১ ) এসে গেছে আল্লাহর ফায়সালা। ১ এখন আর একে ত্বরান্বিত করতে বলো না। পবিত্র তিনি এবং এরা যে শিরক করছে তার ঊর্ধ্বে তিনি অবস্থান করেন। ২
أَتَىٰٓ أَمْرُ ٱللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ ۚ سُبْحَـٰنَهُۥ وَتَعَـٰلَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ ١
২ ) তিনি এ রূহকে ৩ তাঁর নির্দেশানুসারে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর চান নাযিল করেন। ৪ (এ হেদায়াত সহকারে যে, লোকদের) “জানিয়ে দাও, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো।” ৫
يُنَزِّلُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةَ بِٱلرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنْ عِبَادِهِۦٓ أَنْ أَنذِرُوٓا۟ أَنَّهُۥ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱتَّقُونِ ٢
৩ ) তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন। এরা যে শিরক করছে তাঁর অবস্থান তার অনেক ঊর্ধ্বে। ৬
خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِٱلْحَقِّ ۚ تَعَـٰلَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ ٣
৪ ) তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ছোট্ট একটি ফোঁটা থেকে। তারপর দেখতে দেখতে সে এক কলহপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ৭
خَلَقَ ٱلْإِنسَـٰنَ مِن نُّطْفَةٍۢ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌۭ مُّبِينٌۭ ٤
৫ ) তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও।
وَٱلْأَنْعَـٰمَ خَلَقَهَا ۗ لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌۭ وَمَنَـٰفِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ ٥
৬ ) তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো।
وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ ٦
৭ ) তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌঁছতে পারো না। আসলে তোমার রব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়।
وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَىٰ بَلَدٍۢ لَّمْ تَكُونُوا۟ بَـٰلِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ ٱلْأَنفُسِ ۚ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌۭ رَّحِيمٌۭ ٧
৮ ) তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। তিনি (তোমাদের উপকারার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানোই না। ৮
وَٱلْخَيْلَ وَٱلْبِغَالَ وَٱلْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةًۭ ۚ وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ٨
৯ ) আর যেখানে বাঁকা পথও রয়েছে সেখানে সোজা পথ দেখাবার দায়িত্ব আল্লাহর ওপরই বর্তেছে। ৯ তিনি চাইলে তোমাদের সবাইকে সত্য-সোজা পথে পরিচালিত করতেন। ১০
وَعَلَى ٱللَّهِ قَصْدُ ٱلسَّبِيلِ وَمِنْهَا جَآئِرٌۭ ۚ وَلَوْ شَآءَ لَهَدَىٰكُمْ أَجْمَعِينَ ٩
১০ ) তিনিই আকাশ থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেন, যা পান করে তোমরা নিজেরাও পরিতৃপ্ত হও এবং যার সাহায্যে তোমাদের পশুদের জন্যও খাদ্য উৎপন্ন হয়।
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءًۭ ۖ لَّكُم مِّنْهُ شَرَابٌۭ وَمِنْهُ شَجَرٌۭ فِيهِ تُسِيمُونَ ١٠
১.
অর্থাৎ তা একেবারে আসন্ন হয়ে উঠেছে। তার প্রকাশ ও প্রয়োগের সময় নিকটবর্তী হয়েছে। ব্যাপারটা একেবারেই অবধারিত ও সুনিশ্চিত অথবা একান্ত নিকটবর্তী এ ধারণা দেবার জন্য বাক্যটি অতীতকালের ক্রিয়াপদের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। কিংবা কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের সবরের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠেছিল এবং শেষ ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় এসে গিয়েছিল বলেই অতীতকালের ক্রিয়াপদ দ্বারা একথা বলা হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে, এ “ফায়সালা” কি ছিল এবং কোন আকৃতিতে এসেছে? আমরা মনে করি (তবে আল্লাহই সঠিক খবর ভাল জানেন) এ ফায়সালা বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে হিজরতকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াত নাযিলের কিছুদিন পরেই এ হিজরতের হুকুম দেয়া হয়। কুরআন অধ্যয়নে জানা যায়, যে সমাজে নবীর আগমন ঘটে তাদের অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যান একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলেই নবীকে হিজরতের হুকুম দেয়া হয়। এ হুকুম উল্লেখিত সমাজের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। এরপর হয় তাদের ওপর ধ্বংসাত্মক আযাব এসে যায় অথবা নবী ও তাঁর অনুসারীদের হাত দিয়ে তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করে দেয়া হয়। ইতিহাস থেকেও একথাই জানা যায়। হিজরত সংঘটিত হবার পর মক্কার কাফেররা মনে করলো ফায়সালা তাদের পক্ষেই হয়েছে। কিন্তু আট দশ বছরের মধ্যেই দুনিয়াবাসীরা দেখে নিল, শুধুমাত্র মক্কা থেকেই নয়, সমগ্র আরব ভূখণ্ড থেকেই শিরক ও কুফরীকে শিকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে।
২.
প্রথম বাক্য ও দ্বিতীয় বাক্যের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করার জন্য এর পটভূমি সামনে রাখা প্রয়োজন। কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বারবার চ্যালেঞ্জ দিয়ে আসছিল যে, তুমি আল্লাহর যে ফায়সালার কথা বলে আমাদের ভয় দেখিয়ে থাকো তা আসছে না কেন? তাদের এ চ্যালেঞ্জের পিছনে আসলে যে চিন্তাটি সক্রিয় ছিল তা ছিল এই যে, তাদের মুশরিকী ধর্মই সত্য এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খামাখা আল্লাহর নামে একটি ভ্রান্ত ধর্ম পেশ করছেন। আল্লাহ এ ধর্মকে অনুমোদন দান করেননি। তাদের যুক্তি ছিল, আমরা যদি আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে থাকি এবং মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর পাঠানো নবী হয়ে থাকেন তাহলে আমরা তাঁর সাথে যে ব্যবহার করছি তাতে আমাদের সর্বনাশ হওয়া উচিত ছিল না কি? কিন্তু তা হচ্ছে না, এটা কেমন করে সম্ভব? তাই আল্লাহর ফায়সালার ঘোষণা দেবার সাথে সাথেই বলা হয়েছে, এ ফায়সালার প্রয়োগ বিলম্বিত হবার যে কারণ তোমরা মনে করছো তা মোটেই সঠিক নয়। আল্লাহর সাথে কারো শরীক হবার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর সত্তা এর অনেক ঊর্ধ্বে এবং এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।
৩.
অর্থাৎ নবুওয়াতের রূহ। এ রূহ বা প্রাণসত্তায় উজ্জীবিত হয়েই নবী কাজ করেন ও কথা বলেন। স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক জীবনে প্রাণের যে মর্যাদা এ অহী ও নবুওয়াতী প্রাণসত্তা নৈতিক জীবনে সেই একই মর্যাদর অধিকারী। তাই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তার জন্য ‘রূহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ সত্যটি না বুঝার কারণে ঈসায়ীগণ রূহুল কুদুস(.......)-কে তিন খোদার এক খোদা বানিয়ে নিয়েছে।
৪.
ফায়সালা কার্যকর করাবার দাবী জানিয়ে কাফেররা যে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিল তার পেছনে যেহেতু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের অস্বীকৃতিও কার্যকর ছিল, তাই শিরক খণ্ডনের পরপরই তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। তারা বলতো, এ ব্যক্তি যা বলছে, এসব মিথ্যা ও বানোয়াট। এর জবাবে আল্লাহ বলছেন, এ ব্যক্তি হচ্ছে আমার পাঠানো রূহ। এ রূহ ও প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়েই সে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করছে।
তারপর তিনি যে বান্দার ওপর চান এ রূহ নাযিল করেন ---একথার মাধ্যমে নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে কাফেরদের একটি আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। কাফেররা আপত্তি করে বলতো, আল্লাহর যদি নবী পাঠাবার দরকার হয়ে থাকে তাহলে কেবলমাত্র আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদই ﷺ কি এ কাজের যোগ্য সাব্যস্ত হয়েছিল? মক্কা ও তায়েফের সমস্ত বড় বড় সরদাররা কি মরে গিয়েছিল? তাদের কারোর ওপর আল্লাহর দৃষ্টি পড়েনি? এ ধরনের অর্থহীন ও অযৌক্তিক আপত্তির জবাব এছাড়া আর কি হতে পারতো? এ কারণেই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এর এ জবাব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই অবগত আছেন। তাঁর কাজের ব্যাপারে তোমাদের কাছ থেকে তাঁর পরামর্শ নেবার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকেই সঙ্গত মনে করেন নিজের কাজের জন্য নির্বাচিত করে নেন।
৫.
এই বাক্যের মাধ্যমে এ সত্যটি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে যে, নবুওয়াতের রূহ যেখানেই যে ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হয়েছে সেখানেই তিনি এ একটিই দাওয়াত নিয়ে এসেছেন যে, সার্বভৌম কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত এবং একমাত্র তাঁকেই ভয় করতে হবে, তিনি একাই এর হকদার। তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় এমন কোন সত্তা নেই যার অসন্তুষ্টির ভয়, যার শাস্তির আশঙ্কা এবং যার নাফরমানির অশুভ পরিণামের আতঙ্ক মানবিক চরিত্র ও নৈতিকতার নিয়ন্ত্রক এবং মানবিক চিন্তা ও কর্মের সমগ্র ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
৬.
অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নবী যে শিরক পরিহার করার এবং তাওহীদ বিশ্বাসী হবার দাওয়াত দেন, পৃথিবী ও আকাশের সমগ্র সৃষ্টি কারখানাই তার সাক্ষ্য দিয়ে চলছে। এ কারখানা কোন কাল্পনিক গোলক ধাঁধাঁ নয় বরং একটি পুরোপুরি বাস্তব সত্য ব্যবস্থা। এর যেদিকে ইচ্ছা তাকিয়ে দেখো কোথাও থেকে শিরকের সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর সার্বভৌম কর্তৃত্ব কোথাও প্রতিষ্ঠিত দেখা যাবে না। কোন বস্তুর গঠন প্রণালী একথা প্রমাণ করবে না যে, তার অস্তিত্ব অন্য কারোর দান। কাজেই যেখানে এ বাস্তব সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নির্ভেজাল তাওহীদের নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে তোমার এ শিরকের চিন্তাধারা--- যার মধ্যে ধারণা ও অনুমান ছাড়া বাস্তব সত্যের গন্ধমাত্রও নেই--- কোথায় জারী হতে পারে? এরপর বিশ্বজগতের নিদর্শনাবলী এবং স্বয়ং মানুষের নিজের অস্তিত্ব থেকে এমন সব সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হয় যা একদিকে তাওহীদ এবং অন্যদিকে রিসালাতের প্রমাণ পেশ করে।
৭.
এর দুই অর্থ হতে পারে এবং সম্ভবত এখানে এ দুই অর্থই প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ একটি তুচ্ছ শুক্রবিন্দু থেকে এমন মানুষ তৈরী করেছেন যে বিতর্ক ও যুক্তি প্রদর্শন করার যোগ্যতা রাখে এবং নিজের বক্তব্য ও দাবীর পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করতে পারে। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যে মানুষকে আল্লাহ শুক্রবিন্দুর মত নগণ্য জিনিস থেকে তৈরী করেছেন তার অহংকারের বাড়াবাড়িটা দেখো, সে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার মোকাবিলায় নিজেকে পেশ করার জন্য বিতর্কে নেমে এসেছে। প্রথম অর্থটির প্রেক্ষিতে সামনের দিকে একের পর এক কয়েকটি আয়াতে যে দলীল পেশ করা হয়েছে এ আয়াতটি তারই একটি সূত্র। (এ বর্ণণা ধারার শেষ পর্যায়ে আমরা এর ব্যাখ্যা করবো) আর দ্বিতীয় অর্থটির প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি মানুষকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয় যে, বড় বড় বুলি আওড়ানোর আগে নিজের সত্তার দিকে একবার তাকাও। কোন্ আকারে কোথা থেকে বের হয়ে তুমি কোথায় এসে পৌঁছেছো? কোথায় তোমার প্রতিপালনের সূচনা হয়েছিল? তারপর কোন্ পথ দিয়ে বের হয়ে তুমি দুনিয়ায় এসেছো? তারপর কোন্ কোন্ পর্যায় অতিক্রম করে তুমি যৌবন বয়সে পৌঁছেছো এবং এখন নিজেকে বিস্মৃত হয়ে কার মুখের ওপর কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছো?
৮.
অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ জিনিস এমন আছে যা মানুষের উপকার করে যাচ্ছে। অথচ কোথায় কত সেবক তার সেবা করে যাচ্ছে এবং কি সেবা করছে সে সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।
৯.
তাওহীদ, রহমত ও রবুবীয়াতের যু্ক্তি পেশ করতে গিয়ে এখানে ইঙ্গিতে নবুওয়াতের পক্ষেও একটি যুক্তি পেশ করা হয়েছে। এ যুক্তির সংক্ষিপ্তসার হচ্ছেঃ
দুনিয়ায় মানুষের জন্য চিন্তা ও কর্মের অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পথ থাকা সম্ভব এবং কার্যত আছেও। এসব পথ তো আর একই সঙ্গে সত্য হতে পারে না। সত্য একটিই এবং যে জীবনাদর্শটি এ সত্য অনুযায়ী গড়ে ওঠে সেটিই একমাত্র সত্য জীবনাদর্শ। অন্যদিকে কর্মেরও অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন পথ থাকা সম্ভব এবং এ পথগুলোর মধ্যে যেটি সঠিক জীবনাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় সেটিই একমাত্র সঠিক পথ।
এ সঠিক আদর্শ ও সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। বরং এটিই তার আসল মৌলিক প্রয়োজন। কারণ অন্যান্য সমস্ত জিনিস তো মানুষের শুধুমাত্র এমন সব প্রয়োজন পূর্ণ করে যা একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রাণী হওয়ার কারণে তার জন্য অপরিহার্য হয়। কিন্তু এ একটিমাত্র প্রয়োজন শুধুমাত্র মানুষ হবার কারণে তার জন্য অপরিহার্য হয়। এটি যদি পূর্ণ না হয় তাহলে এর মানে দাঁড়ায় এই যে, মানুষের সমস্ত জীবনটাই নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়ে গেছে।
এখন ভেবে দেখো, যে আল্লাহ তোমাদের অস্তিত্বদান করার আগে তোমাদের জন্য এতসব সাজ সরঞ্জাম প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং যিনি অস্তিত্ব দান করার পর তোমাদের প্রাণী-জীবনের প্রত্যেকটি প্রয়োজন পূর্ণ করার এমন সূক্ষ্ম ও ব্যাপকতর ব্যবস্থা করেছেন, তোমরা কি তাঁর কাছে এটা আশা করো যে, তিনি তোমাদের মানবিক জীবনের এই সবচেয়ে বড় ও আসল প্রয়োজনটি পূর্ণ করার ব্যবস্থা না করে থাকবেন?
নবুওয়াতের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাটিই তো করা হয়েছে। যদি তুমি নবুওয়াত না মানো তাহলে বলো তোমার মতে মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ অন্য কি ব্যবস্থা করেছেন? এর জবাবে তুমি একথা বলতে পারো না যে, পথের সন্ধান করার জন্য আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়ে রেখেছেন। কারণ মানবিক বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি ইতিপূর্বেই এমন অসংখ্য পথ উদ্ভাবন করে ফেলেছে যা তার সত্য-সরল পথের সঠিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতার সুস্পষ্ট প্রামণ। আবার তুমি একথাও বলতে পারো না যে, আল্লাহ আমাদের পথ দেখাবার কোন ব্যবস্থা করেননি। কারণ আল্লাহর ব্যাপারে এর চেয়ে বড় আর কোন কুধারণা হতেই পারে না যে, প্রাণী হবার দিক দিয়ে তোমাদের প্রতিপালন ও বিকাশ লাভের এতসব বিস্তারিত ও পূর্ণাংগ ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন অথচ মানুষ হবার দিক দিয়ে তোমাদের একেবারে অন্ধকারের বুকে পথ হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াবার ও পদে পদে ঠোকর খাবার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। (আরো বেশী জানার জন্য সূরা আর রাহমানের ২-৩ টীকা দেখুন)।
১০.
অর্থাৎ যদিও আল্লাহ সমস্ত মানুষকে অন্যান্য সকল ক্ষমতাসীন সৃষ্টির মতো জন্মগতভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করে নিজের এ দায়িত্বটি (যা তিনি মানুষকে পথ দেখাবার জন্য নিজেই নিজের ওপর আরোপ করে নিয়েছিলেন) পালন করতে পারতেন। কিন্তু এটি তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো যে নিজের পছন্দ ও বাছ-বিচারের মাধ্যমে সঠিক ও ভ্রান্ত সব রকমের পথে চলার স্বাধীনতা রাখে। এ স্বাধীন ক্ষমত ব্যবহার করার জন্য তাকে জ্ঞানের উপকরণ, বুদ্ধি ও চিন্তার যোগ্যতা এবং ইচ্ছা ও সংকল্পের শক্তি দান করা হয়েছে। তাকে নিজের ভিতরের ও বাইরের অসংখ্য জিনিস ব্যবহার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তার ভিতরে ও বাইরে সবদিকে এমন সব অসংখ্য কার্যকারণ ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যা তার জন্য সঠিক পথ পাওয়া ও ভুল পথে পরিচালিত হওয়া উভয়টিরই কারণ হতে পারে। যদি তাকে জন্মগতভাবে সঠিক পথানুসারী করে দেয়া হতো তাহলে এসবই অর্থহীন হয়ে যেতো এবং উন্নতির এমন সব উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছানো মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না, যা কেবলমাত্র স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষ লাভ করতে পারে। তাই মহান আল্লাহ মানুষকে দেখাবার জন্য জোরপূর্বক সঠিক পথে পরিচালিত করার পদ্ধতি পরিহার করে রিসালাতের পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এভাবে মানুষের স্বাধীনতা যেমন অক্ষুণ্ণ থাকবে, তেমনি তার পরীক্ষার উদ্দেশ্যও পূর্ণ হবে এবং সত্য-সরল পথ ও সর্বোত্তম যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে তার সামনে পেশ করে দেয়া যাবে।