৭১ ) মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। এরা ভাল কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। ৮০ এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবেই। অবশ্যই আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালী এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।
وَٱلْمُؤْمِنُونَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۢ ۚ يَأْمُرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ ٱللَّهُ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ٧١
৭২ ) এ মুমিন পুরুষ ও নারীকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে তিনি এমন বাগান দান করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান হবে এবং তারা তার মধ্যে চিরকাল বাস করবে। এসব চির সবুজ বাগানে তাদের জন্য থাকবে বাসগৃহ এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَا وَمَسَـٰكِنَ طَيِّبَةًۭ فِى جَنَّـٰتِ عَدْنٍۢ ۚ وَرِضْوَٰنٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ ٧٢
৭৩ ) হে নবী! ৮১ পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাফের ও মুনাফিক উভয়ের মোকাবিল করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। ৮২ শেষ পর্যন্ত তাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থান স্থল।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ جَـٰهِدِ ٱلْكُفَّارَ وَٱلْمُنَـٰفِقِينَ وَٱغْلُظْ عَلَيْهِمْ ۚ وَمَأْوَىٰهُمْ جَهَنَّمُ ۖ وَبِئْسَ ٱلْمَصِيرُ ٧٣
৭৪ ) তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে বলে, আমরা ও কথা বলিনি। অথচ তারা নিশ্চয়ই সেই কুফরীর কথাটা বলেছে। ৮৩ তারা ইসলাম গ্রহণের পর কুফরী অবলম্বন করেছে। তারা এমনসব কিছু করার সংকল্প করেছিল যা করতে পারেনি। ৮৪ আল্লাহ ও তাঁর রসূল নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাব মুক্ত করে দিয়েছেন বলেই তাদের এত ক্রোধ ও আক্রোশ! ৮৫ এখন যদি তারা নিজেদের এহন আচরণ থেকে বিরত হয়, তাহলে তাদের জন্যই ভাল। আর যদি বিরত না হয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং পৃথিবীতে তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী ও সাহায্যকারী কেউ থাকবে না।
يَحْلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُوا۟ وَلَقَدْ قَالُوا۟ كَلِمَةَ ٱلْكُفْرِ وَكَفَرُوا۟ بَعْدَ إِسْلَـٰمِهِمْ وَهَمُّوا۟ بِمَا لَمْ يَنَالُوا۟ ۚ وَمَا نَقَمُوٓا۟ إِلَّآ أَنْ أَغْنَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ مِن فَضْلِهِۦ ۚ فَإِن يَتُوبُوا۟ يَكُ خَيْرًۭا لَّهُمْ ۖ وَإِن يَتَوَلَّوْا۟ يُعَذِّبْهُمُ ٱللَّهُ عَذَابًا أَلِيمًۭا فِى ٱلدُّنْيَا وَٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ وَمَا لَهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ مِن وَلِىٍّۢ وَلَا نَصِيرٍۢ ٧٤
৭৫ ) তাদের মধ্যে এমনও কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিল, যদি তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের ধন্য করেন তাহলে আমরা দান করবো এবং সৎ হয়ে যাবো।
۞ وَمِنْهُم مَّنْ عَـٰهَدَ ٱللَّهَ لَئِنْ ءَاتَىٰنَا مِن فَضْلِهِۦ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ ٧٥
৭৬ ) কিন্তু যখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে বিত্তশালী করে দিলেন তখন তারা কার্পণ্য করতে লাগলো এবং নিজেদের অঙ্গীকার থেকে এমনভাবে পিছটান দিল যে, তার কোন পরোয়াই তাদের রইল না। ৮৬
فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُم مِّن فَضْلِهِۦ بَخِلُوا۟ بِهِۦ وَتَوَلَّوا۟ وَّهُم مُّعْرِضُونَ ٧٦
৭৭ ) ফলে তারা আল্লাহর সাথে এই যে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো এবং এই যে, মিথ্যা বলতে থাকলো, এ কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে মুনাফিকী বদ্ধমূল করে দিলেন, তার দরবারে তাদের উপস্থিতির দিন পর্যন্ত তা তাদের পিছু ছাড়বে না।
فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًۭا فِى قُلُوبِهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ يَلْقَوْنَهُۥ بِمَآ أَخْلَفُوا۟ ٱللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا۟ يَكْذِبُونَ ٧٧
৭৮ ) তারা কি জানে না, আল্লাহ তাদের গোপন কথাও গোপন সলা-পরামর্শ পর্যন্ত জানেন এবং তিনি সমস্ত অদৃশ্য বিষয়ও পুরোপুরি অবগত?
أَلَمْ يَعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ يَعْلَمُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَىٰهُمْ وَأَنَّ ٱللَّهَ عَلَّـٰمُ ٱلْغُيُوبِ ٧٨
৭৯ ) (তিনি এমন সব কৃপণ ধনীদেরকে ভাল করেই জানেন) যারা ঈমানদেরদের সন্তোষ ও আগ্রহ সহকারে আর্থিক ত্যাগ স্বীকারের প্রতি দোষ ও অপবাদ আরোপ করে এবং যাদের কাছে (আল্লাহর পথে দান করার জন্য) নিজেরা কষ্ট সহ্য করে যা কিছু দান করে তাছাড়া আর কিছুই নেই, তাদেরকে বিদ্রূপ করে। ৮৭ আল্লাহ এ বিদ্রূপকারীদেরকে বিদ্রূপ করেন। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। ৮৭ আল্লাহ এ বিদ্রূপকারীদেরকে বিদ্রূপ করেন। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
ٱلَّذِينَ يَلْمِزُونَ ٱلْمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ فِى ٱلصَّدَقَـٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ ۙ سَخِرَ ٱللَّهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٧٩
৮০ ) হে নবী! তুমি এ ধরনের লোকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো, তুমি যদি এদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তাহলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না। কারণ তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে। আর আল্লাহ ফাসেকদেরকে মুক্তির পথ দেখান না।
ٱسْتَغْفِرْ لَهُمْ أَوْ لَا تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِن تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّةًۭ فَلَن يَغْفِرَ ٱللَّهُ لَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ۗ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلْفَـٰسِقِينَ ٨٠
৮০.
মুনাফিকরা যেমন একটি জাতি বা দল তেমনি মু’মিনরাও একটি স্বতন্ত্র দল। যদিও উভয় দলই প্রকাশ্যে ঈমানের স্বীকৃতি দেয়া এবং বাহ্যত ইসলামের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশ নেয়। কিন্তু তবুও উভয়ের স্বভাব-প্রকৃতি, আচর,-আচরণ, অভ্যাস, চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মধারা পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেখানে কেবল মুখে ঈমানের দাবী কিন্তু অন্তরে সত্যিকার ঈমানের ছিঁটেফোটা ও নেই সেখানে জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ড তার প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে ঈমানের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। বাইরে লেবেল আটা রয়েছে, মিশক(মৃগনাভি) বলে। কিন্তু লেবেলের নীচে যা কিছু আছে তা অন্যদিকে ঈমান যেখানে তার মূল তাৎপর্য সহকারে বিরাজিত সেখানে মিশক, তার নিজের চেহারা আকৃতিতে নিজের খোশবু-সুরভিতে এবং নিজের বৈশিষ্ট্য-গুণাবলীতে সব ব্যাপারেই ও সব পরীক্ষাতেই নিজের মিশক, হবার কথা সাড়ম্বরে প্রকাশ করে যাচ্ছে। ইসলাম ও ঈমানদের পরিচিত নামই বাহ্যত উভয় দলকে এক উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। নয়তো আসলে মুনাফিক মুসলমানের নৈতিক বৃত্তি ও স্বভাব প্রকৃতি সত্যিকার ও সাচ্চা ঈমানদার মুসলমান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ কারণে মুনাফিকী স্বভাবের অধিকারী পুরুষ ও নারীরা একটা পৃথক দলে পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে যাওয়া, অসৎ কাজে আগ্রহী হওয়া, নেকীর কাছ থেকে দূরে থাকা এবং সৎকাজের সাথে অসহযোগিতা করার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তাদেরকে পরস্পরের সাথে যুথিবদ্ধ করেছে এবং মু’মিনদের সাথে কার্যত সম্পর্কহীন করে দিয়েছে। অন্যদিকে সাচ্চা মু’মিন পুরুষ ও নারীরা একটি পৃথক দলে পরিণত হয়েছে। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা নেকীর কাজে আগ্রহী এবং গুনাহের কাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। আল্লাহর স্মরণ তাদের জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার জন্য তাদের অন্তর ও হাত সারাক্ষণ উন্মুক্ত থাকে। আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য তাদের জীবনাচরণের অন্তর্ভুক্ত। এ সাধারণ নৈতিক বৃত্তি ও জীবন যাপন পদ্ধতি তাদেরকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে এবং মুনাফিকদের দল থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
৮১ .
তাবুক যুদ্ধের পর যে ভাষণটি নাযিল হয়েছিল এখান থেকে সেই তৃতীয় ভাষণটি শুরু হচ্ছে।
৮২.
এ পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যকলাপের ব্যাপারে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। এর দু’টি কারণ ছিল। এক, তখনো পর্যন্ত মুসলমানদের হাত এত বেশী শক্তিশালী হতে পারেনি, যে, বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে তারা ভেতরের শত্রুদের সাথেও লড়াই করতে পারতো। দুই, যারা সন্দেহ-সংশয়ে ডুবে ছিল ঈমান ও প্রত্যয় লাভ করার জন্য তাদেকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। এ দু’টি কারণ এখন আর বর্তমান ছিল না। মুসলিম শক্তি এখন সমগ্র আরব ভূখণ্ডকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে নিয়েছিল এবং আরবের বাইরের শক্তিগুলোর সাথে সংঘাতের সিলসিলা শুরু হতে যাচ্ছিল। এ কারণে ঘরের এ শত্রুদের মাথা গুড়ো করে দেয়া এখন সম্ভবও ছিল এবং অপরিহার্যও হয়ে পড়েছিল। তাহলে তারা আর বিদেশী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশে আভ্যন্তরীণ বিপদ সৃষ্টি করতে পারতো না। তাছাড়া তাদেরকে ৯ বছর সময় দেয়া হয়েছিল চিন্তা-ভাবনা করার, বুঝার এবং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে যাচাই-পর্যালোচনা করার জন্য। তাদের মধ্যে যথার্থ কল্যাণ লাভের কোন আকাঙ্ক্ষা থাকলে তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতো। এরপর তাদেরকে আরো বেশী সুযোগ সুবিধা দেয়ার মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও এবার জিহাদ শুরু করে দিতে হবে এবং এদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত যে উদার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে তার অবসান ঘটিয়ে কঠোর নীতি অবলম্ব করতে হবে।
তাই বলে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ও কঠোর নীতি অবলম্বন করার মানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়। আসলে এর অর্থ হচ্ছে, তাদের মুনাফিকী মনোভাব ও কর্মনীতিকে এ পর্যন্ত যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং যে কারণে তারা মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে থেকেছে, সাধারণ মুসলমানরা তাদেরকে নিজেদের সমাজেরই একটি অংশ মেনে করেছে এবং তারা ইসলামী দল ও সংগঠনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ও ইসলামী সমাজে মুনাফিকীর বিষ ছড়াবার যে সুযোগ পেয়েছে তা এখন ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। এখন যে ব্যক্তিই মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করবে এবং যার কার্যধারা থেকে একথাও প্রকাশ হবে, যে সে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের অন্তরঙ্গ বন্ধু নয়, সর্ব সম্মুখে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে এবং নিন্দা করতে হবে। মুসলিম সমাজে তার মর্যাদা ও আস্থা লাভের সকল প্রকার সুযোগ খতম করে দিতে হবে। তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দলীয় পরামর্শের ক্ষেত্রে থেকে তাকে দূরে রাখতে হবে। আদালতে তার সাক্ষ্য অনির্ভরযোগ্য গণ্য করতে হবে। বড় বড় পদ ও মর্যাদার দরজা তার জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। সভা-সমিতিতে তাকে গুরুত্ব দেবে না। প্রত্যেক মুসলমান তার সাথে এমন আচরণ করবে যাতে সে নিজে অনুভব করতে পারে যে, সমগ্র মুসলিম সমাজে কোথাও তার কোন মর্যাদা ও গুরুত্ব নেই এবং কারো অন্তরে তার জন্য এতটুকু সম্ভ্রমবোধও নেই। তারপর তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে তার অপরাধ লুকানো যাবে না এবং তাকে ক্ষমা করা ও যাবে না। বরং সর্ব সম্মুখে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দামা চালাতে হবে এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এ পর্যায়ে মুসলমানদেরকে এ নির্দেশটি দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ইসলামী সমাজকে অবনতি ও পতনের আভ্যন্তরীণ কার্যকারণ থেকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো না। যে জামায়াত ও সংগঠন তার নিজের মধ্যে মুনাফিক ও বিশ্বাসঘাতকদেরকে লালন করে এবং যেখানে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা হয়, তার নৈতিক অধঃপতন এবং সবশেষে পূর্ণ ধ্বংস ছাড়া গত্যন্তর নেই। মুনাফিকী প্লেগের মতো একটি মহামারী। আর মুনাফিক হচ্ছে এমন একটি ইঁদুর যে এ মহামারীর জীবাণু বহন করে বেড়ায়। তাকে জনবসতির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়ার অর্থ গোটা জনবসতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। মুসলমানদের সমাজে একজন মুনাফিকদের মর্যাদা ও সম্ভ্রম লাভ করার অর্থ হলো হাজার হাজার মানুষকে বিশ্বাসঘাতকতা ও মুনাফিকী করতে দুঃসাহস যোগানো। এতে সাধারণ্যে এ ধারণা বিস্তার লাভ করে যে, এ সমাজে মার্যাদা লাভ করার জন্য আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সাচ্চা ঈমানদারীর কোন প্রয়োজন নেই। বরং মিথ্যা ঈমানদের প্রদর্শনীয় সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ অবলম্বন করেও এখানে মানুষ ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠতে পারে। একথাটিই রসূলুল্লাহ ﷺ তার একটি সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
من وقر صاحب بدعة فقد أعان على هدم الإسلام
“যে ব্যক্তি কোন বিদআত পন্থীকে সম্মান করলো সে আসলে ইসলামের ইমারত ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করলো।”
৮৩.
এখানে যে কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সেটি কি ছিল? সে সম্পর্কে কোন নিশ্চিত তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছেনি। তবে হাদীসে বেশ কিছু কুফরী কথাবার্তার উল্লেখ করা হয়েছে যা মুনাফিকরা বলাবলি করতো। যেমন এক মুনাফিকের ব্যাপারে বলা হয়েছেঃ
সে তার আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন মুসলিম যুবকের সাথে কথা বলার সময় বললোঃ যদি এ ব্যক্তি (অর্থাৎ নবী (সা.)) যা বলেছেন তা সব সত্য হয় তাহলে আমরা সবাই গাধার চেয়ে ও অধম। আর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ তাবুকের সফরে এক জায়গায় নবী (সা.) এর উটনী হারিয়ে যায়। মুসলমানরা সেটি খুঁজে বেড়াতে থাকে। মুনাফিকদের একটি দল এ ব্যাপারটি নিয়ে নিজেদের মজলিসে খুব হাসাহাসি করতে থাকে। তারা বলতে থাকে, “ইনি তো আকাশের খবর খুব শুনিয়ে থাকেন কিন্তু নিজের উটনীর এখন কোথায় সে খবর তো তার জানা নেই।”
৮৪.
তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা যেসব ষড়যন্ত্র করেছিল এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ষড়যন্ত্রটির মুহাদ্দিসগণ নিম্নোক্ত ভাবে বর্ণনা করেছেন। তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিম সেনাদল যখন এমন একটি পাহাড়ী রাস্তার কাছে পৌঁছুল তখন কয়েক জন মুনাফিক নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিল যে, রাতে উঁচু গিরিপথ দিয়ে চলার সময় নবী (সা.) কে তারা পার্শ্ববর্তী গভীর খাদের মধ্যে ঠেলে ফেলে দেবে। নবী (সা.) একথা জানতে পারলেন। তিনি সমগ্র সেনাদলকে গিরিপথ এড়িয়ে উপত্যকার সমতল ভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন এবং নিজে শুধুমাত্র আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা.) ও হুযাইফা ইবনে ইয়ামনকে ﷺ নিয়ে গিরিপথের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলেন। পথিমধ্যে জানতে পারলেন, দশ বারোজন মুনাফিক মুখোশ পরে পিছনে পিছনে আসছে। এ অবস্থা দেখে হযরত হুযাইফা (রা.) তাদের দিকে ছুটলেন, যাতে তিনি যাতে তিনি তাদের উটগুলোকে আঘাত করে ফিরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তারা, দূর থেকেই হযরত হুযাইফাকে আসতে দেকে ভয় পেয়ে গেলো এবং ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়ে গেলো।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে ষড়যন্ত্রের কথা বর্ণিত হয়েছে সেটি হচ্ছেঃ নবী (সা.) ও তার বিশ্বস্ত সাথীরা রোমানদের সাথে লড়াই করে নিরাপদে ফিরে আসবেন, এটা মুনাফিকরা আশা করেনি। তাই তারা ঠিক করে নিয়েছিল যে যখনই ওদিকে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তখনই তারা মদীনায় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেবে।
৮৫.
রসূলুল্লাহ ﷺ এর হিজরতের পূর্বে মদীনা ছিল আরবের মফস্বল এলাকার ছোট শহরগুলোর মত একটি মামুলী শহর। আওস ও খাযরাজ গোত্র দু’টিও অর্থ সম্পদ ও মর্যাদা-প্রতিপত্তির দিক দিয়ে কোন উঁচু পর্যায়ের ছিল না। কিন্তু রসূলুল্লাহর ﷺ সেখানে আগমনের পর আনসাররা যখন তার সাথে সহযোগিতা করে নিজেদের বিপদের মুখে ঠেলে দিল। তখন মাত্র আট নয় বছরের মধ্যে এ মাঝারী ধরনের মফস্বল শহরটি সারা আরবের রাজধানীতে পরিণত হলো। আর সেই আওস ও খাযরাজের কৃষকরাই হয়ে গেলেন রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও পরিচালক। চতুর্দিক ে থেকে বিজয়, গনীমতের মাল ও ব্যবসায় বাণিজ্যের মুনাফা লব্ধ সম্পদ এ কেন্দ্রিয় শহরটির ওপর বৃষ্টি ধারার মতো বর্ষিত হতে থাকলো। এ অবস্থাটিকে সামনে রেখে আল্লাহ তাদেরকে এ বলে লজ্জা দিচ্ছেন যে, আমার এ নবীর বদৌলতে তোমাদের ওপর এসব নিয়ামত বর্ষণ করা হচ্ছে, এটাই কি তার দোষ এবং এ জন্যই কি তার প্রতি তোমাদের এ ক্রোধ?
৮৬ .
উপরের আয়াতে মুনাফিকদের যে অকৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্ন আচরণের নিন্দা করা হয়েছিল তার আর একটি প্রমাণ তাদের নিজেদেরই জীবন থেকে পেশ করে এখানে সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, আসলে এরা দাগী অপরাধী। এদের নৈতিক বিধানে কৃতজ্ঞতা, অনুগ্রহের স্বীকৃতি ও অঙ্গীকার পালন ইত্যাদি গুণাবলীর নামগন্ধও পাওয়া যায় না।
৮৭.
তাবুক যুদ্ধের সময় যখন নবী (সা.) চাঁদার জন্য আবেদন জানালেন তখন বড় বড় ধনশালী মুনাফিকরা হাত গুটিয়ে বসে রইলো। কিন্তু যখন নিষ্ঠাবান ঈমানদাররা সামনে এগিয়ে এসে চাঁদা দিতে লাগলেন তখন ঐ মুনাফিকরা তাদেরকে বিদ্রূপ করতে লাগলো। কোন সামর্থ্যবান মুসলমান নিজের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনুযায়ী বা তার চেয়ে বেশী অর্থ পেশ করলে তারা তাদের অপবাদ দিতো যে, তারা লোক দেখাবার ও সুনাম কুড়াবার জন্য এ পরিমাণ দান করছে। আর যদি কোন গরীব মুসলমান নিজের ও নিজের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের অভুক্ত রেখে সামান্য পরিমাণ টাকাকড়ি নিয়ে আসতো, অথবা সারা রাত মেহনত মজদুরী করে সামান্য কিছু খেজুর উপার্জন করে তাই এনে রসূলের ﷺ সামনে হাযির করতো, তাহলে এ মুনাফিকরা তাদেরকে এ বলে ঠাট্টা করতো, সাবাস, এবার এক ফড়িং এর ঠ্যাং পাওয়া গেল। এ দিয়ে রোমের দূর্গ জয় করা যাবে।”