এখানে প্রশ্ন জাগে যে, কি কারণে এ বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর মনে আদৌ কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলো না এবং তিনি পূর্ণ নিশ্চয়তা সহ জানতে পারলেন যে, তাঁর চোখ যা দেখছে তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য ও বাস্তব, কোন কাল্পনিক বস্তু বা কোন জিন কিংবা শয়তান নয়? এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা যখন গভীরভাবে চিন্তা করি তখন পাঁচটি কারণ আমাদের বোধগম্য হয়।
প্রথম কারণ, যে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ দেখার কাজটি সংঘটিত হয়েছিল সেটাই তার সত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করে দেয়। রসূলুল্লাহ্ ﷺ অন্ধকারে মুরাকাবারত অবস্থায় স্বপ্নে কিংবা অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় এ দর্শন লাভ করেছিলেন না, বরং তখন সকালের পরিষ্কার আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত ছিল, তিনি পুরোপুরি জাগ্রত ছিলেন, খোলা আকাশে এবং দিনের পূর্ণ আলোতে তিনি নিজ চোখে ঠিক তেমনিভাবে এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন যেমন কোন ব্যক্তি পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস দেখে থাকে। এতে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকে তাহলে আমরা দিনের বেলা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মানুষ, ঘরবাড়ী, মোট কথা যা কিছু দেখে থাকি তা সবই সন্দেহ যুক্ত এবং শুধু দৃষ্টিভ্রম ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।
দ্বিতীয় কারণ, নবী ﷺ এর মানসিক অবস্থাও এর সত্যতার স্বপক্ষে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিলো। তিনি পূর্ণরূপে স্বজ্ঞান ও সুস্থ ছিলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ সুস্থ ও সচল ছিল। তাঁর মন-মগজে পূর্ব থেকে এরূপ কোন খেয়াল চেপে ছিল না যে, এ ধরনের কোন দর্শন লাভ হওয়া উচিত বা হতে যাচ্ছে। এরূপ চিন্তা এবং তা অর্জন করার চেষ্টা থেকে মন-মগজ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। এ পরিস্থিতিতে তিনি আকস্মিকভাবে এ ঘটনার মুখোমুখি হলেন। তাই সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ ছিল না যে, চোখ কোন বাস্তব দৃশ্য দেখছে না, বরং সামনে এসে দাঁড়ানো একটি কাল্পনিক বস্তু দেখছে।
তৃতীয় কারণ, এ পরিস্থিতিতে তাঁর সামনে যে সত্ত্বা আবির্ভূত হয়েছিল তা এত বিরাট, এত জাঁকালো, এত সুন্দর এবং এতই আলোকোদ্ভাসিত ছিল যে, ইতিপূর্বে নবীর ﷺ চিন্তায় ও ধ্যান-ধারণায় এরূপ সত্ত্বার কল্পিত রূপও আসেনি। সুতরাং তা তাঁর কল্পনা প্রসূতও ছিল না। কোন জিন বা শয়তান এমন জাঁকালো হতে পারে না। তাই তিনি তাকে ফেরেশতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্থিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেনঃ সে সময় আমি জিবরাঈলকে দেখেছি, তাঁর তখন ছয়শত ডানা ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। অপর একটি বর্ণনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আরো ব্যাখ্যা করেছেন যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক একটি ডানা এমন বিশাল ছিল যে, গোটা দিগন্ত জুড়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। আল্লাহ তায়ালা নিজে তাঁর অবস্থাকে شَدِيدُ الْقُوَى এবং ذُو مِرَّةٍ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।
চতুর্থ কারণ, সে সত্ত্বা যেসব শিক্ষা দান করেছিলেন তাও এ সাক্ষাতের সত্যতা সম্পর্কে প্রশান্তিদায়ক ছিল। তাঁর মাধ্যমে তিনি হঠাৎ যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গোটা মহাবিশ্বের প্রকৃত সত্য ও তাৎপর্যের ধারক যেসব জ্ঞান লাভ করলেন তাঁর মন-মগজে সে সম্পর্কে কোন ধারণাও ছিল না। তাই তিনি সন্দেহ করেননি যে, আমারই ধ্যান-ধারণা ও কল্পনা সুবিন্যস্ত হয়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। অনুরূপভাবে ঐ জ্ঞান সম্পর্কে এমন সন্দেহ পোষণেরও কোন অবকাশ ছিল না যে, শয়তান ঐ আকৃতিতে এসে তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ, মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজার পরিবর্তে নির্ভেজাল তাওহীদের শিক্ষা দেয়া কি কখনো শয়তানের কাজ হতে পারে, না শয়তান কোনদিন এমন কাজ করেছে? আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে কি শয়তান কখনো মানুষকে সাবধান করেছে? জাহেলীয়াত ও তার রীতিনীতির বিরুদ্ধে কি মানুষকে কখনো ক্ষেপিয়ে তুলেছে? নৈতিক গুণাবলীর প্রতি কি আহবান জানিয়েছে? না কি কোন ব্যক্তিকে বলেছে তুমি নিজে শুধু এ শিক্ষাকে গ্রহণ কর তাই নয়, বরং গোটা বিশ্বের বুক থেকে শিরক জুলুম এবং পাপ পঙ্কিলতাকে উৎখাত এবং ঐসব দুস্কৃতির জায়গায় তাওহীদ, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার সুফলসমূহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাও?
পঞ্চম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আল্লাহ তা’আলা যখন কোন ব্যক্তিকে নবুওয়াত দানের জন্য বাছাই করেন তখন তাঁর হৃদয়-মনকে সব রকম সন্দেহ সংশয় ও শয়তানী প্ররোচনা থেকে মক্ত করে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পূর্ণ করে দেন। এ অবস্থায় তাঁর চোখ যা দেখে এবং কান যা শোনে তার সত্যতা সম্পর্কে তাঁর মন-মগজে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয় না। তিনি সম্পূর্ণ উদার ও উন্মুক্ত মনে এমন প্রতিটি সত্যকে গ্রহণ করে নেন যা তাঁর রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে প্রকাশ হয়। তা চোখে দেখার মত প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন হতে পারে, ইলহামী জ্ঞান হিসেবে তার মনে সৃষ্টি করা হতে পারে কিংবা অহীর পয়গাম হিসেবে আসতে পারে একটি একটি করে যার প্রতিটি শব্দ শুনানো হয়ে থাকে। এর সবকটি ক্ষেত্রেই নবীর এ উপলব্ধি পুরোপুরিই থাকে যে, তিনি সব রকম শয়তানী হস্তক্ষেপ থেকে চূড়ান্তভাবে সুরক্ষিত। যে আকারেই হোক না কেন যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছেছে তা অবিকল তাঁর প্রভুর নিকট থেকে এসেছে। আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত অনুগ্রহ ও নিয়ামতের মত নবীর এ উপলব্ধি ও অনুভূতিও এমন একটি নিশ্চিত জিনিস যার মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মাছের যেমন তার সাঁতারু হওয়া সম্পর্কে অনুভূতি আছে এবং তা আল্লাহ প্রদত্ত। এতে যেমন বিভ্রান্তির লেশমাত্র থাকতে পারে না। অনুরূপ নবীর তাঁর নবী হওয়া সম্পর্কে যে অনূভূতি তাও আল্লাহ প্রদত্ত হয়ে থাকে। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে এ সন্দেহ জাগে না যে, নবী হওয়ার ব্যাপারে হয়তো সে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
আরবীতে ‘সিদরা’ বলা হয় রবই গাছকে আর ‘মুনতাহা’ অর্থ শেষ প্রান্ত সুতরাং سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে শেষ প্রান্তে অবস্থিত বরই-গাছ। আল্লামা আলূসী “রুহুল মাআনীতে” এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ اليها ينتهى علم كل عالم وما وراء ها لا يعلمه الا الله “এ পর্যন্ত গিয়ে সব জ্ঞানীর জ্ঞান শেষ হয়ে যায়। এর পরে যা আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।” ইবনে জারীর তাঁর তাফসীরে এবং ইবনে কাসীর” انهاية فى غريب الحديث والاثر এও প্রায় অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তু জগতের শেষ প্রান্তে অবস্থিত সে কুল বৃক্ষ কেমন এবং তার প্রকৃতি ও পরিচয় কি তা জানা আমাদের জন্য কঠিন। এটা আল্লাহ তা’আলার সৃষ্ট মহাবিশ্বের এমন রহস্যাবৃত বিষয় যেখানে আমাদের বোধ ও উপলব্ধি পৌঁছতে অক্ষম। যাই হোক, সেটা হয়তো এমন কোন জিনিস যা বুঝানোর মানুষের ভাষায় سدرة শব্দের চেয়ে অধিক উপযুক্ত শব্দ আল্লাহ তা’আলা আর কোন কিছুকে মনে করেননি।
“জান্নাতুল মা’ওয়া”র আভিধানিক অর্থ এমন জান্নাত যা অবস্থান স্থল হতে পারে। হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ এটি সেই জান্নাত যা আখেরাতে ঈমানদার ও তাকওয়ার অধিকারী লোকেরা লাভ করবে। এ আয়াত দ্বারাই তিনি প্রমাণ করেছেন যে, এ জান্নাত আসমানে অবস্থিত। কাতাদা (রাঃ) বলেনঃ এটাই সে জান্নাত যেখানে শহীদদের রূহসমূহ রাখা হয়। আখেরাতের যে জান্নাত পাওয়া যাবে এটা সে জান্নাত নয়। ইবনে আব্বাসও (রাঃ) একথাই বলেন। তিনি অধিক এতটুকু বলেছেন যে আখেরাতে ঈমানদারগণ যে জান্নাত লাভ করবেন এটা সে জান্নাত নয়। সে জান্নাতের স্থান এ পৃথিবীতেই।
لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
এসব কারণে বাহ্যত এ বিতর্কের কোন প্রয়োজনই ছিল না যে, এ দু’টি ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ্ ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন, না জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন? কিন্তু যে কারণে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা হচ্ছে, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবা কিরাম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ আমরা নীচে এক এক করে বর্ণনা করলাম।
একঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ
হাদীস গ্রন্থ বুখারীর কিতাবুত তাফসীরে হযরত মাসরূক থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম; “আম্মাজান, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ কি আল্লাহকে দেখেছিলেন? ” তিনি জবাব দিলেন।”তোমার একথা শুনে আমার গায়ের পশম শিউরে উঠেছে। তুমি কি করে ভুলে গেলে যে, তিনটি বিষয় এমন যা কেউ দাবী করলে মিথ্যা দাবী করা হবে।” (তার মধ্যে প্রথম কথাটি হয়রত আয়েশা (রাঃ) যা বললেন, তা হচ্ছে) “কেউ যদি তোমাকে বলে যে, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহকে দেখেছিলেন, তাহলে সে মিথ্যা বলে।” তারপর হযরত আয়েশা (রাঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন। لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ (দৃষ্টিসমূহ তাঁকে দেখতে সক্ষম নয়।)
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ
“কোন মানুষেরই এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তবে হয় অহী হিসেবে বা পর্দার আড়াল থেকে কিংবা তিনি কোন ফেরেশতা পাঠাবেন এবং সে তাঁর ইচ্ছা মাফিক তার প্রতি অহী নাযিল করবে।” এরপর তিনি বললেনঃ “তবে রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দু’বার তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেছেন।”
এ হাদীসের একটি অংশ বুখারীর কিতাবুত তাওহীদের ৪র্থ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বাদউল খালক অধ্যায়ে ইমাম বুখারীর মাসরূক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে মাসরূপ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশার একথা শুনে আমি বললাম তাহলে আল্লাহ তা’আলার একথার কি অর্থ হবে? ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى - فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى তিনি বললেন এর দ্বারা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। তিনি সব সময় মানুষের রূপ ধরে রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কাছে আসতেন। কিন্তু ঐ সময় তিনি তাঁর আসল আকৃতিতে তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং তাঁর শরীরে গোটা দিগন্ত আড়াল হয়ে গিয়েছিল।
মুসলিম কিতাবুল ঈমানের باب فى ذكر كدرة المنتهى এ হযরত আয়েশার (রাঃ) সাথে মাসরূকের এ কথোপকথন অধিক বিস্তারিত রূপে উদ্ধৃত হয়েছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ যে ব্যক্তি দাবী করে যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রবকে দেখেছেন সে আল্লাহ তা’আলার প্রতি অতি বড় অপবাদ আরোপ করে।” মাসরূক বলেনঃ আমি হেলান দিয়ে বসেছিলাম। একথা শুনে আমি উঠে বসলাম এবং বললাম উম্মুল মু’মিনীন তাড়াহুড়ো করবেন না। আল্লাহ তা’আলা কি বলেন নি وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى এবং وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ জবাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ এ উম্মতের মধ্যে আমিই সর্ব প্রথম এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেনঃ
إِنَّمَا هُوَ جِبْرِيلُ عليه السلام, لَمْ أَرَهُ عَلَى صُورَتِهِ الَّتِى خُلِقَ عَلَيْهَا غَيْرَ هَاتَيْنِ الْمَرَّتَيْنِ- رَأَيْتُهُ مُنْهَبِطًا مِنَ السَّمَاءِ سَادًّا عِظَمُ خَلْقِهِ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ والأَرْضِ-
তিনি তো ছিলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যে আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে আসল আকৃতিতে আমি তাঁকে এ দু’বার ছাড়া আর কখনো দেখিনি। দু’বারই আমি তাঁকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছি। সে সময় তাঁর বিশাল সত্তা পৃথিবী ও আসমানের মধ্যবর্তী সমগ্র শূন্যলোক ছেয়ে ফেলেছিলো।”
মাসরূক বর্ণিত এ হাদীস ইবনে মারদুইয়া যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ আমিই সর্ব প্রথম রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেন, না। “আমি তো জিবরাঈলকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছিলাম।”
দুইঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ বুখারী কিতাবুত তাফসীর, মুসলিম কিতাবুল ঈমান এবং তিরমিযী আবওয়াবুত তাফসীরে যির ইবনে হুবাইশ থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এমন আকৃতিতে দেখেছেন যে, তাঁর ছয়শত ডানা ছিল।
মুসলিমে অন্যান্য রেওয়ায়াতে مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى এবং لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى আয়াতেরও এ একই তাফসীর আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে যির ইবনে হুবাইশ বর্ণনা করেছেনঃ
মুসনাদে আহমাদে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের এ তাফসীর যির ইবনে হুবাইশ ছাড়া আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ এবং আবু ওয়ায়েলের মাধ্যমেও বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়াও মুসনাদে আহমাদে যির ইবনে হুবাইশের আরো দু’টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যাতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى - عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى আয়াতের তাফসীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ جِبْرِيلَ عند سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عليه سِتُّمِائَةِ جَنَاحٍ-
“রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেনঃ “আমি জিবরাঈলকে সিদরাতুল মুনতহার কাছে দেখেছি। সে সময় তাঁর ছয়শত ডানা ছিল।”
এ একই বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস শাকীক ইবনে সালামা থেকে ইমাম আহমদও বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসে বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের (রাঃ) মুখ থেকে শুনেছি যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ নিজে বলেছিলেনঃ আমি জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এ আকৃতিতে “সিদরাতুল মুনহাতায়” দেখেছিলাম।
তিনঃ আতা ইবনে আবী রাবাহ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কে وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَى جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ নবী ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)।
চারঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু যার গিফারীর মাধ্যমে আবদুল্লাহ্ ইবনে শাকীক বর্ণিত দু’টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। এক রেওয়াতে তিনি বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেনঃ نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ । অপর রেওয়ায়াতে বলেছেনঃ তিনি আমার এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَيْتُ نُورًا । ইবনুল কাইয়েম زاد المعاد গ্রন্থে নবী ﷺ এর প্রথম উক্তির অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন আমার ও আল্লাহকে দেখার মধ্যে প্রতিবন্ধক ছিল নূর। তিনি দ্বিতীয় উক্তির অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, আমি আমার রবকে দেখিনি, বরং নূর দেখেছি।”
নাসায়ী ও ইবনে আবী হাতেম নিম্নোক্ত ভাষায় হযরত আবু যারের (রাঃ) বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। রসূলুল্লাহ্ ﷺ অন্তর দিয়ে তাঁর রবকে দেখেছেন, চোখ দিয়ে দেখেন নি।”
পাঁচঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসে নবী ﷺ বলেছেনঃ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ “আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টির মধ্য থেকে কারো চোখই আল্লাহ তা’আলা পর্যন্ত পৌঁছেনি।”
ছয়ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহঃ
মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসকে - مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى- وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى আয়াত দু’টির অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাঁর রবকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছেন। মুসনাদে আহমাদেও এ হাদীসটি আছে।
আতা ইবনে আবী রাবাহর বরাত দিয়ে ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে চোখ দিয়ে নয়, অন্তর দিয়ে দেখেছিলেন।
নাসায়ীতে ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ
اتعجبون ان تكون الخلة لابراهيم والكلام لموسى والروية لمحمد؟
“আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলে তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ কে তাঁর দর্শনলাভের মর্যাদা দিয়েছেন” এতে কি তোমরা বিস্ময়বোধ করছো? হাকেমও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং একে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিরমিযীতে শা’বী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস এক মজলিসে বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা তাঁর সাক্ষাত লাভ ও কথোপকথনকে মুহাম্মাদ ﷺ ও মূসা আলাইহিস সালামের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তিনি মুসা আলাইহিস সালামের সাথে দু’বার কথা বলেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ তাঁকে দু’বার দেখেছেন।” ইবনে আব্বাসের এ কথা শুনে মাসরূক হযরত আয়েশার (রাঃ) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ মুহম্মাদ ﷺ কি তাঁর রবকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ “তুমি এমন কথা বলেছো যা শুনে আমার পশম শিউরে উঠেছে।” এরপর হযরত আয়েশা (রাঃ) ও মাসরূকের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে আমরা উপরে হযরত আয়েশার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে উদ্ধৃত করেছি।
তিরমিযীতেই অন্য যেসব হাদীস ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে তার একটিতে তিনি বলেছেন, নবী ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন। দ্বিতীয় একটি হাদীসে বলেছেন; দু’বার দেখেছিলেন এবং তৃতীয় আরেকটি হাদীসে বলেছেন, তিনি অন্তর দিয়ে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন।”
মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে আছেঃ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ رَبِّى تَبَارَكَ وَتَعَالَى “আমি আমার মহাকল্যাণময় ও মর্যাদাবান রবকে দেখেছি।” আরেকটি হাদীসে তিনি বলেনঃ
أَنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قَالَ أَتَانِى رَبِّى اللَّيْلَةَ فِى أَحْسَنِ صُورَةٍ - أَحْسِبُهُ يَعْنِى فِى النَّوْمِ-
রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেনঃ “আমার রব আজ রাতে অতীব সুন্দর আকৃতিতে আমার কাছে এসেছিলেন। আমার মনে হয় নবীর ﷺ এ কথার অর্থ তিনি স্বপ্নে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন।”
তাবারানী ও ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে এও উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ দু’বার তাঁর রবকে দেখেছেন। একবার দেখেছেন চোখে আরেকবার দেখেছেন অন্তর দিয়ে।
সাতঃ মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? নবী ﷺ জবাব দিলেনঃ আমি তাঁকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছি। (ইবনে আবী হাতেম)। এ বর্ণনাটিকে ইবনে জারীর যেরূপ ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছে, নবী ﷺ বললেনঃ “আমি তাঁকে চোখ দিয়ে অন্তর দিয়ে দু’বার দেখেছি।”
আটঃ মি’রাজের ঘটনা প্রসঙ্গে শারীক ইবনে আব্দুল্লাহ্র বরাত দিয়ে ইমাম বুখারী কিতাবুল তাওহীদে হযরত আনাস ইবনে মালেক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে এ কথাগুলো আছেঃ
حَتَّى جَاءَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى وَدَنَا الْجَبَّارُ رَبُّ الْعِزَّةِ فَتَدَلَّى حَتَّى كَانَ مِنْهُ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى اللَّهُ فِيمَا أَوْحَى إِلَيْهِ خَمْسِينَ صَلاَةً-
“তিনি যখন সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন তখন মহাপরাক্রান্ত ও মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং তার উপর দিকে শূন্যে অবস্থান করলেন। এমন কি নবী ﷺ ও তাঁর মধ্যে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের মধ্যকার সমান বা তার চেয়েও কম ব্যবধান রইলো। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর কাছে যেসব বিষয়ে অহী করলেন তার মধ্যে পঞ্চম ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশও ছিল।”
কিন্তু এ হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে ইমাম খাত্তাবী, হাফেজ ইবনে হাজার, ইবনে হাযম এবং الجمع بين الصحيحين প্রণেতা হাফেয আবদুল হক যেসব আপত্তি উত্থাপন করেছেন তা ছাড়াও সবচেয়ে বড় আপত্তি হচ্ছে এটি স্পষ্টরূপে কুরআনের পরিপন্থী। কারণ, কুরআন মজীদে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে। তার মধ্যে প্রথমটি নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে একটি উঁচু দিগন্তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে دَنَا فَتَدَلَّى - فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى বিষয়ক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টি সিদরাতুল মুনতাহার সন্নিকটে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু ওপরে বর্ণিত এ রেওয়ায়াতটি দু’টি সাক্ষাতের ঘটনাকে একসাথে মিলিয়ে জগাখিচুড়ি করে একই সাক্ষাত বানিয়ে ফেলেছে। অতএব কুরআন মজীদের পরিপন্থী হওয়ার কারণে কোন ক্রমেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।
এরপর ওপরে বর্ণিত হাদীসগুলোর প্রসঙ্গে আসা যাক। ও গুলোর মধ্যে আবার হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসগুলোই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা উভয়েই ঐকমত্য সহকারে খোদ রসূলুল্লাহ্ ﷺ থেকে একথা বর্ণনা করেছেন যে, উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আল্লাহ তা’আলাকে নয়, জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন। তাছাড়া এসব হাদীস কুরআন মজিদের বক্তব্য ও ইঙ্গিতের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়া হযরত আবু যার (রাঃ) এবং হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ) নবীর ﷺ যেসব উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস থেকে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে গুরুতর অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন হাদীসে উভয় সাক্ষাতকেই চাক্ষুষ সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটিতে উভয় সাক্ষাতকেই অন্তরের সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটাতে একটি সাক্ষাতকে চাক্ষুষ অপরটিকে অন্তরের বলা হয়েছে, আবার কোনটিতে চাক্ষুষ দর্শনকে পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করা হয়েছে। এসব বর্ণনার একটিও এমন নয় যাতে রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নিজের উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। আর যেখানে তারা রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নিজের কোন কথা বা উক্তি উদ্ধৃত করেছেন সেখানে প্রথমত কুরআন মজীদে বর্ণিত এ দু’টি সাক্ষাত লাভের কোনটিরও নামের উল্লেখ নেই। তাছাড়া তাদের একটি রেওয়ায়াতের ব্যাখ্যা অন্য রেওয়ায়াতের থেকে যা জানা যায় তা হচ্ছে নবী ﷺ কোন সময়ই জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহ তা’আলাকে দেখেননি, স্বপ্নে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন। তাই প্রকৃতপক্ষে এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের সাথে সম্পর্কিত রেওয়ায়াতসমূহের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযীর বর্ণনাসমূহে যদিও রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে কিন্তু যেসব সাহাবায়ে কিরাম নবী ﷺ থেকে একথা থেকে একথা শুনেছেন তাতে তাদের নাম বলা হয়নি। তার একটিতে আবার বলা হয়েছে যে, নবী ﷺ চাক্ষুষ দেখার বিষয় সরাসরি অস্বীকার করেছেন।
লাতের আস্তানা ছিল তায়েফে। বনী সাকীফ গোত্র তার এত ভক্ত ছিল যে, আবরাহা যে সময় হস্তী বাহিনী নিয়ে কা’বা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মক্কার ওপর আক্রমণ করতে যাচ্ছিল তখন তারা শুধু তাদের এ উপাস্যের আস্তানা রক্ষা করার জন্য সে অত্যাচারীকে মক্কার রাস্তা দেখানোর জন্য পথ প্রদর্শক সরবরাহ করেছিল যাতে সে লাতের কোন ক্ষতি না করে। অথচ কা’বা যে আল্লাহর ঘর গোটা আরববাসীর মত সাকীফ গোত্রও একথা বিশ্বাস করতো। লাত শব্দের অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। ইবনে জারীর তাবারীর জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ হচ্ছে এ শব্দটি আল্লাহ শব্দের স্ত্রীলিংগ। মূল শব্দটি ছিল اللهة । এটিকেই পরিবর্তন করে اللات করা হয়েছে। যামাখশারীর মতে- لوى يلوى থেকে শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ ঘুরা বা কারো প্রতি ঝুঁকে পড়া। মুশরিকরা যেহেতু ইবাদতের জন্য তার প্রতি মনযোগী হতো, তার সামনে ঝুঁকতো এবং তার তাওয়াফ করতো তাই তাকে ‘লাত’ আখ্যা দেয়া শুরু হলো। ইবনে আব্বাস نا বর্ণটিতে “তাশদীদ” প্রয়োগ করে لات পড়তেন এবং لت بلت থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে বলতেন। এর অর্থ মন্থন করা বা লেপন করা। ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বর্ণনা করেছেন যে, মূলত সে ছিল একজন মানুষ, যে তায়েফের সন্নিকটে এক কঙ্করময় ভূমিতে বাস করতো এবং হজ্জের উদ্দেশ্যে গমনকারীদের ছাতু ও অন্যান্য খাদ্য খাওয়াতো। সে মারা গেলে লোকেরা ঐ কঙ্করময় ভূমিতে তার নামে একটা আস্তানা গড়ে তোলে এবং তার উপাসনা করতে শুরু করে। কিন্তু লাতের এ ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদের মত সম্মানিত ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও দু’টি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। একটি কারণ হলো একে لات লাত বলা হয়েছে لات “লাত্তা” বলা হয়নি। অপর কারণটি হলো, কুরআন মজীদে তিনজনকেই দেবী বলে উল্লেখ করেছে কিন্তু বর্ণিত হাদীস অনুসারে সে পুরুষ ছিল নারী নয়।
عزى উয্যা শব্দটির উৎপত্তি عزت শব্দ থেকে। এর অর্থ সম্মানিতা। এটা ছিল কুরাইশদের বিশেষ দেবী। এর আস্তানা ছিল মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী “নাখলা” উপত্যকার “হুরাদ” নামক স্থানে (নাখলার অবস্থান জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল-আহকাফ, টীকা-৩৩) বনী হাশেমের মিত্র বনী শায়বান গোত্রের লোক এর প্রতিবেশী ছিল। কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের লোকজন এর যিয়ারতের জন্য আসতো, এর উদ্দেশ্যে মানত করতো এবং বলি দান করতো। কা’বার মত এ স্থানটিতেও কুরবানী বা বলির জন্তু নিয়ে যাওয়া হতো এবং এটিকে সমস্ত মূর্তির চেয়ে অধিক সম্মান দেয়া হতো। ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন আবু উহায়হার মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে আবু লাহাব তাকে রোগ শয্যায় দেখতে গিয়ে দেখলো সে কাঁদছে। আবু লাহাব জিজ্ঞেস করলোঃ আবু উহায়হা, তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছো? মৃত্যু তো সবারই হবে। সে বললোঃ আল্লাহর শপথ, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে কাঁদছি না। আমার মৃত্যুর পর উয্যার পূজার কি উপায় হবে সে দুশ্চিন্তা আমাকে নিশেষ করে দিচ্ছে। আবু লাহাব বললোঃ তোমার জিবদ্দশায় ও তোমার কারণে উয্যার পূজা করা হতো না আর তোমার মৃত্যুর পরে তাকে পরিত্যাগ করাও হবে না। আবু উহায়হা বললোঃ এখন আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে, আমার মৃত্যুর পরে কেউ অবশ্যই আমার স্থান পূরণ করবে।
মানাতের আস্তানা ছিল মক্কা ও মদীনার মাঝে লোহিত সাগরের তীরবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে। বিশেষ করে খুযা’আ, আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকেরা এর খুব ভক্ত ছিল। তার হজ্জ ও তাওয়াফ করা হতো এবং তার উদ্দেশ্যে মানতের বলি দেয়া হতো। হজ্জের মওসূমে হাজীরা বায়তুল্লাহ্র তাওয়াফ এবং আরাফাতের ও মিনার অবস্থানের পর সেখান থেকে মানতের যিয়ারত তথা দর্শনলাভের জন্য লাব্বায়কা লাব্বায়কা ধ্বনি দিতে শুরু করতো। যারা এ দ্বিতীয় হজ্জের নিয়ত করতো তারা সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করতো না।