৭১ ) আর দেখো, আল্লাহ তোমাদের একজনকে আর একজনের ওপর রিযিকের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তারপর যাদেরকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে তারা এমন নয় যে নিজেদের রিযিক নিজেদের গোলামদের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে, যাতে উভয়ে এ রিযিকে সমান অংশীদার হয়ে যায়। তাহলে কি এরা শুধু আল্লাহরই অনুগ্রহ মেনে নিতে অস্বীকার করে? ৬২
وَٱللَّهُ فَضَّلَ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ فِى ٱلرِّزْقِ فَمَا ٱلَّذِينَ فُضِّلُوا۟ بِرَآدِّى رِزْقِهِمْ عَلَىٰ مَا مَلَكَتْ أَيْمَٰنُهُمْ فَهُمْ فِيهِ سَوَآءٌ أَفَبِنِعْمَةِ ٱللَّهِ يَجْحَدُونَ ٧١
৭২ ) আর আল্লাহই তোমাদের জন্য তোমাদের সমজাতীয় স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই এ স্ত্রীদের থেকে তোমাদের পুত্র-পৌত্রাদি দান করেছেন এবং ভালো ভালো জিনিস তোমাদের খেতে দিয়েছেন। তারপর কি এরা (সবকিছু দেখার ও জানার পরও) বাতিলকে মেনে নেয় ৬৩ এবং আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করে?
وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَٰجًا وَجَعَلَ لَكُم مِّنْ أَزْوَٰجِكُم بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ أَفَبِٱلْبَٰطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ ٱللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ ٧٢
৭৩ ) আর তারা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব সত্ত্বার পূজা করে যাদের না আকাশ থেকে তাদের কিছু রিযিক দেবার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, না পৃথিবী থেকে? ৬৪
وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَهُمْ رِزْقًا مِّنَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ شَيْـًٔا وَلَا يَسْتَطِيعُونَ ٧٣
৭৪ ) কাজেই আল্লাহর জন্য সদৃশ তৈরি করো না, ৬৫ আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।
فَلَا تَضْرِبُوا۟ لِلَّهِ ٱلْأَمْثَالَ إِنَّ ٱللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ٧٤
৭৫ ) আল্লাহ একটি উপমা দিচ্ছেন। ৬৬ একজন হচ্ছে গোলাম, যে অন্যের অধিকারভুক্ত এবং নিজেও কোন ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়জন এমন এক ব্যক্তি যাকে আমি নিজের পক্ষ থেকে ভালো রিযিক দান করেছি এবং সে তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খুব খরচ করে। বলো, এরা দু’জন কি সমান? ---আলহামদুলিল্লাহ, ৬৭ কিন্তু অধিকাংশ লোক (এ সোজা কথাটি) জানে না। ৬৮
ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلًا عَبْدًا مَّمْلُوكًا لَّا يَقْدِرُ عَلَىٰ شَىْءٍ وَمَن رَّزَقْنَٰهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا فَهُوَ يُنفِقُ مِنْهُ سِرًّا وَجَهْرًا هَلْ يَسْتَوُۥنَ ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ٧٥
৭৬ ) আল্লাহ আর একটি উপমা দিচ্ছেন। দু’জন লোক। একজন বধির ও বোবা, কোন কাজ করতে পারে না। নিজের প্রভুর ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে আছে। যেদিকেই তাকে পাঠায় কোন ভালো কাজ তার দ্বারা হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয়জন ইনসাফের হুকুম দেয় এবং নিজে সত্য সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত আছে। বলো, এরা দু’জন কি সমান? ৬৯
وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلًا رَّجُلَيْنِ أَحَدُهُمَآ أَبْكَمُ لَا يَقْدِرُ عَلَىٰ شَىْءٍ وَهُوَ كَلٌّ عَلَىٰ مَوْلَىٰهُ أَيْنَمَا يُوَجِّههُّ لَا يَأْتِ بِخَيْرٍ هَلْ يَسْتَوِى هُوَ وَمَن يَأْمُرُ بِٱلْعَدْلِ وَهُوَ عَلَىٰ صِرَٰطٍ مُّسْتَقِيمٍ ٧٦
৭৭ ) আর আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় গোপন সত্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই আছে ৭০ এবং কিয়ামত সংঘটিত হবার ব্যাপারটি মোটেই দেরী হবে না, চোখের পলকেই ঘটে যাবে বরং তার চেয়েও কম সময়ে। ৭১ আসলে আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।
