ত্বাহা

১৩৫ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১১১ ) -লোকদের মাথা চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত সত্তার সামনে ঝুঁকে পড়বে, সে সময় যে জুলুমের গোনাহের ভার বহন করবে সে ব্যর্থ হবে।
وَعَنَتِ ٱلْوُجُوهُ لِلْحَىِّ ٱلْقَيُّومِ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا ١١١
১১২ ) আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে এবং সেই সাথে সে মুমিনও হবে তার প্রতি কোন জুলুম বা অধিকার হরণের আশঙ্কা নেই। ৮৭
وَمَن يَعْمَلْ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا يَخَافُ ظُلْمًا وَلَا هَضْمًا ١١٢
১১৩ ) আর হে মুহাম্মাদ! এভাবে আমি একে আরবী কুরআন বানিয়ে নাযিল করেছি ৮৮ এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী করেছি হয়তো এরা বক্রতা থেকে বাঁচবে বা এদের মধ্যে এর বদৌলতে কিছু সচেতনতার নিদর্শন ফুটে উঠবে। ৮৯
وَكَذَٰلِكَ أَنزَلْنَٰهُ قُرْءَانًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ ٱلْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا ١١٣
১১৪ ) কাজেই প্রকৃত বাদশাহ আল্লাহ‌ হচ্ছেন উন্নত ও মহান। ৯০ আর দেখো, কুরআন পড়ার ব্যাপারে দ্রুততা অবলম্বন করো না যতক্ষণ না তোমার প্রতি তার অহী পূর্ণ হয়ে যায় এবং দোয়া করো, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে আরো জ্ঞান দাও। ৯১
فَتَعَٰلَى ٱللَّهُ ٱلْمَلِكُ ٱلْحَقُّ وَلَا تَعْجَلْ بِٱلْقُرْءَانِ مِن قَبْلِ أَن يُقْضَىٰٓ إِلَيْكَ وَحْيُهُۥ وَقُل رَّبِّ زِدْنِى عِلْمًا ١١٤
১১৫ ) আমি ৯২ এর আগে আদমকে একটি হুকুম দিয়েছিলাম ৯৩ কিন্তু সে ভুলে গিয়েছে এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ় সংকল্প পাইনি। ৯৪
وَلَقَدْ عَهِدْنَآ إِلَىٰٓ ءَادَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِىَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُۥ عَزْمًا ١١٥
১১৬ ) স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমকে সিজদা করো, তারা সবাই সিজদা করলো কিন্তু একমাত্র ইবলীস অস্বীকার করে বসলো।
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَٰٓئِكَةِ ٱسْجُدُوا۟ لِءَادَمَ فَسَجَدُوٓا۟ إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبَىٰ ١١٦
১১৭ ) এ ঘটনায় আমি আদমকে বললাম, ৯৫ “দেখো, এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, ৯৬ এমন যেন না হয় যে, এ তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দেয় ৯৭ এবং তোমরা বিপদে পড়ে যাও।
فَقُلْنَا يَٰٓـَٔادَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَّكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ ٱلْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰٓ ١١٧
১১৮ ) এখানে তো তুমি এ সুবিধে পাচ্ছো যে, তুমি না অভুক্ত ও উলংগ থাকছো
إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ ١١٨
১১৯ ) এবং না পিপাসার্ত ও রৌদ্রক্লান্ত হচ্ছো।” ৯৮
وَأَنَّكَ لَا تَظْمَؤُا۟ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ ١١٩
১২০ ) কিন্তু শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল, ৯৯ বলতে থাকলো, “হে আদম! তোমাকে কি এমন গাছের কথা বলে দেবো যা থেকে অনন্ত জীবন ও অক্ষয় রাজ্য লাভ করা যায়?” ১০০
فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ ٱلشَّيْطَٰنُ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ ٱلْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَّا يَبْلَىٰ ١٢٠
৮৭.
কারণ সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণাবলীর () ভিত্তিতে ফয়সালা হবে। যে ব্যক্তি কোন জুলুমের গোনাহের বোঝা বহন করে নিয়ে আসবে, সে আল্লাহর অধিকারের বিরুদ্ধে জুলুম করুক বা আল্লাহর বান্দাদের অধিকারের বিরুদ্ধে অথবা নিজের নফসের বিরুদ্ধে জুলুম করুন না কেন যে কোন অবস্থায়ই এগুলো তাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে না। অন্যদিকে যারা ঈমান ও সৎকাজ (নিছক সৎকাজ নয় বরং ঈমান সহকারে সৎকাজ এবং নিছক ঈমানও নয় বরং সৎকাজ সহকারে ঈমান) নিয়ে আসবে তাদের ওপর সেখানে জুলুম হবার কোনআশঙ্কা নেই অর্থাৎ নিরর্থক তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না এবং তাদের যাবতীয় কার্যাবলী একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হবে এবং সমস্ত অধিকার গ্রাস করে নেয়া হবে এমন কোনআশঙ্কাও সেখানে থাকবে না।
৮৮.
অর্থাৎ তা এমনিতর বিষয়বস্তু, শিক্ষাবলী ও উপদেশমালায় পরিপূর্ণ। এখানে শুধুমাত্র ওপরের আয়াতগুলোতে বর্ণিত নিকটবর্তী বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি। বরং কুরআনের যেসব বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে সেসব দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবার কুরআন সম্পর্কে সূরার সূচনায় এবং তারপর মূসার কাহিনীর শেষ পর্যায়ের আয়াতগুলোতে যা বলা হয়েছে এর বর্ণনা পরম্পরা সেগুলোর সাথে সম্পর্কিত হয়। এর অর্থ হচ্ছে, তোমার প্রতি যে “স্মারক” পাঠানো হয়েছে এবং আমার কাছ থেকে বিশেষভাবে আমি যে “স্মরণ” তোমাকে দিয়েছি তা এ ধরনের মর্যাদাসম্পন্ন স্মারক ও স্মরণ।
৮৯.
অর্থাৎ এরা নিজেদের গাফলতি থেকে সজাগ হবে, ভুলে যাওয়া শিক্ষাকে কিছুটা স্মরণ করবে এবং পথ ভুলে কোন পথে যাচ্ছে আর এই পথ ভুলে চলার পরিণাম কি হবে সে সম্পর্কে এদের মনে বেশ কিছুটা অনুভূতি জাগবে।
৯০.
কুরআনে সাধারণত একটি ভাষণ শেষ করতে গিয়ে এ ধরনের বাক্য বলা হয়ে থাকে এবং আল্লাহর কালামের সমাপ্তি তাঁর প্রশংসা বাণীর মাধ্যমে করাই হয় এর উদ্দেশ্য। বর্ণনাভংগী ও পূর্বাপর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে এখানে একটি ভাষণ শেষ হয়ে গেছে এবং وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَى آدَمَ থেকে দ্বিতীয় ভাষণ শুরু হচ্ছে। বেশীর ভাগ সম্ভাবনা এটাই যে, এ দু’টি ভাষণ বিভিন্ন সময় নাযিল হয়ে থাকবে এবং পরে নবী ﷺ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী দু’টিকে এক জায়গায় একত্র করে দিয়ে থাকবেন। একত্র করার কারণ উভয় ভাষণের বিষয়গত সাদৃশ্য। এ বিষয়টি আমি পরবর্তী আলোচনায় সুস্পষ্ট করে দেবো।
৯১.
فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ বাক্যেই ভাষণ খতম হয়ে গেছে। এরপর বিদায় নেবার সময় ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটি ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন। অহী নাযিল করার সময় এটা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে সংশোধন করে দেয়া সঙ্গত মনে করা হয়নি। তাই বাণী পাঠানোর কাজ শেষ হবার পর এখন তার এ সংশোধনী দিচ্ছেন। সতর্কবাণীর শব্দাবলী থেকে একথা প্রকাশ হচ্ছে যে, কি ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল। অহীর বাণী গ্রহণ করার সময় নবী ﷺ তা স্মরণ রাখার এবং মুখে পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করে থাকবেন। এ প্রচেষ্টার কারণে তাঁর মনোযোগ বারবার সরে গিয়ে থাকবে। ফলে অহী গ্রহণের ধারাবাহিকতার মধ্যে বাধার সৃষ্টি হয়ে থাকবে। বাণী শোনার প্রতি মনোযোগ পুরোপুরি আকৃষ্ট হয়ে থাকবে। এ অবস্থা দেখে এ প্রয়োজন অনুভব করা হয়েছে যে, তাঁকে অহীর বাণী গ্রহণ করার সঠিক পদ্ধতি বুঝাতে হবে এবং মাঝখানে মাঝখানে স্মরণ রাখার জন্য যে চেষ্টা তিনি করেন তা থেকে তাঁকে বিরত রাখতে হবে।

এ থেকে জানা যায়, সূরা “ত্ব-হা”র এ অংশটি প্রথম যুগের অহীর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম যুগে তখনো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে অহী গ্রহণ করার অভ্যাস ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় কয়েকবার তিনি এ কাজ করেছেন। প্রত্যেকবার এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে দেবার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন না কোন বাক্য উচ্চারণ করা হয়েছে। সূরা “কিয়ামাহ” নাযিলের সময়ও এমনটিই হয়েছিল। তাই তখন বাণীর ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে তাঁকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছিলঃ

لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ - إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ - فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ - ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ –

“কুরআনকে দ্রুত স্মরণ করার জন্য তোমার জিহবা বার বার সঞ্চালন করো না। তা স্মরণ করিয়ে ও পড়িয়ে দেবার দায়িত্ব আমার। কাজেই যখন আমি তা শুনাচ্ছি তখন তুমি গভীর মনোযোগ সহকারে তা শুনতে থাকো, তারপর তার অর্থ বুঝিয়ে দেবার দায়িত্বও আমার।”

সূরা আ’লায়েও তাঁকে এ নিশ্চিন্ততা দেয়া হয়েছে যে,”আমি তা পড়িয়ে দেবো এবং তুমি তা ভুলে যাবে না।” سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَى -পরে যখন তিনি অহীর বাণী গ্রহণ করার ব্যাপারে ভালো মতো পারদর্শিতা লাভ করেন তখন তিনি আর এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হননি। এ কারণে পরবর্তী সূরাগুলোয় এ ধরনের কোন সতর্কবাণী আমরা দেখি না।

৯২.
যেমন এর আগে বলা হয়েছে, এখান থেকে আর একটা আলাদা ভাষণ শুরু হয়েছে। সম্ভবত ওপরের ভাষণের পর কোন এক সময় এটি নাযিল হয়েছিল এবং বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের কারণে এর সাথে মিলিয়ে একই সূরার মধ্যে উভয়কে একত্র করা হয়েছে। বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য একাধিক। যেমনঃ

একঃ কুরআন যে ভুলে যাওয়া শিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তা সেই একই শিক্ষা যা মানব জাতিকে তার সৃষ্টির সূচনায় দেয়া হয়েছিল, আল্লাহ‌ যা মাঝে মাঝে স্মরণ করিয়ে দেয়ার ওয়াদা করেছিলেন এবং যা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য কুরআনের পূর্বে বারবার “স্মারক” আসতে থেকেছে।

দুইঃ শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ বারবার এ শিক্ষা ভুলে যায় এবং সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বারবার সে এ দুর্বলতা দেখিয়ে আসছে। তাই মানুষ বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে থাকার মুখাপেক্ষী।

তিনঃ মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করে তার এমন আচরণের ওপর যা আল্লাহ‌ প্রেরিত এই “স্মারকের” সাথে সে করবে। সৃষ্টির সূচনালগ্নে একথা পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছিল। আজ এটা কোন নতুন কথা বলা হচ্ছে না যে, এর অনুসরণ করলে গোমরাহী ও দুর্ভাগ্য থেকে সংরক্ষিত থাকবে অন্যথায় দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে বিপদে পড়বে।

চারঃ একটি জিনিস হচ্ছে, ভুল, সংকল্পের অভাব ও ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা। এরই কারণে মানুষ তার চিরন্তন শত্রুশয়তানের পরোচনায় পড়ে এবং ভুল করে বসে। মানুষের মনে ভুলের অনুভূতি জাগার সাথে সাথেই সে যদি নিজের দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি সংশোধন করে নেয় এবং অবাধ্যতা পরিহার করে আনুগত্যের সাথে ফিরে আসে তাহলেই সে ক্ষমা লাভ করতে পারে। দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে, বিদ্রোহ ও সীমালঙ্ঘন এবং ভালোভাবে ভেবে চিন্তে আল্লাহর মোকাবিলায় শয়তানের দাসত্ব করা। ফেরাউন ও সামেরী এ কাজ করেছিল। এর ক্ষমার কোন সম্ভাবনা নেই। ফেরাউন ও সামেরী নিজেদের যে পরিণতি ভোগ করেছে এর পরিণতিও তাই হবে। যে ব্যক্তি এ কর্মনীতি অবলম্বন করবে সে-ই এ পরিণতির শিকার হবে।

৯৩.
আদম আলাইহিস সালামের ঘটনা এর আগে সূরা বাকারাহ, সূরা আ’রাফে (দুজায়গায়), সূরা হিজর, সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা কাহফে আলোচিত হয়েছে। এখানে সপ্তমবার এর পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। প্রত্যেক জায়গায় বর্ণনা পরম্পরার সাথে এর সম্পর্কে ভিন্নতর এবং প্রত্যেক জায়গায় এ সম্পর্কের ভিত্তিতেই এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে। যে জায়গায় আলোচ্য বিষয়ের সাথে ঘটনার যে অংশের সম্পর্ক রয়েছে সে জায়গায় সেটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে, অন্য জায়গায় তা পাওয়া যাবে না অথবা বর্ণনাভংগী সামান্য আলাদা হবে। পুরো ঘটনাটি বা এর পূর্ণ তত্ত্ব অনুধাবন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব জায়গাগুলোই পড়ে নেয়া উচিত। আমি সব জায়গায়ই এর সম্পর্ক ও সম্বন্ধ এবং এর ফলাফল টীকায় বর্ণনা করে দিয়েছি।
৯৪.
অর্থাৎ তিনি পরবর্তী পর্যায়ে এ নির্দেশের সাথে যে আচরণ করেন তা অহংকার ও ইচ্ছাকৃত বিদ্রোহের ভিত্তিতে ছিল না বরং গাফলতি ও ভুলের শিকার হবার এবং সংকল্প ও ইচ্ছার দুর্বলতার কারণে ছিল। তিনি এ ধরনের কোন চিন্তা ও সংকল্পের ভিত্তিতে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেননি যে, আমি আল্লাহর পরোয়া করতে যাবো কেন, তাঁর হুকুম হয়েছে তাতে কি হয়েছে, আমার মন যা চাইবে আমি তা করবো, আল্লাহ‌ আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন কেন? এর পরিবর্তে বরং তাঁর আল্লাহর হুকুম অমান্য করার কারণ এই ছিল যে, তিনি আল্লাহর হুকুম মনে রাখার চেষ্টা করেননি, তিনি তাঁকে কি বুঝিয়েছিলেন তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছাশক্তি খুব বেশী মজবুত ছিল না যার ফলে যখন শয়তান তাঁকে প্ররোচিত করতে এলো তখন তিনি পূর্বাহ্ণে প্রদত্ত আল্লাহর সতর্কবাণী ও উপদেশ (যার আলোচনা এখনই সামনে আসছে) স্মরণ করতে পারলেন না এবং শয়তান প্রদত্ত লোভ ও লালসার কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেন না।

“আমি তার মধ্যে সংকল্প পাইনি” এ বাক্যের অর্থ কেউ কেউ এরূপ নিয়েছেন যে, “আমি তার মধ্যে নাফরমানীর সংকল্প পাইনি” অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেছেন ভুল করে করেছেন, নাফরমানী করার সংকল্প নিয়ে করেননি। কিন্তু খামাখা এ ধরনের সংকোচ করার কোন প্রয়োজন নেই। একথা বলতে হলে لَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا عَلَى الْعِصْيَان বলা হতো, শুধুমাত্র لَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا বলা হতো না। আয়াতের শব্দাবলী পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, সংকল্পের অভাব মানে হুকুম মেনে চলার সংকল্পের অভাব, নাফরমানী করার সংকল্পের অভাব নয়। তাছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি ও পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি নজর দিলে পরিষ্কার অনুভূত হয় যে, এখানে আল্লাহ‌ আদম আলাইহিস সালামের ভূমিকা ও মর্যাদা কালিমামুক্ত করার উদ্দেশ্যে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন না বরং তিনি একথা বলতে চান যে, তিনি যে মানবিক দুর্বলতা প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং যে কারণে শুধু তিনি একাই নন বরং তাঁর সন্তানরাও আল্লাহর আগাম সতর্কবাণী সত্ত্বেও নিজের শত্রুর ফাঁদে পা দিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে দিয়েই চলেছে সেটি কি ছিল। উপরন্তু যে ব্যক্তিই খোলা মনে এ আয়াতটি পড়বে তার মনে প্রথমে অর্থটিই ভেসে উঠবে যে, “আমি তার মধ্যে হুকুমের আনুগত্য করার সংকল্প বা মজবুত ইচ্ছাশক্তি পাইনি।” দ্বিতীয় অর্থটি তার মনে ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ না সে আদম আলাইহিস সালামের সাথে গোনাহের সম্পর্কে স্থাপন করা অসঙ্গত মনে করে আয়াতের অন্য কোন অর্থ খোঁজা শুরু করে দেবে। এ অবস্থায় এ অভিমত আল্লামা আলুসীও তাঁর তাফসীরে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

لكن لا يخفى عليك ان هذا التفسير غير متبادر ولاكثير المناسبة للمقام-

“একথা তোমার কাছে গোপন থাকা উচিত নয় যে, আয়াতের শব্দাবলী শুনে এ ব্যাখ্যা সঙ্গে সঙ্গেই মনে উদয় হয় না এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথেও এটা তেমন কোন সম্পর্ক রাখে না।” (দেখুন রুহুল মা’আনী, ১৬ খন্ড, ২৪৩ পৃষ্ঠা)

৯৫.
আদম আলাইহিস সালামকে যে আসল হুকুম দেয়া হয়েছিল তা এখানে বর্ণনা করা হয়নি। সে হুকুমটি হচ্ছে এই যে, “এ বিশেষ গাছটির ফল খেয়ো না।” কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এ হুকুমটি বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে যেহেতু বলার আসল বিষয়টি হচ্ছে শুধুমাত্র এতটুকু যে, মানুষ কিভাবে আল্লাহর আগাম সতর্কবাণী ও উপদেশ দান সত্ত্বেও নিজের পরিচিতি শত্রুর কুমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয় এবং তার এ দুর্বলতা কিভাবে তার থেকে এমন কাজ করিয়ে নেয় যা তার নিজের স্বার্থ বিরোধী হয়, তাই আল্লাহ‌ আসল হুকুম উল্লেখ করার পরিবর্তে এখানে কেবল মাত্র তার সাথে হযরত আদমকে (আ) যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল সেটির উল্লেখ করেছেন।
৯৬.
শত্রুতার প্রদর্শনী তখনই হয়ে গিয়েছিল। আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম স্বচক্ষেই দেখে নিয়েছিলেন ইবলীস তাদেরকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল এবং পরিষ্কার বলে দিয়েছিল।

أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ

“আমি তার চাইতে ভালো, তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং তাকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে।” (আ’রাফঃ ১২ এবং সাদঃ ৭৬)

أَرَأَيْتَكَ هَذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ “একটু দেখো তো, এ সত্তাটিকে তুমি আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছো।” أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا এখন কি আমি তাকে সিজদা করবো যাকে তুমি বানিয়েছো মাটি থেকে? (বনী ইসরাঈলঃ ৬১-৬২) তারপর শুধুমাত্র প্রকাশ্যে নিজের ঈর্ষা প্রকাশ করেই সে ক্ষান্ত থাকেনি বরং আল্লাহর কাছে এই বলে নিজের জন্য অবকাশও চেয়ে নিয়েছিল যে, আমাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার অযোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দিন, আমি তাকে পথভ্রষ্ট করে দেখিয়ে দেবো। সে আপনার কেমন ধরনের প্রতিনিধি। সূরা আ’রাফ, হিজর ও বনী ইসরাঈলে তার এই চ্যালেঞ্জ উচ্চারিত হয়েছে এবং সামনের দিকে সূরা সাদেও আসছে। তাই আল্লাহ‌ যখন বললেন, এ তোমাদের শত্রু তখন এটা নিছক একটা অজানা সংবাদ ছিল না বরং এমন একটা জিনিস ছিল যা ঠিক সময় মতো স্বামী-স্ত্রী উভয়ই স্বচক্ষে দেখে নিয়েছিল এবং স্বকর্ণে শুনেছেনও।

৯৭.
এভাবে উভয়কে একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, যদি প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে তোমরা আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করো তাহলে তোমরা এখানে থাকতে পারবে না এবং তোমাদের যেসব নিয়ামত দান করা হয়েছে সেসব তোমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে।
৯৮.
জান্নাত থেকে বের হবার পর মানুষকে যে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে তার বিবরণ এখানে দেয়া হয়েছে। এ সময় জান্নাতের বড় বড় পূর্ণাংগ ও শ্রেষ্ঠ নিয়ামতগুলো উল্লেখ করার পরিবর্তে তার চারটি মৌলিক নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে তোমাদের জন্য খাদ্য, পানীয়, পোশাক ও গৃহের ব্যবস্থা সরকারীভাবে করা হচ্ছে। এর কোন একটি অর্জন করার জন্য তোমাদের পরিশ্রম করতে ও প্রচেষ্টা চালাতে হচ্ছে না। এ থেকে আপনাআপনি একথা আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যদি তারা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে সরকারী নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে জান্নাত থেকে বের হয়ে তারা এখানকার বড় বড় নিয়ামত তো দূরের কথা মৌলিক জীবন উপকরণও লাভ করবে না। নিজেদের প্রাথমিক প্রয়োজনের জন্যও তারা প্রচেষ্টা চালাতে এবং জীবনপাত করতে বাধ্য হবে। মাথার ঘাম পায়ে না ফেলা পর্যন্ত একবেলার আহারেরও সংস্থান করতে পারবে না। দুবেলা দু’মুঠো আহারের চিন্তা তাদের মনোযোগ, সময় ও শক্তির এমন বৃহত্তম অংশ টেনে বের করে নিয়ে যাবে যে, কোন উন্নতর উদ্দেশ্যের জন্য কিছু করার অবকাশ ও শক্তি তাদের থাকবে না।
৯৯.
এখানে কুরআন পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে যে, আদম ও হাওয়ার মধ্যে আসলে যাকে শয়তান প্ররোচিত করেছিল তিনি হাওয়া ছিলেন না বরং ছিলেন আদম আলাইহিস সালাম। যদিও সূরা আ’রাফের বক্তব্যে দু’জনকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সেখানে দু’জনকেই প্ররোচিত বলা হয়েছে কিন্তু শয়তানের প্ররোচনার গতিমুখ ছিল মূলত হযরত আদমেরই দিকে। অন্যদিকে বাইবেলের বর্ণনা মতে সাপ প্রথমে মহিলা অর্থাৎ হযরত হাওয়ার সাথে কথা বলে এবং হাওয়া তার স্বামীকে প্ররোচিত করে তাঁকে গাছের ফল খাওয়ান। (আদি পুস্তকঃ৩)
১০০.
সূরা আ’রাফে আমরা শয়তানের কথাবার্তার আরো যে বিস্তারিত বিবরণ পাই তা হচ্ছে এই যে,

وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ

“আর সে বললো, তোমাদের রব তোমাদেরকে এ গাছটি থেকে শুধুমাত্র এ জন্য বিরত রেখেছেন, যাতে তোমরা দু’জন ফেরেশতা অথবা চিরঞ্জীব না হয়ে যাও।” (২০ আয়াত)

অনুবাদ: