এসব ব্যবহারের দিক লক্ষ্য করে তাফসীরকারদের মধ্যে কেউ কেউ এ আয়াতের لمم শব্দের অর্থ গ্রহণ করেছেন ছোট গোনাহ। কেউ কেউ এর অর্থ বলেছেন যে, ব্যক্তির কার্যত বড় গোনাহের নিকবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাতে লিপ্ত না হওয়া। কেউ কেউ একে ক্ষণিকের জন্য গোনাহে লিপ্ত হয়ে পরে তা থেকে বিরত হওয়া অর্থে গ্রহণ করেছেন। কারো কারো মতে এর অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি গোনাহের কল্পনা, ইচ্ছা কিংবা সংকল্প করবে ঠিকই কিন্তু কার্যত কোন পদক্ষেপ নেবে না। এ বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীদের মতামত নিম্নরূপঃ
যায়েদ ইবনে আসলাম ও ইবনে যায়েদ বলেনঃ এর অর্থ মানুষ ইসলাম গ্রহণের পূর্বে জাহেলী যুগে যেসব গোনাহ করেছে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তা পরিত্যাগ করেছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) একটি মতও তাই।
ইবনে আব্বাসের (রাঃ) দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে, ব্যক্তির কোন বড় গোনাহ বা অশ্লীল কাজে অল্প সময়ের জন্য কিংবা ভুলক্রমে কখনো লিপ্ত হয়ে পড়া এবং পরে তা পরিত্যাগ করা। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) ইবনে আমর ইবনে আস, মুজাহিদ (রাঃ) হাসান বাসরী (রঃ) এবং আবু সালেহের (রঃ) মতও তাই।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ), মাসরূক এবং শা’বী বলেনঃ এর অর্থ কোন ব্যক্তির কোন বড় গোনাহের নিকটবর্তী হওয়া এবং তার প্রাথমিক পর্যায়সমূহ অতিক্রম করা কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়ে বিরত থাকা। যেমনঃ কেউ চুরি করার উদ্দেশ্যে বের হলো কিন্তু চুরি করা থেকে বিরত থাকলো। কিংবা পরনারীর সাথে মেলামেশা করলো কিন্তু ব্যভিচার করতে অগ্রসর হলো না। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সূত্রে হযরত আবু হুরাইরা এবং আবদুল্লাহ্ আব্বাস থেকেও এ মতটি উদ্ধৃত হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের, ইকরিমা, কাতাদা এবং দাহহাক বলেনঃ এর অর্থ এমন ছোট ছোট গোনাহ যার জন্য দুনিয়াতে কোন শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং আখেরাতেও আযাব দেয়ার কোন ভয় দেখানো হয়নি।
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেনঃ এর অর্থ মনে গোনাহের চিন্তার উদ্রেক করা কিন্তু কার্যত তাতে লিপ্ত না হওয়া।
এগুলো হচ্ছে, সম্মানিত সাহাবা ও তাবেয়ীদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা যা বিভিন্ন রেওয়ায়াতে উদ্ধৃত হয়েছে। পরবর্তী তাফসীরকার, ইমাম ও ফিকাহবিদদের অধিকাংশই এ মত পোষণ করেন, যে এ আয়াত এবং সূরা নিসার ৩১ আয়াত সুস্পষ্টরূপে গোনাহকে সগীরা ও কবীরা এই দু’টি বড় ভাগে বিভক্ত করেছে। এ দু’টি আয়াত মানুষকে আশান্বিত করে যে, তারা যদি বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাদের ছোট ছোট্ গোনাহ মাফ করে দেবেন। যদিও দুয়েকজন বড় আলেম মত প্রকাশ করেছেন যে, কোন গোনাহই ছোট নয়। আল্লাহর অবাধ্যতা মাত্রই বড় গোনাহ। কিন্তু ইমাম গাযযালী (রঃ) বলেছেনঃ কবীরা ও সগীরা গোনাহের পার্থক্য এমন একটি বিষয় যা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, যেসব উৎস থেকে শরীয়াতের হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করা যায় তার সবগুলোতেই এর উল্লেখ আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সগীরা ও কবীরা গোনাহর মধ্যে পার্থক্য কি? এবং কি ধরনের গোনাহ সগীরা আর কি ধরনের গোনাহ কবীরা? এ ব্যাপারে কবীরা ও সগীরা গোনাহর যে সংজ্ঞায় আমরা পূর্ণরূপে নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত তা হচ্ছে, “যে গোনাহকে কিতাব ও সুন্নাহর কোন সুস্পষ্ট উক্তিতে হারাম বলা হয়েছে অথবা যে গোনাহর জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূল দুনিয়াতে কোন শাস্তি নির্দিষ্ট করেছেন অথবা যে গোনাহের কারণে আখেরাতের আযাবের ভয় দেখিয়েছেন বা অভিশাপ দিয়েছেন অথবা তাতে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর আযাব নাযিলের খবর দিয়েছেন।” এ ধরনের সমস্ত গোনাহই কবীরা গোনাহ। এ প্রকৃতির গোনাহ ছাড়া শরীয়াতের দৃষ্টিতে আর যত রকমের অপছন্দনীয় কাজ আছে তার সবই সগীরা গোনাহের সংজ্ঞায় পড়ে। একই ভাবে কেবলমাত্র গোনাহের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা কিংবা ইচ্ছা করাও কাবীরা গোনাহ নয়, সগীরা গোনাহ। এমন কি কোন বড় গোনাহের প্রাথমিক পর্যায়সমূহ অতিক্রম করাও ততক্ষণ পর্যন্ত কাবীরা গোনাহ নয় যতক্ষণ না ব্যক্তি কার্যত তা করে বসবে। তবে সগীরা গোনাহও যখন ইসলামী বিধানকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে করা হয়, আল্লাহ তা’আলার মোকাবিলায় অহংকারের মনোবৃত্তি নিয়ে করা হয় এবং যে শরীয়াত একে খারাপ কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে তাকে আদৌ গুরুত্ব দেয়ার উপযুক্ত মনে করা না হয় তখন তা কবীরা গোনাহে রূপান্তরিত হয়।
কোন কোন ব্যক্তি এ তিনটি মূলনীতিকে ভুল পন্থায় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কোন ব্যক্তি নিজের কাষ্টার্জিত আয় (Earned Income) ছাড়া কোন কিছুর বৈধ মালিক হতে পারে না। কিন্তু একথা কুরআন মজীদেরই দেয়া কিছু সংখ্যক আইন ও নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক। উদাহরণ হিসেবে উত্তরাধিকার আইনের কথা বলা যেতে পারে। এ আইন অনুসারে কোন ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদে বহু সংখ্যক লোক অংশ পায় এবং বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত এ সম্পদ তার শ্রম দ্বারা অর্জিত নয়। শত যুক্তি দেখিয়েও একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু সম্পর্কে একথা প্রমাণ করা যাবে না যে, পিতার পরিত্যক্ত সম্পদে তার শ্রমের কোন ভূমিকা আছে। অনুরূপভাবে যাকাত ও সাদকার বিধান অনুসারে শুধুমাত্র শরয়ী ও নৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে একজনের অর্থ-সম্পদ অন্যেরা লাভ করে থাকে। এভাবে তারা ঐ সম্পদের বৈধ মালিকানা লাভ করে। কিন্তু সেই সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে তার শ্রমের কেন অংশ থাকে না। অতএব কুরআনের কোন একটি আয়াত নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে কুরআনের অন্যান্য শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কুরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আবার কিছু সংখ্যক লোক এসব মূলনীতিকে আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত ধরে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, এসব মূলনীতি অনুসারে এক ব্যক্তির কাজ কি কোন অবস্থায় অপর ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর হতে পারে? এক ব্যক্তি যদি অপর ব্যক্তির জন্য কিংবা তার পরিবর্তে কোন আমল করে তাহলে তার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করা যেতে পারে? এক ব্যক্তির আমল কি অন্য কোন ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া সম্ভব? এসব প্রশ্নের জবাব যদি নেতিবাচক হয় তাহলে “ইসালে সওয়াব” বদলি হজ্জ্ব ইত্যাদি সবই নাজায়েজ হয়ে যায়। এমন কি অন্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাও অর্থহীন হয়ে পড়ে। কেননা যার জন্য দোয়া করা হবে সেই দোয়াও তার নিজের কাজ নয়। তবে শুধুমাত্র মু’তযিলারা ছাড়া ইসলামের অনুসারীদের মধ্য থেকে আর কেউ-ই এ চরম দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেনি। শুধু তারাই এ আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করে থাকে যে, এক ব্যক্তির চেষ্টা-সাধনা কোন অবস্থায়ই অন্যের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। অপরদিকে আহলে সুন্নাত একজনের দোয়া অন্যের জন্য কল্যাণকর হওয়ার বিষয়টা সর্বসম্মতভাবে স্বীকার করে। কেননা, কুরআন থেকেই তা প্রমাণিত। “ইসালে সাওয়াব” এবং অন্য কারো পক্ষ থেকে কৃত কোন নেক কাজের কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে মৌলিক দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই, বরং বিস্তারিত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতানৈক্য বিদ্যমান।
(১) ইসলে সওয়াব হলো, এক ব্যক্তির কোন নেক কাজ করে তার সওয়াব ও প্রতিদান অপর কোন ব্যক্তিকে দেয়া হোক বলে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এ মাসয়ালা সম্পর্কে ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ নিরেট শারীরিক ইবাদাত যেমনঃ নামায, রোযা ও কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির সওয়াব অন্যেরা পেতে পারে না। তবে আর্থিক ইবাদাত যেমনঃ সাদকা কিংবা আর্থিক ও শারীরিক উভয়টির সংমিশ্রিত ইবাদাত যেমনঃ হজ্জ্ব-এ সবের সওয়াব অন্যে পেতে পারে। কারণ, মূলনীতি হিসেবে এটা অবিসংবাদিত যে, এক ব্যক্তির আমল অন্যের কল্যাণে আসবে না। তবে, অনেক সহীহ হাদীসের ভাষ্য অনুসারে যেহেতু সাদকার সওয়াব পৌঁছানো যায় এবং বদলি হজ্জ্ব ও করা যায়, তাই আমরা এ প্রকৃতির ইবাদতের “ইসালে সওয়াব” বা সওয়াব পৌঁছানোর বৈধতা স্বীকার করছি। পক্ষান্তরে হানাফী আলেমদের রায় হলো, মানুষ তাঁর সব রকম নেক আমলের সওয়াব অপরকে দান করতে পারে-তা নামায হোক বা রোযা, কুরআন তেলাওয়াত হোক বা যিকর কিংবা সাদকা হোক বা হজ্জ্ব ও উমরা হোক। এর স্বপক্ষে যুক্তি হচ্ছে শ্রমের কাজ করে মানুষ যেমন মালিককে বলতে পারে, এর পারিশ্রমিক আমার পরিবর্তে অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হোক। তেমনি কোন নেক কাজ করে সে আল্লাহর কাছে এ বলে দোয়া করতে পারে যে কাজের প্রতিদান আমার পক্ষ থেকে অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হোক। এক্ষেত্রে কতিপয় নেকীর কাজকে বাদ দিয়ে অন্য কতিপয় নেকীর কাজের মধ্যে একে সীমিত রাখার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ বিষয়টি বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিতঃ
বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে, আহমাদ, ইবনে মাজা, তাবারানী (ফীল-আওসাত) মুসতাদরিক এবং ইবনে আবী শায়বাতে হযরত আয়েশা, হযরত আবু হুরাইরা, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্, হযরত আবু রাফে, হযরত আবু তালহা আনসারী এবং হুযাইফা ইবনে উসাইদুল গিফারী, কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ দু’টি ভেড়া নিয়ে তার একটি নিজের ও নিজের পরিবারের সবার পক্ষ থেকে এবং অপরটি তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন।
মুসলিম, বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ এবং নাসায়ীতে হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে বললো, আমার মা অকস্মাৎ মারা গিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, যদি তিনি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে অবশ্যই সাদকা করার জন্য বলতেন। এখন আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করি তাহলে তিনি কি তার প্রতিদান পাবেন? নবী ﷺ বললেন, হ্যাঁ।
মুসনাদে আহমাদ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তার দাদা আস ইবনে ওয়ায়েল জাহেলী যুগে একশত উট কুরবানী করার মানত করেছিলেন। তার চাচা হিশাম ইবনুল আস তার অংশের পঞ্চাশটি উট কুরবানী করে দিয়েছেন। হযরত আমর ইবনুল আস রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি করবেন। নবী ﷺ বললেনঃ তোমার পিতা যদি তাওহদীদের অনুসারী হয়ে মারা যারা গিয়ে থাকেন তাহলে তুমি তার পক্ষ থেকে রোযা রাখো অথবা সাদকা করো। এতে তার কল্যাণ হবে।
মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে হযরত হাসান বাসরীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত সা’দ ইবনে উবাই রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে বললেনঃ আমার মা ইনতিকাল করেছেন? আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করবো? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজা প্রভৃতি হাদীসগ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরো কিছু সংখ্যক হাদীস আছে। ঐ সব হাদীসেও রসূলুল্লাহ্ ﷺ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সাদকা করার অনুমতি দিয়েছেন এবং বলেছেন তা মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর।
দারু কুতনীতে বর্ণিত হয়েছেঃ এক ব্যক্তি নবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলো, আমি আমার পিতা-মাতার সেবা তাঁদের জীবদ্দশায়ও করে যাচ্ছি। তাঁদের মৃত্যুর পর কিভাবে সেবা করবো? তিনি বললেনঃ “তাদের মৃত্যুর পর তোমার নামাযের সাথে তাদের জন্যও নামায পড়বে, তোমার রোযার সাথে তাদের জন্য রোযা রাখবে এটাও তাদের সেবার অন্তর্ভুক্ত।” দারু কুতনীতে হযরত আলী (রাঃ) থেকে আরো একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসে তিনি বলেনঃ নবী ﷺ বলেছেন কোন ব্যক্তি যদি কবরস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এবং এগার বার কুল হুয়াল্লাহু আহাদ পড়ে ঐ কবরস্থানের মৃতদের জন্য তাহলে ওখানে যত মৃত আছে তাদের সকলকে সওয়াব দান করা হবে। একটি আরেকটির সমর্থক এ ধরনের বিপুল সংখ্যক হাদীসে এ বিষয় স্পষ্ট করে যে “ইসালে সওয়াব” বা সওয়াব পৌঁছানো শুধু সম্ভবই নয়, বরং সব রকম ইবাদাত এবং নেকীর কাজের সওয়াব পৌঁছানো যেতে পারে। এ জন্য বিশেষ ধরনের আমল বা ইবাদাত নির্দিষ্ট নেই। তবে এ প্রসঙ্গে চারটি বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হবেঃ
একঃ কেবল এমন আমলের সওয়াবই পৌঁছানো যেতে পারে যা নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে শরীয়াতের নিয়ম-কানুন মাফিক করা হয়েছে। তা না হলে একথা স্পষ্ট যে, গায়রুল্লাহ্র জন্য কিংবা শরীয়াতের বিধি-বিধানের পরিপন্থী কোন কাজ বা ইবাদাত করা হলে তা অন্য কারো জন্য দান করা তো দূরের কথা আমলকারী নিজেই তার কোন সওয়াব পেতে পারে না।
দুইঃ যেসব ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার দরবারে সৎলোক হিসেবে মেহমান হয়ে আছে তারা তো নিশ্চিতভাবেই এ সওয়াবের উপহার লাভ করবেন। কিন্তু যারা সেখানে অপরাধী হিসেবে হাজতে বন্দী আছে তাদের কাছে কোন সওয়াব পৌঁছবে বলে আশা করা যায় না। আল্লাহর মেহমানদের কাছে তো উপহার পৌঁছতে পারে। কিন্তু আল্লাহর বন্দীদের কাছে উপহার পৌঁছানো কোন আশা নেই। কোন ব্যক্তি যদি ভুল বুঝার কারণে তার জন্য ইসালে সওয়াব করে তাহলে তার সওয়াব নষ্ট হবে না, বরং অপরাধীর কাছে পৌঁছার বদলে মূল আমলকারীর কাছে ফিরে আসবে। ঠিক মানি অর্ডার যেমন প্রাপকের হাতে না পৌঁছলে প্রেরকের কাছে ফিরে আসে।
তিনঃ সওয়াব পৌঁছানো সম্ভব কিন্তু আযাব পৌঁছানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ কেউ নেককাজ করে অন্য কাউকে তার সওয়াব দান করবে, এটা সম্ভব কিন্তু গোনাহর কাজ করে তার আযাব অন্য কাউকে দান করবে আর তা তার কাছে পৌঁছে যাবে, তা সম্ভব নয়।
চারঃ নেক কাজের দু’টি কল্যাণকর দিক আছে। একটি হচ্ছে, নেক কাজের সে শুভ ফলাফল যা আমলকারীর ব্যক্তিসত্ত্বায় ও চরিত্রের প্রতিফলিত হয় এবং যার কারণে সে আল্লাহর পুরস্কার ও প্রতিদান লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয়ত, তার সেই সব প্রতিদান যা তাকে আল্লাহ তা’আলা পুরস্কার হিসেবে দান করেন। এর প্রথমটির সাথে ইসালে সাওয়াবের কোন সম্পর্ক নেই, শুধু দ্বিতীয়টির সাথে এর সম্পর্ক। এর উদাহরণ হলোঃ কোন ব্যক্তি শরীর চর্চার মাধ্যমে কুস্তিতে দক্ষতা লাভ করে। এভাবে তার মধ্যে যে শক্তি ও দক্ষতা সৃষ্টি হয় তা সর্বাবস্থায় তার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা অন্য কাউকে দেয়া যায় না। অনুরূপভাবে সে যদি কোন রাজ দরবারের কর্মচারী হয় এবং কুস্তিগীর হিসেবে তার জন্য একটি বেতন নির্দিষ্ট থাকে তাহলে সে বেতনও শুধু-সেই পাবে। অন্য কাউকে তা দেয়া হবে না। তবে তার কর্মতৎপরতায় খুশী হয়ে তার পৃষ্ঠপোষক তাকে যেসব পুরস্কার ও উপহার দেবে সেগুলো সম্পর্কে সে আবেদন করতে পারে যে তা তার শিক্ষক, মাতা-পিতা কিংবা অন্য কল্যাণকামী ও হিতাকাংখীদের দেয়া হোক। নেক কাজের ব্যাপারটাও তাই। এর আত্মিক কল্যাণসমূহ হস্তান্তর যোগ্য নয়। তার প্রতিদানও কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। কিন্তু তার পুরস্কার ও সওয়াব সম্পর্কে সে আল্লাহ তা’আলার কাছে এ বলে দোয়া করতে পারে যে, তা তার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা কোন কল্যাণকামীকে দান করা হোক। এ কারণে একে “ইসালে জাযা” প্রতিদান পৌঁছানো নয়, “ইসালে সওয়াব” সওয়াব পৌঁছানো বলা হয়ে থাকে।
(২) এক ব্যক্তির চেষ্টা ও তৎপরতা অন্য কোন ব্যক্তির জন্য উপকার হওয়ার আরেকটি রূপ হচ্ছে, ব্যক্তি হয় অন্য কারোর ইচ্ছা বা ইঙ্গিতে তার জন্য কোন নেক কাজ করবে। কিংবা তার ইচ্ছা বা ইঙ্গিত ছাড়াই তার পক্ষ থেকে এমন কোন কাজ করবে যা মূলত ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব ছিল কিন্তু সে নিজে তা আদায় করতে পারেনি। এ ব্যাপারে হানাফী ফিকাহবিদদের মত হলোঃ ইবাদাত তিন, প্রকারঃ এক, নিরেট, দৈহিক ইবাদাত, যেমনঃ নামায। দুই, নিরেট আর্থিক ইবাদাত, যেমনঃ যাকাত এবং তিন, দেহ ও অর্থের সমন্বিত ইবাদাত। যেমনঃ হজ্জ্ব । এসব ইবাদাতের মধ্যে প্রথম প্রকারের ইবাদাতে কোন রকম প্রতিনিধিত্ব চলে না। যেমন এক ব্যক্তির প্রতিনিধি হিসেবে আরেক ব্যক্তি নামায পড়তে পারে না। দ্বিতীয় প্রকারের ইবাদাতের প্রতিনিধিত্ব চলতে পারে। যেমনঃ স্বামী, স্ত্রীর অলঙ্কারাদির যাকাত আদায় করতে পারে। তৃতীয় প্রকারের ইবাদতে প্রতিনিধিত্ব নিজের দায়িত্ব তখনি চলতে পারে যখন মূল ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে কোন কাজ করা হচ্ছে, নিজের দায়িত্ব নিজে পালনে সাময়িকভাবে নয়, বরং স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। যেমন, বদলি হজ্জ্ব শুধু এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে হতে পারে যে, নিজে হজ্জ্ব পালন করতে যেতে অক্ষম এবং কখনো হজ্জ্ব পালনে যেতে সক্ষম হওয়ার আশাও করা যায় না। মালেকী ও শাফেয়ী মাযাহাবের অনুসারীগণও এ মতের সমর্থক। তবে বদলী হজ্জ্বের জন্য ইমাম মালেক শর্ত আরোপ করেছেন যে, বাপ যদি ছেলেকে এ মর্মে অসীয়াত করে থাকে যে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে তার পক্ষ থেকে হজ্জ্ব করবে তাহলে তা জায়েজ হবে অন্যথায় নয়। তবে এব্যাপারে হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে বাপের ইঙ্গিত বা অসীয়ত থাক বা না থাক, ছেলে তার পক্ষ থেকে বদলি হজ্জ্ব করতে পারে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, খাস’আম গোত্রের এক মহিলা রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে বললোঃ আমার পিতার ওপর হজ্জ্বের আদেশ এমন অবস্থায় প্রযোজ্য হয়েছে যখন তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তিনি উটের পিঠে বসে থাকতে পারেন না। নবী ﷺ বললেনঃ فَحُجِّى عَنْهُ “তার পক্ষ থেকে তুমি হজ্জ্ব আদায় করো। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, নাসয়ী)। হযরত আলীও (রাঃ) প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।” (আহমাদ, তিরমিযী)।
হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) যুবায়ের খাস’আম গোত্রেরই একজন পুরুষের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, সে ও তার বৃদ্ধ পিতা সম্পর্কে এ একই প্রশ্ন করেছিলো। নবী ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমিই কি তার বড় ছেলে। সে বললো হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ فَقَضَيْتَهُ عَنْهُ كَانَ يُجْزِئُ ذَلِكَ عَنْهُ- তুমি কি মনে করো, যদি তোমার পিতা ঋণী থাকে আর আর তুমি তা আদায় করে দাও তাহলে তার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে? সে বললোঃ জি, হ্যাঁ। তিনি বললেন فاحجج عنه তাহলে অনুরূপভাবে তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্জ্ব ও আদায় করো। (আহমাদ নাসায়ী)।
ইবনে আব্বাস বলেনঃ জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা এসে বললোঃ আমার মা হজ্জ্ব করার মানত করেছিলেন। কিন্তু হজ্জ্ব আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। এখন আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ্ব আদায় করতে পারি? রসূলুল্লাহ্ ﷺ জবাব দিলেনঃ তোমার মা যদি ঋণগ্রস্ত হতো তাহলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে পারতে না? একইভাবে তোমরা আল্লাহর হকও আদায় করো। আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর অধিকার প্রদান করা সবচেয়ে বেশী জরুরী কাজ। (বুখারী, নাসায়ী) বুখারী ও মুসলিমে আরো একটি রেওয়ায়াত হচ্ছে, এক ব্যক্তি এসে তার বোন সম্পর্কে প্রশ্ন করলো যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী ﷺ তাকেও এ একই জবাব দিলেন।
এসব বর্ণনা থেকে অর্থ ও দেহের সমন্বিত ইবাদাতসমূহে প্রতিনিধিত্বের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর থাকে নিরেট দৈহিক ইবাদাতসমূহ। এ বিষয়ে এমন কিছু হাদীস আছে যা থেকে এ প্রকৃতির ইবাদাতসমূহের ক্ষেত্রেও প্রতিনিধিত্বের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন ইবনে আব্বাসের (রাঃ) এই বর্ণনা যে, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা নবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলোঃ আমার মা রোযা মানত করেছিলেন। কিন্তু তা পূরণ করার পূর্বেই তিনি মারা গিয়েছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে রোযা রাখতে পারি? নবী ﷺ বললেনঃ তার পক্ষ থেকে রোযা রাখো। (বুখারী মুসলিম, আহমাদ, নাসায়ী, আবু দাউদ)। হযরত বুরাইদা (রাঃ) বর্ণিত এ হাদীস থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এক মহিলা তার মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো যে, তার ওপর এক মাসের (অথবা আরেকটি বর্ণনা অনুসারে দুমাসের) রোযা ওয়াজিব ছিল। আমি কি তার পক্ষ থেকে এ রোযা পালন করবো? নবী ﷺ তাকেও অনুমতি দিলেন। (মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী আবু দাউদ)। তাছাড়া হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসেও নবী ﷺ বলেছেনঃ مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ কেউ যদি মারা যায় আর তার ওপর কিছু রোযা থাকে তাহলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক সেই রোযা রাখবে (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ) বাযযার বর্ণিত হাদীসে নবীর ﷺ কথা উল্লেখিত হয়েছে এরূপঃ فَلْيَصُمْ عَنْهُ وَلْيَّهُ اِنْ شَاءَ অর্থাৎ তার অভিভাবক ইচ্ছা করলে তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে। এসব হাদীসের ভিত্তিতে আসহাবুল হাদীস, ইমাম আওযায়ী এব জাহেরিয়ারগণ দৈহিক ইবাদাতসমূহেও প্রতিনিধিত্ব জায়েজ হওয়ার সমর্থক। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম যায়েদ ইবনে আলীর ফতোয়া হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা যেতে পারে না। ইমাম আহমাদ, ইমাম লাইস এবং ইসহাক ইবনে রাহবিয়া বলেনঃ এটা কেবল তখনই করা যেতে পারে যখন মৃত ব্যক্তি তা মানত করেছে কিন্তু পূরণ করতে পারিনি। বিরোধিদের যুক্তি হলো, যেসব হাদীসে থেকে এর বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার বর্ণনাকারীগণ নিজেরাই ঐ সব হাদীসের পরিপন্থী ফতোয়া দিয়েছেন। নাসায়ী ইবনে আব্বাসের ফতোয়া নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করেছেনঃ لايصل احد عن احد ولايصم احد عن احد কোন ব্যক্তি যেন কারো পক্ষ থেকে নামায না পড়ে এবং রোযাও না রাখে। আবদুর রাযযাকের বর্ণনা অনুসারে হযরত আয়েশার ফতোয়া হলো لاتصوموا عن موتكم واطعموا عنهم “তোমাদের মৃতদের পক্ষ থেকে রোযা রেখো না, খাবার খাইয়ে দাও।” আবদুর রাযযাক, আবদুল্লাহ্, ইবনে উমর থেকেও একথাই উদ্ধৃত করেছেন, অর্থাৎ মৃতের পক্ষ থেকে যেন রোযা রাখা না হয়। এ থেকে জানা যায় যে, প্রথম প্রথম শারীরিক ইবাদাতসমূহেও প্রতিনিধিত্বের অনুমতি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থিরকৃত হয় যে, এটা করা জায়েজ নয়। অন্যথায় কি করে সম্ভব যে যারা রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা নিজেরাই আবার তার পরিপন্থী ফতোয়া প্রদান করবেন?
এক্ষেত্রে একথা ভালভাবে বুঝতে হবে, যে প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে কোন ফরয পালন কেবল তাদের জন্যই উপকারী হতে পারে যারা নিজে ফরয আদায়ে আগ্রহী কিন্তু বাস্তব কোন অসুবিধার কারণে অপারগ হয়ে পড়েছেন। তবে সমর্থ ও সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হজ্জ্ব আদায় করা থেকে বিরত থাকে এবং এ ফরযটি আদায় করা সম্পর্কে তার মনে কোন অনুভূতি পর্যন্ত না থেকে থাকে তার জন্য বদলি হজ্জ্ব যতই করা হোক না কেন তা তার জন্য কল্যাণকর হবে না। এটা ঠিক যেন কোন ব্যক্তি কর্তৃক অপর কোন ব্যক্তির ঋণের টাকা আত্মসাত করা এবং মৃত্যু পর্যন্ত পরিশোধ করার ইচ্ছা না থাকা। পরবর্তী সময়ে তার পক্ষ থেকে যদি প্রতিটি পাইও পরিশোধ করা হয় তবুও আল্লাহ তা’আলার দৃষ্টিতে সে ঋণ আত্মসাতকারী হিসেবেই গণ্য হবে। অপরের আদায় করে দেয়ায় কেবল সেই ব্যক্তিই নিষ্কৃতি পেতে পারে যে তার জীবদ্দশায় ঋণ আদায়ে আগ্রহী ছিল। কিন্তু কোন অসুবিধার কারণে আদায় করতে পারেনি।