وَلِلَّهِ غَيْبُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَمَآ أَمْرُ ٱلسَّاعَةِ إِلَّا كَلَمْحِ ٱلْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ ٧٧
৭৮ ) আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন, ৭২ যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। ৭৩
وَٱللَّهُ أَخْرَجَكُم مِّنۢ بُطُونِ أُمَّهَٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْـًٔا وَجَعَلَ لَكُمُ ٱلسَّمْعَ وَٱلْأَبْصَٰرَ وَٱلْأَفْـِٔدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ٧٨
৭৯ ) এরা কি কখনো পাখিদের দেখেনি, আকাশ নিঃসীমে কিভাবে তারা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে? আল্লাহ ছাড়া কে তাদেরকে ধরে রেখেছে? এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য।
أَلَمْ يَرَوْا۟ إِلَى ٱلطَّيْرِ مُسَخَّرَٰتٍ فِى جَوِّ ٱلسَّمَآءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا ٱللَّهُ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَٰتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ٧٩
৮০ ) আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরগুলোকে বানিয়েছেন শান্তির আবাস। তিনি পশুদের চামড়া থেকে তোমাদের জন্য এমনসব ঘর তৈরি করে দিয়েছেন ৭৪ যেগুলোকে তোমরা সফর ও স্বগৃহে অবস্থান উভয় অবস্থায়ই সহজে বহন করতে পারো। ৭৫ তিনি পশুদের পশম, লোম ও চুল থেকে তোমাদের জন্য পরিধেয় ও ব্যবহার-সামগ্রীসমূহ সৃষ্টি করেছেন, যা জীবনের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তোমাদের কাজে লাগবে।
وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنۢ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُم مِّن جُلُودِ ٱلْأَنْعَٰمِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَآ أَثَٰثًا وَمَتَٰعًا إِلَىٰ حِينٍ ٨٠
৬২.
বর্তমানকালে এ আয়াত থেকে বড়ই অদ্ভূদ ও উদ্ভট অর্থ বের করা হয়েছে। কুরআনের আয়াতকে তার প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক একটি আয়াতের আলাদা আলাদা অর্থ করলে কেমন অন্তহীন অপব্যাখ্যার দরজা খুলে যায় এটা হচ্ছে তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এক শ্রেণীর পণ্ডিতেরা এ আয়াতটিকে ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শনের বুনিয়াদ এবং অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা গণ্য করেছেন। তাদের মতে আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে, যাদেরকে আল্লাহ রিযিকের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তাদের নিজেদের রিযিক নিজেদের গোলাম ও চাকর বাকরদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া উচিত। যদি বিলিয়ে দেয়া না হয় তাহলে তারা আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকারকারী বলে গণ্য হবে। অথচ এ সমগ্র আলোচনার মধ্যে কোথাও অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা বর্ণনার আদৌ কোন সুযোগই নেই। প্রথম থেকে সমগ্র ভাষণটিই চলছে শিরককে মিথ্যা প্রতিপন্ন ও তাওহীদকে সত্য প্রমাণ করার জন্য এবং সামনের দিকেও এ একই বিষয়বস্তুই একের পর এক এগিয়ে চলছে। এ আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার একটি ধারা বর্ণনা করার কোন সুযোগই কি এখানে আছে? আয়াতকে তার প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রেখে বিচার করলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, এখানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়বস্তুরই আলোচনা চলছে। এখানে একথা প্রমাণ করা হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের ধন-সম্পদে যখন নিজেদের গোলাম ও চাকর বাকরদেরকে সমান মর্যাদা দাও না অথচ এ সম্পদ আল্লাহর দেয়া তখন তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহর সাথে তাঁর ক্ষমতাহীন গোলামদেরকেও শরীক করা এবং ক্ষমতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে আল্লাহর এ গোলামদেরকেও তাঁর সাথে সমান অংশীদার গণ্য করাকে তোমরা কেমন করে সঠিক মনে করো?
সূরা রূমের ২৮ আয়াতে এ একই যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। সেখানে এর শব্দগুলো হচ্ছেঃ
ضَرَبَ لَكُمْ مَثَلًا مِنْ أَنْفُسِكُمْ هَلْ لَكُمْ مِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنْتُمْ فِيهِ سَوَاءٌ تَخَافُونَهُمْ كَخِيفَتِكُمْ أَنْفُسَكُمْ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
“আল্লাহর তোমাদের সামনে আরেকটি উপমা তোমাদের সত্তা থেকেই পেশ করেন। আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তাতে কি তোমাদের গোলাম তোমাদের সাথে শরীক আছে? আর এভাবে শরীক বানিয়ে তোমরা ও তারা কি সমান সমান হয়ে গিয়েছ? এবং তোমরা কি তাদেরকে ঠিক তেমনি ভয় পাও যেমন তোমাদের সমপর্যায়ের লোকদেরকে ভয় পাও? এভাবে আল্লাহ খুলে খুলে নিশানী বর্ণনা করেন তাদের জন্য যারা বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগায়।”
দু’টি আয়াতের তুলনামূলক আলোচনা করলে পরিষ্কার জানা যায়, উভয় স্থানেই একই উদ্দেশ্য, একই উপমা বা দৃষ্টান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এদের একটি অন্যটির ব্যাখ্যা করছে।
সম্ভবত أَفَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ বাক্যাংশ থেকেই ঐ বুদ্ধিজীবীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। উপমা বর্ণনার পর সাথে সাথেই এ বাক্যাংশটি দেখে তারা মনে করেছে নিশ্চয়ই এর অর্থ এই হবে যে অধীনস্থদের মধ্যে রিযিক বিলিয়ে না দেয়াটাই মূলত আল্লাহর নিয়ামতের অস্বীকৃতি। অথচ যে ব্যক্তি কুরআনে সামান্য পারদর্শিতাও রাখেন তিনিই জানেন যে আল্লাহর নিয়ামতের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য সত্তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো এ কিতাবের দৃষ্টিতে আল্লাহর নিয়ামতের অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বিষয়টির কুরআনে এত বেশী পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে, তিলাওয়াত ও চিন্তা গবেষণায় অভ্যস্ত লোকেরা এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন না। অবশ্যি সূচীপত্রের সাহায্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ রচনাকারীগণ এ ব্যাপারটি নাও জানতে পারেন।
আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকৃতির এই তাৎপর্যটি অনুধাবন করার পর এ বাক্যাংশের অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, এরা যখন প্রভু ও গোলামের পার্থক্য ভাল করেই জানে এবং নিজেদের জীবনে সর্বক্ষণ এ পার্থক্যের দিকে নজর রাখে তখন একমাত্র আল্লাহর ব্যাপারেই কি এরা এত অবুঝ হয়ে গেছে যে, তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর সাথে শরীক ও তাঁর সমকক্ষ মনে করার এবং তাঁর কাছ থেকে এরা যেসব নিয়ামত লাভ করেছে সেগুলোর জন্য তাঁর বান্দাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোকে জরুরী মনে করে?
৬৩.
‘বাতিলকে মেনে নেয়’ অর্থাৎ এ ভিত্তিহীন ও অসত্য বিশ্বাস পোষণ করে যে, তাদের ভাগ্য ভাঙা-গড়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা, সন্তান দেয়া, রুজি রোজগার দেয়া বিচার-আচার ও মামলা-মোকদ্দমায় জয়লাভ করানো এবং রোগ-শোক থেকে বাঁচানোর ব্যাপারটি কতিপয় দেব-দেবী, জিন এবং অতীতের বা পরবর্তীকালের কোন মহাপুরুষের হাতে রয়েছে।
৬৪.
এসব নিয়ামত আল্লাহর দেয়া, একথা যদিও মক্কায় মুশরিকরা অস্বীকার করতো না এবং এসব নিয়ামতের ব্যাপারে আল্লাহর অনুগ্রহ মেনে নিতেও তারা গররাযী ছিল না কিন্তু তারা যে ভুলটা করতো সেটা ছিল এ যে, এই নিয়ামতগুলোর ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সাথে সাথে তারা নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে এমন বহু সত্তার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো যাদেরকে তারা কোন প্রকার প্রমাণ ও সনদপত্র ছাড়াই এ নিয়ামতগুলো প্রদানের ক্ষেত্রে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছিল। এ জিনিসটিকেই কুরআন “আল্লাহর অনুগ্রহের অস্বীকৃতি” বলে গণ্য করছে। যে উপকার করলো, তার উপকারের জন্য যে উপকার করেনি তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মূলত উপকারীর উপকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর, কুরআনে এ কথাটিকে একটি সাধারণ নীতি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে কুরআন একথাটিকেও একটি মূলনীতি হিসেবে বর্ণনা করছে যে, বিনা যুক্তি-প্রমাণে উপকারী সম্পর্কে ধারণা করা যে, তিনি নিজ অনুগ্রহ ও দয়ার বশে এ উপকার করেননি বরং অমুক ব্যক্তির অছিলায় বা অমুক ব্যক্তির সুবিধার্থে অথবা অমুক ব্যক্তির সুপারিশক্রমে কিংবা অমুকের হস্তক্ষেপ করার কারণে এ উপকার করেছেন, এটাও মূলত তার উপকারের প্রতি অস্বীকৃতিরই শামিল।
ইনসাফ ও সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি এ মৌলিক কথা দু’টিকে পুরোপুরি সমর্থন করে। সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিই এর যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পারে। মনে করুন, কোন অভাবী ব্যক্তির প্রতি করুণা করে আপনি তাকে সাহায্য করলেন এবং সে তখনই উঠে দাঁড়িয়ে এমন এক ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো যার এ সাহায্যে কোন হাতই ছিল না। এ অবস্থায় আপনি নিজের উদার মনোবৃত্তির কারণে তার এ অবাঞ্ছিত আচরণকে যতই উপেক্ষা করুন না কেন এবং আগামীতে নিজের সাহায্য যতই জারী রাখুন না কেন, তবুও মনে মনে নিশ্চয়ই ভাববেন এ লোকটি আসলে বড়ই নির্লজ্জ ও অকৃতজ্ঞ। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ করে যদি আপনি জানতে পারেন, তার এ কাজটি করার কারণ এই ছিল যে, সে মনে করে, আপনি তাকে কিছু সাহায্য করেছেন তার পেছনে আপনার সততা ও দানশীলতার মনোবৃত্তি কার্যকর ছিল না বরং সবকিছু করেছিলেন ঐ ব্যক্তির খাতিরে, অথচ আসল ঘটনা তা ছিল না, তাহলে এক্ষেত্রে আপনি নিশ্চয়ই একে নিজের অপমান মনে করবেন। আপনার কাছে তার এ উদ্ভট ব্যাখ্যার অর্থ এ হবে যে, সে আপনার সম্পর্কে বড়ই ভুল ধারণা রাখে এবং আপনাকে দয়ার্দ্র ও স্নেহশীল বলে মনে করে না। বরং আপনাকে মনে করে একজন বন্ধু বৎসল লোক। বন্ধুর কথায় আপনি ওঠা বসা করেন। কয়েকজন পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে যদি কেউ এসে যায় তাহলে আপনি সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের খাতিরে তাকে সাহায্য করেন অন্যথায় আপনার আঙুলের ফাঁক দিয়ে দানের একটা সিকিও গলতে পারে না।
৬৫.
‘আল্লাহর জন্য সদৃশ তৈরী করো না’--- অর্থাৎ আল্লাহকে দুনিয়ার রাজা-মহারাজা ও বাদশাহ-শাহানশাহদের সমপর্যারে রেখে বিচার করো না। রাজা-বাদশাহদের অনুচর, সভাসদ ও মোসাহেবদের মাধ্যম ছাড়া তাদের কাছে কেউ নিজের আবেদন নিবেদন পৌঁছাতে পারে না। ঠিক তেমনি আল্লাহর ব্যাপারেও তোমরা এ ধারণা করতে থাকো যে, তিনি নিজের শাহী মহলে ফেরেশতা, আউলিয়া ও অন্যান্য সভাসদ পরিবৃত হয়ে বিরাজ করছেন এবং এদের মাধ্যমে ছাড়া তাঁর কাছে কারোর কোন কাজ সম্পন্ন হতে পারে না।
৬৬.
অর্থাৎ যদি উপমার সাহায্যে কথা বুঝতে হয় তাহালে আল্লাহ সঠিক উপমা দিয়ে তোমাদের সত্য বুঝিয়ে দেন। তোমরা যেসব উপমা দিচ্ছো সেগুলো ভুল। তাই তোমরা সেগুলো থেকে ভুল ফলাফল গ্রহণ করে থাকো।
৬৭.
প্রশ্ন ও আলহাম্দুলিল্লাহ এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ফাঁক রয়ে গেছে। এ ফাঁক পূরণ করার জন্য আলহাম্দুলিল্লাহ এর মধ্যেই একটি তাৎপর্যময় ইঙ্গিত রয়ে গেছে। একথা সুস্পষ্ট যে, নবীর মুখ থেকে একথা শুনে মুশরিকদের পক্ষে এ দু’টি সমান এ ধরনের জবাব দেয়া কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। নিশ্চয়ই এর জবাবে কেউ না কেউ পরিষ্কারভাবে একথা স্বীকার করে থাকতে পারে যে, আসলে দু’টি সমান নয়। আবার কেউ এ ভয়ে নীরবতা অবলম্বন করে থাকতে পারে যে, স্বীকারোক্তিমূলক জবাব দেবার মাধ্যমে তার অনিবার্য ফলাফলকেও স্বীকার করে নিতে হবে এবং এর ফলে স্বতস্ফূর্তভাবেই তাদের শিরক বাতিল হয়ে যাবে। কাজেই নবী উভয়ের জবাব পেয়ে বললেন, আলহাম্দুল্লিল্লাহ। স্বীকারকারীদের স্বীকারোক্তির পরও আলহাম্দুল্লিল্লাহ এবং নীরবতা পালনকারীদের নীরবতার ওপরও আলহাম্দুলিল্লাহ। প্রথম অবস্থাটিতে এর অর্থ হয় “আল্লাহর শোকর অন্তত এতটুকু কথা তো তোমরা বুঝতে পেরেছো।” দ্বিতীয় অবস্থায় এর অর্থ হয়, “নীরব হয়ে গেছে? আলহাম্দুলিল্লাহ, নিজেদের সমস্ত হঠকারিতা সত্ত্বেও দু’টি অবস্থা সমান বলে দেবার হিম্মত তোমাদেরও নেই।”
৬৮.
অর্থাৎ যদিও তারা মানুষের মধ্যে ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাধরের মধ্যকার পার্থক্য অনুভব করে এবং এ পার্থক্য সামনে রেখেই প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা আচরণ করে, তবুও তারা এমনি মূর্খ ও অবুঝ সেজে আছে যে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার পার্থক্য তারা বুঝতে পারে না। স্রষ্টার সত্তা, গুণাবলী, অধিকার, শক্তিমত্তা সবকিছুতেই তারা সৃষ্টিকে শরীক মনে করছে এবং সৃষ্টির সাথে এমন আচরণ করছে যা একমাত্র স্রষ্টার সাথেই করা যেতে পারে। উপায় উপকরণের ওপর নির্ভরশীল এ জগতে কারোর কাছে কোন জিনিস চাইতে হলে আমরা গৃহম্বামীর কাছেই চেয়ে থাকি, চাকর বাকরদের কাছে চাই না। কিন্তু সমগ্র দয়া-দাক্ষিণ্যের উৎস যেই সত্তা, তার কাছ থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যখন সচেষ্ট হই, তখন সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিককে বাদ দিয়ে তাঁর বান্দাদের কাছে হাত পাতি।
৬৯.
প্রথম উপমায় আল্লাহ ও বানোয়াট মাবুদদের পার্থক্যটা কেবলমাত্র ক্ষমতা ও অক্ষমতার দিক দিয়ে সুস্পষ্ট করা হয়েছিল। এখন এ দ্বিতীয় উপমায় সেই পার্থক্যটিকে আরো বেশী সুস্পষ্ট করে গুণাবলীর দৃষ্টিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ও এ বানোয়াট মাবুদদের মধ্যে ফারাক শুধুমাত্র এতটুকুই নয় যে, একজন ক্ষমতাধর মালিক এবং অন্যজন ক্ষমতাহীন গোলাম বরং এছাড়াও তাদের মধ্যে এ ফারাকটিও রয়েছে যে, এ গোলাম তোমাদের ডাকও শোনে না। তার নিজের সারাটি জীবন তার মালিক ও প্রভুর সত্তার ওপর নির্ভরশীল। আর প্রভু যদি তার ওপর কোন কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে সে কিছুই করতে পারে না। অন্যদিকে প্রভুর অবস্থা হচ্ছে এই যে, তিনি কেবল বক্তাই নন বরং জ্ঞানী বক্তা। তিনি দুনিয়াকে ইনসাফের হুকুম দেন। তিনি কেবল কাজ করার ক্ষমতাই রাখেন না বরং যা করেন তা সঠিক ও ন্যায়সঙ্গতভাবেই করেন, সততা ও নির্ভুলতার সাথে করেন। তাহলে বলো, এ ধরনের প্রভু ও গোলামকে তোমরা সমান মনে করো কেমন করে? এটা তোমাদের কোন্ ধরনের বুদ্ধিমত্তা?
৭০.
পরবর্তী বাক্য থেকে বুঝা যায়, এটি আসলে মক্কার কাফেরদের একটি প্রশ্নের জবাব। তারা প্রায়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করতো, তুমি আমাদের যে কিয়ামতের আগমনের খবর দিচ্ছো তা যদি সত্যি সত্যিই আসে, তাহলে তা কবে কোন্ তারিখে আসবে? এখানে প্রশ্ন উদ্ধৃত না করে তার জবাব দেয়া হচ্ছে।
৭১.
অর্থাৎ কিয়ামত আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে কোন দীর্ঘকালীন পর্যায়ে সংঘটিত হবে না। তার আসার আগে তোমরা দূর থেকে তাকে আসতে দেখবে না এবং এর মাঝখানে তোমরা নিজেদেরকে সামলে নিয়ে তার জন্য কিছু প্রস্তুতিও করতে পারবে না। যেকোন দিন যেকোন মুহূর্তে চোখের পলকে বা তার চেয়েও কম সময়ে তা এসে যাবে। কাজেই যে চিন্তা-ভাবনা করতে চায় তার গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত এবং নিজের মনোভাব ও কর্মনীতি সম্পর্কে যে ফায়সালাই করতে হয় শীঘ্রই করা দরকার। “এখন তো কিয়ামত অনেক দূরে, যখন তা আসতে থাকবে তখনই আল্লাহর সাথে একটা মিটমাট করে নেবো,” কারো এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে তার ওপর ভরসা করে বসে থাকা উচিত নয়। তাওহীদ সম্পর্কে ভাষণ দিতে দিতে তার মাঝখানে হঠাৎ এভাবে কিয়ামতের আলোচনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, লোকেরা যেন তাওহীদ ও শিরকের মাঝখানে কোন একটি আকীদা নির্বাচন করার ব্যাপারটিকে নিছক একটি তাত্বিক ব্যাপার মনে না করে বসে। তাদের এ অনুভূতি থাকা উচিত যে, কোন অজ্ঞাত মুহূর্তে যে কোন সময় হঠাৎ একটি ফায়সালার সময় এসে যাবে এবং সে সময় এ নির্বাচনের সঠিক বা ভুল হওয়ার ওপর মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করবে। এ সতর্কবাণীর পর আবার আগে থেকে চলে আসা সেই একই আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
৭২.
অর্থাৎ এমনসব উপকরণ যার সাহায্যে তোমরা দুনিয়ায় সব রকমের জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহ করে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ কাম চালাবার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছো। জন্মকালে মানব সন্তান যত বেশী অসহায় ও অজ্ঞ হয় এমনটি অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপকরণাদির (শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, বিবেক ও চিন্তাশক্তি) সাহায্যেই সে উন্নতি লাভ করে পৃথিবীর সকল বস্তুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং তাদের ওপর রাজত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করে।
৭৩.
অর্থাৎ যে আল্লাহ তোমাদের এসব অগণিত নিয়ামত দান করেছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এ নিয়ামতগুলোর ব্যাপারে এর চেয়ে বেশী অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে যে, এ কান দিয়ে মানুষ সব কিছু শোনে কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর কথা শোনে না, এ চোখ দিয়ে সবকিছু দেখে কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখে না এবং এ মস্তিস্ক দিয়ে সবকিছু চিন্তা করে কিন্তু শুধুমাত্র একথা চিন্তা করে না যে, আমার যে অনুগ্রহকারী আমার প্রতি এসব অনুগ্রহ করেছেন তিনি কে?
৭৪.
অর্থাৎ পশুচর্মের তাঁবু। আরবে এর ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
৭৫.
অর্থাৎ যখন কোথাও রওয়ানা হয়ে যেতে চাও তখন তাকে সহজে গুটিয়ে ভাঁজ করে নিয়ে বহন করতে পারো। আবার যখন কোথাও অবস্থান করতে চাও তখন অতি সহজেই ভাঁজ খুলে খাঁটিয়ে ঘর বানিয়ে ফেলতে পারো।