১১১ ) (এদের সবার ফায়সালা সেদিন হবে) যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি আত্মরক্ষার চিন্তায় মগ্ন থাকবে এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিদান পুরোপুরি দেয়া হবে আর কারো প্রতি সামান্যতমও জুলুম হবে না।
يَوْمَ تَأْتِى كُلُّ نَفْسٍ تُجَٰدِلُ عَن نَّفْسِهَا وَتُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ١١١
১১২ ) আল্লাহ একটি জনপদের দৃষ্টান্ত দেন। সেটি শান্তি ও নিরাপত্তার জীবন যাপন করছিল এবং সবদিক দিয়ে সেখানে আসছিল ব্যাপক রিযিক, এ সময় তাঁর অধিবাসীরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ অস্বীকার করলো। তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করালেন এভাবে যে, ক্ষুধা ও ভীতি তাদেরকে গ্রাস করলো।
وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ ءَامِنَةً مُّطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّن كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ ٱللَّهِ فَأَذَٰقَهَا ٱللَّهُ لِبَاسَ ٱلْجُوعِ وَٱلْخَوْفِ بِمَا كَانُوا۟ يَصْنَعُونَ ١١٢
১১৩ ) তাদের কাছে তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে একজন রসূল এলো। কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করলো। শেষ পর্যন্ত আযাব তাদেরকে পাকড়াও করলো, যখন তারা জালেম হয়ে গিয়েছিল। ১১২
وَلَقَدْ جَآءَهُمْ رَسُولٌ مِّنْهُمْ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمُ ٱلْعَذَابُ وَهُمْ ظَٰلِمُونَ ١١٣
১১৪ ) কাজেই হে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের যা কিছু পাক-পবিত্র ও হালাল রিযিক দিয়েছেন তা খাও এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, ১১৩ যদি তোমরা সত্যিই তাঁর বন্দেগী করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকো ১১৪
فَكُلُوا۟ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلًا طَيِّبًا وَٱشْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ١١٤
১১৫ ) আল্লাহ যা কিছু তোমাদের ওপর হারাম করেছেন তা হচ্ছে, মৃতদেহ, রক্ত, শূয়োরের গোশত এবং যে প্রাণীর ওপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নাম নেয়া হয়েছে। তবে যদি কেউ আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা পোষণ না করে অথবা প্রয়োজনের সীমা না ছাড়িয়ে ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়ে এসব খেয়ে নেয় তাহলে নিশ্চিতই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়। ১১৫
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ ٱلْمَيْتَةَ وَٱلدَّمَ وَلَحْمَ ٱلْخِنزِيرِ وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ ٱللَّهِ بِهِۦ فَمَنِ ٱضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ ١١٥
১১৬ ) আর এই যে, তোমাদের কণ্ঠ ভুয়া হুকুম জারী করে বলতে থাকে এটি হালাল এবং ওটি হারাম, এভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। ১১৬ যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবে না।
وَلَا تَقُولُوا۟ لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ ٱلْكَذِبَ هَٰذَا حَلَٰلٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ ١١٦
১১৭ ) দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ মাত্র কয়েকদিনের এবং পরিশেষে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
مَتَٰعٌ قَلِيلٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ١١٧
১১৮ ) ইতিপূর্বে ১১৭ আমি তোমাকে যেসব জিনিসের কথা বলেছি সেগুলো আমি বিশেষ করে ইহুদীদের জন্য হারাম করেছিলাম। ১১৮ আর এটা তাদের প্রতি আমার জুলুম ছিল না বরং তাদের নিজেদেরই জুলুম ছিল, যা তারা নিজেদের ওপর করছিল।
وَعَلَى ٱلَّذِينَ هَادُوا۟ حَرَّمْنَا مَا قَصَصْنَا عَلَيْكَ مِن قَبْلُ وَمَا ظَلَمْنَٰهُمْ وَلَٰكِن كَانُوٓا۟ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ ١١٨
১১৯ ) তবে যারা অজ্ঞতার কারণে খারাপ কাজ করেছে এবং তারপর তাওবা করে নিজেদের কাজের সংশোধন করে নিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই তোমার রব তাওবা ও সংশোধনের পর তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا۟ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٍ ثُمَّ تَابُوا۟ مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوٓا۟ إِنَّ رَبَّكَ مِنۢ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ ١١٩
১২০ ) প্রকৃতপক্ষে ইবরাহীম নিজেই ছিল একটি পরিপূর্ণ উম্মত, ১১৯ আল্লাহর হুকুমের অনুগত এবং একনিষ্ঠ। সে কখনো মুশরিক ছিল না।
إِنَّ إِبْرَٰهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِّلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ ١٢٠
১১২.
এখানে যে জনপদের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে তাকে চিহ্নিত করা হয়নি। মুফাসসিরগণও এ জনপদটির স্থান নির্দেশ করতে পারেননি। বাহ্যত ইবনে আব্বাসের (রা.) এ উক্তি সঠিক মনে হয় যে, এখানে ভীতি ও ক্ষুধা দ্বারা জনপদটির আক্রান্ত হবার যে কথা বলা হয়েছে সেটি হবে মক্কার দুর্ভিক্ষ, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের পর বেশ কিছুকাল পর্যন্ত মক্কাবাসীদের ওপর জেঁকে বসেছিল।
১১৩.
এ থেকে জানা যায় ওপরে যে দুর্ভিক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এ সূরা নাযিলের সময় তা খতম হয়ে গিয়েছিল।
১১৪.
অর্থাৎ যদি সত্যিই তোমরা আল্লাহর বন্দেগীর স্বীকৃতি দিয়ে থাকো, যেমন তোমরা দাবী করছো, তাহলে তোমরা নিজেরাই কোন জিনিসকে হালাল ও কোন জিনিসকে হারাম করার অধিকার গ্রহণ করো না। বরং যে রিযিককে স্বয়ং আল্লাহ হালাল ও পবিত্র ঘোষণা করেছেন তা খাও এবং তাঁর শোকর করো। আর যা কিছু আল্লাহর আইনে হারাম অপবিত্র ও কলুষিত তা থেকে দূরে থাকো।
১১৫.
এ হুকুমটি ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ৩, সূরা মায়েদার ১৭৩ এবং সূরা আন’আমের ৩৫ আয়াতেও এসেছে।
১১৬.
এ আয়াতটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হালাল ও হারাম করার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। অথবা অন্য কথায়, একমাত্র আল্লাহই আইন প্রণেতা। অন্য যে ব্যক্তিই বৈধতা ও অবৈধতার ফায়সালা করার ধৃষ্টতা দেখাবে। সে নিজের সীমালঙ্ঘন করবে। তবে যদি সে আল্লাহর আইনকে অনুমতিপত্র হিসেবে মেনে নিয়ে তার ফরমানসমূহ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে বলে, অমুক জিনিসটি অথবা কাজটি বৈধ এবং অমুকটি অবৈধ তাহলে তা হতে পারে। এভাবে নিজের হালাল ও হারাম করার স্বাধীন ক্ষমতাকে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ বলে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি এ ধরনের বিধান তৈরী করে তার এ কাজটি দু’টি অবস্থার বাইরে যেতে পারে না। হয় সে দাবী করছে যে, যে জিনিসকে সে আল্লাহর কিতাবের অনুমোদন ছাড়াই বৈধ বা অবৈধ বলছে তাকে আল্লাহ বৈধ বা অবৈধ করেছেন। অথবা তার দাবী হচ্ছে, আল্লাহ নিজের হালাল ও হারাম করার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে মানুষকে স্বাধীনভাবে তার নিজের জীবনের শরীয়াত তৈরী করার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ দু’টি দাবীর মধ্য থেকে যেটিই সে করবে তা নিশ্চিতভাবেই মিথ্যাচার এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ ছাড়া আর কিছুই হবে না।
১১৭.
ওপরে উল্লেখিত হুকুমের বিরুদ্ধে যেসব আপত্তি উত্থাপন করা হচ্ছিল তার জবাবে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে। মক্কার কাফেরদের প্রথম আপত্তি ছিলঃ তুমি যেসব জিনিস হালাল করে রেখেছো বনী ইসরাঈলদের শরীয়াতে তো তেমনি ধরনের আরো বহু জিনিস হারাম হয়ে আছে। যদি ঐ শরীয়াতটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত হয়ে থাকে তাহলে তুমি নিজেই তার বিরুদ্ধাচরণ করছো। যদি ঐ শরীয়াতটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত হয়ে থাকে এবং তোমার শরীয়াত ও আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তাহলে উভয়ের মধ্যে এ বিরোধ কেন? দ্বিতীয় আপত্তিটি ছিলঃ বনী ইসরাঈলের শরীয়াতে শনিবারের সমস্ত দুনিয়াবী কাজ কারবার হারাম হবার যে আইনটি ছিল তাকেও তুমি উড়িয়ে দিয়েছো। এটা কি তোমার স্বেচ্ছাকৃত কাজ, না আল্লাহ নিজেই তাঁর দু’টি শরীয়াত দু’ধরনের পরস্পর বিরোধী হুকুম রেখেছেন?
১১৮.
এখানে সূরা “আন ’আম”--এর ১৪৬ আয়াতঃ
وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ الايه
---এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ আয়াতে ইহুদীদের নাফরমানির কারণে বিশেষ করে কোন্ কোন্ জিনিস তাদের জন্য হারাম করা হয়েছিল তা বলা হয়েছে।
এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। সূরা নাহলের এ আয়াতে সূরা আন’আমের একটি আয়াতের বরাত দেয়া হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, সুরা আন’আম এ সূরার আগে নাযিল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সূরা আন’আমে এক জায়গায় বলা হয়েছে।
وَمَا لَكُمْ أَلَّا تَأْكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ (ايت : 119)
এখানে সূরা নাহলের দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কারণ মক্কী সূরাগুলোর মধ্যে আন’আম ছাড়া এই একটি মাত্র সূরাতেই হারাম জিনিসগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, এর মধ্যে কোন্ সূরাটি আগে নাযিল হয়েছিল এবং কোনটি পরে? আমাদের মতে এর সঠিক জবাব হচ্ছে এই যে, প্রথমে নাযিল হয়েছিল সূরা নাহ্ল। সূরা আন’আমের উপরোল্লিখিত আয়াতে এরই বরাত দেয়া হয়েছে। পরে কোন এক সময় মক্কার কাফেররা সূরা নাহলের এ আয়াতগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের ইতিপূর্বে বর্ণিত আপত্তিগুলো উত্থাপন করে। সে সময় সূরা আন’আম নাযিল হয়ে গিয়েছিল। তাই তাদেরকে জবাব দেয়া হয়েছে, আমরা পূর্বেই অর্থাৎ সূরা আন’আমে বলে এসেছি যে, ইহুদীদের জন্য কয়েকটি জিনিস বিশেষভাবে হারাম করা হয়েছিল। আর যেহেতু এ আপত্তি সূরা নাহলের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল তাই এর জবাবও সূরা নাহলেই প্রাসঙ্গিক বাক্য হিসেবে সংযোজিত হয়েছে।
১১৯.
অর্থাৎ তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মতের সমান। যখন দুনিয়ায় কোন মুসলমান ছিল না তখন একদিকে তিনি একাই ছিলেন ইসলামের পতাকাবাহী এবং অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ ছিল কুফরীর পতাকাবাহী। আল্লাহর এ একক বান্দাই তখন এমন কাজ করেন যা করার জন্য একটি উম্মতের প্রয়োজন ছিল। তিনি এক ব্যক্তি মাত্র ছিলেন না, ব্যক্তির মধ্যে তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।