আন্ নাহল

১২৮ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৬১ ) আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের বাড়াবাড়ি করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করতেন তাহলে ভূপৃষ্ঠে কোন একটি জীবকেও ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি সবাইকে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। তারপর যখন সেই সময়টি এসে যায় তখন তা থেকে এক মুহূর্তও আগে পিছে হতে পারে না।
وَلَوْ يُؤَاخِذُ ٱللَّهُ ٱلنَّاسَ بِظُلْمِهِم مَّا تَرَكَ عَلَيْهَا مِن دَآبَّةٍ وَلَٰكِن يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰٓ أَجَلٍ مُّسَمًّى فَإِذَا جَآءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَـْٔخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ ٦١
৬২ ) আজ এরা দু’টি জিনিস আল্লাহর জন্য স্থির করছে যা এরা নিজেদের জন্য অপছন্দ করে। আর এদের কণ্ঠ মিথ্যা উচ্চারণ করে যে, এদের জন্য শুধু মঙ্গলই মঙ্গল। এদের জন্য তো শুধু একটি জিনিসই আছে এবং তা হচ্ছে দোযখের আগুন। নিশ্চয়ই এদেরকে সবার আগে তার মধ্যে পৌঁছানো হবে।
وَيَجْعَلُونَ لِلَّهِ مَا يَكْرَهُونَ وَتَصِفُ أَلْسِنَتُهُمُ ٱلْكَذِبَ أَنَّ لَهُمُ ٱلْحُسْنَىٰ لَا جَرَمَ أَنَّ لَهُمُ ٱلنَّارَ وَأَنَّهُم مُّفْرَطُونَ ٦٢
৬৩ ) আল্লাহর কসম, হে মুহাম্মাদ! তোমার আগেও বহু জাতির মধ্যে আমি রসূল পাঠিয়েছি। (এর আগেও এ রকমই হতো) শয়তান তাদের খারাপ কার্যকলাপকে তাদের সামনে সুশোভন করে দেখিয়েছে (এবং রসূলদের কথা তারা মানেনি) । সেই শয়তানই আজ এদেরও অভিভাবক সেজে বসে আছে এবং এরা মর্মন্তুদ শাস্তির উপযুক্ত হচ্ছে।
تَٱللَّهِ لَقَدْ أَرْسَلْنَآ إِلَىٰٓ أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَزَيَّنَ لَهُمُ ٱلشَّيْطَٰنُ أَعْمَٰلَهُمْ فَهُوَ وَلِيُّهُمُ ٱلْيَوْمَ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣
৬৪ ) আমি তোমার প্রতি এ কিতাব এজন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি এ মতভেদের তাৎপর্য এদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরো। যার মধ্যে এরা ডুবে আছে। এ কিতাব পথনির্দেশ ও রহমত হয়ে নাযিল হয়েছে তাদের জন্য যারা একে মেনে নেবে। ৫৩
وَمَآ أَنزَلْنَا عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِى ٱخْتَلَفُوا۟ فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ٦٤
৬৫ ) (তুমি দেখছো প্রত্যেক বর্ষাকালে) আল্লাহ‌ আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন এবং তার বদৌলতে তিনি সহসাই মৃত জমিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটি নিদর্শন রয়েছে যারা শোনে তাদের জন্য। ৫৩(ক)
وَٱللَّهُ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً فَأَحْيَا بِهِ ٱلْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَآ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَةً لِّقَوْمٍ يَسْمَعُونَ ٦٥
৬৬ ) আর তোমাদের জন্য গবাদি পশুর মধ্যেও একটি শিক্ষা রয়েছে। তাদের পেট থেকে গোবর ও রক্তের মাঝখানে বিদ্যমান একটি জিনিস আমি তোমাদের পান করাই, অর্থাৎ নির্ভেজাল দুধ, ৫৪ যা পানকারীদের জন্য বড়ই সুস্বাদু ও তৃপ্তিকর।
وَإِنَّ لَكُمْ فِى ٱلْأَنْعَٰمِ لَعِبْرَةً نُّسْقِيكُم مِّمَّا فِى بُطُونِهِۦ مِنۢ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَّبَنًا خَالِصًا سَآئِغًا لِّلشَّٰرِبِينَ ٦٦
৬৭ ) (অনুরূপভাবে) খেজুর গাছ ও আংগুর লতা থেকেও আমি একটি জিনিস তোমাদের পান করাই, যাকে তোমরা মাদকেও পরিণত করো এবং পবিত্র খাদ্যেও। ৫৫ বুদ্ধিমানদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে একটি নিশানী।
وَمِن ثَمَرَٰتِ ٱلنَّخِيلِ وَٱلْأَعْنَٰبِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَةً لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ٦٧
৬৮ ) আর দেখো তোমার রব মৌমাছিদেরকে একথা অহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেনঃ ৫৬ তোমরা পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মাচার ওপর ছড়ানো লতাগুল্মে নিজেদের চাক নির্মাণ করো।
وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى ٱلنَّحْلِ أَنِ ٱتَّخِذِى مِنَ ٱلْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ ٱلشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ ٦٨
৬৯ ) তারপর সব রকমের ফলের রস চোসো এবং নিজের রবের তৈরি করা পথে চলতে থাকো। ৫৭ এ মাছির ভেতর থেকে একটি বিচিত্র রংগের শরবত বের হয়, যার মধ্যে রয়েছে নিরাময় মানুষের জন্য। ৫৮ অবশ্যি এর মধ্যেও একটি নিশানী রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে। ৫৯
ثُمَّ كُلِى مِن كُلِّ ٱلثَّمَرَٰتِ فَٱسْلُكِى سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا يَخْرُجُ مِنۢ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَٰنُهُۥ فِيهِ شِفَآءٌ لِّلنَّاسِ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ٦٩
৭০ ) আর দেখো, আল্লাহ‌ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যুদান করেন, ৬০ আবার তোমাদের কাউকে নিকৃষ্টতম বয়সে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়, যখন সবকিছু জানার পরেও যেন কিছুই জানে না। ৬১ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আল্লাহই জ্ঞানেও পরিপূর্ণ এবং ক্ষমতায়ও।
وَٱللَّهُ خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّىٰكُمْ وَمِنكُم مَّن يُرَدُّ إِلَىٰٓ أَرْذَلِ ٱلْعُمُرِ لِكَىْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْـًٔا إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ٧٠
৫৩.
অন্য কথায় এ কিতাব নাযিল হওয়ার কারণে এরা একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেছে। কল্পনা, ভাব-বিলাস, কুসংস্কার ও অন্ধ অনুকরণের ভিত্তিতে যে অসংখ্য ও বিভিন্ন মতবাদ ও ধর্মে এরা বিভক্ত হয়ে গেছে সেগুলোর পরিবর্তে সবাই একমত হতে পারে সত্যের এমন একটি স্থায়ী বুনিয়াদ এদের নাগালের ভেতরে এসে গেছে। এখন এ নিয়ামতটি এসে যাওয়ার পরও যারা অতীতের অবস্থাকেই প্রাধান্য দিয়ে যাওয়ার মত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছে তাদের পরিণাম ধ্বংস ও লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছু নয়। এখন যারা এ কিতাবকে মেনে নেবে একমাত্র তারাই সত্য-সরল পথ পাবে এবং তারাই অঢেল রবকত ও রহমতের অধিকারী হবে।
৫৩(ক).
অর্থাৎ প্রতি বছর তোমাদের চোখের সামনে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে, পৃথিবী একটি নিরস বিশুষ্ক প্রান্তরের মত পড়ে আছে। সেখানে জীবনের স্পন্দন নেই। ঘাস-লতা-গুল্ম-পাতা-সবুজের চিহ্নই নেই। নেই কোন ধরনের পোকা মাকড়ের অস্তিত্ব। এ সময় এসে গেলো বর্ষার মওসুম। দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি আকাশ থেকে নেমে আসাতেই এ মরা যমীনের বুক চিরে জীবনের তরংগ জেগে উঠতে থাকে। যমীনের বিভিন্ন স্তরে জমে থাকা অসংখ্য বীজ সহসাই জেগে ওঠে। তাদের প্রত্যেকের মধ্য থেকে গত বর্ষায় জন্মলাভ করার পর মরে যাওয়া উদ্ভিদগুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। গরমের মওসুমে নাম নিশানা পর্যন্ত মুছে গিয়েছিল এমন সব অগণিত মৃত্তিকার কীট অকস্মাৎ আবার দেখা যায় যেমন বিগত বর্ষায় দেখা গিয়েছিল। নিজেদের জীবনে তোমরা এসব বারবার দেখতে থাকো। এরপরও নবীর মুখ থেকে একথা শুনে অবাক হয়ে যাও যে, আল্লাহ মৃত্যুর পর সমস্ত মানুষকে পুনর্বার জীবিত করবেন। এ অবাক হওয়ার কারণ এছাড়া আর কী হতে পারে যে, তোমাদের পর্যবেক্ষণ বুদ্ধি-জ্ঞানহীন পশুদের পর্যবেক্ষণের মতই। তোমরা বিশ্ব-জাহানের বিস্ময়কর চমৎকারিত্ব দেখো কিন্তু তার পেছনে স্রষ্টার ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার নিদর্শন গুলো দেখো না। অন্যথায় নবীর বর্ণনা শোনার পর তোমাদের মন অনিবার্যভাবে চিৎকার করে বলে উঠতো যে, ‘এসব নিদর্শন যথার্থই নবীর বর্ণনাকে সমর্থন করে’।
৫৪.
“গোবর ও রক্তের মধ্যস্থিত”---এর অর্থ হচ্ছে, পশু যে খাদ্য খায় তা থেকে তো একদিকে রক্ত তৈরী হয় এবং অন্যদিকে তৈরী হয় মলমূত্র। কিন্তু এ পশুদের স্ত্রী জাতির মধ্যে আবার এ একই খাদ্য থেকে তৃতীয় একটি জিনিসও তৈরী হয়। বর্ণ, গন্ধ, গুণ উপকারিতা ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে আগের দু’টি থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা। তারপর বিশেষ করে গবাদি পশুর মধ্যে এর উৎপাদন এত বেশী হয় যে, তারা নিজেদের সন্তানদের প্রয়োজন পূর্ণ করার পর মানুষের জন্য এ উৎকৃষ্টতম খাদ্য বিপুল পরিমাণে সরবরাহ করতে থাকে।
৫৫.
এখানে আনুসঙ্গিকভাবে এ ব্যাপারেও একটি পরোক্ষ আভাস দেয়া হয়েছে যে, ফলের এ রসের মধ্যে এমন উপাদানও রয়েছে যা মানুষের জন্য জীবনদায়ী খাদ্য পরিণত হতে পারে, আবার এমন উপাদানও আছে যা পচে মাদক দ্রব্যে পরিণত হয়। এখন মানুষ এ উৎসটি থেকে পাক-পবিত্র রিযিক গ্রহণ করবে, না বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে বিনষ্টকারী মদ গ্রহণ করবে, তা তার নিজের নির্বাচন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। শরাব বা মদ যে পাক-পবিত্র রিযিক নয়, এখানে তাও জানা গেলো এবং এটি তার হারাম হওয়ার দিকে আর একটি পরোক্ষ ইঙ্গিত।
৫৬.
অহীর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ‘ইলকা’ (মনের মধ্যে কোন কথা নিক্ষেপ করা) ও ইলহাম (গোপন শিক্ষা ও উপদেশ দান করা) অর্থে ব্যবহৃত হয়। মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে যে শিক্ষা দান করেন তা যেহেতু কোন মকতব, স্কুল বা শিক্ষায়তনে দেয়া হয় না বরং এমন সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে দেয়া হয় যে, বাহ্যত কাউকে শিক্ষা দিতে এবং কাউকে শিক্ষা নিতে দেখা যায় না, তাই একে কুরআনে অহী, ইলকা ও ইলহাম শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। এখন এ তিনটি শব্দ আলাদা আলাদা পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। অহী শব্দটি নবীদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ইলহামকে আউলিয়া ও বিশেষ বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর ইলকা শব্দটি অপেক্ষাকৃত ব্যাপক অর্থবোধক এবং সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

কিন্তু কুরআনে এ পারিভাষিক অর্থের পার্থক্যটা পাওয়া যায় না। এখানে আকাশের ওপরও অহী নাযিল হয় এবং সেই অনুযায়ী তার সব ব্যবস্থা পরিচালিত হয় (وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاءٍ أَمْرَهَا– حم السجده) পৃথিবীর ওপরও অহী নাযিল হয় এবং এর ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথেই সে নিজের কাহিনী শুনাতে থাকে (يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا - بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا– الزلزل) ফেরেশতাদের ওপরও অহী নাযিল হয় এবং সেই মোতাবেক তারা কাজ করে (إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ–الانفال) মৌমাছিদেরকে তাদের সমস্ত কাজ অহীর (প্রকৃতিগত শিক্ষা) মাধ্যমে শেখানো হয়। আলোচ্য আয়াতে এ বিষয়টিই দেখা যাচ্ছে। আর এই অহী কেবলমাত্র মৌমাছি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই বরং মাছের সাঁতার কাটা, পাখির উড়ে চলা, নবজাত শিশুর দুধ পান করার বিষয়টাও আল্লাহর অহীই শিক্ষা দান করে। তাছাড়া চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা অনুসদ্ধান ছাড়াই একজন মানুষকে যে অব্যর্থ কৌশল বা নির্ভুল মত অথবা চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথ বুঝানো হয় তাও অহী। (وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيهِ– القصص) এ অহী থেকে কোন একজন মানুষও বঞ্চিত নয়। দুনিয়ায় যত নতুন নতুন উদ্ভাবন ও কল্যাণকর আবিষ্কার হয়েছে যত বড় বড় শাসক, বিজেতা, চিন্তানায়ক ও লেখক যুগান্তকারী ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী কর্ম সম্পাদন করেছেন তার সবের পেছনেই এ অহীর কার্যকারিতা দেখা যায়। বরং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত যে অভিজ্ঞতার সুম্মুখীন হয় তা হচ্ছে এই যে, কখনো বসে বসে একটি কথা মনে হলো অথবা কোন কৌশল মাথায় এলো কিংবা স্বপ্নে কিছু দেখা দেলো এবং পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেলো যে, অদৃশ্য থেকে পাওয়া সেটি তার জন্য একটি সঠিক পথনির্দেশনা ছিল।

এ বিভিন্ন ধরনের অহীর মধ্যে নবীদেরকে যে অহী করা হতো সেটি ছিল একটি বিশেষ ধরনের অহী। এ অহীটির বৈশিষ্ট্য অন্যান্য অহী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এতে যাকে অহী করা হয় সে এ অহী আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ও নিশ্চিত থাকে। এ অহী হয় আকীদা-বিশ্বাস, বিধি-বিধান, আইন-কানুন ও নির্দেশাবলী সংক্রান্ত। আর নবী এ অহীর মাধ্যমে মানব সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ দেবেন এটিই হয় এর নাযিল করার উদ্দেশ্য।

৫৭.
‘রবের তৈরী করা পথে’ বলে মৌমাছিদের একটি দল যে ব্যবস্থা ও কর্মপদ্ধতির আওতাধীনে কাজ করে সেই সমগ্র ব্যবস্থা ও কর্মপদ্ধতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মৌচাকের আকৃতি ও কাঠামো, তাদের দল গঠন প্রক্রিয়া, তাদের বিভিন্ন কর্মীর মধ্যে কর্মবন্টন, তাদের আহার সংগ্রহের জন্য অবিরাম যাওয়া-আসা এবং তাদের নিয়ম মাফিক মধু তৈরী করে তা ক্রমাগত গুদামে সঞ্চয় করতে থাকা--- এসব হচ্ছে সেই পথ যা তাদের রব তাদের কাজ করার জন্য এমনভাবে সুগম করে দিয়েছেন যে, তাদের কখনো এ ব্যাপারে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন হয় না। এটা একটা নির্ধারিত ব্যবস্থা। এরই ভিত্তিতে একটি বাঁধাধরা নিয়মে এ অগণিত চিনিকলগুলো হাজার হাজার বছর ধরে কাজ করে চলছে।
৫৮.
মধু যে একটি উপকারী ও সুস্বাদু খাদ্য তা কারোর অজানা নেই। তাই একথাটি এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তাবে তার মধ্যে যে রোগ নিরাময় শক্তি আছে একথাটা তুলনামূলকভাবে একটি অজানা বিষয়। এজন্য একথাটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। মধু প্রথমত কোন কোন রোগে এমনিতেই উপকারী। কেননা, তার মধ্যে রয়েছে ফুল ও ফলের রস এবং তাদের উন্নত পর্যায়ের গ্লুকোজ। তারপর মধুর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা নিজে কখনো পচে না এবং অন্য জিনিসকেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজের মধ্যে পচন থেকে সংরক্ষিত রাখে। এর ফলে ঔষধ তৈরী করার জন্য তার সাহায্য গ্রহণ করার মত যোগ্যতা তার মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়। এজন্যই ঔষধ নির্মাণ শিল্পে অ্যাল-কোহলের পরিবর্তে মধুর ব্যবহার শত শত বছর থেকে চলে আসছে। তাছাড়া মৌমাছি যদি এমন কোন এলাকায় কাজ করে যেখানে কোন বিশেষ ধরনের বনৌষধি বিপুল পরিমাণ পাওয়া যায় তাহলে সেই এলাকার মধু নিছক মধুই হয় না বরং তা ঐ ঔষধির সর্বোত্তম উপাদান ধারণ করে এবং যে রোগের ঔষধ আল্লাহ ঐ ঔষধির মধ্যে তৈরী করেছেন তার জন্যও তা উপকারী হয়। যদি যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী মৌমাছিদের সাহায্যে এ কাজ করানো হয় এবং বিভিন্ন ঔষধি বৃক্ষের উপাদান তাদের সাহায্যে বের করে তাদের মধু আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষিত হয় তাহলে আমাদের মতে এ মধু ল্যাবরেটরিতে তৈরী উপাদানের চেয়ে বেশী উপকারী প্রমাণিত হবে।
৫৯.
এ গোটা বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত দ্বিতীয় অংশের সত্যতা সপ্রমাণ করা। দু’টি কারণেই কাফের ও মুশরিকরা তাঁর বিরোধিতা করতো। এক, তিনি পরকালীন জীবনের ধারণা পেশ করেন। এ ধারণা চরিত্র ও নৈতিকতার সমগ্র নকশাটাই বদলে দেয়। দুই, তিনি কেবল মাত্র এক আল্লাহকেই মাবুদ, আনুগত্য করার যোগ্য, সংকট থেকে উদ্ধারকারী ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী গণ্য করেন। এর ফলে শিরক ও নাস্তিক্যবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমগ্র জীবন ব্যবস্থাটাই ভ্রান্ত গণ্য হয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের উপরোক্ত দু’টি অংশকে সত্য প্রমাণ করার জন্য এখানে বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলীর প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়েছে। বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, নিজের চারপাশের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখো, সর্বত্র এই যে চিহ্নগুলো পাওয়া যাচ্ছে এগুলো কি নবীর বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করছে, না তোমাদের কাল্পনিক চিন্তা-ভাবনা ও কুসংস্কারকে সত্য প্রমাণ করছে? নবী বলেন, মরার পর তোমাদের আবার জীবিত করা হবে। তোমরা নবীর একথাকে একটি অসম্ভব কথা বলে গণ্য করছো। কিন্তু প্রতি বর্ষাকালে পৃথিবী এর প্রমাণ পেশ করে। সৃষ্টির পুনরাবর্তন কেবল সম্ভবই নয় বরং প্রতি বর্ষাকালে তোমাদের চোখের সামনে ঘটছে। নবী বলেন, এ বিশ্ব-জাহান আল্লাহবিহীন নয়। তোমাদের নাস্তিকরা একথাকে একটি প্রামণহীন দাবী মনে করছে। কিন্তু গবাদি পশুর গঠনাকৃতি, খেজুর ও আংগুরের উৎপাদন এবং মৌমাছির সৃষ্টি কৌশল একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, একজন প্রাজ্ঞ ও করুণাময় রব এ জিনিসগুলোর নকশা তৈরী করেছেন। অন্যথায় এতগুলো পশু, এতসব গাছপালা এবং এত বিপুল সংখ্যক মৌমাছি মিলেমিশে মানুষের জন্য এ নানাবিধ উন্নতমানের, উৎকৃষ্ট, সুস্বাদু ও লাভজনক জিনিস প্রতিদিন যথানিয়মে তৈরী করে যাচ্ছে, এটা কেমন করে সম্ভব ছিল? নবী বলেন, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কেউ উপাস্য, মাবুদ এবং প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা লাভের হকদার নেই। তোমাদের মুশরিকরা একথায় নাক সিটকায় এবং নিজেদের বহু সংখ্যক উপাস্যের পূজাবেদীতে অর্ঘ ও উপঢৌকনাদি নিবেদন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তোমরা নিজেরাই বলো, এ দুধ, খেজুর, আংগুর ও মধু এগুলো তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য, এ নিয়ামতগুলো আল্লাহ ছাড়া আর কে তোমাদের দান করেছেন? কোন্ দেবী, দেবতা বা অলী তোমাদের আহার পৌঁছাবার এ ব্যবস্থা করেছেন?
৬০.
অর্থাৎ আসল ব্যাপার শুধু এতটুকুই নয় যে, তোমাদের প্রতিপালন ও খাদ্য সংস্থাপনের এ সমগ্র ব্যবস্থাপনাটিই আল্লাহর হাতে রয়েছে বরং প্রকৃত সত্য এটাও যে, তোমাদের জীবন ও মৃত্যু দু’টোই আল্লাহর ক্ষমতার অধীন। অন্য কেউ তোমাদের জীবনও দান করতে পারে না, আর মৃত্যুও ঘটাতে পারে না।
৬১.
অর্থাৎ এ জ্ঞনবত্তা যা নিয়ে তোমরা গর্ব ও অহংকার করে বেড়াও এবং যার বদৌলতে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর ওপর তোমাদের শ্রেষ্টত্ব স্বীকৃত হয়েছে, তাও আল্লাহর দান। তোমরা নিজেদের চোখে নিজেদের জীবনের একটি বিস্ময়কর শিক্ষণীয় দৃশ্য দেখে থাকো। যখন কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ দীর্ঘায়ূ দান করেন, অনেক বেশী বয়স হয়ে যায় তখন এ ব্যক্তিই যে কখনো তার যৌবনকালে অন্যকে জ্ঞান দিতো, সে কেমন একটা লোলচর্ম বৃদ্ধে এবং অথর্ব-অক্ষম একটা নিরেট মাংস পিণ্ডে পরিণত হয়, যার কোন হুঁশ-জ্ঞান থাকে না।
অনুবাদ: