৩১ ) আমি তোমাদের একথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে। একথাও বলি না যে, আমি অদৃশ্যের জ্ঞান রাখি এবং আমি ফেরেশতা এ দাবীও করি না। ৩৭ আর আমি একথাও বলতে পারি না যে, তোমরা যাদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখো তাদেরকে আল্লাহ কখনো কোন কল্যাণ দান করবেন না। তাদের মনের অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন। যদি আমি এমনটি বলি তাহলে আমি হবো জালেম।”
وَلَآ أَقُولُ لَكُمْ عِندِى خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعْلَمُ ٱلْغَيْبَ وَلَآ أَقُولُ إِنِّى مَلَكٌۭ وَلَآ أَقُولُ لِلَّذِينَ تَزْدَرِىٓ أَعْيُنُكُمْ لَن يُؤْتِيَهُمُ ٱللَّهُ خَيْرًا ۖ ٱللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا فِىٓ أَنفُسِهِمْ ۖ إِنِّىٓ إِذًۭا لَّمِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ ٣١
৩২ ) শেষ পর্যন্ত তারা বললো, “হে নূহ! তুমি আমাদের সাথে ঝগড়া করেছো, অনেক ঝগড়া করেছো, যদি সত্যবাদী হও তাহলে এখন আমাদের যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছো তা নিয়ে এসো।”
قَالُوا۟ يَـٰنُوحُ قَدْ جَـٰدَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَٰلَنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ ٣٢
৩৩ ) নূহ জবাব দিল, “তা তো আল্লাহই আনবেন যদি তিনি চান এবং তা প্রতিহত করার ক্ষমতা তোমাদের নেই।
قَالَ إِنَّمَا يَأْتِيكُم بِهِ ٱللَّهُ إِن شَآءَ وَمَآ أَنتُم بِمُعْجِزِينَ ٣٣
৩৪ ) এখন যদি আমি তোমাদের কিছু মঙ্গল করতে চাইও তাহলে আমার মঙ্গলাকাংখা তোমাদের কোন কাজে লাগবে না যখন আল্লাহ নিজেই তোমাদের বিভ্রান্ত করার এরাদা করে ফেলেছেন। ৩৮ তিনিই তোমাদের রব এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।”
وَلَا يَنفَعُكُمْ نُصْحِىٓ إِنْ أَرَدتُّ أَنْ أَنصَحَ لَكُمْ إِن كَانَ ٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يُغْوِيَكُمْ ۚ هُوَ رَبُّكُمْ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ٣٤
৩৫ ) হে মুহাম্মাদ! এরা কি একথা বলে যে, এ ব্যক্তি নিজেই সবকিছু রচনা করেছে? ওদেরকে বলে দাও, “যদি আমি নিজে এসব রচনা করে থাকি, তাহলে আমার অপরাধের দায়-দায়িত্ব আমার। আর যে অপরাধ তোমরা করে যাচ্ছো তার জন্য আমি দায়ী নই।” ৩৯
أَمْ يَقُولُونَ ٱفْتَرَىٰهُ ۖ قُلْ إِنِ ٱفْتَرَيْتُهُۥ فَعَلَىَّ إِجْرَامِى وَأَنَا۠ بَرِىٓءٌۭ مِّمَّا تُجْرِمُونَ ٣٥
৩৬ ) নূহের প্রতি অহী নাযিল করা হলো এ মর্মে যে, তোমার কওমের মধ্য থেকে যারা ইতিমধ্যে ঈমান এনেছে, তারা ছাড়া এখন আর কেউ ঈমান আনবে না। তাদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ করা পরিহার করো
وَأُوحِىَ إِلَىٰ نُوحٍ أَنَّهُۥ لَن يُؤْمِنَ مِن قَوْمِكَ إِلَّا مَن قَدْ ءَامَنَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوا۟ يَفْعَلُونَ ٣٦
৩৭ ) এবং আমার তত্ত্বাবধানে আমার অহী অনুযায়ী একটি নৌকা বানানো শুরু করে দাও। আর দেখো যারা জুলুম করেছে তাদের জন্য আমার কাছে কোন সুপারিশ করো না, এরা সবাই এখন ডুবে যাবে। ৪০
وَٱصْنَعِ ٱلْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا وَلَا تُخَـٰطِبْنِى فِى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓا۟ ۚ إِنَّهُم مُّغْرَقُونَ ٣٧
৩৮ ) নূহ যখন নৌকা নির্মাণ করছিল তখন তার কওমের সরদারদের মধ্য থেকে যারাই তাঁর কাছ দিয়ে যেতো তারাই তাঁকে উপহাস করতো। সে বললো, “যদি তোমরা আমাকে উপহাস করো তাহলে আমিও তোমাদের উপহাস করছি।
وَيَصْنَعُ ٱلْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌۭ مِّن قَوْمِهِۦ سَخِرُوا۟ مِنْهُ ۚ قَالَ إِن تَسْخَرُوا۟ مِنَّا فَإِنَّا نَسْخَرُ مِنكُمْ كَمَا تَسْخَرُونَ ٣٨
৩৯ ) শিগ্গীর তোমরা জানতে পারবে কার ওপর লাঞ্ছনাকর আযাব নাযিল হবে এবং কার ওপর এমন আযাব নাযিল হবে যা ঠেকাতে চাইলেও ঠেকানো যাবে না। ৪১
فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ مَن يَأْتِيهِ عَذَابٌۭ يُخْزِيهِ وَيَحِلُّ عَلَيْهِ عَذَابٌۭ مُّقِيمٌ ٣٩
৪০ ) অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেলো এবং চুলা উথলে উঠলো ৪২ তখন আমি বললাম, “সব ধরনের প্রাণীর এক এক জোড়া নৌকায় তুলে নাও। নিজের পরিবারবর্গকেও--- তবে তাদের ছাড়া যাদেরকে আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে ৪৩ --- এতে তুলে নাও এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে এতে বসাও।” ৪৪ তবে সামান্য সংখ্যক লোকই নূহের সাথে ঈমান এনেছিল।
حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءَ أَمْرُنَا وَفَارَ ٱلتَّنُّورُ قُلْنَا ٱحْمِلْ فِيهَا مِن كُلٍّۢ زَوْجَيْنِ ٱثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَيْهِ ٱلْقَوْلُ وَمَنْ ءَامَنَ ۚ وَمَآ ءَامَنَ مَعَهُۥٓ إِلَّا قَلِيلٌۭ ٤٠
৩৭.
বিরোধী পক্ষ তাঁর ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে বলেছিল, তোমাকে তো আমরা আমাদেরই মত একজন মানুষ দেখছি। তাদের আপত্তির জবাবে একথা বলা হয়েছিল। এখানে হযরত নূহ (আ) বলেন, যথার্থই আমি একজন মানুষ। একজন মানুষ হওয়া ছাড়া নিজের ব্যাপারে তো আমি আর কিছুই দাবী করিনি। তাহলে তোমরা আমার বিরুদ্ধে এ আপত্তি উঠাচ্ছো কেন? আমি শুধু এতটুকুই দাবী করি যে, আল্লাহ আমাকে জ্ঞান ও কর্মের সহজ সোজা পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা এ ব্যাপারটির পরীক্ষা করে নাও। কিন্তু এ দাবীর ব্যাপারটি পরীক্ষা করার এ কোন্ ধরনের পদ্ধতি যে, কখনো তোমরা আমার কাছে গায়েবের খবর জিজ্ঞেস করো, কখনো এমন ধরনের অদ্ভূত দাবী উত্থাপন করতে থাকো যাতে মনে হয় যেন আল্লাহর ভাণ্ডারের সমস্ত চাবী আমার কাছে আছে আবার কখনো আপত্তি করতে থাকো যে, আমি মানুষের মতো আহার-বিহার করি কেন? যেন মনে হয় আমি ফেরেশতা হবার দাবী করেছিলাম। যে ব্যক্তি আকীদা-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা ও সমাজ-সংস্কৃতির ব্যাপারে সঠিক পথের দিশা দেবার দাবী করেছে তাকে এ জিনিসগুলোর ব্যাপারে যে কোন প্রশ্ন চাও করতে পারো। কিন্তু তোমরা দেখি অদ্ভূত লোক। তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করছো অমুকের মোষের নর-বাচ্চা হবে না মাদী-বাচ্চা? প্রশ্ন হলো মানুষের জীবনের জন্য সঠিক নৈতিক ও তামাদ্দুনিক নীতি বর্ণনা করার সাথে মোষের বাচ্চা প্রসব করার কোন সম্পর্ক আছে কি? (দেখুন সূরা আন’আম, ৩১ ও ৩২ টীকা)
৩৮.
অর্থাৎ আল্লাহ যদি তোমাদের হঠকারিতা, দুর্মতি এবং সদাচারে আগ্রহহীনতা দেখে এ ফায়সালা করে থাকেন যে, তোমাদের সঠিক পথে চলার সুযোগ আর দেবেন না এবং যেসব পথে তোমরা উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে চাও সেসব পথে তোমাদের ছেড়ে দেবেন তাহলে এখন আর তোমাদের কল্যাণের জন্য আমার কোন প্রচেষ্টা সফলকাম হতে পারে না।
৩৯.
বক্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে হযরত নূহের (আ) এ কাহিনী শুনে বিরোধীরা আপত্তি করে থাকবে যে, মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের ওপর প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে নিজেই এ কাহিনী বানিয়ে পেশ করছে। যেসব আঘাত সে সরাসরি আমাদের ওপর করতে চায় না সেগুলোর জন্য সে একটি কাহিনী তৈরী করেছে এবং এভাবে “ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো”র মতো আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ কারণে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে এ বাক্যে তাদের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে।
আসলে হীনমনা লোকদের দৃষ্টি সবসময় কোন বিষয়ের খারাপ দিকের প্রতিই পড়ে থাকে। ভালোর প্রতি তাদের কোন আগ্রহ না থাকায় ভালো দিকের প্রতি তাদের দৃষ্টিই যায় না। কোন ব্যক্তি যদি তোমাদের কোন জ্ঞানের কথা বলে থাকে অথবা কোন সুশিক্ষা দিতে থাকে কিংবা তোমাদের কোন ভুলের দরুন তোমাদের সতর্ক করে, তাহলে তা থেকে ফায়দা হাসিল করো এবং নিজেদের সংশোধন করে নাও। কিন্তু হীন লোকেরা সবসময় তার মধ্যে দুষ্কৃতির এমন কোন বিষয় খুঁজবে যার ফলে জ্ঞান ও উপদেশ ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং তারা নিজেরা কেবল দুষ্কৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিতই থাকবে না বরং বক্তার গায়েও কিছু দুষ্কৃতির ছাপ লাগিয়ে দেবে। সর্বোত্তম উপদেশও নষ্ট করে দেয়া যেতে পারে যদি শ্রোতা তাকে কল্যাণকামিতার পরিবর্তে “আঘাত” করার অর্থে গ্রহণ করে এবং সে মানসিকভাবে নিজের ভুল উপলব্ধি ও অনুভব করার পরিবর্তে কেবল বিরূপ মনোভাবই পোষণ করতে থাকে। তারপর এ ধরনের লোকেরা হামেশা নিজেদের চিন্তার ভিত গড়ে তোলে একটি মৌলিক কুধারণার ওপর। কোন একটি বক্তব্য নিরেট সত্য অথবা স্রেফ একটি বানোয়াট কাহিনী উভয়ই হতে পারে। এ উভয় রকমের সম্ভাবনা যেখানে সমান সমান, সেখানে বক্তব্যটি যদি কারোর অবস্থার সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায় এবং তাতে তার কোন ভুলের প্রতি অংগুলি নির্দেশ থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে একজন প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ হবে তাকে একটি যথার্থ সত্য কথা মনে করে তার শিক্ষণীয় দিক থেকে ফায়দা হাসিল করা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই এ মর্মে দোষারোপ করে যে, বক্তা নিছক তার ওপর চাপিয়ে দেবার জন্য এ মনগড়া কাহিনী রচনা করেছে তাহলে সে হবে নেহাতই একজন কুধারণা পোষক ও বক্র দৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তি।
এ কারণে বলা হয়েছে, যদি আমি এ কাহিনী তৈরী করে থাকি তাহলে আমার অপরাধের জন্য আমি দায়ী কিন্তু তোমরা যে অপরাধ করছো তা তো যথাস্থানে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তার জন্য আমি নই, তোমরাই দায়ী হবে এবং তোমরাই পাকড়াও হবে।
৪০.
এ থেকে জানা যায়, কোন জাতির কাছে যখন নবীর পয়গাম পৌঁছে যায় তখন সে কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত অবকাশ পায় যতক্ষণ তার মধ্যে কিছু সৎ ব্যক্তির বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যখন তার সমস্ত সত্যনিষ্ঠ লোক বের হয়ে যায় এবং সেখানে কেবল অসৎ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী লোকেরাই অবশিষ্ট থেকে যায় তখন আল্লাহ সেই জাতিকে আর অবকাশ দেন না। তখন তাঁর রহমতই দাবী জানাতে থাকে যে, পঁচা ফলের ঝুড়ি সদৃশ ঐ জাতিটাকে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়া হোক যাতে তা ভালো ফলগুলোকেও নষ্ট না করে দেয়। এ অবস্থায় তার প্রতি সদয় হওয়া আসলে সারা দুনিয়াবাসী এবং এ সঙ্গে ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতিও নির্দয় আচরণ করার নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়।
৪১.
এটি একটি চমকপ্রদ ব্যাপার। এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায়, মানুষ দুনিয়ার বাইরের চেহারা দেখে কেমন প্রতারিত হয়। যখন নূহ আলাইহিস সালাম সাগর থেকে অনেক দূরে শুকনো স্থলভূমির ওপর নিজের জাহাজটি নির্মাণ করছিলেন তখন যথার্থই লোকদের দৃষ্টিতে তাঁর এ কাজটি অত্যন্ত হাস্যকর মনে হয়ে থাকবে এবং তারা হয়তো হাসতে হাসতে বলে থাকবে, “মিয়া সাহেবের পাগলামি শেষ পর্যন্ত এতদূর পৌঁছে গেছে যে, এবার তিনি শুকনো ডাংগায় জাহাজ চালাবেন।” সেদিন তাদের কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, কয়েকদিন পরে সত্যিই এখানে জাহাজ চলবে। তারা এ কাজটিকে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের মস্তিষ্ক বিকৃতির একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ গণ্য করে থাকবে এবং পরস্পরকে বলে থাকবে, যদি ইতিপূর্বে এ ব্যক্তির পাগলামির ব্যাপারে তোমাদের মনে কোন সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে এবার নিজের চোখে দেখে নাও কি কাণ্ডটা সে এখন করছে। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্য ব্যাপার জানতো এবং আগামীকাল এখানে জাহাজের কি রকম প্রয়োজন হবে একথা যার জানা ছিল সে উল্টো তাদের অজ্ঞতা ও প্রকৃত ব্যাপার না জানা এবং তদুপরি তাদের বোকার মতো নিশ্চিন্ত থাকার ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চয়ই হেসে থাকবে।
সে নিশ্চয়ই বলে থাকবে “কত বড় অজ্ঞ নাদান এ লোকগুলো, এদের মাথার ওপর উদ্যত মৃত্যুর খড়গ, আমি এদেরকে সাবধানও করে দিলাম যে, সেই খড়গ মাথার ওপর পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং এরপর এদের চোখের সামনেই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুতি গ্রহণ করছি কিন্তু এরা নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে এবং উল্টো আমাকেই পাগল মনে করছে। এ বিষয়টিকে যদি একটু বিস্তারিতভাবে ভেবে দেখা যায় তাহলে বুঝা যাবে যে, দুনিয়ায় বাহ্যিক ও স্থূল জ্ঞানের আলোকে বুদ্ধিমত্তা ও নির্বুদ্ধিতার যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় তা প্রকৃত ও যথার্থ সত্য জ্ঞানের আলোকে নির্ধারিত মানদণ্ডের তুলনায় কত বেশী ভিন্নতর হয়ে থাকে। বাহ্যদৃষ্টিতে যে ব্যক্তি দেখে, সে যে জিনিসটিকে চরম বুদ্ধিমত্তা মনে করে, প্রকৃত সত্যদর্শীর চোখে তা হয় চরম নির্বুদ্ধিতা। অন্যদিকে বাহ্যদর্শীর চোখে যে জিনিসটি একেবারেই অর্থহীন, পুরোপুরি পাগলামি ও নেহাত হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়, সত্যদর্শীর কাছে তা-ই পরম জ্ঞানগর্ভ, সুচিন্তিত ও গুরুত্বের অধিকারী এবং বুদ্ধিবৃত্তির যথার্থ দাবী হিসেবে পরিগণিত হয়।
৪২.
এ সম্পর্কে মুফাস্সিরগণের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে যা বুঝা যায় সেটিকেই আমরা সঠিক মনে করি। কুরআনের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, প্লাবনের সূচনা হয় একটি বিশেষ চুলা থেকে। তার তলা থেকে পানির স্রোত বের হয়ে আসে। তারপর একদিকে আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হতে থাকে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফুঁড়ে পানির ফোয়ারা বেরিয়ে আসতে থাকে। এখানে কেবল চুলা থেকে পানি উথলে ওঠার কথা বলা হয়েছে এবং সামনের দিকে গিয়ে বৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু সূরা ‘কামারে’ এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُنْهَمِرٍ - وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُونًا فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ
“আমি আকাশের দরজা খুলে দিলাম। এর ফলে অনবরত বৃষ্টি পড়তে লাগলো। মাটিতে ফাটল সৃষ্টি করলাম। ফলে চারদিকে পানির ফোয়ারা বের হতে লাগলো। আর যে কাজটি নির্ধারিত করা হয়েছিল এ দু’ধরনের পানি তা পূর্ণ করার জন্য পাওয়া গেলো।”
তাছাড়া “তান্নূর” (চুলা) শব্দটির ওপর আলিফ-লাম বসানোর মাধ্যমে একথা প্রকাশ করা হয় যে, একটি বিশেষ চুলাকে আল্লাহ এ কাজ শুরু করার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই চুলাটির তলা ঠিক সময় মতো ফেটে পানি উথলে ওঠে। পরে এ চুলাটিই প্লাবনের চুলা হিসেবে পরিচিত হয়। সূরা মু’মিনূনের ২৭ আয়াতে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, এ চুলাটির কথা আগেই বলে দেয়া হয়েছিল।
৪৩.
অর্থাৎ তোমার পরিবারের যেসব লোকের কথা আগেই বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা কাফের এবং আল্লাহর রহমতের অধিকারী নয় তাদেরকে নৌকায় ওঠাবে না। সম্ভবত এরা ছিল দু’জন। একজন ছিল হযরত নূহের (আ) ছেলে। তার ডুবে যাওয়ার কথা সামনেই এসে যাচ্ছে। অন্যজন ছিল হযরত নূহের (আ) স্ত্রী। সূরা তাহরীমে এর আলোচনা এসেছে। সম্ভবত পরিবারের অন্যান্য লোকজনও এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু কুরআনে তাদের নাম নেই।
৪৪.
যেসব ঐতিহাসিক ও নৃ-বিজ্ঞানী সমগ্র মানবজাতির বংশধারা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের তিন ছেলের সাথে সংযুক্ত করেন, এখান থেকে তাদের মতবাদ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। আসলে ইসরাঈলী পৌরণিক বর্ণনাগুলো এ বিভ্রান্তির উৎস। সেখানে বলা হয়েছে যে, নূহের প্লাবনের হাত থেকে হযরত নূহ (আ) ও তাঁর তিন ছেলে এবং তাদের স্ত্রীরা ছাড়া আর কেউ রক্ষা পায়নি (দেখুন বাইবেল, আদি পুস্তক ৬: ১৮, ৭: ৭, ৯: ১ এবং ৯: ১৯)। কিন্তু কুরআনের বহু জায়গায় একথা স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত নূহের পরিবার ছাড়া তাঁর কওমের বেশ কিছু সংখ্যক লোককেও, তাঁদের সংখ্যা সামান্য হলেও আল্লাহ প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাছাড়া কুরআন পরবর্তী মানব সম্প্রদায়কে শুধুমাত্র নূহের বংশধর নয় বরং তাঁর সাথে নৌকায় যেসব লোককে আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন তাদের সবার বংশধর গণ্য করেছে। বলা হয়েছেঃ
ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ
“যাদেরকে আমি নৌকায় নূহের সাথে সওয়ার করিয়েছিলাম তাদের বংশধর।” (বনী ইসরাঈল ৩)
مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ
“আদমের বংশধরদের মধ্য থেকে এবং নূহের সাথে যাদেরকে আমি নৌকায় সওয়ার করিয়েছিলাম তাদের মধ্য থেকে।” (মারয়াম, ৫৮ আয়াত)