো ওয়াকিফহাল ব্যক্তি এভাবেই সবাইকে ডাকতো এবং লোকেরা তার আওয়াজ শুনতেই চারদিকে থেকে দৌড়ে যেতো। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আওয়াজ শুনে লোকেরা যার যার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তখন তিনি বললেনঃ “হে লোকেরা! যদি আমি বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। তাহলে কি তোমরা আমার কথা সত্য বলে মেনে নেবে? ” সবাই বললো, হ্যাঁ আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তুমি কখনো মিথ্যা বলনি। তিনি বললেন, “বেশ, তাহলে আমি আল্লাহর কঠিন আযাব আসার আগে তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাঁর পাকড়াও থেকে নিজেদের বাঁচাবার চিন্তা করো। আল্লাহর মোকাবিলায় আমি তোমাদের কোন কাজে লাগতে পারবোনা। কিয়ামতের দিন কেবলমাত্র মুত্তাকীরাই হবে আমার আত্মীয়। এমন যেন না হয়, অন্য লোকেরা সৎকাজ নিয়ে আসবে এবং তোমরা দুনিয়ার জঞ্জাল মাথায় করে নিয়ে উপস্থিত হবে। সে সময় তোমরা ডাকবে, হে মুহাম্মাদ! কিন্তু আমি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবো। তবে দুনিয়ায় আমার সাথে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক এবং এখানে আমি তোমাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবো।” এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অনেকগুলো হাদীস বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত আয়েশা, আবু হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, যুহাইর ইবনে আমর ও কুবাইসাহ ইবনে মাহারিক থেকে বর্ণিত হয়েছে।

কুরআনে وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ---এর হুকুম হলো এবং নবী (সা.) তাঁর আত্মীয়দেরকে একত্র করে একথা জানিয়ে দিয়ে সে হুকুম তামিল করলেন, ব্যাপারটির এখানেই শেষ নয়। আসলে এর মধ্যে যে মূলনীতি সুস্পষ্ট করা হয়েছিল তা ছিল এই যে, দ্বীনের মধ্যে নবী ও তাঁর বংশের জন্য এমন কোন বিশেষ সুবিধা নেই যা থেকে অন্যরা বঞ্চিত। যে জিনিসটি প্রাণ সংহারক বিষ সেটি সবারই জন্য প্রাণ সংহারক। নবীর কাজ হচ্ছে সবার আগে নিজে তা থেকে বাঁচবেন এবং নিজের নিকটবর্তী লোকদেরকে তার ভয় দেখাবেন। তারপর সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সবাইকে এ মর্মে সতর্ক করে দেবেন যে, এটি যে-ই খাবে, সে-ই মারা পড়বে। আর যে জিনিসটি লাভজনক তা সবার জন্য লাভজনক। নবীর দায়িত্ব হচ্ছে, সবার আগে তিনি নিজে সেটি অবলম্বন করবেন এবং নিজের আত্মীয়দেরকে সেটি অবলম্বন করার উপদেশ দেবেন। এর ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি দেখে নেবে এ ওয়াজ-নসিহত শুধুমাত্র অন্যের জন্য নয় বরং নিজের দাওয়াতের ব্যাপারে নবী আন্তরিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন এ পদ্ধতি অবলম্বন করে গেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন যখন তিনি শহরে প্রবেশ করলেন তখন ঘোষণা করে দিলেনঃ

كُلَّ رِبًا فِى الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعٌ تحت قدمى ها تين وأَوَّلَ رِباً يُوضَعُ رِبَا عَبَّاسِ

“লোকদের কাছে অনাদায়কৃত জাহেলী যুগের প্রত্যেকটি সুদ আমার এ দু’পায়ের তলে পিষ্ট করা হয়েছে। আর সবার আগে যে সুদকে আমি রহিত করে দিচ্ছি তা হচ্ছে আমার চাচা আব্বাসের সুদ।”

(উল্লেখ্য, সুদ হারাম হবার আগে আব্বাস (রা.) সুদে টাকা খাটাতেন এবং সে সময় পর্যন্ত লোকদের কাছে তাঁর বহু টাকার সুদ পাওনা ছিল) একবার চুরির অভিযোগে তিনি কুরাইশদের ফাতিমা নামের একটি মেয়ের হাত কাটার হুকুম দিলেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) তার পক্ষে সুপারিশ করলেন। এতে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তাহলে আমি তার হাত কেটে দিতাম।

১৩৬.
এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তোমার আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে থেকে যারা ঈমান এনে তোমার অনুসরণ করবে তাদের সাথে কোমল, স্নেহপূর্ণ ও বিনম্র ব্যবহার করো। আর যারা তোমার কথা মানবে না তাদের দায়মুক্ত হবার কথা ঘোষণা করে দাও। দুই, যেসব আত্মীয়কে সতর্ক করার হুকুম দেয়া হয়েছিল এ উক্তি কেবলমাত্র তাদের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং এটি ব্যাপকভাবে সবার জন্য। অর্থাৎ যারা ঈমান এনে তোমার আনুগত্য করে তাদের সাথে বিনম্র আচরণ করো এবং যারাই তোমার নাফরমানি করে তাদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দাও যে, তোমাদের কার্যকলাপের সমস্ত দায়-দায়িত্ব থেকে আমি মুক্ত।

এ আয়াত থেকে জানা যায়, সে সময় কুরাইশ ও তার আশেপাশের আরববাসীদের মধ্যে এমন কিছু লোকও ছিল যারা রসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতার স্বীকৃতি দিয়েছিল কিন্তু কার্যত তারা তাঁর আনুগত্য করছিল না বরং তারা যথারীতি তাদের ভ্রষ্ঠ ও বিভ্রান্ত সমাজ কাঠামোর মধ্যে ঠিক তেমনিভাবে জীবন যাপন করে যাচ্ছিল যেমন অন্যান্য কাফেররা করছিল। আল্লাহ‌ এ ধরণের স্বীকৃতি দানকারীদেরকে এমন সব মু’মিনদের থেকে আলাদা গণ্য করেছিলেন যাঁরা নবীর ﷺ স্বীকৃতি দান করার পর তাঁর আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করেছিল। বিনম্র ব্যবহার করার হুকুম শুধুমাত্র এ শেষোক্ত দলটির জন্য দেয়া হয়েছিল। আর যারা নবীর ﷺ আনুগত্য করা থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল, যার মধ্যে তাঁর সত্যতার স্বীকারকারী এবং তাঁকে অস্বীকারকারীও ছিল, তাদের সম্পর্কে নবীকে ﷺ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা প্রকাশ করে দাও এবং পরিষ্কার বলে দাও, নিজেদের কর্মকাণ্ডের ফলাফলে তোমরা নিজেরাই ভুগবে এবং তোমাদের সতর্ক করে দেবার পর এখন আর তোমাদের কোন কাজের দায়-দায়িত্ব আমার ওপর নেই।

১৩৭.
অর্থাৎ দুনিয়ার বৃহত্তম শক্তিরও পরোয়া করো না এবং মহাপরাক্রমশালী ও দয়াময় সত্তার উপর নির্ভর করে কাজ করে যাও। তাঁর পরাক্রমশালী হওয়াই একথার নিশ্চয়তা বিধান করে যে, যার পেছনে তাঁর সমর্থন আছে তাকে দুনিয়ায় কেউ হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে না। আর তাঁর দয়াময় হওয়া এ নিশ্চিন্ততার জন্য যথেষ্ট যে, তাঁর জন্য যে ব্যক্তি সত্যের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার কাজে জীবন উৎসর্গ করবে তার প্রচেষ্টাকে তিনি কখনো নিষ্ফল হতে দেবেন না।
১৩৮.
ওঠার অর্থ রাতে নামাযের জন্য ওঠাও হতে পারে, আবার রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য ওঠাও হতে পারে।
১৩৯.
এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, আপনি যখন জামায়াতের সাথে নামায পড়ার সময় নিজের মুকতাদীদের সাথে উঠা-বসা ও রুকূ’-সিজদা করেন তখন আল্লাহ‌ আপনাকে দেখতে থাকেন। দুই, রাতের বেলা উঠে যখন নিজের সাথীরা (যাদের বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ হিসেবে “সিজদাকারী” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) তাদের পরকাল গড়ার জন্য কেমন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখার উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকেন তখন আপনি আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকেন না। তিন, আপনি নিজের সিজদাকারী সাথীদেরকে সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর বান্দাদের সংশোধন করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আল্লাহ‌ তা অবগত আছেন। চার, সিজদাকারী লোকদের দলে আপনার যাবতীয় তৎপরতা আল্লাহর নজরে আছে। তিনি জানেন আপনি কিভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, কিভাবে ও কেমন পর্যায়ে তাদের আত্মশুদ্ধি করছেন এবং কিভাবে ভেজাল সোনাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছেন।

নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের এসব গুণের উল্লেখ এখানে যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তার সম্পর্কে ওপরের বিষয়বস্তুর সাথেও এবং সামনের বিষয়বস্তুর সাথেও আছে। ওপরের বিষয়বস্তুর সাথে তার সম্পর্ক হচ্ছে এই যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রহমত ও তাঁর শক্তিশালী সমর্থন লাভের যোগ্য। কারণ আল্লাহ‌ কোন অন্ধ ও বধির মাবুদ নন বরং একজন চক্ষুষ্মান ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন শাসক। তাঁর পথে আপনার সংগ্রাম-সাধনা এবং সিজদাকারী সাথীদের মধ্যে আপনার তৎপরতা সবকিছু তাঁর দৃষ্টিতে আছে। পরবর্তী বিষয়বস্তুর সাথে এর সম্পর্ক হচ্ছে এই যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো যে ব্যক্তি জীবন এবং যার সাথীদের গুণাবলী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথীদের মতো, তার ওপর শয়তান অবতীর্ণ হয় অথবা সে কবি একথা কেবলমাত্র একজন বুদ্ধিভ্রষ্ট ব্যক্তিই বলতে পারে। শয়তান যেসব গণকের কাছে আসে তাদের এবং কবি ও তাদের সাথী সহযোগীদের আচার-আচরণ কেমন হয়ে থাকে তা কি কারো অজানা? তোমাদের নিজেদের সমাজে এ ধরনের লোক বিপুল সংখ্যায় পাওয়া যায়। কোন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি কি ঈমানদারীর সাথে একথা বলতে পারে, সে মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সাথীদের জীবন এবং কবি ও গণকদের জীবনের মধ্যে কোন ফারাক দেখে না? এখন এর চেয়ে বড় বেহায়াপনা আর কি হতে পারে যে, আল্লাহর এ বান্দাদেরকে প্রকাশ্যে কবি ও গণৎকার বলে পরিহাস করা হচ্ছে অথচ কেউ একটু লজ্জাও অনুভব করছে না।

অনুবাদ: