৪১ ) নূহ বললো, “এতে আরোহণ করো, আল্লাহর নামেই এটা চলবে এবং থামবে। আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” ৪৫
۞ وَقَالَ ٱرْكَبُوا۟ فِيهَا بِسْمِ ٱللَّهِ مَجْر۪ىٰهَا وَمُرْسَىٰهَآ ۚ إِنَّ رَبِّى لَغَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ ٤١
৪২ ) নৌকা তাদেরকে নিয়ে পর্বত প্রমাণ ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে ভেসে চলতে লাগলো। নূহের ছেলে ছিল তাদের থেকে দূরে। নূহ চীৎকার করে তাকে বললো, “হে আমার পুত্র! আমাদের সাথে আরোহণ করো, কাফেরদের সাথে থেকো না।”
وَهِىَ تَجْرِى بِهِمْ فِى مَوْجٍۢ كَٱلْجِبَالِ وَنَادَىٰ نُوحٌ ٱبْنَهُۥ وَكَانَ فِى مَعْزِلٍۢ يَـٰبُنَىَّ ٱرْكَب مَّعَنَا وَلَا تَكُن مَّعَ ٱلْكَـٰفِرِينَ ٤٢
৪৩ ) সে পাল্টা জবাব দিল, “আমি এখনই একটি পাহাড়ে চড়ে বসছি। তা আমাকে পানি থেকে বাঁচাবে।” নূহ বললো, “আজ আল্লাহর হুকুম থেকে বাঁচাবার কেউ নেই, তবে যার প্রতি আল্লাহ রহমত করেন সে ছাড়া।” এমন সময় একটি তরংগ উভয়ের মধ্যে আড়াল হয়ে গেলো এবং সেও নিমজ্জিতদের দলে শামিল হলো।
قَالَ سَـَٔاوِىٓ إِلَىٰ جَبَلٍۢ يَعْصِمُنِى مِنَ ٱلْمَآءِ ۚ قَالَ لَا عَاصِمَ ٱلْيَوْمَ مِنْ أَمْرِ ٱللَّهِ إِلَّا مَن رَّحِمَ ۚ وَحَالَ بَيْنَهُمَا ٱلْمَوْجُ فَكَانَ مِنَ ٱلْمُغْرَقِينَ ٤٣
৪৪ ) হুকুম হলো, “হে পৃথিবী! তোমার সমস্ত পানি গিলে ফেলো এবং হে আকাশ। থেমে যাও।” সে মতে পানি ভূগর্ভে বিলীন হয়ে গেলো, ফায়সালা চূড়ান্ত করে দেয়া হলো এবং নৌকা জুদীর ওপর থেমে গেলো ৪৬ তারপর বলে দেয়া হলো, জালেম সম্প্রদায় দূর হয়ে গেলো!
وَقِيلَ يَـٰٓأَرْضُ ٱبْلَعِى مَآءَكِ وَيَـٰسَمَآءُ أَقْلِعِى وَغِيضَ ٱلْمَآءُ وَقُضِىَ ٱلْأَمْرُ وَٱسْتَوَتْ عَلَى ٱلْجُودِىِّ ۖ وَقِيلَ بُعْدًۭا لِّلْقَوْمِ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٤٤
৪৫ ) নূহ তাঁর রবকে ডাকলো। বললো, “হে আমার রব! আমার ছেলে আমার পরিবারভুক্ত এবং তোমার প্রতিশ্রুতি সত্য ৪৭ আর তুমি সমস্ত শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও উত্তম শাসক।” ৪৮
وَنَادَىٰ نُوحٌۭ رَّبَّهُۥ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ٱبْنِى مِنْ أَهْلِى وَإِنَّ وَعْدَكَ ٱلْحَقُّ وَأَنتَ أَحْكَمُ ٱلْحَـٰكِمِينَ ٤٥
৪৬ ) জবাবে বলা হলো, “হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে তো অসৎ কর্মপরায়ণ। ৪৯ কাজেই তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করো না যার প্রকৃত তত্ত্ব তোমার জানা নেই। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না।” ৫০
قَالَ يَـٰنُوحُ إِنَّهُۥ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ ۖ إِنَّهُۥ عَمَلٌ غَيْرُ صَـٰلِحٍۢ ۖ فَلَا تَسْـَٔلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌ ۖ إِنِّىٓ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلْجَـٰهِلِينَ ٤٦
৪৭ ) নূহ তখনই বললো, “হে আমার রব! যে জিনিসের ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো--- এ থেকে আমি তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। যদি তুমি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহমত না করো তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো।” ৫১
قَالَ رَبِّ إِنِّىٓ أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْـَٔلَكَ مَا لَيْسَ لِى بِهِۦ عِلْمٌۭ ۖ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِى وَتَرْحَمْنِىٓ أَكُن مِّنَ ٱلْخَـٰسِرِينَ ٤٧
৪৮ ) হুকুম হলো, “হে নূহ! নেমে যাও, ৫২ আমার পক্ষ থেকে শান্তি ও বরকত তোমার ওপর এবং তোমার সাথে যেসব সম্প্রদায় আছে তাদের ওপর। আবার কিছু সম্প্রদায় এমনও আছে যাদেরকে আমি কিছুকাল জীবন উপকরণ দান করবো তারপর আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে স্পর্শ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
قِيلَ يَـٰنُوحُ ٱهْبِطْ بِسَلَـٰمٍۢ مِّنَّا وَبَرَكَـٰتٍ عَلَيْكَ وَعَلَىٰٓ أُمَمٍۢ مِّمَّن مَّعَكَ ۚ وَأُمَمٌۭ سَنُمَتِّعُهُمْ ثُمَّ يَمَسُّهُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌۭ ٤٨
৪৯ ) হে মুহাম্মাদ! এসব গায়েবের খবর, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি। এর আগে তুমি এসব জানতে না এবং তোমার কওমও জানতো না। কাজেই সবর করো। মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম। ৫৩
تِلْكَ مِنْ أَنۢبَآءِ ٱلْغَيْبِ نُوحِيهَآ إِلَيْكَ ۖ مَا كُنتَ تَعْلَمُهَآ أَنتَ وَلَا قَوْمُكَ مِن قَبْلِ هَـٰذَا ۖ فَٱصْبِرْ ۖ إِنَّ ٱلْعَـٰقِبَةَ لِلْمُتَّقِينَ ٤٩
৫০ ) আর আদের কাছে আমি তাদের ভাই হূদকে পাঠালাম। ৫৪ সে বললোঃ “হে আমার স্বজাতীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর বন্দেগী করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা নিছক মিথ্যা বানিয়ে রেখেছো। ৫৫
وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًۭا ۚ قَالَ يَـٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُۥٓ ۖ إِنْ أَنتُمْ إِلَّا مُفْتَرُونَ ٥٠
৪৫.
এ হলো মু’মিনের সত্যিকার পরিচয়। কার্যকারণের এ জগতে সে অন্যান্য দুনিয়াবাসীর ন্যায় প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সমস্ত উপায় ও কলা-কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু সে উপায় ও কলা-কৌশলের ওপর ভরসা করে না। ভরসা করে একমাত্র আল্লাহর ওপর। সে খুব ভালো করেই জানে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর দয়া ও করুণা পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে যুক্ত না হলে তার কোন উপায় ও কলা-কৌশল শুরুও হতে পারে না, ঠিক মতো চলতেও পারে না, আর চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতেও পারে না।
৪৬.
জুদী পাহাড়টি কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে উমর দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। বাইবেলে উল্লেখিত নৌকার অবস্থান স্থলের নাম আরারত বলা হয়েছে। এটি আর্মেনিয়ার একটি পাহাড়েরও নাম এবং একটি পাহাড় শ্রেণীর নামও। পাহাড় শ্রেণী বলতে যে আরারতের কথা বলা হয়েছে সেটি আর্মেনিয়ার উচ্চ মালভূমি থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে কুর্দিস্থান পর্যন্ত চলে গেছে। এ পাহাড় শ্রেণীর একটি পাহাড়ের নাম জুদী পাহাড়। আজো এ পাহাড়টি এ নামেই পরিচিত। প্রাচীন ইতিহাসে এটাকেই নৌকা থামার জায়গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগে বেরাসাস (BERASUS) নামে ব্যবিলনের একজন ধর্মীয় নেতা পুরাতন কুলদানী বর্ণনার ভিত্তিতে নিজের দেশের যে ইতিহাস লেখেন তাতে তিনি জুদী নামক স্থানকেই নূহের নৌকা থামার জায়গা হিসেবে উল্লেখ করেন। এরিস্টটলের শিষ্য এবিডেনাস (ABYDENUS) ও নিজের ইতিহাস গ্রন্থে একথা সত্য বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া তিনি নিজের সময়ের অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ইরাকে বহু লোকের কাছে এ নৌকার অংশ বিশেষ রয়েছে। সেসব ধুয়ে তারা রোগ নিরাময়ের জন্য রোগীদের পান করায়।
এখানে যে প্লাবনের কথা বলা হয়েছে সেটি কি সারা পৃথিবীব্যাপী ছিল অথবা যে এলাকায় নূহের সম্প্রদায়ের অধিবাস ছিল কেবল সেই এলাকাভিত্তিক ছিল? এটি এমন একটি প্রশ্ন যার মীমাংসা আজো হয়নি। ইসরাঈলী বর্ণনাগুলোর কারণে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এ প্লাবন এসেছিল সারা দুনিয়া জুড়ে---(আদিপুস্তক ৭: ১৮-২৪)। কিন্তু কুরআনের কোথাও একথা বলা হয়নি। কুরআনের ইঙ্গিতসমূহ থেকে অবশ্যই একথা জানা যায় যে, নূহের প্লাবন থেকে যাদেরকে রক্ষা করা হয়েছিল পরবর্তী মানব বংশ তাদেরই আওলাদ।
মানচিত্র-()
কওমে নূহ-এর এলাকা ও জুদী পাহাড়
কিন্তু এথেকে একথা প্রমাণ হয় না যে, প্লাবন সারা দুনিয়া জুড়ে এসেছিল। কেননা একথা এভাবেও সত্য হতে পারে যে, সে সময় দুনিয়ার যে অংশ জুড়ে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল প্লাবন সে অংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর প্লাবনের পরে মানুষের যে বংশধারার উন্মেষ ঘটেছিল তারাই ধীরে ধীরে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এ মতবাদের সমর্থন দু’টি জিনিস থেকে পাওয়া যায়। এক, ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও মৃত্তিকাস্তরের ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে দাজলা ও ফোরাত বিধৌত এলাকায় একটি মহাপ্লাবনের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সারা দুনিয়ার সমস্ত অংশ জুড়ে কোন এক সময় একটি মহাপ্লাবন হয়েছিল এমন কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। দুই, সারা দুনিয়ার অধিকাংশ জাতির মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে একটি মহাপ্লাবনের কাহিনী শ্রুত হয়ে আসছে। এমন কি অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও নিউগিনির মতো দূরবর্তী দেশগুলোর পুরাকালের কাহিনীতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কোন এক সময় এসব জাতির পূর্বপুরুষরা পৃথিবীর একই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিল এবং তখন সেখানেই এ মহাপ্লাবন এসেছিল। তারপর যখন তাদের বংশধররা দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল তখন এ ঘটনার কাহিনীও তারা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। (দেখুন সূরা আ’রাফ, ৪৭ টীকা)
৪৭.
অর্থাৎ তুমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমার পরিজনদেরকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে। এখন ছেলে তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তাকেও রক্ষা করো।
৪৮.
অর্থাৎ তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এরপর আর কোন আবেদন নিবেদন খাটবে না। আর তুমি নির্ভেজাল জ্ঞান ও পূর্ণ ইনসাফের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকো।
৪৯.
ব্যাপারটা ঠিক এ রকম, যেমন এক ব্যক্তির শরীরের কোন একটা অংশ পচে গেছে। ডাক্তার অঙ্গটি কেটে ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন রোগী ডাক্তারকে বলছে, এটাতো আমার শরীরের একটা অংশ, আপনি কেটে ফেলে দেবেন? ডাক্তার জবাবে বলেন, এটা তোমার শরীরের অংশ নয়। কারণ এটা পচে গেছে। এ জবাবের অর্থ কখনো এ নয় যে, প্রকৃতপক্ষে এ অঙ্গটির শরীরের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। বরং এর অর্থ হবে, তোমার শরীরের জন্য সুস্থ ও কার্যকর অঙ্গের প্রয়োজন, পচা অঙ্গের নয়। কারণ পচা অঙ্গ একদিকে যেমন শরীরের কোন কাজে আসে না তেমনি অন্যদিকে বাদবাকি সমস্ত শরীরটাকেও নষ্ট করে দেয়। কাজেই যে অঙ্গটি পচে গেছে সেটি আর এ অর্থে তোমার শরীরের কোন অংশ নয় যে অর্থে শরীরের সাথে অঙ্গের সম্পর্কের প্রয়োজন হয়। ঠিক এমনিভাবেই একজন সৎ ও সত্যনিষ্ঠ পিতাকে যখন একথা বলা হয় যে, এ ছেলেটি তোমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত নয়, কারণ চরিত্র ও কর্মের দিক দিয়ে সে ধ্বংস হয়ে গেছে তখন এর অর্থ এ হয় না যে, এর মাধ্যমে তার ছেলে হবার বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে এর অর্থ শুধু এতটুকুই হয় যে, বিকৃত ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া লোক তোমার সৎ পরিবারের সদস্য হতে পারে না। সে তোমার রক্ত সম্পর্কীয় পরিবারের একজন সদস্য হতে পারে কিন্তু তোমার নৈতিক পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। আর আজ যে বিষয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে সেটি বংশগত বা জাতি-গোষ্ঠীগত কোন বিরোধের ব্যাপার নয়। এক বংশের লোকদের রক্ষা করা হবে এবং অন্য বংশের লোকদের ধ্বংস করে দেয়া হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। বরং এটি হচ্ছে কুফরী ও ঈমানের বিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার। এখানে শুধুমাত্র যারা সৎ তাদেরকে রক্ষা করা হবে এবং যারা অসৎ ও নষ্ট হয়ে গেছে তাদেরকে খতম করে দেয়া হবে।
ছেলেকে অসৎকর্ম পরায়ণ বলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। স্থুল দৃষ্টি সম্পন্ন লোকেরা সন্তানকে ভালোবাসে ও লালন করে শুধু এজন্য যে, তারা তাদের পেটে বা ঔরসে জন্ম নিয়েছে এবং তাদের সাথে তাদের রক্ত সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সৎ বা অসৎ হওয়ার ব্যাপারটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু মু’মিনের দৃষ্টি হতে হবে সত্যের প্রতি নিবদ্ধ। তাকে তো ছেলেমেয়েদেরকে এ দৃষ্টিতে দেখতে হবে যে, এরা আল্লাহর সৃষ্টি কতিপয় মানুষ। প্রাকৃতিক নিয়মে আল্লাহ এদেরকে তার হাতে সোর্পদ করেছেন। এদেরকে লালন-পালান করে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ দুনিয়ায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তৈরী করতে হবে। এখন তার যাবতীয় পরিশ্রম ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও তার ঘরে জন্ম নেয়া কোন ব্যক্তি যদি সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তৈরী হতে না পারে এবং যিনি তাকে মু’মিন বাপের হাতে সোর্পদ করেছিলেন নিজের সেই রবেরই বিশ্বস্ত খাদেম হতে না পারে, তাহলে সেই বাপকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, তার সমস্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এরপর এ ধরনের ছেলে-মেয়েদের সাথে তার মানসিক যোগ থাকার কোন কারণই থাকতে পারে না।
তারপর সংসারের সবচেয়ে প্রিয় ছেলেমেয়েদের ব্যাপারটি যখন এই তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে মু’মিনের দৃষ্টিভঙ্গি যা কিছু হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ঈমান একটি চিন্তাগত ও নৈতিক গুণ। এ গুণের প্রেক্ষিতেই মু’মিনকে মু’মিন বলা হয়। মু’মিন হওয়ার দিক দিয়ে অন্য মানুষের সাথে তার নৈতিক ও ঈমানী সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্কই নেই। রক্ত-মাংসের সম্পর্কযুক্ত কেউ যদি তার সাথে এ গুণের ক্ষেত্রে সম্পর্কিত হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সে তার আত্মীয়। কিন্তু যদি সে এ গুণ শূন্য হয় তাহলে মু’মিন শুধুমাত্র রক্ত-মাংসের দিক দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক রাখবে। তার হৃদয় ও আত্মার সম্পর্ক তার সাথে হতে পারে না। আর ঈমান ও কুফরীর বিরোধের ক্ষেত্রে যদি সে তার মুখোমুখি দাঁড়ায় তাহলে এ অবস্থায় সে এবং একজন অপরিচিত কাফের তার চোখে সমান হয়ে দেখা দেবে।
৫০.
এ উক্তি দেখে কারো এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, হযরত নূহের (আ) মধ্যে ঈমানী চেতনার অভাব ছিল অথবা তাঁর ঈমানে জাহেলিয়াতের কোন গন্ধ ছিল। আসল কথা হচ্ছে, নবীগণও মানুষ। আর মু’মিনের পূর্ণতার জন্য যে সর্বোচ্চ মানদণ্ড কায়েম করা হয়েছে সর্বক্ষণ তার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করে থাকা কোন মানুষের সাধ্যায়াত্ত নয়। কোন কোন সময় কোন নাজুক মনস্তাত্বিক অবস্থায় নবীর মতো উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোকও মুহূর্তকালের জন্য হলেও নিজের মানবিক দুর্বলতার কাছে পরাস্ত হন। কিন্তু যখনই তিনি অনুভব করেন অথবা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয় যে, তিনি কাংখিত মানের নিচে নেমে যাচ্ছেন তখনই তিনি তাওবা করেন এবং নিজের ভুলের সংশোধন করে নেবার ব্যাপারে এক মুহূর্তও ইতস্তত করেন না। হযরত নূহের নৈতিক উচ্চমানের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, জওয়ান ছেলেকে চোখের সামনে ডুবে যেতে দেখছেন! এ দৃশ্য দেখে তাঁর কলিজা ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে। কিন্তু যখনই আল্লাহ সবধান করে জানিয়ে দেন, যে ছেলে হককে ত্যাগ করে বাতিলের সহযোগী হয়েছে তাকে নিছক তোমার ঔরসজাত বলেই নিজের ছেলে মনে করা একটি জাহেলী ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। তখনই তিনি নিজের মানসিক আঘাতের ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে ইসলামের কাংখিত চিন্তা ও ভাবধারার দিকে ফিরে আসেন।
৫১.
নূহের ছেলের এ ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে তাঁর ইনসাফ যে কি পরিমাণ পক্ষপাতহীন এবং তাঁর ফায়সালা যে কত চূড়ান্ত হয়ে থাকে তা বলেছেন। মক্কার মুশরিকরা মনে করতো, আমরা যাই করি না কেন আমাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে পারে না। কারণ আমরা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আওলাদ এবং বড় বড় দেব-দেবীর ভক্ত। ইহুদী ও খৃস্টানরাও এমনি ধরনের কিছু ধারণা পোষণ করতো এবং এখনো পোষণ করে থাকে। অনেক ভ্রষ্টাচারী মুসলমানও এ ধরনের কিছু মিথ্যা ধারণার ওপর নির্ভর করে বসে আছে। তারা মনে করে, আমরা অমুক বুজুর্গের আওলাদ এবং অমুক বুজুর্গের ভক্ত। কাজেই তাদের সুপারিশই আমাদের আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবে। কিন্তু এখানে এর বিপরীতে যে দৃশ্য দেখানো হচ্ছে তা হচ্ছে এই যে, একজন মহান মর্যাদাশালী নবী নিজের চোখের সামনে নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে ডুবে যেতে দেখছেন এবং অস্থির হয়ে সন্তানের গোনাহ মাফ করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু আল্লাহর দরবার থেকে জবাবে তাঁকে ধমক দেয়া হচ্ছে। বাপের পয়গম্বরীর মর্যাদাও ছেলেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারছে না।
৫২.
অর্থাৎ যে পাহাড়ের ওপর নৌকা থেমেছিল তার ওপর থেকে নেমে যাও।
৫৩.
অর্থাৎ যেভাবে শেষ পর্যন্ত নূহ ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা সাফল্য লাভ করেছিলেন এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল ঠিক তেমনি তুমি ও তোমার সাথীরাও সাফল্য লাভ করবে এবং তোমাদেরও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এটিই আল্লাহর চিরাচরিত রীতি, শুরুতে সত্যের দুশমনরা যতই সফলতার অধিকারী হোক না কেন সবশেষে একমাত্র তারাই সফলকাম হয় যারা আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে চিন্তা ও কর্মের ভুল পথ পরিহার করে হকের উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকে। কাজেই এখন যেসব বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেসব সমস্যা-সংকটের সম্মুখীন তোমাদের হতে হচ্ছে এবং তোমাদের দাওয়াতকে দাবিয়ে দেবার জন্য তোমাদের বিরোধীদের আপাতদৃষ্টে যে সাফল্য দেখা যাচ্ছে, তাতে তোমাদের মন খারাপ করার প্রয়োজন নেই। বরং তোমরা সবর ও হিম্মত সহকারে কাজ করে যাও।
৫৪.
সূরা আ’রাফের ৫ রুকূ’র টীকাগুলো এক নজর দেখে নিন।
৫৫.
অর্থাৎ অন্যান্য যেসব মাবুদদের তোমরা বন্দেগী ও পূজা-উপাসনা করো তারা আসলে কোন ধরনের প্রভুত্বের গুণাবলী ও শক্তির অধিকারী নয়। বন্দেগী ও পূজা লাভের কোন অধিকারই তাদের নেই। তোমরা অযথাই তাদরকে মাবুদ বানিয়ে রেখেছো। তারা তোমাদের আশা পূরণ করবে এ আশা নিয়ে বৃথাই বসে আছো।