কেউ কেউ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা করেছেন যে, “চাঁদ বিদীর্ণ হবে” আরবী ভাষায় বাকরীতি অনুসারে এ অর্থ গ্রহণ সম্ভব হলেও বাক্যের পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে এ অর্থ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। প্রথমত এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতের প্রথম অংশ অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার সময় চাঁদ যদি বিদীর্ণ না হয়ে থাকে বরং ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিদীর্ণ হয় তাহলে তার ভিত্তিতে একথা বলা একেবারেই নিরর্থক যে, কিয়ামতের সময় সন্নিকটবর্তী হয়েছে। ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে এমন ঘটনা কিয়ামত সন্নিকটবর্তী হওয়ার প্রমাণ হতে পারে কি করে যে তাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যুক্তিযুক্ত হবে? দ্বিতীয়ত এ অর্থ গ্রহণ করার পর যখন আমরা পরবর্তী বাক্য পাঠ করি তখন বুঝা যায় যে, এর সাথে তার কোন মিল নেই। পরবর্তী আয়াত সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, লোকেরা সে সময় কোন নিদর্শন দেখেছিল যা ছিল কিয়ামতের সম্ভাব্যতার স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু তারা তাকে যাদুর তেলেসমাতি আখ্যায়িত করে অস্বীকার করেছিলো এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয় বলে নিজেদের বদ্ধমূল ধারণা আঁকড়ে ধরে পড়েছিলো। যদি وَانْشَقَّ الْقَمَرُ কথাটির অর্থ “চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে” গ্রহণ করা হয় তাহলেই কেবল পূর্বাপর প্রসঙ্গের মাঝে তা খাপ খায়। কিন্তু এর অর্থ যদি “বিদীর্ণ হবে” গ্রহণ করা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সব কথাই সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। বক্তব্যের ধারাবাহিকতার মাঝে এ অংশটি জুড়ে দিয়ে দেখুন, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, একথাটির কারণে গোটা বক্তব্যই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
“কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হবে। কিন্তু এসব লোকের অবস্থা হচ্ছে, তারা যে নিদর্শনই দেখে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এতো গতানুগতিক যাদু। এরা অস্বীকার করলো এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করলো।”
সুতরাং প্রকৃত সত্য এই যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত তা কেবল হাদীসের বর্ণনা সমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তবে হাদীস সমূহের বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি সবিস্তারে জানা যায় এবং তা কবে ও কোথায় সংঘটিত হয়েছিলো তাও অবহিত হওয়া যায়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আহমদ, আবু ‘উওয়ানা, আবু দাউদ তায়ালেসী, আবদুর রাযযাক, ইবনে জারীর, বায়হাকী, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও আবু নু’য়াইম ইস্পাহানী বিপুল সংখ্যক সনদের মাধ্যমে হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে উমর, হযরত হুযাইফা, হযরত আনাস ইবনে মালেক ও হযরত জুবাইর ইবনে মুত’এম থেকে এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন।
এসব সম্মানিত সাহাবা কিরামের মধ্যে তিনজন অর্থাৎ আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, হযরত হুযাইফা ও হযরত জুবাইর ইবনে মুত’এম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে দু’জন এমন ব্যক্তি আছেন যারা প্রত্যক্ষদর্শী নন। কারণ এটি তাদের মধ্যে একজনের (আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস) জন্মের পূর্বের ঘটনা। আর অপরজন ঘটনার সময় শিশু ছিলেন। কিন্তু তারা উভয়েই যেহেতু সাহাবী। তাই যেসব বয়স্ক সাহাবা এ ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন তাঁদের নিকট থেকে শুনেই হয়তো তারা এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
সমস্ত রেওয়ায়াত একত্রিত করলে এ ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় তা হচ্ছে, এটি হিজরতের প্রায় পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। সেদিন ছিল চান্দ্র মাসের চতুর্দশ রাত্রি। চাঁদ তখন সবে মাত্র উদিত হয়েছিলো। অকস্মাৎ তা দ্বিখণ্ডিত হলো এবং তার একটি অংশ সম্মুখের পাহাড়ের এক দিকে আর অপর অংশ অপরদিকে পরিদৃষ্ট হলো। এ অবস্থা অল্প কিছু সময় মাত্র স্থিতি পায়। এর পরক্ষণেই উভয় অংশ আবার পরস্পর সংযুক্ত হয়। নবী ﷺ সে সময় মিনাতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি লোকদের বললেনঃ দেখো এবং সাক্ষী থাকো। কাফেররা বললোঃ মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের ওপর যাদু করেছিলো তাই আমাদের দৃষ্টি ভ্রম ঘটেছিল। অন্যরা বললোঃ মুহাম্মাদ আমাদের ওপর যাদু করতে পারে, তাই বলে সমস্ত মানুষকে তো যাদু করতে সক্ষম নয়। বাইরের লোকদের আসতে দাও। আমরা তাদেরকেও জিজ্ঞেস করবো, তারাও এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে কি না। বাইরে থেকে কিছু লোক আসলে তারা বললো যে, তারাও এ দৃশ্য দেখেছে।
হযরত আনাস থেকে বর্ণিত কোন কোন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে এরূপ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা একবার নয়, দুইবার সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু প্রথমত সাহাবীদের মধ্যে আর কেউ এ কথা বর্ণনা করেননি। দ্বিতীয়ত হযরত আনাসের কোন কোন রেওয়ায়াতে (مَرَّتَيْن) দুইবার কথাটি উল্লেখিত হয়েছে এবং কোনটিতে فِرْقَتَيْن বা شِقَّتَيْنَ দুই খণ্ড শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। তৃতীয়ত, কুরআন মজীদে শুধু একবার খণ্ডিত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এ দিক দিয়ে সঠিক কথা এটিই যে, এ ঘটনা শুধু একবারই সংঘটিত হয়ছিলো।
এ সম্পর্কে সমাজে কিছু কিচ্ছাকাহিনীও প্রচলিত আছে। ওগুলোতে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ আঙুল দিয়ে চাঁদের দিকে ইশারা করলেন আর তা দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেল। তাছাড়া চাঁদের একটি অংশ নবীর ﷺ জামার গলদেশ দিয়ে প্রবেশ করে হাতার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গেল। এসব একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী।
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ ঘটনার সত্যিকার ধরন ও প্রকৃতি কি ছিল? এটা কি কোন মু’জিযা ছিল যা মক্কার কাফেরদের দাবীর প্রেক্ষিতে রিসালাতের প্রমাণ হিসেবে রসূলুল্লাহ্ ﷺ দেখিয়েছিলেন? নাকি এটা কোন দুর্ঘটনা ছিল যা আল্লাহর কুদরত বা অসীম ক্ষমতায় চাঁদের বুকে সংঘটিত হয়েছিল এবং রসূলুল্লাহ্ ﷺ সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শুধু এই জন্য যে, তা কিয়ামতের সম্ভাব্যতাও সন্নিকটবর্তী হওয়ার একটি নিদর্শন। মুসলিম মনীষীদের একটি বিরাট গোষ্ঠী এ ঘটনাকে নবীর ﷺ মু’জিযা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁদের ধারণা অনুসারে মক্কার কাফেরদের দাবীর কারণে এ মু’জিযা দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসসমূহের দু’য়েকটির ওপর ভিত্তি করেই এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি ছাড়া অন্য আর কোন সাহাবীই এ কথা বর্ণনা করেননি। ইবনে হাজার তাঁর ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেনঃ “যতগুলো সূত্রে এ ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হযরত আনাস বর্ণিত হাদীস ছাড়া আর কোথাও এ কথা আমার চোখে পড়েনি যে, মুশরিকদের দাবীর কারণে চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।” باب انْشِقَاقِ الْقَمَرِ । আবু নুয়াইম ইস্পাহানী “দালায়েলুন নবুওয়াত” গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ্ উবনে আব্বাস থেকেও একই বিষয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তার সনদ দুর্বল। মজবুত সনদে হাদীস গ্রন্থসমূহে যতগুলো হাদীস হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতেই একথার উল্লেখ নেই। তাছাড়া হযরত আনাস ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস উভয়ই এ ঘটনার সম সাময়িক ছিলেন না। অপর দিকে যেসব সাহাবাকিরাম সে সময় বর্তমান ছিলেন- যেমনঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত হুযাইফা (রাঃ), হযরত জুবাইর (রাঃ), ইবনে মুত’এম, হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর, তাঁদের কেউ-ই এ কথা বলেননি যে, মক্কার মুশরিকরা নবীর ﷺ নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে কোন নির্দশনের দাবী করেছিলো এবং সে কারণেই তাদেরকে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার এ মু’জিযা দেখানো হয়েছিলো। সব চেয়ে বড় কথা, কুরআন মজীদ এ ঘটনাকে মুহাম্মাদের ﷺ রিসালাতের নিদর্শন হিসেবে পেশ করছে না, বরং কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার নিদর্শন হিসেবে পেশ করছে। তবে নবী ﷺ লোকদেরকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার যে খবর দিয়েছিলেন এ ঘটনা তার সত্যতা প্রমাণ করেছিলো। সুতরাং এদিক দিয়ে এ ঘটনা অবশ্যই তাঁর নবুওয়াতেরও সত্যতার স্পষ্ট প্রমাণ ছিল।
বিরুদ্ধবাদীরা এক্ষেত্রে দুই ধরনের আপত্তি উত্থাপন করে থাকে। প্রথমত, তাদের মতে এরূপ ঘটা আদৌ সম্ভব নয় যে, চাঁদের মত বিশালায়তন একটি উপগ্রহ বিদীর্ণ হয়ে দুই খণ্ড হয়ে যাবে এবং খণ্ড দু’টি পরস্পর শত সহস্র মাইল দূরত্বে চলে যাওয়ার পর আবার পরস্পর সংযুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, তারা বলে এ ঘটনা যদি ঘটেই থাকে তাহলে তা দুনিয়াময় প্রচার হয়ে যেতো, ইতিহাসে তার উল্লেখ দেখা যেতো এবং জ্যোতিষ-শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে তার বর্ণনা থাকতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ দু’টি আপত্তি গুরুত্বহীন। চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সম্ভাব্যতার প্রশ্নে বলা যায়, তা সম্ভব নয়, একথা প্রাচীন কালে হয়তো বা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহসমূহের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে বর্তমানে মানুষ যে জ্ঞান ও তথ্য লাভ করেছে তার ভিত্তিতে একটি গ্রহ তার আভ্যন্তরীণ অগ্ন্যৎপাতের কারণে বিদীর্ণ হতে পারে। এ ভয়ানক বিস্ফোরণের ফলে তা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বহুদূরে চলে যেতে পারে এবং তার কেন্দ্রের চৌম্বুক শক্তির কারণে পুনরায় পরস্পর সংযুক্ত হতে পারে। এটা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব। এরপর দ্বিতীয় আপত্তির গুরুত্বহীন হওয়া সম্পর্কে বলা যায়, এ ঘটনা অকস্মাৎ এবং মুহূর্তের জন্য সংঘটিত হয়েছিল। সে বিশেষ মুহূর্তে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি চাঁদের দিকে নিবদ্ধ থাকবে এটি জরুরী নয়। সে মূহুর্তে বিস্ফোরণের কোন শব্দ হয়নি যে, সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। এ উদ্দেশ্যে পূর্বাহ্ণেই কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি যে, লোকজন তার অপেক্ষায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকবে। ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র তা দৃষ্টিগোচর হওয়াও সম্ভব ছিল না। সে সময় শুধু আরব ও তার পূর্বাঞ্চল সন্নিহিত দেশ সমূহেই চন্দ্র উদিত হয়েছিল। সে সময় ইতিহাস চর্চার রুচি ও প্রবণতা ছিল না এবং স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবেও সে সময় তা এতটা উন্নত ছিল না যে, পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহের যেসব লোক তা দেখেছিলো তারা তা লিপিবদ্ধ করে নিতো, কোন ঐতিহাসিকের কাছে এসব প্রমাণাদি সংগৃহীত থাকতো এবং কোন গ্রন্থে সে তার লিপিবদ্ধ করতো। তা সত্ত্বেও মালাবারের ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, সে রাতে সেখানকার একজন রাজা এ দৃশ্য দেখেছিলেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি ও পঞ্জিকাসমূহে এ ঘটনার উল্লেখ কেবল তখনই থাকা জরুরী হতো যদি এর দ্বারা চন্দ্রের গতি, তার পরিক্রমণের পথ এবং উদয়াস্তের সময়ে কোন পরিবর্তন সূচিত হতো। কিন্তু তা যেহেতু, হয়নি, তাই প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিদদের দৃষ্টিও এদিকে আকৃষ্ট হয়নি। সে যুগের মান মন্দিরসমূহও এতটা উন্নত ছিল না যে, নভোমণ্ডলে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই তারা পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডভুক্ত করতে পারতেন।