১ ) ভ্রুকুঁচকাল ও মুখ ফিরিয়ে নিল,
عَبَسَ وَتَوَلَّىٰٓ ١
২ ) কারণ সেই অন্ধটি তাঁর কাছে এসেছে। ১
أَن جَآءَهُ ٱلْأَعْمَىٰ ٢
৩ ) তুমি কি জানো, হয়তো সে শুধরে যেতো
وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُۥ يَزَّكَّىٰٓ ٣
৪ ) অথবা উপদেশের প্রতি মনোযোগী হতো এবং উপদেশ দেয়া তার জন্য উপকারী হতো?
أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ ٱلذِّكْرَىٰٓ ٤
৫ ) যে ব্যক্তি বেপরোয়া ভাব দেখায়
أَمَّا مَنِ ٱسْتَغْنَىٰ ٥
৬ ) তুমি তার প্রতি মনোযোগী হও,
فَأَنتَ لَهُۥ تَصَدَّىٰ ٦
৭ ) অথচ সে যদি শুধরে না যায় তাহলে তোমার উপর এর কি দায়িত্ব আছে?
وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّىٰ ٧
৮ ) আর যে নিজে তোমার কাছে দৌঁড়ে আসে
وَأَمَّا مَن جَآءَكَ يَسْعَىٰ ٨
৯ ) এবং সে ভীত হচ্ছে,
وَهُوَ يَخْشَىٰ ٩
১০ ) তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো। ২
فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّىٰ ١٠
১.
এই প্রথম বাক্যটির প্রকাশ ভংগী বড়ই চমকপ্রদ। পরবতী বাক্যগুলোতে সরাসরি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। এ থেকে একথা প্রকাশ হয় যে, ভ্রুকুঁচকাবার ও মুখ ফিরিয়ে নেবার কাজটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই করেছিলেন। কিন্তু বাক্যটির সূচনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে মনে হয়েছে, তিনি নন অন্য কেউ এ কাজটি করেছে। এই প্রকাশ ভংগীর মাধ্যমে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এটা আপনার করার মতো কাজ ছিল না। আপনার উন্নত চরিত্রের সাথে পরিচিত কোন ব্যক্তি এ কাজটি দেখলে ভাবতো, আপনি নন বরং অন্য কেউ এ কাজটি করছে।
এখানে যে অন্ধের কথা বলা হয়েছে, ইতিপূর্বে ভূমিকায় আমরা এ সম্পর্কিত আলোচনায় বলেছি, তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে উম্মে মাকতূম (রা.)। হাফেজ ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল ইসতিআব’ এবং হাফেজ ইবনে হাজর ‘আল আসাবাহ’ গ্রন্থে তাঁকে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা.) ফুফাত ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা লিখেছেন, তাঁর মা উম্মে মাকতূম ছিলেন হযরত খাদীজার (রা.) পিতা খুওয়াইলিদের সহোদর বোন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর এই আত্মীয়তার সম্পর্ক জানার পর তিনি যে তাঁকে গরীব বা কম মর্যাদা সম্পন্ন মনে করে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছিলেন এবং বড়লোকদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ থাকে না। কারন তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন শ্যালক। বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে সমাজের সাধারণ শ্রেণীভুক্ত নন বরং অভিজাত বংশীয় ছিলেন। তাঁর প্রতি তিনি যে আচরণ করেছিলেন তা ‘অন্ধ’ শব্দটি থেকেই সুস্পষ্ট। রসূলের ﷺ অনাগ্রহ ও বিরূপ আচরণের কারণ হিসেবে আল্লাহ নিজেই এ শব্দটি উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ রসূলে করীমের (সা.) ধারণা ছিল, আমি বর্তমানে যেসব লোকের পেছনে লেগে আছি এবং যাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছি তাদের একজনও যদি হেদায়াত লাভ করে তাহলে তার মাধ্যমে ইসলামের শক্তি অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। বিপরীত পক্ষে ইবনে উম্মে মাকতূম হচ্ছেন একজন অন্ধ। দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে এই সরদারদের মধ্য থেকে একজনের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের জন্য যতটা লাভজনক হবে ইবনে মাকতূমের ইসলাম গ্রহণ ততটা লাভজনক হতে পারে না। তাই তিনি মনে করেছিলেন, সরদারদের সাথে আলোচনার মাঝখানে বাঁধা না দিয়ে অন্য সময় তিনি যা কিছু জানতে চান জেনে নিতে পারবেন।
২.
দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ ﷺ এই মূল বিষয়টির প্রতিই অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন। আর এই বিষয়টি বুঝাবার জন্যই মহান আল্লাহ প্রথমে ইবনে উম্মে মাকতূমের সাথে আচরণের ব্যাপারে তাঁকে পাকড়াও করেন। তারপর সত্যের আহবায়কের দৃষ্টিতে কোন্ জিনিসটি সত্যিকারভাবে গুরুত্ব লাভ করবে এবং কোন্ জিনিসটি গুরুত্ব লাভ করবে না তা তাঁকে জানান। একদিকে এক ব্যক্তির বাহ্যিক অবস্থা পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে সত্যের সন্ধানে ফিরছে, বাতিলের অনুগামী হয়ে আল্লাহর গযবের মুখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ভীত সন্ত্রস্ত। তাই সত্য সঠিক পথ সম্পর্কে জানার জন্য সে নিজে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। অন্যদিকে আর এক ব্যক্তির আচরণ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে যে, সত্য সন্ধানের কোন আগ্রহই তার মনে নেই। বরং সে নিজেকে কারোর সত্য পথ জানিয়ে দেবার মুখাপেক্ষীই মনে করে না। এই দু’ধরনের লোকের মধ্যে কে ঈমান আনলে দ্বীনের বেশী উপকার হতে পারে এবং কার ঈমান আনা দ্বীনের প্রচার এই প্রসারের বেশী সহায়ক নয়, এটা দেখার বিষয় নয়। বরং এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, কে হেদায়াত গ্রহণ করে নিজেকে সুধরে নিতে প্রস্তুত এবং কে হেদায়াতের এই মূল্যবান সম্পদটির আদতে কোন কদরই করে না। প্রথম ধরনের লোক অন্ধ, কানা, খোঁড়া, অংগহীন সহায়-সম্বল শক্তি সামর্থ্যহীন হলে এবং বাহ্যত দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন বড় রকমের অবদান রাখার যোগ্যতা সম্পন্ন না হলেও হকের আহবায়কের কাছে তিনিই হবেন মূল্যবান ব্যক্তি। তার দিকেই তাঁকে নজর দিতে হবে। কারণ এই দাওয়াতের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর বান্দাদের জীবন ও কার্যক্রম সংশোধন করা। আর এই ব্যক্তির অবস্থা একথা প্রকাশ করছে যে, তাকে উপদেশ দেয়া হলে সে সংশোধিত হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা সমাজে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, সত্যের আহবায়কের তাদের পেছনে লেগে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতিই প্রকাশ্যে একথা জানাচ্ছে যে, তারা সংশোধিত হতে চায় না। কাজেই তাদের সংশোধন করার প্রচেষ্টায় সময় ব্যয় করা নিছক সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা সংশোধিত হতে না চাইলে তাদেরই ক্ষতি, সত্যের আহবায়কের ওপর এর কোন দায়-দায়িত্ব নেই।