ত্বাহা

১৩৫ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১০১ ) আর এ ধরনের লোকেরা চিরকাল এ দুর্ভাগ্য পীড়িত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য (এই অপরাধের দায়ভার) বড়ই কষ্টকর বোঝা হবে। ৭৭
خَٰلِدِينَ فِيهِ وَسَآءَ لَهُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ حِمْلًا ١٠١
১০২ ) সেদিন যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে ৭৮ এবং আমি অপরাধীদেরকে এমনভাবে ঘেরাও করে আনবো যে, তাদের চোখ (আতংকে) দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে। ৭৯
يَوْمَ يُنفَخُ فِى ٱلصُّورِ وَنَحْشُرُ ٱلْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا ١٠٢
১০৩ ) তারা পরস্পর চুপিচুপি বলাবলি করবে, দুনিয়ায় বড়জোর তোমরা দশটা দিন অতিবাহিত করেছো” ৮০
يَتَخَٰفَتُونَ بَيْنَهُمْ إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا عَشْرًا ١٠٣
১০৪ ) --আমি ৮১ ভালোভাবেই জানি তারা কিসব কথা বলবে, (আমি এও জানি) সে সময় তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী সতর্ক অনুমানকারী হবে সে বলবে, না, তোমাদের দুনিয়ার জীবন তো মাত্র একদিনের জীবন ছিল।
نَّحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ إِذْ يَقُولُ أَمْثَلُهُمْ طَرِيقَةً إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا يَوْمًا ١٠٤
১০৫ ) -এ লোকেরা ৮২ তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড়গুলো কোথায় চলে যাবে? বলো, আমার রব তাদেরকে ধূলি বানিয়ে উড়িয়ে দেবেন
وَيَسْـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلْجِبَالِ فَقُلْ يَنسِفُهَا رَبِّى نَسْفًا ١٠٥
১০৬ ) এবং যমীনকে এমন সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে,
فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا ١٠٦
১০৭ ) তার মধ্যে তোমরা কোন উঁচু নিচু ও ভাঁজ দেখতে পাবে না। ৮৩
لَّا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجًا وَلَآ أَمْتًا ١٠٧
১০৮ ) --সেদিন সবাই নকীবের আহবানে সোজা চলে আসবে, কেউ সামান্য দর্পিত ভংগীর প্রকাশ ঘটাতে পারবে না এবং করুণাময়ের সামনে সমস্ত আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে, মৃদু খসখস শব্দ ৮৪ ছাড়া তুমি কিছুই শুনবে না।
يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ ٱلدَّاعِىَ لَا عِوَجَ لَهُۥ وَخَشَعَتِ ٱلْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَٰنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا ١٠٨
১০৯ ) সেদিন সুপারিশ কার্যকর হবে না, তবে যদি করুণাময় কাউকে অনুমতি দেন এবং তার কথা শুনতে পছন্দ করেন। ৮৫
يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَٰنُ وَرَضِىَ لَهُۥ قَوْلًا ١٠٩
১১০ ) -তিনি লোকদের সামনের পেছনের সব অবস্থা জানেন এবং অন্যেরা এর পুরো জ্ঞান রাখে না। ৮৬
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِۦ عِلْمًا ١١٠
৭৭.
এখানে প্রথমত বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ উপদেশ বাণী অর্থাৎ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তার বিধান ও পথ নির্দেশনা গ্রহণে অস্বীকার করবে সে নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। এর ফলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এবং তাঁকে প্রেরণকারী আল্লাহর কোন ক্ষতি হবে না। তার এ নির্বুদ্ধিতা হবে তার নিজেরই সাথে শত্রুতারই নামান্তর। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির কাছে কুরআনের এ নসীহত পৌঁছে গেছে এবং সে এটা গ্রহণ করতে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে ও ইতস্তত করছে সে আখেরাতে শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। আয়াতের শব্দাবলী ব্যাপক অর্থ প্রকাশক। কোন দেশ, জাতিও সময়ের সাথে সেগুলো বিশেষভাবে সম্পর্কিত নয়। যতদিন এ কুরআন দুনিয়ায় থাকবে, যেখানে, যে দেশে এবং জাতি ও ব্যক্তির কাছে এটা পৌঁছে যাবে সেখানে তার জন্য দুটোই পথ খোলা থাকবে। তৃতীয় কোন পথ সেখানে থাকবে না। হয় একে মেনে নিয়ে এর আনুগত্য করতে হবে আর নয়তো একে অস্বীকার করে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। প্রথম পথ অবলম্বনকারী পরিণতি সামনের দিকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় পথ অবলম্বকারীদের পরিণতি এ আয়াতে বাতলে দেয়া হয়েছে।
৭৮.
শিঙ্গা মানে রণভেরী, রণতুর্য। আজকাল এর বিকল্প হিসেবে বিউগল বলা যেতে পারে। সেনাদলকে একত্র ও বিক্ষিপ্ত করার এবং নির্দেশ দেবার জন্য বিউগল বাজানো হয়। আল্লাহ‌ তাঁর বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন যা মানুষের জীবন ব্যবস্থা পরিচালনায় ব্যবহৃত শব্দের সাথে সাদৃশ্য রাখে। এ শব্দ ও পরিভাষাগুলো ব্যবহার করার মূল লক্ষ হচ্ছে আমাদের ধারণা, কল্পনা ও চিন্তাশক্তিকে আসল জিনিসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। আমরা সত্যিই আল্লাহর রাজ্যের বিভিন্ন জিনিসকে হুবহু এ সীমিত অর্থে গ্রহণ করবো এবং সেগুলোকে এসব সীমিত আকারের জিনিস মনে করে নেবো যেমন আমাদের জীবনে পাওয়া যায়, এটা কখনোই এর উদ্দেশ্য নয়। প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত লোকদের জমা করার এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা ঘোষণা করার জন্য এমন কোন না কোন জিনিস বাজানো বা কোন কিছুতে ফুঁক দিয়ে বিকট আওয়াজ সৃষ্টি করা হয় যা রনভেরী, রনতুর্য বা বিউগলের সাথে সাদৃশ্য রাখে। আল্লাহ‌ বলেন, কিয়ামতের দিন এমনি একটি জিনিস ফুঁক দেয়া হবে (যা আমাদের বিউগলের মতো। একবার তাতে ফুঁক দেয়া হবে) তখন সবাই মারা পড়বে। দ্বিতীয়বার ফুঁক দেয়া হবে, তখন সবাই জেগে উঠবে এবং পৃথিবীর সব দিক থেকে বের হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে ছুটে আসতে থাকবে। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামল ১০৬ টীকা)।
৭৯.
মুল শব্দ “যুরকান।” এটা হচ্ছে “আযরাক”-এর বহুবচন। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন যারা ‘আযরাক’বা সাদাটে নীলচে ভাব ধারণ করবে। কারণ ভয়ে ও আতংকে তাদের রক্ত শুকিয়ে যাবে এবং তাদের অবস্থা এমন হয়ে যাবে যেন তাদের শরীরে এক বিন্দুও রক্ত নেই। আবার অন্য কিছু লোক এ শব্দকে “আযরাকুল আয়েন” বা নীল চক্ষুওয়ালার অর্থে গ্রহণ করেছেন। তারা এর অর্থ করেন অত্যাধিক ভয়ে তাদের চোখের মনি থির হয়ে যাবে। যখন কারোর চোখ আলোহীন হয়ে পড়ে তখন তার চোখের মনি সাদা হয়ে যায়।
৮০.
এর আরেকটি মানে এ হতে পারে মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত তোমাদের বড় জোর দশ দিন অতিবাহিত হয়ে থাকবে।” কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থান থেকে জানা যায়, কিয়ামতের দিন লোকেরা নিজেদের দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কেও আন্দাজ করে নেবে যে, তা ছিল অতি সামান্য দিনের এবং মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে সময়কাল অতিবাহিত হয়ে থাকবে সে সম্পর্কেও তাদের এ প্রায় একই ধরনের অনুমান হবে। কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ - قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ

“আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর ছিলে? জবাব দেবে, একদিন বা দিনের এক অংশ থেকেছি, গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করে নিন।” (আল মু’মিনূনঃ ১১২-১১৩)

অন্য জায়গায় বলা হচ্ছেঃ

وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُونَ مَا لَبِثُوا غَيْرَ سَاعَةٍ كَذَلِكَ كَانُوا يُؤْفَكُونَ - وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَالْإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ اللَّهِ إِلَى يَوْمِ الْبَعْثِ فَهَذَا يَوْمُ الْبَعْثِ وَلَكِنَّكُمْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

“আর যেদিন কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন অপরাধীরা কসম খেয়ে খেয়ে বলবে, আমরা (মৃত অবস্থায়) এক ঘণ্টার বেশী সময় পড়ে থাকিনি। এভাবে তারা দুনিয়ায়ও ধোকা খেতে থেকেছে। আর যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছিল তারা বলবে, আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য অনুযায়ী তোমরা তো পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত পড়ে থেকেছো এবং আজ সে পুনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা জানতে না।” (আর-রূমঃ ৫৫-৫৬)

এসব সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে প্রমাণ হয় দুনিয়ার জীবন ও আলমে বরযখের (মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত) জীবন উভয়কে তারা সামান্য মনে করবে। দুনিয়ার জীবন সম্বন্ধে তারা এ কথা এজন্য বলবে যে, নিজেদের আশা-আকাংখার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় একটি চিরন্তন জীবনে যখন তাদের চোখ মেলতে হবে এবং যখন তারা দেখবে এখানকার জন্য তারা কিছুই তৈরী করে আনেনি, তখন চরম আক্ষেপ ও হতাশার সাথে তারা নিজেদের পৃথিবীর জীবনের দিকে ফিরে দেখবে এবং দুঃখ করে বলতে থাকবে, হায়! মাত্র দু’দিনের আনন্দ ও ভোগ বিলাসের লোভে আমরা চিরকালের জন্য নিজেদের পায়ে কুড়াল মারলাম। মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জীবনকাল তাদের কাছে সামান্য মনে হবে, কারণ মৃত্যুপরের জীবনকে তারা দুনিয়ায় অসম্ভব মনে করতো এবং কুরআন বর্ণিত পরকালীন জগতের ভূগোল কখনোই গুরুত্ব সহকারে তাদের কাছে গৃহীত হয়নি। এ ধারণা-কল্পনা নিয়েই তারা দুনিয়ার জীবনের সচেতন মুহূর্তগুলো নিঃশেষ করেছিল। আর এখন হঠাৎ চোখ মেলতেই সামনে দেখবে দ্বিতীয় জীবনের সূচনা। এ জীবনের শুরুতেই বিউগলের বিকট আওয়াজে নিজেদের দেখবে মার্চ করতে করতে এগিয়ে যেতে। ভীষণ আতংকের মধ্যে এখন তারা মনে করতে থাকবে অমুক হাসপাতালে বেহুশ হবার পর থেকে এ পর্যন্ত কতটুকু সময়ই বা কেটে গেছে। তাদের মগজে একথা আসবেই না যে, দুনিয়ায় তারা মারা পড়েছিল এবং এখন সে দ্বিতীয় জীবনটিই শুরু হয়েছে, যাকে তারা একেবারে অর্থহীন ও অযৌক্তিক বলে ঠাট্টা করে হেসে উড়িয়ে দিতো। তাই তাদের প্রত্যেকেই একথা মনে করতে থাকবে, সম্ভবত আমি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম এবং এখন এমন এক সময় আমার চেতনা ফিরে এসেছে অথবা ঘটনাক্রমে এমন এক জায়গায় আমি পৌঁছে গেছি যেখানে কোন রকমের দুর্ঘটনার কারণে লোকেরা একদিকে দৌড়ে চলছে। এটাও অসম্ভব মনে হয় না যে, আজকাল যারা মরছে তারা কিয়ামতের শিংগার আওয়াজকে কিছুক্ষণ পর্যন্ত বিমান আক্রমণের পূর্বের সতর্কতামূলক সাইরেন ধ্বনি বলে মনে করতে থাকবে।

৮১.
এটি একটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। ভাষণের মাঝখানে এর সাহায্যে শ্রোতাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে। শ্রোতাদের মনে এ সন্দেহ জাগার সম্ভাবনা রয়েছে যে, সে সময় হাশরের ময়দানে ছুটে চলা লোকেরা চুপিসারে যে আলাপ করবে তা আজ এখানে কেমন করে বর্ণনা করা হচ্ছে?
৮২.
এটিও একটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। ভাষণের মাঝখানে কোন শ্রোতার প্রশ্নের জবাবে এ বাক্যটি বলা হয়েছে। মনে হয় যখন এ সূরাটি একটি ঐশী ভাষণ হিসেবে শুনানো হচ্ছিল তখন কেই বিদ্রূপ করার জন্য এ প্রশ্নটি উঠিয়েছিল যে, কিয়ামাতের যে চিত্র আপনি আঁকছেন তাতে তো মনে হচ্ছে সারা দুনিয়ার লোকেরা কোন সমতল প্রান্তরের ওপর দিয়ে ছুটে চলতে থাকবে। তাহলে এ বিশালাকৃতির পাহাড়গুলো তখন কোথায় চলে যাবে? এ প্রশ্নের সুযোগটি বুঝার জন্য যে পরিবেশে এ ভাষণ দেয়া হচ্ছিল সেটি সামনে রাখতে হবে। মক্কা যে স্থানে অবস্থিত তার অবস্থা একটি জলাধারের মতো, যার চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। প্রশ্নকারী এ পাহাড়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে একথা বলে থাকবে। অহীর ইশারায় উপস্থিত ক্ষেত্রে তখনই এর এ জবাব দেয়া হয়েছে যে, এ পাহাড়গুলো ভেঙ্গে বালুকা রাশির মতো গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়া হবে এবং সেগুলো ধূলোমাটির মতো সারা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে সমগ্র দুনিয়াকে এমন একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেয়া হবে যেখানে কোন উঁচু নীচু, ঢালু বা অসমতল জায়গা থাকবে না। তার অবস্থা এমন একটি পরিষ্কার বিছানার মতো হবে যাতে সামান্যতমও খাঁজ বা ভাঁজ থাকবে না।
৮৩.
পরকালীন জগতে পৃথিবী যে নতুন রূপ নেবে কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় তা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ইনশিকাকে বলা হয়েছে إِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ ”যখন পৃথিবী বিস্তৃত করে দেয়া হবে।” সূরা ইনফিতারের বলা হয়েছে إِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ “যখন সাগর চিরে ফেলা হবে।” এর অর্থ সম্ভবত এই যে, সমুদ্রের তলদেশ ফেটি যাবে এবং সমস্ত পানি পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগে চলে যাবে। সূরা তাকবীররে বলা হয়েছেঃ إِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ ”যখন সমুদ্র ভরে দেয়া হবে বা সমান করে দেয়া হবে।” এখানে বলা হচ্ছে যে, পাহাড়গুলো ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে সারা পৃথিবীকে একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করা হবে। মনের পাতায় এর যে আকৃতি গড়ে উঠে তা হচ্ছে এই যে, পরকালীন দুনিয়ায় সমস্ত সমুদ্র ভরাট করে, পাহাড়গুলো ভেঙ্গে উঁচু নীচু সমান করে, বন-জংগল সাফ করে পুরোপুরি একটি বলের গাত্রাবরণের মতো সমান ও মসৃণ করে দেয়া হবে। এ আকৃতি সম্পর্কে সূরা ইবরাহীমের ৪৮আয়াতে বলা হয়েছে يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ “এমন দিন যখন পৃথিবীকে পরিবর্তিত করে ভিন্ন কিছু করে দেয়া হবে।” এ আকৃতির পৃথিবীর ওপর হাশর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আল্লাহ‌ সেখানে আদালত তথা ন্যায়বিচার কায়েম করবেন। তারপর সবশেষে তাকে যে আকৃতি দান করা হবে সূরা যুমারের ৭৪ আয়াতে তা এভাবে বলা হয়েছেঃ

وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ

অর্থাৎ মুত্তাকীরা “বলবে, সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমাদের দ্বারা তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদের পৃথিবীর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন। আমরা এ জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা নিজেদের জায়গা বানিয়ে নিতে পারি। কাজেই সৎকর্মশীলদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম প্রতিদান।”

এ থেকে জানা যায়, সবশেষে এ সমগ্র পৃথিবীটিকেই জান্নাতে পরিণত করা হবে এবং আল্লাহর মুত্তাকী ও সৎকর্মশীল বান্দারা হবে এর উত্তরাধিকারী। সে সময় সারা পৃথিবী একটি দেশে পরিণত হবে। পাহাড়-পর্বত, সাগর, নদী, মরুভূমি আজ পৃথিবীকে অসংখ্য দেশে বিভক্ত করে রেখেছে এবং এ সাথে বিশ্বমানবতাকেও বিভক্ত করে দিয়েছে। এগুলোর সেদিন কোন অস্তিত্বই থাকবে না। (উল্লেখ্য, সাহাবা ও তাবেঈদের মধ্যে ইবনে আব্বাস (রা.) ও কাতাদাহও এ মত পোষন করতেন যে জান্নাত এ পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠিত হবে। সূরা নাজম এর عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى - عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى আয়াতের ব্যাখ্যা তারা এভাবে করেন যে, এখানে এমন জান্নাতের কথা বলা হয়েছে যেখানে এখন শহীদদের রূহ রাখা হয়।)

৮৪.
মূলে ‘হাম্স’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি পায়ের আওয়াজ, চুপিচুপি কথা বলার আওয়াজ, উটের চলার আওয়াজ এবং আরো এ ধরনের হালকা আওয়াজের জন্য বলা হয়। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, সেখানে চলাচলকারীদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া চুপিচুপি গুনগুন করে কথা বলার কোন আওয়াজ শোনা যাবে না। চতুর্দিকে একটি ভয়ংকর ভীতিপ্রদ পরিবেশ বিরাজ করবে।
৮৫.
এ আয়াতের দু’টি অনুবাদ হতে পারে। একটি অনুবাদ আমরা অবলম্বন করেছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, “সেদিন সুপারিশ কার্যকর হবে না, তবে যদি কারো পক্ষে করুণাময় এর অনুমতি দেন এবং তার জন্য কথা শুনতে রাজি হয়ে যান।” এখানে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর প্রকৃত ব্যাপারও এই যে, কিয়ামতের দিন কারো সুপারিশ করার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুখ খোলা তো দূরের কথা, টুঁশব্দটি করারও কারোর সাহস হবে না। আল্লাহ‌ যাকে বলার অনুমতি দেবেন একমাত্র সেই-ই সুপারিশ করতে পারবে। এ দু’টি কথা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে। একদিকে বলা হয়েছেঃ

مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

“কে আছে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর সামনে সুপারিশ করতে পারে? ” (আল বাকারাহ, ২৫৫ আয়াত)

আরো বলা হয়েছেঃ

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا

“সেদিন যখন রূহ ও ফেরেশতারা সবাই কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াবে, একটুও কথা বলবে না, শুধুমাত্র সে-ই বলতে পারবে যাকে করুণাময় অনুমতি দেবেন এবং যে ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।” (আন নাবা, ৩৮ আয়াত)

অন্যদিকে বলা হয়েছেঃ

لَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

“আর তারা কারোর সুপারিশ করে না সেই ব্যক্তির ছাড়া যার পক্ষে সুপারিশ শোনার জন্য (রহমান) রাজী হবেন এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে থাকে।” (আল আম্বিয়া, ২৮ আয়াত)

আরো বলা হয়েছেঃ

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

“কত ফেরেশতা আকাশে আছে, তাদের সুপারিশ কোনই কাজে লাগবে না, তবে একমাত্র তখন যখন আল্লাহর কাছ থেকে অনুমতি নেবার পর সুপারিশ করা হবে এবং এমন ব্যক্তির পক্ষে করা হবে যার জন্য তিনি সুপরিশ শুনতে চান এবং পছন্দ করেন। (আন নাজম, ২৬ আয়াত)

৮৬.
সুপারিশের প্রতি এ বিধি-নিষেধ আরোপিত কেন, এর কারণ এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। ফেরেশতা, আম্বিয়া বা আউলিয়া যে-ই হোন না কেন কারো রেকর্ড সম্পর্কে এদের কারো কিছুই জানা নেই এবং জানার কোন ক্ষমতাও এদের নেই। দুনিয়ায় কে কি করতো এবং আল্লাহর আদালতে কে কোন ধরনের ভূমিকা ও কার্যাবলী এবং কেমন দায়িত্বের বোঝা নিয়ে এসেছে তাও কেউ জানে না। অপরদিকে আল্লাহ‌ প্রত্যেকের অতীতের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড জানেন। তার বর্তমান ভূমিকাও তিনি জানেন। সে সৎ হলে কেমন ধরনের সৎ। অপরাধী হলে কোন পর্যায়ের অপরাধী। তার অপরাধ ক্ষমা যোগ্য কি না। সে কি পূর্ণ শাস্তি লাভের অধিকারী অথবা কম শাস্তির। এহেন অবস্থায় কেমন করে ফেরেশতা, নবী ও সৎলোকদেরকে তাদের ইচ্ছা মতো যার পক্ষে যে কোন ধরনের সুপারিশ তারা চায় তা করার জন্য তাদেরকে অবাধ অনুমতি দেয়া যেতে পারে? একজন সাধারণ অফিসার তার নিজের ক্ষুদ্রতম বিভাগে যদি নিজের প্রত্যেকটি বন্ধু ও আত্মীয়ের সুপারিশ শুনতে শুরু করে দেন তাহলে মাত্র চারদিনেই সমগ্র বিভাগটিকে ধ্বংস করে ছাড়বেন। তাহলে আকাশ ও পৃথিবীর শাসনকর্তার কাছ থেকে কেমন করে আশা করা যেতে পারে যে, তার দরবারে ব্যাপকভাবে সুপারিশ চলতে থাকবে এবং প্রত্যেক বুযর্গ সেখানে গিয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করিয়ে আনবেন। অথচ তাদের কেউই যাদের সুপারিশ তারা করছেন তাদের কার্যকলাপ কেমন তা জানেন না। দুনিয়ায় যে কর্মকর্তা দায়িত্বের সামান্যতম অনুভূতিও রাখেন তার কর্মনীতি এ পর্যায়েরই হয়ে থাকে যে, যদি তার কোন বন্ধু তার কোন অধস্তন কর্মচারীর সুপারিশ নিয়ে আসে তাহলে সে তাকে বলে, আপনি জানেন না এ ব্যক্তি কত বড় ফাঁকিবাজ, দায়িত্বহীন, ঘুষখোর ও অত্যাচারী। আমি এর যাবতীয় কীর্তিকলাপের খবর রাখি। কাজেই আপনি মেহেরবানী করে অন্তত আমার কাছে তার সুপারিশ করবেন না। এ ছোট্ট উদাহরণটির ভিত্তিতে অনুমান করা যেতে পারে যে, এ আয়াতে সুপারিশ সম্পর্কে যে নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে তা কতদূর সঠিক, যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করার দরজা বন্ধ হবে না। আল্লাহর সৎ বান্দারা, যারা দুনিয়ায় মানুষের সাথে সহানুভূতিশীল ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলেন তাদেরকে আখেরাতেও সহানুভূতির অধিকার আদায় করার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু তারা সুপারিশ করা আগে অনুমতি চেয়ে নেবেন। যার পক্ষে আল্লাহ‌ তাদেরকে বলার অনুমতি দেবেন একমাত্র তার পক্ষেই তারা সুপারিশ করতে পারবেন। আবার সুপারিশ করার জন্যও শর্ত হবে যে, তা সঙ্গত এবং ন্যায়ভিত্তিক হতে হবে যেমন وَقَالَ صَوَابًا এবং ঠিক কথা বলবে) আল্লাহর এ উক্তিটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, সেখানে আজেবাজে সুপারিশ করার কোন সুযোগ থাকবে না। যেমন একজন দুনিয়ায় শত শত হাজার হাজার লোকের অধিকার গ্রাস করে এসেছে কিন্তু কোন এক বুযুর্গ হঠাৎ উঠে তার পক্ষে সুপারিশ করে দিলেন যে, হে আল্লাহ! তাকে পুরস্কৃত করুন কারণ সে আমার বিশেষ অনুগ্রহ ভাজন।
অনুবাদ: