৫১ ) তাদের বলে দাও, “আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোন (ভাল বা মন্দ) কিছুই আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক এবং ঈমানদারদের তাঁর ওপরই ভরসা করা উচিত।” ৫১
قُل لَّن يُصِيبَنَآ إِلَّا مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَىٰنَا ۚ وَعَلَى ٱللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٥١
৫২ ) তাদের বলে দাও, “তোমরা আমাদের ব্যাপারে যে জিনিসের অপেক্ষায় আছো তা দুটি ভালর একটি ছাড়া আর কি? ৫২ অন্যদিকে আমরা তোমাদের ব্যাপারে যে জিনিসের অপেক্ষায় আছি তা হচ্ছে এই যে আল্লাহ হয় নিজেই তোমাদের শাস্তি দেবেন, না হয় আমাদের হাত দিয়ে দেয়াবেন? তাহলে এখন তোমরা অপেক্ষা করো এবং আমরা ও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকছি।”
قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَآ إِلَّآ إِحْدَى ٱلْحُسْنَيَيْنِ ۖ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَن يُصِيبَكُمُ ٱللَّهُ بِعَذَابٍۢ مِّنْ عِندِهِۦٓ أَوْ بِأَيْدِينَا ۖ فَتَرَبَّصُوٓا۟ إِنَّا مَعَكُم مُّتَرَبِّصُونَ ٥٢
৫৩ ) তাদের বলে দাও, “তোমরা নিজেদের ধন-সম্পদ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ব্যয় কর অথবা অনিচ্ছাকৃত ভাবে ব্যয় কর, ৫৩ তা গৃহীত হবে না। কারণ তোমরা ফাসেক গোষ্ঠী।”
قُلْ أَنفِقُوا۟ طَوْعًا أَوْ كَرْهًۭا لَّن يُتَقَبَّلَ مِنكُمْ ۖ إِنَّكُمْ كُنتُمْ قَوْمًۭا فَـٰسِقِينَ ٥٣
৫৪ ) তাদের দেয়া সম্পদ গৃহীত না হবার এছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে, নামাযের জন্য যখন আসে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলে তা করে অনিচ্ছাকৃত ভাবে।
وَمَا مَنَعَهُمْ أَن تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَـٰتُهُمْ إِلَّآ أَنَّهُمْ كَفَرُوا۟ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأْتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَـٰرِهُونَ ٥٤
৫৫ ) তাদের ধন-দৌলত ও সন্তানের আধিক্য দেখে তোমরা প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ চান, এ জিনিসগুলোর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে তাদের শাস্তি দিতে। ৫৪ আর তারা যদি প্রাণও দিয়ে দেয়, তাহলে তখন তারা থাকবে সত্য অস্বীকার করার অবস্থায়। ৫৫
فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَٰلُهُمْ وَلَآ أَوْلَـٰدُهُمْ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنفُسُهُمْ وَهُمْ كَـٰفِرُونَ ٥٥
৫৬ ) তারা আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে বলে, আমরা তোমাদেরই লোক। অথচ তারা মোটেই তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আসলে তারা এমন একদল লোক যারা তোমাদের ভয় করে।
وَيَحْلِفُونَ بِٱللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنكُمْ وَمَا هُم مِّنكُمْ وَلَـٰكِنَّهُمْ قَوْمٌۭ يَفْرَقُونَ ٥٦
৫৭ ) যদি তারা কোন আশ্রয় পেয়ে যায় অথবা কোন গিরি-গুহা কিংবা ভিতরে প্রবেশ করার মত কোন জায়গা, তাহলে দৌড়ে গিয়ে সেখানে লুকিয়ে থাকবে। ৫৬
لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَـًٔا أَوْ مَغَـٰرَٰتٍ أَوْ مُدَّخَلًۭا لَّوَلَّوْا۟ إِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ ٥٧
৫৮ ) হে নবী! তাদের কেউ কেউ সাদকাহ বন্টনের ব্যাপারে তোমার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাচ্ছে। এ সম্পদ থেকে যদি তাদের কিছু দেয়া হয় তাহলে তারা খুশী হয়ে যায়, আর না দেয়া হলে বিগড়ে যেতে থাকে। ৫৭
وَمِنْهُم مَّن يَلْمِزُكَ فِى ٱلصَّدَقَـٰتِ فَإِنْ أُعْطُوا۟ مِنْهَا رَضُوا۟ وَإِن لَّمْ يُعْطَوْا۟ مِنْهَآ إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ ٥٨
৫৯ ) কতই না ভাল হতো, আল্লাহ ও তার রসূল যা কিছুই তাদের দিয়েছিলেন তাতে যদি তারা সন্তুষ্ট থাকতো ৫৮ এবং বলতো, “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি নিজের অনুগ্রহ থেকে আমাদের আরো অনেক কিছু দেবেন এবং তাঁর রসূলও আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। ৫৯ আমরা আল্লাহরই প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছি।” ৬০
وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا۟ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَقَالُوا۟ حَسْبُنَا ٱللَّهُ سَيُؤْتِينَا ٱللَّهُ مِن فَضْلِهِۦ وَرَسُولُهُۥٓ إِنَّآ إِلَى ٱللَّهِ رَٰغِبُونَ ٥٩
৬০ ) এ সাদকা গুলো তো আসলে ফকীর ৬১ মিসকীনদের ৬২ জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত ৬৩ এবং যাদের জন্য মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য। ৬৪ তাছাড়া দাস মুক্ত করার, ৬৫ ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, ৬৬ আল্লাহর পথে ৬৭ এবং মুসাফিরদের উপকারে ৬৮ ব্যয় করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহর সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ।
۞ إِنَّمَا ٱلصَّدَقَـٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَٱلْمَسَـٰكِينِ وَٱلْعَـٰمِلِينَ عَلَيْهَا وَٱلْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِى ٱلرِّقَابِ وَٱلْغَـٰرِمِينَ وَفِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةًۭ مِّنَ ٱللَّهِ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ ٦٠
৫১.
এখানে দুনিয়া পূজারী ও আল্লাহ বিশ্বাসী মানসিকতার পার্থক্য সুস্পষ্ট করে তূলে ধারা হয়েছে। দুনিয়া পূজারী নিজের প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য সবকিছু করে। কোন বৈষয়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ওপরই তার প্রবৃত্তির সুখ ও আনন্দ নির্ভর করে। এ উদ্দেশ্য লাভে সক্ষম হলেই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আর উদ্দেশ্য লাভে ব্যার্থ হলে সে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। তারপর বস্তুগত কার্যকারণই প্রায় তার সমস্ত সহায় অবলম্বনের কাজ করে। সেগুলো অনুকূল হলে তা মনোবল বেড়ে যেতে থাকে। আর প্রতিকূল হলে সে হিম্মত হারাতে থাকে। অন্যদিকে আল্লাহে বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই সবকিছু করে। এ কাজে সে নিজের শক্তি বা বস্তুগত উপায়-উপকরণের ওপর ভরসা করে না বরং সে পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহর সত্তার ওপর। সত্যের পথে কাজ করতে গিয়ে সে বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে অথবা সাফল্যের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করলে, উভয় অবস্থায় সে মনে করে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হচ্ছে। বিপদ আপদ তার মনোবল ভাংতে পারে না। আবার সাফল্যও তাকে অহংকারে লিপ্ত করতে পারে না। কারণ, প্রথমত সে উভয়কে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বলে মনে করে। সব অবস্থায় সে আল্লাহর সৃষ্ট এ পরীক্ষায় নিরাপদে উত্তীর্ণ হতে চায়। দ্বিতীয়ত তার সামনে কোন বৈষয়িক উদ্দেশ্য থাকে না এবং তার মাধ্যমে সে নিজের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার করে না। তার সামনে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাত্র উদ্দেশ্য। বৈষয়িক সাফল্য লাভ করা বা না করার মাধ্যমে তার এ উদ্দেশ্যের নিকটবর্তী হওয়া বা দূরে অবস্থান করার ব্যাপাটি পরিমাপ করা যায় না। বরং আল্লাহর পথে জান ও মাল উৎসর্গ করার যে দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছিল তা সে কতদূর পালন করেছে। তার ভিত্তিতেই তার পরিমাপ করা যায়। যদি এ দায়িত্ব সে পালন করে থাকে তাহলে দুনিয়ায় সে সম্পূর্ণরূপে হেরে গেলেও তার পূর্ণ আস্থা থাকে যে, সে যে আল্লাহর জন্য ধন-প্রাণ উৎসর্গ করেছে তিনি তার প্রতিদান নষ্ট করে দেবেন না। তারপর বৈষয়িক কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের আশায় সে বসে থাকে না। সেগুলোর অনুকূল ও প্রতিকূল হওয়া তাকে আনন্দিত ও নিরানন্দ করে না। সে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখে। তিনিই কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণ রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক। কাজেই তার ওপর ভরসা করে সে প্রতিকূল অবস্থায়ও এমন হিম্মত ও দৃঢ় সংকল্প সহকারে কাজ করে যায় যে, দুনিয়া পূজারীরা একমাত্র অনুকূল অবস্থায়ই সেভাবে কাজ করতে পারে। তাই মহান আল্লাহ বলেন ঐসব দুনিয়া পূজারী মুনাফিকদের বলে দাও, আমাদের ব্যাপারটা তোমাদের থেকে মূলগত ভাবে ভিন্ন। তোমাদের আনন্দ ও নিরানন্দের রীতি-পদ্ধতি আমাদের থেকে আলাদা। তোমাদের নিশ্চিন্ততা ও অস্থিরতার উৎস এক, আমাদের অন্য।
৫২.
মুনাফিকরা তাদের আভাস অনুযায়ী এ সময়ও কুফর ও ইসলামের সংঘাতে অংশ না নিয়ে নিজেরা চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেছিল। এ সংঘাতের পরিণামে রসূল ও তার সাহাবীরা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন, না রোমীদের সামরিক শক্তির সাথে সংঘর্ষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান, দূরে বসে তারা তা দেখতে চাচ্ছিল। এখানে তাদের প্রত্যাশার জবাব দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছে, দু’টি ফলাফলের মধ্যে তোমরা একটির প্রকাশের অপেক্ষা করছো। অথচ ঈমানদারদের জন্য উভয় ফলাফলই যথার্থ ভাল ও কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিজয়ী হলে, এটা যে তাদের জন্য ভাল একথা সবার জানা। কিন্তু নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের পথে প্রাণ দান করে যদি তারা মাটিতে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়াবাসীরা তাদের চরম ব্যর্থ বলে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে এটিও আর এক রকমের সাফল্য। কারণ মু’মিন একটি দেশ জয় করলো কি করলো না অথবা কোন সরকার প্রতিষ্ঠিত করলো কি না, এটা তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি নয়। বরং মু’মিন তার আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার জন্য নিজের মন, মস্তিষ্ক, দেহ ও প্রাণের সমুদয় শক্তি নিয়োজিত করেছে কিনা, এটাই তার মাপকাঠি। এ কাজ যদি সে করে থাকে তাহলে দুনিয়ার বিচারে তার ফলাফল শূন্য হলেও আসলে সে সফলকাম।
৫৩.
কোন কোন মুনাফিক এমনও ছিল, যারা নিজেদেরকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে যদিও প্রস্তুত ছিল না, তবে তারা এ জিহাদ ও এ প্রচেষ্টা-সাধনা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থেকে মুসলমানদের দৃষ্টিতে নিজেদের সমস্ত মর্যাদা খুইয়ে ফেলতে এবং নিজেদের মুনাফিকীকে সর্বসম্মুখে প্রকাশ করে দিতেও চাচ্ছিল না। তাই তারা বলছিল, বর্তমানে আমরা যদিও অক্ষমতার কারণে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি চাচ্ছি। কিন্তু যুদ্ধের জন্য অর্থ সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত।
৫৪.
অর্থাৎ এ ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতির মায়ার ডোরে আবদ্ধ হয়ে তারা সে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করেছে, সেজন্য মুসলিম সমাজে তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। এতদিনকার আরবীয় সমাজে তাদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-মর্যাদা, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল নব্য ইসলামী সামাজ ব্যবস্থায় তা সম্পূর্ণ মাটিতে মিশে যাবে। যেসব নগণ্য দাস ও দাস পুত্ররা এবং মামুলী কৃষক ও রাখালরা ঈমানী নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রমাণ পেশ করেছে, এ নতুন সমাজে তারা হবে মর্যাদাশীল অন্যদিকে বংশানুক্রমিক সমাজনেতা ও সমাজপতিরা নিজেদের দুনিয়া প্রীতির কারণে মর্যাদাহীন হয়ে পড়বে।
হযরত উমরের (রা.) মজলিসে একবার একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটি ছিল এ অবস্থার একটি চমকপ্রদ চিত্র। সুহাইল ইবনে আমর ও হারেস ইবনে হিশামের মতো বড় বড় কুরাইশী সরদাররা হযরত উমরের (রা.) সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে আনসার ও মহাজিরদের মধ্যে থেকে মামুলী পর্যায়ের কোন লোক হলেও হযরত উমর (রা.) তাকে ডেকে নিজের কাছে বসাচ্ছিলেন এবং এ সমাজপতিদের সরে তার জন্য জায়গা করে দিতে বলেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সমাজপতিরা সরতে সরতে একেবারে মজলিসের কিনারে গিয়ে পৌঁছলেন। বাইরে বের হয়ে এসে হারেস ইবনে হিশাম নিজের সাথীদের বললেন, তোমরা দেখলে তো আজ আমাদের সাথে কি ব্যবহার করা হলো? সুহাইল ইবনে আমর বললেন, এতে উমরের কোন দোষ নেই। দোষ আমাদের। কারণ আমাদের যখন এ দ্বীনের দিকে ডাকা হয়েছিল তখন আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম এবং এ লোকেরা দৌড়ে এসেছিল। তারপর এ দু সমাজপতি দ্বিতীয়বার হযরত উমরের কাছে হাযির হলেন। এবার তারা বললেন, আজ আমরা আপনার আচরণ দেখলাম। আমরা জানি, আমাদের ত্রুটির কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু এখন এর প্রতিবিধানের কোন উপায় আছে কি? হযরত উমর (রা.) মুখে কোন জবাব দিলেন না। তিনি শুধু রোম সীমান্তের দিকে ইশারা করলেন। মানে, তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, এখন জিহাদের ময়দানে জান-মাল উৎসর্গ করো, তাহলে হয়তো তোমরা নিজেদের হারানো মর্যাদা আবার ফিরে পাবে।
৫৫.
অর্থাৎ এতসব লাঞ্ছনা-গাঞ্জনার মধ্যেও তাদের জন্য আরো বড় বিপদ হবে এই যে, তারা নিজেদের মধ্যে যে মুনাফিকী চরিত্র বৈশিষ্ট্য লালন করছে তার বদৌলতে মরার আগ পর্যন্ত তারা সত্যিকার ঈমান লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং নিজেদের পার্থিব সুখ-সুবিধা ধ্বংস করার পর দুনিয়া থেকে এমন অবস্থায় বিদায় নেবে যে, তাদের আখেরাত হবে এর চাইতেও অনেক বেশী খারাপ।
৫৬.
মদীনার এ মুনাফিকদের বেশীরভাগই ধনী ও বয়স্ক। ইবনে কাসির তার আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে তাদের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে শুধুমাত্র একজন যুবকের নাম পাওয়া যায়। তাদের একজনও গরীব নয়। এরা মদীনায় বিপুল-ভূ-সম্পত্তি ও চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিরাট কারবারের মালিক ছিল। সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বহুদর্শিতা এদের সুযোগ-সন্ধানী ও সুবিধাবাদী বানিয়ে দিয়েছিল। ইসলাম যখন মদীনায় পৌঁছলো এবং জনবসতির একটি বড় অংশপূর্ণ আন্তরিকতা ও ঈমানী জোশের সাথে ইসলাম গ্রহণ করলো তখন এ শ্রেণীটি পড়লো উভয় সংকটে। তারা দেখলো এ নতুন দ্বীন একদিকে তাদের নিজেদের গোত্রের অধিকাংশ বরং তাদের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত ঈমানের নেশায় মাতিয়ে তুলেছে। তাদের বিপরীত সারিতে দাঁড়িয়ে তারা যদি এখন কুফরী ও অস্বীকারের ঝাণ্ডা উত্তোলিত করে রাখে, তাহলে তাদের নেতৃত্ব-সরদারী, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-সম্মান, সুনাম-সুখ্যাতি, সবকিছুই হারিয়ে যাবে। এমনকি তাদের নিজেদের পারিবারিক পরিমণ্ডলেই তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণারআশঙ্কা দেখা দেবে। অন্যদিকে এ দ্বীনের সাথে সহযোগিতা করার অর্থ হবে, তাদেরকে সমগ্র আরবের এমনকি চারপাশের সমস্ত জাতি-গোত্র ও রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকা। সত্য ও ন্যায় যে আসলেই একটি মূল্যবান জিনিস তার প্রেম সুধা পান করে যে মানুষ সব রকমের বিপদ আপদ মাথা পেতে নিতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে নিজের জান-মালও পর্যন্ত কুরবানী করতে পারে। পার্থিব স্বার্থে মোহ ও প্রবৃত্তির গোলামীতে আকণ্ঠ ডুবে থাকার কারণে সে কথা উপলব্ধি করার যোগ্যতা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়কে শুধুমাত্র স্বার্থ ও সুবিধাবাদের দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তাই ঈমানের দাবী করার মধ্যই তারা নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণের সবচেয়ে অনুকূল ও উপযোগী পথ খুঁজে পেয়েছিল। কারণ তারা এভাবে একদিকে নিজেদের জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের বাহ্যিক মান-সম্ভ্রম, সহায়-সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য যথাযথ ভাবে টিকিয়ে রাখতে পারবে। অন্যদিকে মু’মিন হওয়াটাও তাদের এড়িয়ে যাওয়া দরকার, যাতে আন্তরিকতার পথ অবলম্বন করার ফলে অনিবার্যভাবে যেসব বিপদ আপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। তাদের এ মানসিক অবস্থাকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আসলে তারা তোমাদের সাথে নেই। বরং ক্ষতির ভয় তাদেরকে জবরদস্তি তোমাদের সাথে বেধে দিয়েছে। যে জিনিসটি তাদের নিজেদের কে মুসলমানদের মধ্যে গণ করাতে বাধ্য করেছে তা হচ্ছে এই ভীতি যে, মদীনায় থাকা অবস্থায় যদি তারা প্রকাশ্যে অমুসলিম হয়ে বাস করতে থাকে তাহলে তাদের সমস্ত মর্যাদা ও প্রতিপত্তি খতম হয়ে যাবে এমনকি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাথেও তাদের সম্পর্কে ছেদ ঘটবে। আর যদি তারা মদীনা ত্যাগ করে তাহলে নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করতে হবে। আবার কুফরীর প্রতিও তাদের এতটা আন্তরিকতা ছিল না যে, তার জন্য তারা এসব ক্ষতি বরদাশত করতে পারতো। এ উভয় সংকটে পড়ে তারা বাধ্য হয়ে মদীনায় থেকে গিয়েছে। মন না চাইলেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামায পড়তো এবং যাকাতকে জরিমানা ভেবে হলেও অগত্যা আদায় করতো। নয়তো প্রতিদান জিহাদ, প্রতিদান কোন না কোন ভয়াবহ দুশমনের সাথে পাঞ্জা কষাকষি এবং প্রতিদান জান-ও মাল কুরবানীর যে বিপদ ঘাড়ে চেপে আছে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা এত বেশী অস্থির যে, যদি তারা সাধারণ কোন সুড়ঙ্গ তথা কোন গর্তও দেখতে পেতো এবং সেখানে গেলে নিরাপদ আশ্রয় লাভের সম্ভাবনা থাকতো তাহলে দৌড়ে গিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়তো।
৫৭.
এ প্রথমবার আরবে একটি নির্দিষ্ট পরমাণের বেশী ধন-সম্পদের অধিকারী লোকদের উপর যথারীতি যাকাত ধার্য করা হয়েছিল। তাদের কৃষি উৎপাদন, গবাদিপশু ও ব্যবসায় পণ্য এবং খনিজ দ্রব্য ও সোনা রূপার সঞ্চয় থেকে আড়াই ভাগ, ৫ ভাগ, ১০ ভাগ ও ২০ ভাগ আদায় করা হতো। একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে এসব যাকাতের সম্পদ সংগ্রহ করা হতো এবং একটি কেন্দ্রে জমা করে বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে খরচ করা হতো। এভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নবী (সা.) এর কাছে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ সংগৃহীত হয়ে আসতো এবং তার হাত দিয়ে তা লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, যা ইতিপূর্বে আরবের লোকেরা কখনো এক জন লোকের হাতে একই সঙ্গে সংগৃহীত হতে এবং তার হাত দিয়ে খরচ হতে দেখেনি। এ সম্পদ দেখে দুনিয়া পূজারী মুনাফিকদের জিভ দিয়ে লালা ঝরতো। তারা চাইতো, এ প্রবহমান নদী থেকে তারা যেন আশ মিটিয়ে পানি পান করতে পারে। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। এখানে যিনি পানি পান করাচ্ছিলেন তিনি নিজের জন্য এবং নিজের সংশ্লিষ্টদের জন্য এ নদীর প্রতি বিন্দু পানি হারাম করে দিয়েছিলেন। কেউ আশা করতে পারে না, তার হাতের পানির পেয়ালা হকদার ছাড়া আর কারোর ঠোঁট স্পর্শ করতে পারে। এ কারণেই নবী (সা.) এর সদকা বিতরণের অবস্থা দেখে মুনাফিকরা চাপা আক্রোশে গুমরে মরছিল। বন্টনের সময় তারা নানা অভিযোগে, তাকে অভিযুক্ত করতো। তাদের আসল অভিযোগ ছিল এ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ আমাদের দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এ আসল অভিযোগ গোপন করে তারা এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করতো যে, ইনসাফের সাথে সম্পদ বণ্টন করা হচ্ছে না এবং এ ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে।
৫৮.
অর্থাৎ গণিমতের মাল থেকে যা কিছু নবী (সা.) তাদের দেন, তাই নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকতো। অন্যদিকে আল্লাহর অনুগ্রহে তারা যা কিছু উপার্জন করে এবং অর্থ উপার্জনের আল্লাহ প্রদত্ত উপকরণের মাধ্যমে যে ধরনের সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির তারা লাভ করছে তাকেই নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করতো।
৫৯.
অর্থাৎ যাকাত ছাড়াও অন্য যে সমস্ত ধন-সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসবে তা থেকে নিজ নিজ প্রাপ্য অনুযায়ী আমরা অংশ লাভ করতে থাকবো, যেমন ইতিপূর্বে করে এসেছি।
৬০ .
অর্থাৎ দুনিয়া ও তার তুচ্ছ সম্পদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নেই। বরং আমাদের দৃষ্টি রয়েছে আল্লাহ ও তাঁর অনুগ্রহের ওপর। তাঁরই সন্তুষ্টি আমরা চাই। আমাদের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। তিনি যা দেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।
৬১.
ফকির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের মুখাপেক্ষী। কোন শারীরিক ত্রুটি বা বার্ধ্যক্যজনিত করণে কেউ স্থায়ীভাবে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে অথবা কোন সাময়িক কারণে আপাতত কোন ব্যক্তি অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সহায়তা পেলে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, এ পর্যায়ের সব ধরনের অভাবী লোকের জন্য সাধারণভাবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এতীম শিশু, বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার এবং এমন সব লোক যারা সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
৬২.
মিসকীন শব্দের মধ্যে দ্বীনতা, দুর্ভাগ্য পীড়িত অভাব, অসহায়তা ও লাঞ্ছনা অর্থ নিহিত রয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে সাধারণ অভাবীদের চাইতে যাদের অবস্থা বেশী খারাপ তারাই মিসকীন। নবী (সা.) এ শব্দটির ব্যাখ্যা করে বিশেষ করে এমন সব লোকদেরকে সাহায্য লাভের অধিকারী গণ্য করেছেন, যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারেনি, ফলে অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু তাদের পদমর্যাদা সচেতনতা কারোর সামনে তাদের হাত পাতার অনুমতি দেয় না। আবার তাদের বাহ্যিক অবস্থাও এমন নয় যে, কেউ তাদেরকে দেখে অভাবী মনে করবে এবং সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিবে। হাদীসে এভাবে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ
الْمِسْكِينُ الَّذِى لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ ، وَلاَ يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ
"যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং যে নিজে দাঁড়িয়ে কারোর কাছে সাহায্যও চায় না, সে-ই মিসকীন” অর্থাৎ সে একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র গরীব মানুষ।
৬৩.
অর্থাৎ যারা সাদকা আদায় করা, আদায় করা ধন-সম্পদ সংরক্ষণ করা, সে সবের হিসেব-নিকেশ করা, খাতাপত্রে লেখা এবং লোকদের মধ্যে বণ্টন করার কাজে সরকারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত থাকে। ফকীর বা মিসকীন না হলেও এসব লোকের বেতন সর্বাবস্থায় সাদকার খাত থেকে দেয়া হবে। এখানে উচ্চারিত এ শব্দগুলো এবং এ সুরার ১০৩ আয়াতের শব্দাবলী
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً(তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদাকা উসূল করো) একথাই প্রমাণ করে, যে, যাকাত আদায় ও বণ্টন ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, নবী ﷺ খোদ নিজের ও নিজের বংশের (বনী হাশেম) ওপর যাকাতের মাল হারাম ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই তিনি নিজে সবসময় বিনা পারিশ্রমিকে যাকাত আদায় ও বন্টনের কাজ করেন। বনী হাশেমদের অন্য লোকদের জন্যও তিনি এ নীতি নির্ধারণ করে যান। তিনি বলে যান, তারা যদি বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করে তাহলে এটা তাদের জন্য ধৈর্য। আর পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ বিভাগের কোন কাজ করলে তা তাদের জন্য বৈধ নয়। তার বংশের কোন লোক যদি সাহেব নেসাব (অর্থাৎ কমপক্ষে যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দেয়া ফরয) হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত দেয়া ফরয হবে। কিন্তু যদি সে গরীব, অভাবী, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফির হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য যাকাত নেয়া হারাম হবে। তবে বনী হাশেমদের নিজেদের যাকাত বনি হাশেমরা নিতে পারবে কিনা এবং ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ তাও না জায়েজ বলে মত প্রকাশ করেন।
৬৪.
মন জয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার যে হুকুম এখানে দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা ইসলামের বিরোধীতায় ব্যাপকভাবে তৎপর এবং অর্থ দিয়ে যাদের শত্রুতার তীব্রতা ও উগ্রতা হ্রাস করা যেতে পারে অথবা যারা কাফেরদের শিবিরে অবস্থান করেছে ঠিকই কিন্তু অর্থের সাহায্যে সেখান থেকে ভাগিয়ে এনে মুসলমানদের দলে ভিড়িয়ে দিলে তারা মুসলমানদের সাহায্যকারী হতে পারে কিংবা যারা সবেমাত্র ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং তাদের পূর্বেকার শত্রুতা বা দুর্বলতাগুলো দেখেআশঙ্কা জাগে যে, অর্থ দিয়ে তাদের বশীভূত না করলে তারা আবার কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, এ ধরনের লোকেদেরকে স্থায়ীভাবে বৃত্তি দিয়ে বা সাময়িকভাবে এককালীন দানের মাধ্যমে ইসলামের সমর্থক ও সাহায্যকারী অথবা বাধ্য ও অনুগত কিংবা কমপক্ষে এমন শত্রুতে পরিণত করা যায়, যারা কোন প্রকার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। এ খাতে গণিমতের মাল ও অন্যান্য উপায়ে অর্জিত অর্থ থেকেও ব্যয় করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন হলে যাকাতের তহবিল থেকেও ব্যয় করা যায়। এ ধরনের লোকদের জন্য, ফকির, মিসকিন বা মুসাফির হবার শর্ত নেই। বরং ধনী ও বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদের যাকাত দেয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, নবী (সা.) এর আমলে তালীফে কলব, তথা মন জয় করার উদ্দেশ্যে বহু লোককে বৃত্তি দেয়া এবং এককালীন দান করা হতো। কিন্তু তার পরেও এ খাতটি অপরিবর্তিত ও অব্যাহত রয়েছে কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম আবু হানিফা (র) ও তার সহযোগীদের মতে, হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমরের(রা.) আমল থেকে এ খাতটি রহিত হয়ে গেছে। কাজেই এখন তালীফে কলবের জন্য কাউকে কিছু দেয়া জায়েজ নয়। ইমাম শাফেয়ীর (র) মতে তালীফে কলবের উদ্দেশ্যে ফাসেক মুসলমানদেরকে যাকাত তহবিল থেকে দেয়া যেতে পারে কিন্তু কাফেরদের দেয়া যেতে পারে না। অন্যান্য কতিপয় ফকীহের মতে, মুআল্লাফাতুল কুলুব, (যাদের মন জয় করা ইস্পিত হয়) এর খাত আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজন দেখা দিলে এ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।
হানাফীগণ এ প্রসঙ্গে প্রমাণ উপস্থাপন করে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর উয়ইনা ইবনে হিসন ও আকরা ইবনে হাবেস হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে আসে এবং তাঁর কাছে একটি জমি চায়। তিনি তাদেরকে জমিটির একটি দানপত্র লিখে দেন। তারা এ দানপত্রকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য অন্যান্য প্রধান সাহাবীগণের সাক্ষ্যও এতে সন্নিবেশ করতে চায়। সেমতে অনেক সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়ে যায়। কিন্তু তারা যখন হযরত উমরের (রা.) কাছে সাক্ষ্য নিতে যায় তখন তিনি দানপত্রটি পড়ে তাদের সামনেই সেটি ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি তাদেরকে বলেন, অবশ্যই তালীফে কলব করার জন্য নবী (সা.) তোমাদের দান করতেন। কিন্তু তখন ছিল ইসলামের দুর্বলতার যুগ। আর এখন আল্লাহ ইসলামকে তোমাদের মতো, লোকদের প্রতি নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এ ঘটনার পর তারা হযরত আবু বকরের (রা.) এর কাছে এসে অভিযোগ করে এবং তাকে টিটকারী দিয়ে বলেঃ খলীফা কি আপনি, না উমর? কিন্তু হযরত আবু বকর নিজেও এর কোন প্রতিবাদ করেননি। কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের একজনও হযরত উমরের এ মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। এ থেকে হানাফিগণ এ মর্মে প্রমাণ পেশ করেছেন, যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি তারা অর্জন করেছে তখন যে কারণে প্রথম দিকে মুআল্লাফাতুল কুলূবের অংশ রাখা হয় তা আর বর্তমান রইলো না। এ কারণে সাহাবীগণের ইজমার মাধ্যমে এ অংশটি চিরকালের জন্য বাতিল হয়ে গেছে।
ইমাম শাফিয়ী (র) এ প্রসঙ্গে প্রমাণ পেশ করে বলেন, তালীফে কলব, এর জন্য যাকাতের মাল দেবার ব্যাপারটা নবী (সা.) এর কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত নয়। হাদীসে আমরা যতগুলো ঘটনা পাই তা থেকে একথাই জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ তালীফে কলবের জন্য কাফেরদেরকে যা কিছু দেবার তা গণিমতের মাল থেকেই দিয়েছেন, যাকাতের মাল থেকে দেননি।
আমাদের মতে প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুআল্লাফাতুল কুলুবের অংশ কিয়ামত পর্যন্ত বাতিল হবার কোন প্রমাণ নেই। হযরত উমর (রা.) যা কিছু বলেছেন তা নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সঠিক ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র যদি তালীফে কলবের জন্য অর্থ-ব্যয় করার প্রয়োজন নেই মনে করে, তাহলেও এ খাতে কিছু ব্যয় করতেই হবে এমন কোন ফরয তার ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। কিন্তু কখনো প্রয়োজন দেখা দিলে যাতে ব্যয় করা যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ যে অবকাশ রেখেছেন তা অবশ্যই অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত। হযরত উমর ও সাহাবায়ে কেরামের যে বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল তা ছিল মূলত এই যে, তাদের আমলে যে অবস্থা ছিল তাতে তালীফে কলবের জন্য কাউকে কিছু দেবার প্রয়োজন তারা অনুভব করতেন না। কাজেই কোন গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী স্বার্থ তথা প্রয়োজন ও কল্যাণের খাতিরে কুরআনে যে খাতটি রাখা হয়েছিল, সাহাবীগণের মতৈক্য তাকে খতম করে দিয়েছে বলে সিদ্ধান্তে আসার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
অন্যদিকে ইমাম শাফেয়ীর অভিমতটি অবশ্যই এতটুকু পর্যন্ত তো সঠিক মনে হয় যে, সরকারের কাছে যখন অন্যান্য খাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ-সম্পদ মওজুদ থাকে তখন তালীফে কলবের খাতে তার যাকাতের অর্থ-সম্পদ ব্যয় না করা উচিত। কিন্তু যখন যাকাতের অর্থ-সম্পদ থেকে এ খাতে সাহায্য নেবার প্রয়োজন দেখা দেবে তখন তা ফাসেকদের জন্য ব্যয় করা যাবে, কাফেরদের জন্য ব্যয় করা যাবে না, এ ধরনের পার্থক্য কারার কোন কারণই সেখানে নেই। কারণ কুরআনে মুআল্লাফাতুল কূলুবের যে অংশ রাখা হয়েছে, তা তাদের ঈমানের দাবীর কারণে নয়। বরং এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম নিজের প্রয়োজনে তাদের তালীফে কলব তথা মন জয় করতে চায়। আর শুধুমাত্র অর্থের সাহায্যেই এ ধরনের লোকদের মন জয় করা যেতে পারে। এ প্রয়োজন ও এ গুণ-বৈশিষ্ট্য যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই মুসলমানদের সরকার কুরআনের বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার অধিকার রাখে। নবী (সা.) এ খাত থেকে কাফেরদের কিছুই দেননি। এর কারণ তার কাছে অন্য খাতে অর্থ ছিল। নয়তো এ খাত থেকে কাফেরদেরকে দেয়া যদি অবৈধ হতো তাহলে তিনি একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিতেন।
৬৫.
দাসদেরকে দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা দু’ভাবে হতে পারে। এক, যে দাস তার মালিকের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছে যে, সে একটা বিশেষ পরিমাণ অর্থ আদায় করলে মালিক তাকে দাসত্ব মুক্ত করে দেবে। তাকে দাসত্ব মুক্তির এ মূল্য আদায় করতে যাকাত থেকে সাহায্য করা যায়। দুই, যাকাতের অর্থে দাস কিনে তাকে মুক্ত করে দেয়া। এর মধ্যে প্রথমটির ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত। কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থাটিকে হযরত আলী(রা.) সাঈদ ইবনে জুবাইর, লাইস, সাওরী, ইবরাহীম নাখয়ী, শা'বী, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন, হানাফী ও শাফেয়ীগণ নাজায়েজ গণ্য করেন অন্যদিকে ইবনে আব্বাস (রা.) হাসান বসরী, মালেক, আহমদ ও আবু সাওর একে জায়েয মনে করেন।
৬৬.
অর্থাৎ এমন ধরনের ঋণগ্রস্ত, যারা নিজেদের সমস্ত ঋণ আদায় করে দিলে তাদের কাছে নেসাবের চাইতে কম পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে। তারা অর্থ উপার্জনকারী হোক বা বেকার, আবার সাধারণ্যে তাদের ফকীর মনে করা হোক বা ধনী। উভয় অবস্থায় যাকাতের খাত থেকে তাদেরকে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক ফকীহ এ মত পোষণ করেছেন যে, অসৎকাজে ও অমিতব্যয়িতা করে যারা নিজেদের টাকা পয়সা উড়িয়ে দিয়ে ঋণের ভারে ডুবে মরছে, তাওবা না করা পর্যন্ত তাদের সাহায্য করা যাবে না।
৬৭.
আল্লাহর পথে শব্দ দু’টি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব সৎকাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এমন সমস্ত কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে কেউ কেউ এমত পোষণ করেছেন যে, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে যাকাতের অর্থ যে কোন সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম যুগের ইমামগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে মত পোষণ করেছে সেটিই যথার্থ সত্য। তাদের মতে এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেসব লোক এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম রত থাকে, তারা নিজেরা সচ্ছল ও অবস্থা সম্পন্ন হলেও এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদের সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপ ভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমস্ত সময় ও শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।
এখানে আর একটি কথা অনুধাবন করতে হবে। প্রথম যুগের ইমামগণের বক্তব্য সাধারণত এক্ষেত্রে গাযওয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি যুদ্ধের সমর্থক। তাই লোকেরা মনে করে যাকাতের ব্যয় খাতে ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথের যে খাত রাখা হয়েছে তা শুধু যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু আসলে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ যুদ্ধ বিগ্রহের চাইতে আরো ব্যাপকতর জিনিসের নাম। কুফরের বাণীকে অবদমিত এবং আল্লাহর বাণীকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করা আর আল্লাহর দ্বীনকে একটি জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত ও প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা ও কাজ করা হয়, তা সবই এ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর আওতাভুক্ত।
৬৮.
মুসাফির তার নিজের গৃহে ধনী হলেও সফরের মধ্যে সে যদি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তাহলে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে। এখানে কোন কোন ফকীহ শর্ত আরোপ করেছেন, অসৎকাজ করা যার সফরের উদ্দেশ্য নয় কেবল মাত্র সেই ব্যক্তিই এ আয়াতের প্রেক্ষিতে সাহায্য লাভের অধিকারী হবে। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও এ ধরনের কোন শর্ত নেই। অন্যদিকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি, যে ব্যক্তি অভাবী ও সাহায্য লাভের মুখাপেক্ষী তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তার পাপাচার বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে গোনাহগার ও অসৎ চরিত্রের লোকদেরকে বিপদে সাহায্য করলে এবং ভাল ও উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের চরিত্র সংশোধন করার প্রচেষ্টা চালালে তা তাদের চরিত্র সংশোধনের সবচেয়ে বড় উপায় হতে পারে।