১ ) শপথ সে বাতাসের যা ধূলাবালি উড়ায়।
وَٱلذَّٰرِيَـٰتِ ذَرْوًۭا ١
২ ) আবার পানি ভরা মেঘরাশি বয়ে নিয়ে যায় ১
فَٱلْحَـٰمِلَـٰتِ وِقْرًۭا ٢
৩ ) তারপর ধীর মৃদুমন্দ গতিতে বয়ে যায়।
فَٱلْجَـٰرِيَـٰتِ يُسْرًۭا ٣
৪ ) অতঃপর একটি বড় জিনিস (বৃষ্টি) বন্টন করে। ২
فَٱلْمُقَسِّمَـٰتِ أَمْرًا ٤
৫ ) প্রকৃত ব্যাপার হলো, তোমাদেরকে যে জিনিসের ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে ৩ তা সত্য।
إِنَّمَا تُوعَدُونَ لَصَادِقٌۭ ٥
৬ ) কর্মফল প্রদানের সময় অবশ্যই আসবে। ৪
وَإِنَّ ٱلدِّينَ لَوَٰقِعٌۭ ٦
৭ ) শপথ বিবিধ আকৃতি ধারণকারী আসমানের। ৫
وَٱلسَّمَآءِ ذَاتِ ٱلْحُبُكِ ٧
৮ ) (আখেরাত সম্পর্কে) তোমাদের কথা পরস্পর ভিন্ন। ৬
إِنَّكُمْ لَفِى قَوْلٍۢ مُّخْتَلِفٍۢ ٨
৯ ) তার ব্যাপারে সে-ই বিরক্ত যে হকের প্রতি বিমুখ। ৭
يُؤْفَكُ عَنْهُ مَنْ أُفِكَ ٩
১০ ) ধ্বংস হয়েছে অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা, ৮
قُتِلَ ٱلْخَرَّٰصُونَ ١٠
১.
এ ব্যাপারে সমস্ত তাফসীরকার একমত যে, الذَّارِيَاتِ অর্থ বিক্ষিপ্তকারী ও ধূলাবালি ছড়ানো বাতাস এবং
الْحَامِلَاتِ وِقْرًا (ভারী বোঝা বহনকারী) অর্থ সেই বাতাস যা সমুদ্র থেকে লক্ষ কোটি গ্যালন বাষ্প মেঘের আকারে বহন করে আনে। হযরত উমর, হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), মুজাহিদ, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, হাসান বাসরী, কাতাদা ও সুদ্দী প্রমুখ মুফাসসিরগণের থেকে বর্ণিত হয়েছে।
২.
الْجَارِيَاتِ يُسْرًا ও الْمُقَسِّمَاتِ أَمْرًا এর ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ এ কথাটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বা এ অর্থ গ্রহণ করা জায়েজ মনে করেছেন যে, এ দু’টি বাক্যাংশের অর্থও বাতাস। অর্থাৎ এ বাতাসই আবার মেঘমালা বহন করে নিয়ে যায় এবং ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহর নির্দেশানুসারে যেখানে যতটুকু বর্ষণের নির্দেশ দেয়া হয় ততটুকু পানি বণ্টন করে। আরেক দল
الْمُقَسِّمَاتِ أَمْرًا আয়াতাংশের অর্থ করেছেন দ্রুতগতিশীল নৌকাসমূহ এবং
الْجَارِيَاتِ يُسْرًا অর্থ করেছেন সেসব ফেরেশতা যারা আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাঁর সমস্ত সৃষ্টির জন্য বরাদ্দকৃত জিনিস তাদের মধ্যে বণ্টন করে। একটি রেওয়ায়াত অনুসারে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ দু’টি আয়াতাংশের এ অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন, আমি এ অর্থ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে না শুনে থাকলে বর্ণনা করতাম না। এর ওপর ভিত্তি করে আল্লামা আলুসী এ ধারণা প্রকাশ করেন যে, এটি ছাড়া এ আয়াতাংশ দু’টির আর কোন অর্থ গ্রহণ করা জায়েয নয়। যারা অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করেছেন তারা অনর্থক দুঃসাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু হাফেয ইবনে কাসীর বলেন, এ রেওয়ায়াতের সনদ দূর্বল এবং এর ওপর ভিত্তি করে অকাট্যভাবে বলা যায় না যে, নবী (সা.) সত্যিই এসব আয়াতাংশের এ ব্যাখ্যাই বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, সাহাবা ও তাবেয়ীদের একটি উল্লেখযোগ্য দল কর্তৃক এ দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাফসীরকারদের বড় দল প্রথম তাফসীরটিও বর্ণনা করেছেন। আর কথার ধারাবাহিকতার সাথে এ অর্থটিই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। শাহ রাফীউদ্দিন সাহেব, শাহ আবদুল কাদের সাহেব এবং মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেবও তাদের অনুবাদে প্রথম অর্থটিই গ্রহণ করেছেন।
৩.
মূল আয়াতে تُوعَدُونَ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি যদি মূল ধাতু
وعد থেকে গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে তার অর্থ হবে তোমাদেরকে যে বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে, আর যদি
وعيد থেকে গঠিত হয়ে থাকে তাহলে অর্থ হবে, “তোমাদেরকে যে জিনিসের ভয় দেখানো হচ্ছে।” ভাষাগতভাবে দু’টি অর্থই যথাযথ ও নির্ভুল। কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্রের সাথে দ্বিতীয় অর্থটিই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, যারা কুফর, শিরক ও পাপাচারে ডুবে ছিল এবং কখনো নিজ কৃতকর্মের প্রতিফল পেতে হবে এবং সেজন্য জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে একথা মানতে প্রস্তুত ছিল না এখানে তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। এ কারণে আমরা
تُوعَدُونَ শব্দটিকে প্রতিশ্রুতি অর্থে গ্রহণ না করে ভীতি অর্থে গ্রহণ করেছি।
৪.
এটাই ছিল মূল কথা যে জন্য শপথ করা হয়েছে। এ শপথের অর্থ হচ্ছে, যে নজিরবিহীন শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে বৃষ্টিপাতের এ মহা ব্যবস্থাপনা তোমাদের চোখের সমানে চলছে এবং তার মধ্যে যে যুক্তি, কৌশল ও উদ্দেশ্য সক্রিয় দেখা যাচ্ছে তা প্রমাণ করেছে যে, এ পৃথিবী কোন উদ্দেশ্যহীন ও অনর্থক বালু মাটির খেলাঘর নয় যেখানে লক্ষ কোটি বছর থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে অতি বড় একটি খেলা চলছে, বরং প্রকৃতপক্ষে এটা একটা পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি কাজ কোন না কোন উদ্দেশ্য ও উপযোগিতা সামনে রেখে হচ্ছে। এ ব্যবস্থাপনায় কোনক্রমেই এটা সম্ভব নয় যে, এখানে মানুষের মত একটা সৃষ্টিকে বিবেক-বুদ্ধি, চেতনা-বিবেচনা, বাছ-বিচার কর্মের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খাটানোর অধিকার দিয়ে তার মধ্যে ভাল ও মন্দের নৈতিক অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং তাকে সব রকম ন্যায় ও অন্যায় এবং ভুল ও নির্ভুল কাজ করার সুযোগ দিয়ে পৃথিবীতে যথেচ্ছা আচরণ করার জন্য একেবারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাকে কখনো একথা জিজ্ঞেস করা হবে না যে, তাকে যে মন-মগজ ও দৈহিক শক্তি দেয়া হয়েছিল পৃথিবীতে কাজ করার জন্য যে ব্যাপক উপায়-উপকরণ তার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খাটানোর যেসব ইখতিয়ার তাকে দেয়া হয়েছিল তা সে কিভাবে ব্যবহার করেছে। যে বিশ্ব-ব্যবস্থায় সবকিছুর পেছনেই একটা উদ্দেশ্য কার্যকর সেখানে শুধু মানুষের মত একটি মহাসৃষ্টির আবির্ভাব কিভাবে উদ্দেশ্যহীন হতে পারে? যে ব্যবস্থায় প্রতিটি জিনিস জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর সেখানে শুধুমাত্র মানুষের সৃষ্টি অর্থহীন হতে পারে কি করে? যেসব সৃষ্টির জ্ঞান-বুদ্ধি ও বোধশক্তি নেই এ বস্তুজগতেই তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যায়। এ কারণে তাদের আয়ুস্কাল শেষ হওয়ার পর যদি তাদের ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে তা যথাযথ ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ তাদেরকে কোন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দেয়া হয়নি। তাই তাদের জবাবদিহিরও কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধি, চেতনা ও বিবেক এবং ক্ষমতা-ইখতিয়ারের অধিকারী সৃষ্টি---যার কাজ-কর্ম শুধু বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যার নৈতিক প্রভাবও আছে এবং যার নৈতিক ফলাফল সৃষ্টিকারী কাজ-কর্মের ধারাবাহিকতা শুধু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে না, মৃত্যুর পরও তার নৈতিক ফলাফল উদ্ভব হতে থাকে এমন সৃষ্টিকে শুধু তার বস্তুগত তৎপরতা শেষ হয়ে যাওয়ার পর উদ্ভিদ ও জীব-জন্তুর মত কি করে ধ্বংস করা যেতে পারে? সে তার নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছায় যে নেক কাজ বা বদ কাজই করে থাকুক না কেন তার সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিদান তার অবশ্যই পাওয়া উচিত। কারণ যে উদ্দেশ্যে তাকে অন্যসব সৃষ্টির মত না করে ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টি হিসেবে বানানো হয়েছে এটা তার মৌলিক দাবী। তাকে যদি জবাবদিহি করতে না হয়, তার নৈতিক কাজ-কর্মের জন্য যদি পুরস্কার ও শাস্তি না হয় এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ারবিহীন সৃষ্টিকূলের মত স্বাভাবিক জীবন শেষ হওয়ার পর তাকে ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে তাকে সৃষ্টি করা অবশ্যই অর্থহীন হবে। কিন্তু একজন মহাজ্ঞানী ও বিচক্ষণ স্রষ্টার কাছে এরূপ নিরর্থক কাজের আশা করা যায় না।
এছাড়াও আখেরাত এবং পুরস্কার ও শাস্তি সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে সৃষ্টির এ চারটি নিদর্শনের নামে শপথ করার আরো একটি কারণ আছে। আখেরাত অস্বীকারকারীরা যে কারণে মৃত্যুর পরের জীবনকে অসম্ভব মনে করে তা এই যে, মৃত্যর পর আমরা যখন মাটিতে বিলীন হয়ে যাবো এবং আমাদের অণু-পরমাণু যখন মাটিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে তখন কি করে সম্ভব যে, দেহের এসব বিক্ষিপ্ত অংশ পুনরায় একত্রিত হবে এবং পুনরায় আমাদেরকে সৃষ্টি করা হবে। আখেরাতের প্রমাণ হিসেবে সৃষ্টির যে চারটি নিদর্শনকে পেশ করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে আপনা থেকেই এ সন্দেহ ও ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠের যতগুলো পানির ভাণ্ডারে সূর্যের কিরণ পৌঁছে ততগুলো পানির ভাণ্ডারে সূর্যের তাপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় পানির অগণিত বিন্দু তার ভাণ্ডারে পড়ে না থেকে শুন্যে উড়ে যায়। কিন্তু তা নিঃশেষ হয়ে যায় না, বরং বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে প্রতিটি বিন্দু বাতাসের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এ বাতাসই বাষ্পে রূপান্তরিত ঐ সব বারিবিন্দুকে একত্রিত করে গাঢ় মেঘের সৃষ্টি করে ঐ মেঘরাশিকে নিয়ে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সময় নির্ধারিত আছে ঠিক সেই সময় প্রতিটি বিন্দুকে ঠিক সেই আকৃতিতে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয় যে আকৃতিতে তা পূর্বে ছিল। প্রতিনিয়ত এই যে দৃশ্য মানুষের চোখের সামনে অতিক্রান্ত হচ্ছে তা সাক্ষ্য দেয় যে, মৃত মানুষদের দেহের অঙ্গ-পত্যঙ্গও আল্লাহর একটি মাত্র ইঙ্গিতেই একত্রিত হতে পারে এবং ঐসব মানুষ আগে যেমন ছিল ঠিক সেই আকৃতিতেই তাদেরকে পুনরায় জীবিত করা যেতে পারে। এসব অংগ-প্রত্যংগ মাটি, বাতাস বা পানি যার মধ্যেই মিশে যেয়ে থাক না কেন সর্বাবস্থায়ই তা এ পৃথিবী এবং এর পরিমণ্ডলেই আছে। যে আল্লাহ পানি থেকে বাষ্পরাশি তৈরী করে তা বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার পর পুনরায় সেই বাতাসের সাহায্যেই তা একত্রিত করেন এবং পরে পানির আকারে তা বর্ষণ করেন, তাঁর জন্য মানব-দেহের অংগ-প্রত্যংগকে বাতাস, পানি ও মাটির মধ্য থেকে বেছে একত্রিত এবং পূর্বের মত সংযোজিত করে দেয়া কঠিন হবে কেন?
৫.
মূল আয়াতে ذَاتِ الْحُبُكِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
حبك রাস্তাসমূহ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। বায়ু প্রবাহের কারণে মরুভূমির বালুকারাশি এবং বদ্ধ পানিতে যে ঢেউ সৃষ্টি হয় তাকেও বলে। আবার কোঁকড়া চুলে যে গুচ্ছ ও ভাঁজের সৃষ্টি হয় তা বুঝানোর জন্যও এ শব্দটিকে ব্যবহৃত হয়। এখানে আসমানকে
حبك এর অধিকারী বলার কারণ হচ্ছে যে, অধিকাংশ সময় আসমানে নানা আকৃতির মেঘরাশি ছেয়ে থাকে এবং বাতাসের প্রভাবে বারবার তার আকৃতি পরিবর্তিত হতে থাকে এবং কখনো কোন আকৃতি না স্থায়িত্ব লাভ করে না অন্য আকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। অথবা এ কারণে বলা হয়েছে যে, রাতের বেলা যখন আকাশে তারকাসমূহ চড়িয়ে থাকে তখন মানুষ তার নানা রকম আকৃতি দেখতে পায় যার কোনটি অন্যগুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয় না।
৬.
এ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের ব্যাপারে বিভিন্ন আকৃতির আসমানের শপথ করা হয়েছে উপমা হিসেবে। অর্থাৎ আসমানের মেঘমালা ও তারকাপুঞ্জের আকৃতি যেমন ভিন্ন এবং তাদের মধ্যে কোন সাদৃশ্য ও মিল দেখা যায় না, তোমরাও আখেরাত সম্পর্কে অনুরূপ রকমারি মতামত ও বক্তব্য পেশ করছো এবং তোমাদের একজনের কথা আরেকজনের থেকে ভিন্ন। তোমাদের কেউ বলে এ পৃথিবী অনাদি ও চিরস্থায়ী। তাই কোন রকম কিয়ামত সংঘটিত হতে পারে না। কেউ বলে, এ ব্যবস্থা ধ্বংসশীল এবং এক সময় এটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে মানুষসহ যেসব জিনিস ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তার পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। কেউ পুনরুজ্জীবনকে সম্ভব বলে মনে করে কিন্তু তার আকীদা-বিশ্বাস এই যে, মানুষ তার ভাল কাজের ফলাফল ভোগের জন্য এ পৃথিবীতে বারবার জন্ম নেয়। কেউ জান্নাত এবং জাহান্নামও বিশ্বাস করে, কিন্তু তার সাথে আবার জন্মান্তরবাদেরও সমন্বয় সাধন করে অর্থাৎ তার ধারণা হচ্ছে গোনাহগার ব্যক্তি জাহান্নামেও শাস্তি ভোগ করে এবং এ পৃথিবীতেও শাস্তি পাওয়ার জন্য বারবার জন্ম লাভ করতে থাকে। কেউ বলে, দুনিয়ার এ জীবনটাই তো একটা শাস্তি। মানবাত্মার যতদিন পর্যন্ত বন্তু জীবনের সাথে সম্পর্ক থাকে ততদিন পর্যন্ত মরে পুনরায় এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে থাকে। তার প্রকৃত মুক্তি (নির্বান লাভ) হচ্ছে, অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়। কেউ আখেরাত এবং জান্নাত ও জাহান্নাম বিশ্বাস করে ঠিকই, কিন্তু বলে, আল্লাহ তাঁর একমাত্র পুত্রকে ক্রুশে মৃত্যু দান করে মানুষের সর্বকালের গোনাহর কাফফারা আদায় করে দিয়েছেন। মানুষ আল্লাহর সেই পুত্রের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নিজের কুকর্মের মন্দ পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। কিছু লোক আছে যারা আখেরাত এবং শাস্তি ও পুরস্কারে বিশ্বাস করেও এমন কিছু বুযুর্গ ব্যক্তিকে সুপারিশকারী মনে করে নেয়---তাদের ধারণায় তারা আল্লাহর এতই প্রিয় বা আল্লাহর কাছে এমন ক্ষমতার অধিকারী যে, যারাই তাদের ভক্ত হয়ে যাবে তারা পৃথিবীতে সবকিছু করেও শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। এসব সম্মানিত সত্তা সম্পর্কে এ আকীদা পোষণকারীদের মধ্যে মতের মিল নেই। প্রত্যেক গোষ্ঠিই তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা সুপারিশকারী বানিয়ে রেখেছে। মতের এ ভিন্নতাই প্রমাণ করে যে, অহী ও রিসালাতের তোয়াক্কা না করে মানুষ তার নিজের এবং এ পৃথিবীর পরিণতি সম্পর্কে যখনই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা অজ্ঞতা প্রসূত হয়েছে। অন্যথায়, মানুষের কাছে সত্যিই যদি এ ব্যাপারে সরাসরি জ্ঞান লাভের কোন মাধ্যম থাকতো তাহলে এত ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী আকীদা-বিশ্বাস সৃষ্টি হতো না।
৭.
মূল আয়াতের বাক্য হলো يُؤْفَكُ عَنْهُ مَنْ أُفِكَ । এ আয়াতাংশে ব্যবহৃত
عنه সর্বনাম দ্বারা দু’টি জিনিস বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। এক, কৃতকর্মের প্রতিদান। দুই, ভিন্ন ভিন্ন কথা ও বক্তব্য। প্রথম ক্ষেত্রে এ বাণীর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কৃতকর্মের প্রতিদান অবশ্যই সামনে আসবে, যদিও তোমরা সে প্রতিদান প্রাপ্তি সম্পর্কে নানা রকমের ভিন্ন ভিন্ন আকীদা পোষণ করে থাকো। তবে তা মেনে নিতে কেবল সেই ব্যক্তিই বিদ্রোহ করে যে ন্যায় ও সত্য বিমুখ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এ বাণীর অর্থ দাঁড়ায় এই নানা রকমের বক্তব্য ও মতামত দেখে কেবল সেই ব্যক্তিই বিভ্রান্ত হয় যে ন্যায় ও সত্যের প্রতি বিমুখ।
৮.
এ বাক্যটি দ্বারা কুরআন মজীদ মানুষকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে সাবধান করছে। পার্থিব জীবনের ছোট ছোট ক্ষেত্রে অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোন পরিমাপ ও মূল্যায়ণ করা কিছুটা চলতে পারে যদিও তা জ্ঞানের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু গোটা জীবনের কৃতকর্মের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে কিনা এবং যদি করতে হয় তাহলে কার কাছে কখন জবাবদিহি আমাদেরকে করতে হবে? সেই জবাবদিহিতে আমাদের সফলতা ও ব্যর্থতার ফলাফল কি হবে? এটা এমন কোন প্রশ্ন নয় যে, এ সম্পর্কে মানুষ শুধু অনুমান ও ধারণা অনুসারে একটা কিছু ঠিক করে নেবে এবং জুয়ার বাজি ধরার মত নিজের জীবনরূপ পূঁজির সবটাই বাজি ধরে বসবে। কারণ, এ অনুমান যদি ভ্রান্ত হয় তাহলে তার অর্থ হবে, ব্যক্তি নিজেকেই নিজে ধ্বংস করে ফেললো। তাছাড়া মানুষ যেসব বিষয়ে শুধু অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে এটি আদৌ সে ধরনের নয়। কারণ, যা মানুষের ধরা-ছোঁয়ার গণ্ডির মধ্যে কেবল সেসব ক্ষেত্রেই অনুমান চলতে পারে। কিন্তু এটা এমন একটা বিষয় যার কোন কিছুই ধরা-ছোঁয়ার গণ্ডিভুক্ত নয়। তাই এর কোন অনুমান ভিত্তিক মূল্যায়ণ সঠিক হতে পারে না। এখন প্রশ্ন থাকে তাহলে অনুভূতি ও উপলব্ধির বাইরে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঠিক উপায় কি? কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ প্রশ্নের যে জবাব দেয়া হয়েছে এবং এ সূরা থেকেও এ জওয়াবেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মানুষ নিজে সরাসরি ন্যায় ও সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। আল্লাহ তাঁর নবীর মাধ্যমে ন্যায় ও সত্যের জ্ঞান দান করে থাকেন। এ জ্ঞানের সত্যতা সম্পর্কে মানুষ তার নিজের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারে এভাবে যে, যমীন, আসমান ও তার নিজের মধ্যে যে অসংখ্য নিদর্শন বিদ্যমান তা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখবে যে, নবী যা বলছেন এসব নিদর্শন কি সেই সত্যই প্রমাণ করছে, না এ বিষয়ে অন্যরা যেসব ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পেশ করেছে সেগুলোকেই সমর্থন করছে? আল্লাহ ও আখেরাত সম্পর্কে জ্ঞানগত বিশ্লেষণের এটিই একমাত্র পন্থা যা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ পন্থা বাদ দিয়ে যে ব্যক্তিই নিজের আন্দাজ-অনুমান অনুসারে চলেছে সে-ই ধ্বংস হয়েছে।