আয্ যুখরুফ

৮৯ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৪১ ) আমি তোমাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেই কিংবা এদেরকে যে পরিণামের প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছি তা তোমাকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দেই এখন তো আমার এদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
فَإِمَّا نَذْهَبَنَّ بِكَ فَإِنَّا مِنْهُم مُّنتَقِمُونَ ٤١
৪২ ) এদের বিরুদ্ধে আমি পূর্ণ ক্ষমতা রাখি। ৩৭
أَوْ نُرِيَنَّكَ ٱلَّذِى وَعَدْنَـٰهُمْ فَإِنَّا عَلَيْهِم مُّقْتَدِرُونَ ٤٢
৪৩ ) অহীর মাধ্যমে তোমার কাছে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে সর্বাবস্থায় তুমি দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে থাকো নিশ্চয়ই তুমি সোজা পথে আছো। ৩৮
فَٱسْتَمْسِكْ بِٱلَّذِىٓ أُوحِىَ إِلَيْكَ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ ٤٣
৪৪ ) প্রকৃত সত্য হলো, এ কিতাব তোমার ও তোমার কর্মের জন্য অনেক বড় একটি মর্যাদা এবং এজন্য অচিরেই তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। ৩৯
وَإِنَّهُۥ لَذِكْرٌۭ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ ۖ وَسَوْفَ تُسْـَٔلُونَ ٤٤
৪৫ ) তোমার পূর্বে আমি যত রসূল পাঠিয়েছিলাম তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি উপাসনার জন্য রহমান খোদা ছাড়া আর কোন উপাস্য নির্দিষ্ট করেছিলাম কিনা? ৪০
وَسْـَٔلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رُّسُلِنَآ أَجَعَلْنَا مِن دُونِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ءَالِهَةًۭ يُعْبَدُونَ ٤٥
৪৬ ) আমি ৪১ মূসাকে আমার নিদর্শনসমূহসহ ৪২ ফেরাউন ও তার সভাসদদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সে গিয়ে তাদের বলেছিলোঃ আমি বিশ্ব-জাহানের রবের রসূল।
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِـَٔايَـٰتِنَآ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ وَمَلَإِي۟هِۦ فَقَالَ إِنِّى رَسُولُ رَبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٤٦
৪৭ ) অতঃপর সে যখন তাদের সামনে আমার নিদর্শনসমূহ পেশ করলো তখন তারা বিদ্রূপ করতে লাগলো।
فَلَمَّا جَآءَهُم بِـَٔايَـٰتِنَآ إِذَا هُم مِّنْهَا يَضْحَكُونَ ٤٧
৪৮ ) আমি তাদেরকে একের পর এক এমন সব নিদর্শন দেখাতে থাকলাম যা আগেরটার চেয়ে বড় হতো। আমি তাদেরকে আযাবের মধ্যে লিপ্ত করলাম যাতে তারা তাদের আচরণ থেকে বিরত থাকে। ৪৩
وَمَا نُرِيهِم مِّنْ ءَايَةٍ إِلَّا هِىَ أَكْبَرُ مِنْ أُخْتِهَا ۖ وَأَخَذْنَـٰهُم بِٱلْعَذَابِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ٤٨
৪৯ ) প্রত্যেক আযাবের সময় তারা বলতো, হে যাদুকর! তোমার রবের পক্ষ থেকে তুমি যে পদমর্যাদা লাভ করেছো তার ভিত্তিতে আমাদের জন্য তাঁর কাছে দোয়া করো। আমরা অবশ্যই সঠিক পথে এসে যাবো।
وَقَالُوا۟ يَـٰٓأَيُّهَ ٱلسَّاحِرُ ٱدْعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ إِنَّنَا لَمُهْتَدُونَ ٤٩
৫০ ) কিন্তু আমি যেই মাত্র তাদের ওপর থেকে আযাব সরিয়ে দিতাম তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতো। ৪৪
فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ ٱلْعَذَابَ إِذَا هُمْ يَنكُثُونَ ٥٠
৩৭.
যে পরিস্থিতিতে একথা বলা হয়েছে তা সামনে রাখলেই এ কথার তাৎপর্য ভালভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে। মক্কার কাফেররা মনে করছিলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তি সত্তাই তাদের জন্য বিপদ হয়ে আছে। মাঝ পথ থেকে এই কাঁটা সরিয়ে দিতে পারলেই তাদের সব কিছু সুন্দর ও ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন না কোনভাবে তাঁকে হত্যা করার জন্য তারা রাত দিন বসে বসে পরামর্শ করতো। এতে আল্লাহ‌ তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলছেনঃ তোমার বর্তমান থাকা না থাকা কিছুই আসে যায় না। তুমি বেঁচে থাকলে তোমার চোখের সামনেই তাদের দুর্ভাগ্য নেমে আসবে। আর যদি তোমাকে উঠিয়ে নেয়া হয় তাহলে তোমার বিদায়ের পরে তাদের দফারফা হবে। অশুভ কর্মফল এখন তাদের ভাগ্যের লিখন হয়ে গিয়েছে। এর হাত থেকে তাদের পক্ষে রক্ষা পাওয়া আর সম্ভব নয়।
৩৮.
অর্থাৎ জুলুম ও বে-ঈমানীর সাহায্যে ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতাকারীরা তাদের এই কৃতকর্মের শাস্তি কখন এবং কি পায় তুমি সে চিন্তা করবে না। অথবা তোমার জীবদ্দশায় ইসলাম প্রসার লাভ করে কিংবা করে না, সে চিন্তাও তুমি করবে না। তোমার জন্য সান্তনা হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছ। অতএব, ফলাফলের চিন্তা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করতে থাকো। আর আল্লাহ‌ তোমার সামনেই বাতিলের মাথা অবনত করান না তোমার বিদায়ের পরে করান সেটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দাও।
৩৯.
অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির মধ্যে কোন ব্যক্তির জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না যে, আল্লাহ‌ তাকেই তাঁর কিতাব নাযিলের জন্য বাছাই করছেন এবং কোন জাতির জন্যও এর চেয়ে বড় কোন সৌভাগ্য কল্পনা করা যেতে পারে না যে, দুনিয়ার অন্য সব জাতিকে বাদ দিয়ে আল্লাহ‌ তাদের মধ্যেই তাঁর নবীকে সৃষ্টি করছেন, তাদের ভাষায় তাঁর কিতাব নাযিল করছেন এবং তাদেরকেই গোটা বিশ্বব্যাপী আল্লাহর বানীবাহক হওয়ার মহা সুযোগ দান করছেন যদি কুরাইশ ও আরববাসীদের এই বিরাট মর্যাদার উপলব্ধি না থেকে থাকে এবং যদি তারা তার অমর্যাদা করতে চায় তাহলে এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন এজন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।
৪০.
রসূলদের জিজ্ঞেস করার অর্থ তাদের আনীত কিতাবসমূহ থেকে জেনে নেয়া। যেমনفَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ আয়াতাংশের অর্থ “যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয় তাহলে তা আল্লাহ‌ ও রসূলের কাছে নিয়ে যাও নয়, বরং তার অর্থ হচ্ছে, সে ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাতের স্মরণাপন্ন হও। অনুরূপ রসূলদেরকে জিজ্ঞেস করার অর্থ, যে রসূলগণ দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন তাদের সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো নয়, বরং এর সঠিক তাৎপর্য হলো আল্লাহর রসূলগণ পৃথিবীতে যেসব শিক্ষা রেখে গিয়েছেন তার মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখো, মহান আল্লাহ‌ ছাড়া আরো কেউ উপাসনা লাভের যোগ্য তা কেউ শিখিয়েছিলেন কিনা।
৪১.
এখানে এ ঘটনাটা তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এক-আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়ে আরববাসীদের বর্তমানে একটি সুযোগ দান করেছেন। যখনই আল্লাহ‌ কোন দেশ ও জাতির কাছে তাঁর নবী পাঠিয়ে তাদের এ ধরনের সুযোগ দান করেন কিন্তু সে জাতি তার মর্যাদা ও মূল্য দেয়া এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে ফিরাউন ও তার কওম যেমন নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছিলো তেমন কাজ করে বসে। তখন তারা এমন পরিণামের সম্মুখীন হয় যা ইতিহাসে শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে আছে। দুই-যেভাবে বর্তমানে মক্কার কুরাইশ গোত্রের কাফেররা তাদের নেতাদের তুলনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নগণ্য ও হেয় মনে করছে ফিরাউনও তার বাদশাহী, জাঁকজমক, প্রতিপত্তি এবং ধন-সম্পদের গর্বে গর্বিত হয়ে মূসা আলাইহিস সালামকে ঠিক তেমনি নগণ্য ও হেয় মনে করেছিলো। কিন্তু মহান আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন রকম। এবং বাস্তবে হেয় ও নগণ্য কে ছিলো সেই ফায়সালাই শেষ পর্যন্ত তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তিন-আল্লাহর নিদর্শনসমুহের সাথে বিদ্রূপ করা এবং তাঁর সতর্ক বাণীসমূহের বিরুদ্ধে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করা কোন ছোটখাট ব্যাপার নয়, বরং অত্যন্ত চড়া মূল্য দাবী করার মত ব্যাপার। যারা এর পরিণাম ভোগ করেছে তাদের উদাহরণ থেকে যদি শিক্ষা গ্রহণ না করো তাহলে নিজেও একদিন সেই পরিণাম ভোগ করবে।
৪২.
এর অর্থ প্রাথমিক যেসব নিদর্শন নিয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের দরবারে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ লাঠি ও ‘ইয়াদে বায়দা’ বা আলোকোজ্জ্বল হাত (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ৮৭ থেকে ৮৯; ত্বাহা, টীকা ১২, ১৩, ২৯, ৩০; আশ শু’আরা, টীকা ২৬-২৯; আন নামল, টীকা ১৬; আল কাসাস, টীকা ৪৪ ও ৪৫)।
৪৩.
এসব নিদর্শন বলতে বুঝানো হয়েছে সেই নিদর্শনসমূহকে যা আল্লাহ‌ পরবর্তীকালে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তাদের দেখিয়ে ছিলেন। নিদর্শনগুলো ছিলঃ

একঃ জনসমক্ষে যাদুকরদের সাথে আল্লাহর নবীর মোকাবিলা হয় এবং তারা পরাজিত হয়ে ঈমান আনে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ৮৮ থেকে ৯২; ত্বাহা, টীকা ৩০ থেকে ৫০; আশ শু’আরা, টীকা ২৯ থেকে ৪০।

দুইঃ হযরত মূসার ভবিষ্যত বাণী আনুসারে মিসর দেশে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ হয় এবং হযরত মূসার দোয়ার কারণেই তা দূরীভূত হয়।

তিনঃ তাঁর ভবিষ্যত বাণীর পর গোটা দেশে ভয়াবহ বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ বর্ষণসহ প্রবল ঝড়, তুফান আসে, যা জনপদ ও কৃষি ক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে। বিপদও তাঁর দোয়াতেই কেটে যায়।

চারঃ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে গোটা দেশে পঙ্গপালের ভয়ানক আক্রমণ হয় এবং এ বিপদও ততক্ষণ পর্যন্ত দূরীভূত হয়নি যতক্ষন না তিনি তা দূরীভূত হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন।

পাঁচঃ তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী গোটা দেশে উকুন ও কীটানু ছড়িয়ে পড়ে যার কারণে একদিকে মানুষ ও জীবজন্তু মারাত্মক কষ্টে পড়ে, অপর দিকে খাদ্য শস্যের গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়। এ আযাব কেবল তখনই দূরীভূত হয় যখন কাকুতি-মিনতি করে হযরত মূসার দ্বারা দোয়া করানো হয়।

ছয়ঃ হযরত মূসা (আ) এর পূর্ব-সতর্ক বাণী অনুসারে গোটা দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের সয়লাব আসে যার ফলে গোটা জনপদের প্রায় দমবদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা হয়। আল্লাহর এ সৈনিকরাও হযরত মূসার দোয়া ছাড়া ফিরে যায়নি।

সাতঃ ঠিক তাঁর ঘোষণা মোতাবেক রক্তের আযাব দেখা দেয়। যার ফলে সমস্ত নদী নালা, কূপ, ঝর্ণাসমূহ, দীঘি এবং হাউজের পানি রক্তে পরিণত হয়, মাছ মরে যায়, সর্বত্র পানির আধারে দূর্গন্ধ সৃষ্টি হয় এবং পুরো এক সপ্তাহ পর্যন্ত মিশরের মানুষ পরিষ্কার পানির জন্য তড়পাতে থাকে। এ বিপদও কেবল তখনই কেটে যায় যখন তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হযরত মূসাকে দিয়ে দোয়া করানো হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সুরা আল আ’রাফ, টীকা ৯৪-৯৬; আন নামল টীকা ১৬ ও ১৭; আল মু’মিন, টীকা ৩৭।

বাইবেলের যাত্রা পুস্তকের ৭, ৮, ৯, ১০ ও ১২ অধ্যায়েও এসব আযাবের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। তবে তা কল্পকাহিনী ও সত্যের সংমিশ্রণ মাত্র। সেখানে বলা হয়েছে, যখন রক্তের আযাব এলো তখন যাদুকররাও অনুরূপ রক্ত তৈরী করে দেখালো। কিন্তু উকুনের আযাব আসলে জবাবে যাদুকররা উকুন সৃষ্টি করতে পারলো না। তারা বললো, এটা আল্লাহর কাজ। এর চেয়েও অধিক মজার ব্যাপার হলো, অসংখ্য ব্যাঙের সয়লাব সৃষ্টি হলে জবাবে যাদুকররাও ব্যাঙের সয়লাব আনলো এবং এরপরও ফেরাউন মূসার কাছেই আবেদন জানালো যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এ আযাব দূর করিয়ে দিন। প্রশ্ন হচ্ছে যাদুকররাও যেখানে ব্যাঙের সয়লাব আনতে সমর্থ ছিল সেখানে ফেরাউন যাদুকরদের দিয়েই এই আযাব দূর করিয়ে নিলো না কেন? তাছাড়া কোনগুলো যাদুকরদের ব্যাঙ আর কোনগুলো আল্লাহর ব্যাঙ তাই বা কি করে বুঝা গেল? রক্ত সম্পর্কেও এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত মূসার সাবধান বাণী অনুসারে যখন সব জায়গায় পানির ভাণ্ডার রক্তে পরিণত হয়েছিলো তখন যাদুকররা কোন পানিকে রক্ত বানিয়েছিলো এবং কিভাবে বুঝা গেল অমুক জায়গার পানি যাদুকরদের যাদু বিদ্যা দ্বারা রক্তে পরিণত হয়েছে? এ ধরনের বক্তব্যের কারণে স্পষ্ট বুঝা যায়, বাইবেল আল্লাহর নির্ভেজাল বাণী সমাহার নয়। বরং যারা তা রচনা করেছে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তার মধ্যে অনেক কিছু সংযোজিত করেছে। তবে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ঐ সব রচয়িতারা ছিল নগণ্য জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক। কোন কথা সুন্দর করে রচনা করার যোগ্যতা পর্যন্ত তাদের ছিল না।

৪৪.
ফেরাউন ও তার কওমের নেতাদের হঠকারিতার মাত্রা পরিমাপ করা যায় এভাবে যে, যখন তারা আল্লাহর আযাবে অতিষ্ঠ হয়ে তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মূসাকে দিয়ে দোয়া করতে চাইতো তখনও তারা তাঁকে নবী বলে সম্বোধন না করে যাদুকর বলেই সম্বোধন করতো। অথচ যাদুর তাৎপর্য তারা জানতো না, তা নয়। তাছাড়া একথাও তাদের কাছে গোপন ছিল না যে, এসব অদ্ভূত কর্মকাণ্ড কোন প্রকার যাদুর সাহায্যে সংগঠিত হতে পারে না। একজন যাদুকর বড় জোর যা করতে পারে তা হচ্ছে, একটি সীমিত পরিসরে যেসব মানুষ তার সামনে বর্তমান থাকে সে তাদের মন-মস্তিষ্কের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে তারা মনে করতে থাকে, পানি রক্তে পরিণত হয়েছে অথবা ব্যাঙ উপছে পড়ছে কিংবা পঙ্গপালের ঝাঁক ক্রমে এগিয়ে আসছে। এই সীমিত পরিসরের মধ্যেও পানি বাস্তবিকই রক্তে পরিণত হবে না। বরং ঐ পরিসর থেকে মুক্ত হওয়া মাত্রই পানি পানিতে পরিণত হবে। বাস্তবে কোন ব্যাঙ সৃষ্টি হবে না। আপনি যদি সেটিকে ধরে ঐ গণ্ডির বাইরে নিয়ে যান তাহলে আপনার হাতে ব্যাঙের বদলে থাকবে শুধু বাতাস। পঙ্গপালের ঝাকও হবে শুধু মনের কল্পনা। তা কোন ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করতে পারবে না। এখন কথা হলো, একটা গোটা দেশ দুর্ভিক্ষ কবলিত হওয়া, কিংবা সমগ্র দেশের নদী-নালা, ঝর্ণা এবং কূপসমূহ রক্তে পরিপূর্ণ হওয়া অথবা হাজার হাজার মাইল এলাকা জুড়ে পঙ্গপালের আক্রমণ হওয়া এবং লাখ লাখ একর জমির ফসল ধ্বংস করা। আজ পর্যন্ত কখনো কোন যাদুকর এ কাজ করতে সক্ষম হয়নি এবং যাদুর জোরে কখনো তা সম্ভবও নয়। কোন রাজা-বাদশাহর কাছে এমন কোন যাদুকর থাকলে তার সেনাবাহিনী রাখার এবং যুদ্ধের বিপদাপদ সহ্য করার প্রয়োজনই হতো না। যাদুর জোরেই সে গোটা দুনিয়াকে পদানত করতে পারতো। যাদুকরদের এমন শক্তি থাকলে তারা কি রাজা-বাদশাহদের অধীনে চাকরি করতো? তারা নিজেরাই কি বাদশাহ হয়ে বসতো না?

মুফাসসিরগণ এখানে সাধারণভাবে একটি জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। অর্থাৎ আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফেরাউন ও তার সভাসদরা হযরত মূসার কাছে যখন দোয়ার জন্য আবেদন করতো তখনো তারা তাকে ‘হে যাদুকর’ বলে সম্বোধন করতো কি করে? বিপদের সময় সাহায্য প্রার্থনাকারী তো তোষামোদ করে থাকে, নিন্দাবাদ নয়। এ কারণে তারা এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সে যুগে মিসরবাসীদের দৃষ্টিতে যাদু অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিদ্যা ছিল। ‘হে যাদুকর’ বলে তারা প্রকৃতপক্ষে হযরত মূসার নিন্দাবাদ করতো না, বরং তাদের মতে যেন সম্মানের সাথে তাঁকে ‘হে জ্ঞানী’ বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু এ ব্যাখ্যা পুরোপুরিই ভুল। কারণ কুরআনের অন্যান্য স্থানে যেখানেই ফেরাউন কর্তৃক মূসাকে যাদুকর এবং তাঁর পেশকৃত মু’জিযাসমূহকে যাদু বলে আখ্যায়িত করার কথা উদ্ধৃত হয়েছে সেখানেই নিন্দাবাদ ও হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং স্পষ্ট বুঝা গেছে, তাদের কাছে যাদু ছিল একটি মিথ্যা জিনিস। আর এ কারণেই তারা হযরত মূসার বিরুদ্দে যাদুর অভিযোগ আরোপ করে তাঁকে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার বলে আখ্যায়িত করতো। তাই এক্ষেত্রে ‘যাদুকর’ কথাটি হঠাৎ করে তাদের দৃষ্টিতে সম্মানিত আলেম বা বিদ্বানের উপাধি হয়ে যাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো, দোয়ার জন্য আবেদন জানানোর সময়ও যখন তারা প্রকাশ্যে হযরত মূসার অমর্যাদা করতো তখন তিনি তাদের আবেদন গ্রহণই বা করতেন কেন? এর জবাব হচ্ছে, হযরত মূসার লক্ষ্য ছিল আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব লোকদের কাছে ‘ইতমামে হুজ্জত’ বা যুক্তি-প্রমাণের চূড়ান্ত করা। আযাব দূরীভূত করার জন্য তাঁর কাছে তাদের দোয়ার আবেদন করাই প্রমাণ করছিল যে, আযাব কেন আসছে কোথা থেকে আসছে এবং কে তা দূর করতে পারে মনে মনে তারা তা উপলব্ধি করে ফেলেছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তারা হঠকারিতা করে তাঁকে যাদুকর বলতো এবং আযাব কেটে যাওয়ার পর সঠিক পথ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতো তখন মূলত তারা আল্লাহর নবীর কোন ক্ষতি করতো না। বরং নিজেদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমাকে আরো বেশি জোরালো করে তুলতো। আর আল্লাহ‌ তাঁর ফায়সালা করে দিয়েছিলেন তাদের পুরোপুরি মূলোৎপাটন করার মাধ্যমে। তাঁকে তাদের যাদুকর বলার অর্থ এ নয় যে, তারা সত্যিই মন থেকেও বিশ্বাস করতো, তাদের ওপর যেসব আযাব আসছে তা যাদুর জোরেই আসছে। তারা মনে মনে ঠিকই উপলব্ধি করতো যে এগুলো সবই বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর নিদর্শন। কিন্তু জেনে শুনেও তা অস্বীকার করতো। সূরা নামলে এ কথাটিই বলা হয়েছেঃ

আরবীوَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا (ايت : 14)

“তারা মনে মনে বিশ্বাস করে ফেলেছিলো। কিন্তু জুলুম ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে এসব নিদর্শন অস্বীকার করতো।”

অনুবাদ: