১১ ) (এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে) তারা তাদের বাপকে গিয়ে বললো, “আব্বাজান! কি ব্যাপার, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের ওপর ভরসা করেন না? অথচ আমরা তাঁর সত্যিকার শুভাকাংখী।
قَالُوا۟ يَـٰٓأَبَانَا مَا لَكَ لَا تَأْمَ۫نَّا عَلَىٰ يُوسُفَ وَإِنَّا لَهُۥ لَنَـٰصِحُونَ ١١
১২ ) আগামীকাল তাঁকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, সে কিছু ফলমূল খাবে এবং দৌড়ঝাঁপ করে মন চাঙ্গা করবে। আমরা তাঁর হেফাজত করবো।” ১১
أَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًۭا يَرْتَعْ وَيَلْعَبْ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَـٰفِظُونَ ١٢
১৩ ) বাপ বললো, “তোমরা তাঁকে নিয়ে যাবে, এটা আমাকে কষ্ট দেবে এবং আমার আশঙ্কা হয়, তোমরা তাঁর প্রতি অমনোযোগী থাকবে এবং নেকড়ে তাঁকে খেয়ে ফেলবে।”
قَالَ إِنِّى لَيَحْزُنُنِىٓ أَن تَذْهَبُوا۟ بِهِۦ وَأَخَافُ أَن يَأْكُلَهُ ٱلذِّئْبُ وَأَنتُمْ عَنْهُ غَـٰفِلُونَ ١٣
১৪ ) তারা জবাব দিল, “যদি আমাদের সংঘবদ্ধ দল থাকতে তাকে নেকড়ে খেয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা হবো বড়ই অকর্মন্য।”
قَالُوا۟ لَئِنْ أَكَلَهُ ٱلذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّآ إِذًۭا لَّخَـٰسِرُونَ ١٤
১৫ ) এভাবে চাপ দিয়ে যখন তারা তাঁকে নিয়ে গেলো এবং সিদ্ধান্ত করলো তাঁকে একটি অন্ধ কূপে ফেলে দেবে তখন আমি ইউসুফকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, “এক সময় আসবে যখন তুমি তাদেরকে তাদের এ কৃতকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তাদের কাজের ফলাফল সম্পর্কে তারা জানে না।” ১২
فَلَمَّا ذَهَبُوا۟ بِهِۦ وَأَجْمَعُوٓا۟ أَن يَجْعَلُوهُ فِى غَيَـٰبَتِ ٱلْجُبِّ ۚ وَأَوْحَيْنَآ إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُم بِأَمْرِهِمْ هَـٰذَا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ ١٥
১৬ ) রাতে তারা কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার কাছে এসে
وَجَآءُوٓ أَبَاهُمْ عِشَآءًۭ يَبْكُونَ ١٦
১৭ ) বললো, “আব্বাজান! আমরা দৌঁড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের জিনিসপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, ইতিমধ্যে নেকড়ে বাঘ এসে তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী।”
قَالُوا۟ يَـٰٓأَبَانَآ إِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا يُوسُفَ عِندَ مَتَـٰعِنَا فَأَكَلَهُ ٱلذِّئْبُ ۖ وَمَآ أَنتَ بِمُؤْمِنٍۢ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صَـٰدِقِينَ ١٧
১৮ ) তারা ইউসুফের জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। একথা শুনে তাদের বাপ বললো, “বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি বড় কাজকে সহজ করে দিয়েছে। ঠিক আছে, আমি সবর করবো এবং খুব ভালো করেই সবর করবো। ১৩ তোমরা যে কথা সাজাচ্ছো তার ওপর একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।” ১৪
وَجَآءُو عَلَىٰ قَمِيصِهِۦ بِدَمٍۢ كَذِبٍۢ ۚ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًۭا ۖ فَصَبْرٌۭ جَمِيلٌۭ ۖ وَٱللَّهُ ٱلْمُسْتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ ١٨
১৯ ) ওদিকে একটি কাফেলা এলো। তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে পানি নেবার জন্য পাঠালো। সে কূয়ার মধ্যে পানির ডোল নামিয়ে দিল। সে (ইউসুফকে দেখে) বলে উঠলো, “কী সুখবর! এখানে তো দেখছি একটি বালক।” তারা তাকে পণ্য দ্রব্য হিসেবে লুকিয়ে ফেললো। অথচ তারা যা কিছু করছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত ছিলেন।
وَجَآءَتْ سَيَّارَةٌۭ فَأَرْسَلُوا۟ وَارِدَهُمْ فَأَدْلَىٰ دَلْوَهُۥ ۖ قَالَ يَـٰبُشْرَىٰ هَـٰذَا غُلَـٰمٌۭ ۚ وَأَسَرُّوهُ بِضَـٰعَةًۭ ۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌۢ بِمَا يَعْمَلُونَ ١٩
২০ ) শেষে তারা তাঁকে সামান্য দামে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল। ১৫ আর তার দামের ব্যাপারে তারা বেশী আশা করছিল না।
وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍۢ دَرَٰهِمَ مَعْدُودَةٍۢ وَكَانُوا۟ فِيهِ مِنَ ٱلزَّٰهِدِينَ ٢٠
১১.
এ বর্ণনাটিও বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা থেকে ভিন্ন ধরনের। তাদের বর্ণনা হচ্ছে, ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পশু চরাতে সিককিমের দিকে গিয়েছিল। হযরত ইয়াকূব নিজেই তাদের সন্ধানে হযরত ইউসুফকে তাদের পেছনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একথা কল্পনাই করা যায় না যে, হযরত ইয়াকুব (আ) হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাথে তার ভাইদের হিংসার কথা জানা সত্ত্বেও তাঁকে নিজের হাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন। তাই কুরআনের বর্ণনাই অধিকতর বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়।
১২.
মূল ইবারতে
وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ বাক্য এমনভাবে এসেছে যার ফলে তার তিনটি অর্থ হয় এবং তিনটি অর্থই এখানে মানানসই বলে মনে হয়। একটি অর্থ হচ্ছে, আমি ইউসুফকে এ সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এবং তার ভাইয়েরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখবর ছিল যে, তাকে অহীর মাধ্যমে সবকিছু জানানো হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তুমি এমন অবস্থায় তাদের এ কর্ম সম্পর্কে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে যেখানে তোমার অবস্থানের ব্যাপারটি তারা কল্পনাও করতে পারবে না। তৃতীয় অর্থটি হচ্ছে, আজ এরা না জেনে বুঝে একটি কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে এর ফলাফল কি হবে তা এরা জানে না।
এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যে কি সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল বাইবেল ও তালমূদে এর কোন উল্লেখ নেই। বিপরীত পক্ষে তালমূদে যে বর্ণনা এসেছে তা হচ্ছে এই যে, ইউসুফকে যখন কূপে ফেলে দেয়া হলো তখন তিনি জোরে জোরে কাঁদতে থাকলেন এবং চিৎকার করে ভাইদের কাছে ফরিয়াদ করলেন। কুরআনের বর্ণনা পড়লে মনে হবে এমন এক যুবকের কথা বলা হচ্ছে যিনি আগামীতে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। অন্যদিকে তালমূদ পড়লে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা হচ্ছে এই যে, জনমানবশূন্য বিয়াবনে কয়েকজন বদ্দু একটি বালককে কূপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে এবং এ সময় একজন সাধারণ বালক যা করে সে-ও তাই করছে।
১৩.
কুরআনের ইবারতে صَبْرٌ جَمِيلٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ “ভালো সবর” হতে পারে। এর অর্থ হয় এমন সবর যার মধ্যে অভিযোগ, ফরিয়াদ, ভয়-ভীতি ও কান্নাকাটি নেই। একজন উচ্চ ও প্রশস্ত হৃদয়বত্তার অধিকারী মানুষের ওপর যে বিপদ আসে তাকে ধীর স্থির চিত্তে বরদাশত করে যাওয়াই এ সবরের প্রকৃতি।
১৪.
বাইবেল ও তালমূদ এখানে হযরত ইয়াকূবের প্রতিক্রিয়ার এমন ছবি এঁকেছে যা যে কোন সাধারণ বাপের প্রতিক্রিয়া থেকে কোন অংশেই ভিন্নতর নয়। বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, “তখন ইয়াকূব নিজের জামা ফেড়ে ফেলেন, নিজের কোমরের সাথে চট জড়িয়ে নেন এবং বহুদিন পর্যন্ত ছেলের জন্য মাতম করতে থাকেন।” তালমূদে বলা হয়েছে, “ইয়াকূব ছেলের জামা চিনতে পেরেই উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ নিথর-নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকেন। তারপর উঠে বিকট জোরে চিৎকার দিয়ে বলেন, হ্যাঁ এ আমার ছেলের জামা। এরপর তিনি বছরের পর বছর ধরে ইউসুফের জন্য মাতম করতে থাকেন।”
এ বর্ণনায় হযরত ইয়াকূবকে ঠিক তেমনটি করতে দেখা যাচ্ছে যেমনটি এ অবস্থায় প্রত্যেক বাপ করে থাকে। কিন্তু কুরআন এর যে বর্ণনা দিয়েছে তা আমাদের সামনে একটি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ছবি তুলে ধরেছে। এ ব্যক্তি আপাদমস্তক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতর প্রতিমূর্তি। এতবড় শোকাবহ ও হৃদয়বিদারক খবর শুনেও তিনি নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন না। প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পরিস্থিতির সঠিক চেহারা অনুমান করতে পারছেন। তিনি বুঝতে পারেন এটা একটা বানোয়াট কথা। তাঁর হিংসুটে ছেলেরা ঘটনাটা সাজিয়ে তাঁর সামনে পেশ করেছে। তারপর বিশাল হৃদয় ব্যক্তিদের মতো তিনি সবর করেন এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করেন।
১৫.
ঘটনাটা সহজভাবে বলতে গেলে এরূপ বলা যায় যে, ইউসুফের ভাইয়েরা হযরত ইউসুফকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরে কাফেলার লোকজন এসে তাঁকে সেখান থেকে বের করে আনে। তারা তাঁকে মিসরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, ইউসুফের ভাইয়েরা পরে ইসমাঈলীদের একটি কাফেলা দেখে ইউসুফকে কূয়া থেকে বের করে তাদের হাতে বিক্রি করে দিতে চায়। কিন্তু তার আগেই মাদয়ানের সওদাগর তাঁকে কূয়া থেকে বের করে ফেলে। এ সওদাগরেরা বিশ দিরহামে ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে দেয়। সামনের দিকে গিয়ে বাইবেল লেখকরা একথা ভুলে যান যে, ইতিপূর্বে তারা ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন। তাই তারা ইসমাঈলীদের পরিবর্তে আবার মাদয়ানের সওদাগরদের দ্বারা তাঁকে মিসরীয়দের হাতে বিক্রি করাচ্ছেন। (দেখুন, আদি পুস্তক ৩৭: ২৫-২৮ এবং ৩৬) অন্যদিকে তালমূদের বর্ণনা হচ্ছে, মাদয়ানের সওদাগরেরা ইউসুফকে কূয়া থেকে বের করে এনে নিজেদের গোলামে পরিণত করে। অবশেষে তারা বিশ দিরহাম মূল্য পরিশোধ করে ইউসুফের ভাইদেরকে রাজি করে। তারপর তারা বিশ দিরহামের বিনিময়েই ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে। আর ইসমাঈলীরা মিসরে গিয়ে তাঁকে বিক্রি করে। এখান থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এ বর্ণনার প্রচলন হয়েছে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফকে বিক্রি করে কিন্তু জানা উচিত, কুরআন এ সমস্ত বর্ণনা সমর্থন করেনি।