وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ
"তারা (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা) মিহি রেশম এবং মখমল ও কিংখাবের সবুজ পোশাক পরিধান করবে। সুউচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে।”
একারণে সেসব মুফাসসিরদের মতামত সঠিক বলে মনে হয় না যারা বলেন, এর অর্থ এমন কাপড় যা তাদের আসন ও পালংকের ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে অথবা সেসব কিশোর বালকদের পোশাক-পরিচ্ছদ যারা তাদের সেবা ও খেদমতের জন্য সদা তৎপর থাকবে।
فَلَوْلَا أُلْقِيَ عَلَيْهِ أَسْوِرَةٌ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ جَاءَ مَعَهُ الْمَلَائِكَةُ مُقْتَرِنِينَ
“সে যদি যমীন ও আসমানের বাদশাহর পক্ষ থেকেই প্রেরিত হয়ে থাকতো তাহলে তার সোনার কংকন নাই কেন? কিংবা ফেরেশতাদের একটি বাহিনী অন্তত তার আরদালী হয়ে আসতো।” (আয যুখরুফ, ৫৩)
পরিশিষ্ট-১
৩৩নং টীকার সাথে সংশ্লিষ্ট
এ আয়াতগুলোতে তিনটি কথা বলা হয়েছে। এক, কেউ চাইলে তার রবের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে পারে। দুই, যদি আল্লাহ না চান তাহলে শুধু তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না। তিন, আল্লাহ অত্যন্ত কুশলী, সূক্ষ্মদর্শী ও মহাজ্ঞানী। এ তিনটি কথা সম্পর্কে যদি ভালভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে মানুষের বাছাই বা পছন্দ করার স্বাধীনতা এবং আল্লাহর ইচ্ছার মধ্যকার সম্পর্ক খুব ভালভাবেই বুঝা যায় এবং তাকদীর সম্পর্কে মানুষের মনে যেসব জটিলতা দেখা যায় তা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম আয়াত থেকে জানা যায় যে, এ পৃথিবীতে মানুষকে যে ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তা শুধু এতটুকু যে, এখানে জীবন যাপনের জন্য যেসব ভিন্ন ভিন্ন পথ তার সামনে আসে তার মধ্য থেকে কোন একটি পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেবে। গ্রহণ বা বাছাই করার এরূপ অনেক স্বাধীনতা (Freedom of Choice) আল্লাহ তা’আলা তাকে দিয়েছেন। যেমন, এক ব্যক্তির সামনে যখন তা জীবিকা উপার্জনের প্রশ্ন দেখা দেয় তখন তার সামনে অনেকগুলো পথ থাকে। এসব পথের মধ্যে কিছু সংখ্যক থাকে হালাল পথ। যেমন, সবরকম বৈধ শ্রমকর্ম, চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য অথবা শিল্প ও কারিগরি কিংবা কৃষি। আবার কিছু সংখ্যক থাকে হারাম পথ। যেমন চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, পকেট মারা, ব্যভিচার, সুদখোরী, জুয়া, ঘুষ এবং হারাম প্রকৃতির সবরকম চাকুরি-বাকুরি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি। এসব পথের মধ্যে থেকে কোন্ পথটি সে বেছে নেবে এবং কিভাবে সে তার জীবিকা উপার্জন করতে চায় সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার মানুষকেই দেয়া হয়েছে। অনুরূপ নৈতিক চরিত্রেরও বিভিন্ন ঢং বা প্রকৃতি আছে। এক দিকে আছে দ্বীনদারী, আমানতদারী, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, ইনসাফ, দয়ামায়া, সমবেদনা এবং সতীত্ব ও পবিত্রতার মত উন্নত স্বভাব ও গুণাবলী। অন্যদিকে আছে বদমাইশী, নীচতা, জুলুম-অত্যাচার, বেঈমানী, বখাটেপনা, বেহুদাপনা ও অভদ্রতার মত হীন স্বভাবসমূহ। এর মধ্যে থেকে যে ঢং ও প্রকৃতির নৈতিক চরিত্রের পথ বা দোষ-গুণ সে অবলম্বন করতে চায় তা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তার আছে। আদর্শ ও ধর্মের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এক্ষেত্রেও মানুষের সামনে বহু পথ খোলা আছে। নাস্তিকতা তথা আল্লাহকে অস্বীকার করা, শিরক ও মূর্তিপূজা, শিরক ও তাওহীদের বিভিন্ন সংমিশ্রণ এবং আল্লাহর আনুগত্যের একমাত্র নিখাদ ধর্ম কুরআন যার শিক্ষা দেয়। এর মধ্যেও মানুষ কোন্্টিকে গ্রহণ করতে চায় সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ইখতিয়ার মানুষের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা জোর করে তার ওপরে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না যে, সে নিজে হালাল রুজি খেতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাকে হারাম খোর হতে বাধ্য করছেন অথবা সে কুরআনের অনুসরণ করতে চায় কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাকে জোরপূর্বক নাস্তিক, মুশরিক অথবা কাফের বানিয়ে দিচ্ছেন। অথবা সে চায় সৎ মানুষ হতে কিন্তু আল্লাহ তাকে খামাকা অসৎ বানিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু পছন্দ ও নির্বাচনের এ স্বাধীনতার পরেও মানুষের যা ইচ্ছা তাই করতে পারা আল্লাহর ইচ্ছা, তার অনুমোদন ও তাওফীক দানের ওপর নির্ভর করে। মানুষ যে কাজ করার আকাংখা, ইচ্ছা বা সংকল্প করেছে তা মানুষকে করতে দেয়ার ইচ্ছা যদি আল্লাহর থাকে তবেই সে তা করতে পারে। অন্যথায় সে যত চেষ্টাই করুক না কেন আল্লাহর অনুমোদন ও তার ইচ্ছা ছাড়া সে কিছুই করতে সক্ষম নয়। দ্বিতীয় আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। এ ব্যাপারটিকে এভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন যে, দুনিয়ার সব মানুষকে যদি সব ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দিয়ে দেয়া হতো আর এ বিষয়টিও তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হতো যে, সে যা ইচ্ছা করতে পারবে তাহলে সারা দুনিয়ার সব ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-শৃংখলা ধ্বংস এবং ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতো। যাকে ইচ্ছা হত্যা করার অবাধ স্বাধীনতা পেলে একজন হত্যাকারীই সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিল। একজন পকেটমারের যদি এ ক্ষমতা থাকতো যে, যার পকেট ইচ্ছা সে মারতে পারবে তাহলে পৃথিবীর কোন মানুষের পকেটই তার হাত থেকে রক্ষা পেতো না। কোন চোরের হাত থেকে কারো সম্পদ রক্ষা পেতো না, কোন ব্যভিচারীর হাতে থেকে কোন নারীর সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা পেতো না এবং কোন ডাকাতের হাত থেকে কারো বাড়ী-ঘর রক্ষা পেতো না, যদি এদের সবারই যথেচ্ছাচারের পূর্ণ ইখতিয়ার বা ক্ষমতা থাকতো। তাই মানুষ ন্যায় বা অন্যায় যে পথেই চলতে ইচ্ছা করুক না কেন সে পথে চলতে দেয়া না দেয়ার বিষয়টি আল্লাহ নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি গোমরাহীর পথ বর্জন করে সত্যের পথে চলার অবলম্বন করতে চায় আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাওফীক লাভ করেই কেবল সে সত্য পথে চলার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো, গোমরাহীকে বর্জন করে হিদায়াতকে বাছাই ও গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত খোদ মানুষকেই নিতে হবে। তা না হলে আল্লাহ তা’আলা জোরপূর্বক যেমন কাউকে চোর, খুনী, নাস্তিক বা মুশরিক বানান না তেমনি জোরপূর্বক তাকে ঈমানদারও বানান না।
অতঃপর তৃতীয় আয়াতে এ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলার এ ইচ্ছা আবার নিয়ম-বিধি মুক্ত স্বেচ্ছাচারমূলক (Arbitrary) ব্যাপার কিনা এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা عليم এবং حكيم অর্থাৎ তিনি যেমন সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী, তেমনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, কুশলী ও প্রজ্ঞাময়। তিনি যা কিছু করেন জ্ঞান ও বিজ্ঞতার সাথেই করেন। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল-ত্রুটি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কাকে কি “তাওফীক” দিতে হবে এবং কি দিতে হবে না, কাকে কি কাজ করতে দেয়া উচিত আর কাকে দেয়া উচিত নয় সে সিদ্ধান্ত তিনি পূর্ণ জ্ঞান এবং যুক্তি ও কৌশলের ভিত্তিতে গ্রহণ করেন। মানুষকে তিনি যতটা অবকাশ দেন এবং উপায়-উপকরণকেও যতটা তার অনুকূল করে দেন ভাল হোক বা মন্দ হোক মানুষ নিজের ইচ্ছানুসারে ঠিক ততটা কাজই করতে পারে। হিদায়াত লাভের ব্যাপারটাও এ নিয়মের বাইরে নয়। কে হিদায়াতের উপযুক্ত আর কে নয় নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলাই তা জানেন এবং নিজের যুক্তি ও কৌশলের ভিত্তিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণও তিনিই করে থাকেন।