قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ
“বলে দাও, যে ব্যক্তি জিব্রীলের সাথে শত্রুতা রাখে তার জানা উচিত, সে-ই এ কুরআন আল্লাহর হুকুমে তোমার অন্তরে নাযিল করেছে।” (আল বাকারাহঃ ৯৭ আয়াত)
এখানে তাঁর নাম না নিয়ে তাঁর জন্য “রূহুল আমীন” (আমানতদার বা বিশ্বস্ত রূহ) পদবী ব্যবহার করে একথা ব্যক্ত করতে চাওয়া হয়েছে যে, রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এ নাযিলকৃত জিনিসটি নিয়ে কোন বস্তুগত শক্তি আসেনি, যার মধ্যে পরিবর্তন ও অবক্ষয়ের সম্ভাবনা আছে বরং এসেছে একটি নির্ভেজাল রূহ। তাঁর মধ্যে বস্তুবাদিতার কোন গন্ধ নেই। তিনি পুরোপুরি আমানতদার। আল্লাহর বাণী যেভাবে তাঁকে সোপর্দ করে দেয়া হয় ঠিক তেমনি হুবহু তিনি তা পৌঁছিয়ে দেন। নিজের পক্ষ থেকে কিছু বাড়ানো বা কমানো অথবা নিজেই কিছু রচনা করে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির একটি পুরাতন অভিমতের সপক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে এ আয়াতটি তার অন্যতম। ইমাম সাহেবের মতটি হচ্ছেঃ
যদি কোন ব্যক্তি নামাজে কুরআনের অনুবাদ পড়ে নেয় সে আরবীতে কুরআন পড়তে সক্ষম হলেও বা না হলেও, তার নামাজ হয়ে যায়। আল্লামা আবু বকর জাসসাসের ভাষায় এ যুক্তির ভিত্তি হলো, আল্লাহ এখানে বলছেন, এ কুরআন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যেও ছিল। আর একথা সুস্পষ্ট, সে কিতাবগুলোতে কুরআন আরবী ভাষার শব্দ সমন্বয়ে ছিল না। অন্য ভাষায় কুরআনের বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করে দেয়া সত্ত্বেও তা কুরআনই থাকে। কুরআন হওয়াকে বাতিল করে দেয় না। (আহকামুল কুরআন, তৃতীয় খণ্ড, ৪২৯ পৃষ্ঠা) কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা একেবারেই সুস্পষ্ট। কুরআন মজীদ বা অন্য কোন আসমানী কিতাবের কোনটিরও নাযিল হবার ধরণ এমন ছিল না যে, আল্লাহ নবীর অন্তরে কেবল অর্থই সঞ্চার করে দিয়েছেন এবং তারপর নবী তাকে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বরং প্রত্যেকটি কিতাব যে ভাষায় এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে শব্দ ও বিষয়বস্তু উভয়টি সহকারেই এসেছে। পূর্ববর্তী যেসব কিতাবে কুরআনের শিক্ষা ছিল মানবিক ভাষা সহকারে নয় বরং আল্লাহর ভাষা সহকারেই ছিল এবং সেগুলোর কোনটির অনুবাদকেও আল্লাহর কিতাব বলা যেতে পারে না এবং তাকে আসলের স্থলাভিষিক্ত করাও সম্ভব নয়। আর কুরআন সম্পর্কে বার বার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে তার প্রতিটি শব্দ আরবী ভাষায় হুবহু নাযিল হয়েছেঃ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا-(يوسف-2) “নিশ্চিতভাবে আমি তা নাযিল করেছি আরবী ভাষায় কুরআন আকারে।” وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا “আর এভাবে আমি তা নাযিল করেছি একটি নির্দেশ আরবী ভাষায়।” قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ (الزمر-28) “আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতা মুক্ত।” (আয্ যুমারঃ ২৮) তারপর আলোচ্য আয়াতের সাথে সংযুক্ত পূর্ববর্তী আয়াতেই বলা হয়েছে, রূহুল আমীন আরবী ভাষায় একে নিয়ে নাযিল হয়েছেন। এখন তাঁর সম্পর্কে কেমন করে এ কথা বলা যেতে পারে যে, কোন মানুষ অন্য ভাষায় তার যে অনুবাদ করেছে তাও কুরআনই হবে এবং তার শব্দাবলী আল্লাহর শব্দাবলীর স্থলাভিষিক্ত হবে। মনে হচ্ছে যুক্তির এ দুর্বলতাটি মহান ইমাম পরবর্তী সময়ে উপলব্ধি করে থাকতে পারেন। তাই নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় এ কথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, এ বিষয়ে নিজের অভিমত পরিবর্তন করে তিনি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মত গ্রহণ করে নিয়েছিলেন অর্থাৎ যে ব্যক্তি আরবী ভাষায় কিরআত তথা কুরআন পড়তে সক্ষম নয় সে ততক্ষণ পর্যন্ত নামাজে কুরআনের অনুবাদ পড়তে পারে যতক্ষণ সে আরবী শব্দ উচ্চারণ করার যোগ্যতা অর্জন না করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আরবীতে কুরআন পড়তে পারে সে যদি কুরআনের অনুবাদ পড়ে তাহলে তার নামাজ হবে না। আসলে ইমামদ্বয় এমন সব আজমী তথা অনারব নওমুসলিমকে এ সুযোগটি দেবার প্রস্তাব করেছিলেন যারা ইসলাম গ্রহণ করার পরপরই আরবী ভাষায় নামাজ পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতো না। এ ব্যাপারে কুরআনের অনুবাদও কুরআন এটা তাদের যুক্তির ভিত্তি ছিল না। বরং তাদের যুক্তি ছিল, ইশারায় রুকূ-সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য জায়েয ঠিক তেমনি আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় নামাজ পড়াও এমন ব্যক্তির জন্য জায়েয যে আরবী হরফ উচ্চারণ করতে অক্ষম। অনুরূপভাবে যেমন অক্ষমতা দূর হবার ইশারায় রুকূ- সিজদাকারীর নামাজ হবে না ঠিক তেমনি কুরআন পড়ার ক্ষমতা অর্জন করার পর অনুবাদ পাঠকারীর নামাযও হবে না। (এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সারখসী লিখিত মাবসূত, প্রথম খণ্ড, ৩৭ পৃষ্ঠা এবং ফাতহুল কাদীর ও শারহে ইনায়াহ আলাল হিদায়াহ প্রথম খণ্ড, ১৯০-২০১ পৃষ্ঠা)
সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে জানা যায়, এ আয়াতগুলো নাযিল হবার কাছাকাছি সময়ে হাবশা (বর্তমানে ইথিয়োপিয়া) থেকে হযরত জা’ফর রাদিয়াল্লাহু আনহুর দাওয়াত শুনে ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দল মক্কায় আসে। তারা মসজিদে হারামে কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের সামনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত মোলাকাত করে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন আপনি কি শিক্ষা নিয়ে এসেছেন? তিনি জবাবে কুরআনের কিছু আয়াত শুনান। এগুলো শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে এবং তারা তখনই তাঁর প্রতি ঈমান আনে। তারপর যখন তারা তাঁর কাছ থেকে উঠে যায় তখন আবু জাহেল কয়েকজন কুরাইশকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে দেখা করে এবং তাদেরকে কঠোরভাবে তিরষ্কার করে। সে বলে “তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কাফেলা কখনো এখানে আসেনি। হে হতভাগার দল! তোমাদের দেশের লোকেরা তোমাদের এখানে পাঠিয়েছিল এ ব্যক্তির অবস্থা অনুসন্ধান করে তাদের কাছে সঠিক তথ্য নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তোমরা তো তাঁর সাথে সাক্ষাত করার সাথে সাথেই নিজেদের ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বসলে?” তারা ছিল ভদ্র ও শরীফ লোক। আবু জাহেলের এ নিন্দাবাদ ও ভর্ৎসনায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে তারা সালাম দিয়ে সরে গেল এবং বলতে থাকলোঃ আমরা আপনার সাথে বিতর্ক করতে চাই না। আপনার ধর্ম আপনার ইচ্ছা ও আপনার ক্ষমতার আওতাধীন এবং আমাদের ধর্মও আমাদের ইচ্ছা ও আমাদের ক্ষমতার আওতাধীন। যে জিনিসের মধ্যে নিজেদের কল্যাণ দেখেছি সেটিই আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি। (দ্বিতীয় খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা) সূরা কাসাসে এ ঘটনার আলোচনা এভাবে এসেছেঃ
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِهِ هُمْ بِهِ يُؤْمِنُونَ - وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّنَا إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ ................... وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
“এর আগে যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম তারা এ কুরআনের প্রতি ঈমান আনে এবং যখন তাদেরকে তা শুনানো হয় তখন বলে, আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। এ হচ্ছে আমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আমরা এর আগেও এই দ্বীন ইসলামের ওপর ছিলাম। .........আর যখন তারা অর্থহীন কথাবার্তা শুনলো তখন বিতর্ক এড়িয়ে গেলো এবং বললো আমাদের কাজ আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য। তোমাদের সালাম জানাই। আমরা মূর্খদের পদ্ধতি পছন্দ করি না। (অর্থাৎ তোমরা আমাদের দু’টি কথা শুনালে জবাবে আমরাও তোমাদের দু’টি কথা শুনালাম)
وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَابًا فِي قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ
“যদি আমি তোমাদের ওপর কোন কাগজে লেখা কিতাব নাযিল করে দিতাম এবং এরা হাত দিয়ে তা ছুঁয়েও দেখে নিতো, তাহলেও যাদের না মানার তারা বলতো, এতো পরিষ্কার যাদু।” (আল আন’আমঃ ৭ আয়াত)
وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَابًا مِنَ السَّمَاءِ فَظَلُّوا فِيهِ يَعْرُجُونَ - لَقَالُوا إِنَّمَا سُكِّرَتْ أَبْصَارُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَسْحُورُونَ
“আর যদি আমি তাদের ওপর আকাশের কোন দরজাও খুলে দিতাম এবং তারা তার মধ্যে চড়তে থাকতো, তাহলে তারা বলতো আমাদের চোখ প্রতারিত হচ্ছে বরং আমাদের ওপর যাদু করা হয়েছে।” (আল হিজরঃ ১৪-১৫)