আয্ যুখরুফ

৮৯ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১১ ) যিনি আসমান থেকে একটি বিশেষ পরিমাণে পানি বর্ষণ করেছেন ১০ এবং তার সাহায্যে মৃত ভূমিকে জীবিত করে তুলেছেন। তোমাদের এভাবেই একদিন মাটির ভেতর থেকে বের করে আনা হবে। ১১
وَٱلَّذِى نَزَّلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءًۢ بِقَدَرٍۢ فَأَنشَرْنَا بِهِۦ بَلْدَةًۭ مَّيْتًۭا ۚ كَذَٰلِكَ تُخْرَجُونَ ١١
১২ ) তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করেছেন। ১২ যিনি তোমাদের জন্য নৌকা-জাহাজ এবং জীব-জন্তুকে সওয়ারি বানিয়েছেন যাতে তোমরা তার পিঠে আরোহণ করো
وَٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْأَزْوَٰجَ كُلَّهَا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلْفُلْكِ وَٱلْأَنْعَـٰمِ مَا تَرْكَبُونَ ١٢
১৩ ) এবং পিঠের ওপর বসার সময় তোমাদের রবের ইহসান স্মরন করে বলোঃ পবিত্র সেই সত্তা যিনি আমাদের জন্য এসব জিনিসকে অনুগত করে দিয়েছেন। তা না হলে এদের আয়ত্বে আনার শক্তি আমাদের ছিল না। ১৩
لِتَسْتَوُۥا۟ عَلَىٰ ظُهُورِهِۦ ثُمَّ تَذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ رَبِّكُمْ إِذَا ٱسْتَوَيْتُمْ عَلَيْهِ وَتَقُولُوا۟ سُبْحَـٰنَ ٱلَّذِى سَخَّرَ لَنَا هَـٰذَا وَمَا كُنَّا لَهُۥ مُقْرِنِينَ ١٣
১৪ ) এক দিন আমাদের রবের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। ১৪
وَإِنَّآ إِلَىٰ رَبِّنَا لَمُنقَلِبُونَ ١٤
১৫ ) (এসব কিছু জানা এবং মানার পরেও) এসব লোক তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকেই কোন কোন বান্দাকে তাঁর অংশ বানিয়ে দিয়েছে। ১৫ প্রকৃত সত্য এই যে, মানুষ সুস্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।
وَجَعَلُوا۟ لَهُۥ مِنْ عِبَادِهِۦ جُزْءًا ۚ إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَكَفُورٌۭ مُّبِينٌ ١٥
১৬ ) আল্লাহ কি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে থেকে নিজের জন্য কন্যা বেছে নিয়েছেন এবং তোমাদের পুত্র সন্তান দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।
أَمِ ٱتَّخَذَ مِمَّا يَخْلُقُ بَنَاتٍۢ وَأَصْفَىٰكُم بِٱلْبَنِينَ ١٦
১৭ ) অথচ অবস্থা এই যে, এসব লোক সেই দয়াময় আল্লাহর সাথে যে ধরনের সন্তানকে সম্পর্কিত করে এদের নিজেদের কাউকে যদি সেই সন্তানের জন্মলাভের সুসংবাদ দেয়া হয় তাহলে তার মুখমণ্ডলে কালিমা ছেয়ে যায় এবং মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ১৬
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِمَا ضَرَبَ لِلرَّحْمَـٰنِ مَثَلًۭا ظَلَّ وَجْهُهُۥ مُسْوَدًّۭا وَهُوَ كَظِيمٌ ١٧
১৮ ) আল্লাহর ভাগে কি সেই সব সন্তান যারা অলঙ্কারাদির মধ্যে বেড়ে ওঠে এবং বিতর্ক ও যুক্তি পেশের ক্ষেত্রে নিজের লক্ষ্য পুরোপুরি সুস্পষ্ট করতেও পারে না? ১৭
أَوَمَن يُنَشَّؤُا۟ فِى ٱلْحِلْيَةِ وَهُوَ فِى ٱلْخِصَامِ غَيْرُ مُبِينٍۢ ١٨
১৯ ) এরা ফেরেশতাদেরকে- যারা দয়াময় আল্লাহর খাস বান্দা। ১৮ স্ত্রীলোক গণ্য করেছে। এরা কি তাদের দৈহিক গঠন দেখেছে? ১৯ এদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে নেয়া হবে এবং সেজন্য এদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।
وَجَعَلُوا۟ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةَ ٱلَّذِينَ هُمْ عِبَـٰدُ ٱلرَّحْمَـٰنِ إِنَـٰثًا ۚ أَشَهِدُوا۟ خَلْقَهُمْ ۚ سَتُكْتَبُ شَهَـٰدَتُهُمْ وَيُسْـَٔلُونَ ١٩
২০ ) এরা বলেঃ “দয়াময় আল্লাহ‌ যদি চাইতেন (যে আমরা তাদের ইবাদত না করি) তাহলে আমরা কখনো পূজা করতাম না। ২০ এ বিষয়ে প্রকৃত সত্য এরা আদৌ জানে না, কেবলই অনুমানে কথা বলে।
وَقَالُوا۟ لَوْ شَآءَ ٱلرَّحْمَـٰنُ مَا عَبَدْنَـٰهُم ۗ مَّا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ ٢٠
১০.
অর্থাৎ প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য বৃষ্টির একটা গড় পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন যা দীর্ঘকাল প্রতি বছর একই ভাবে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে এমন কোন অনিয়ম নেই যে কখনো বছরে দুই ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হবে আবার কখনো দুইশ’ ইঞ্চি হবে। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন মওসুমের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করে এমনভাবে বর্ষণ করেন সাধারণত তা ব্যাপক মাত্রায় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতার জন্য উপকারী হয়। এটাও তাঁর জ্ঞান ও কৌশলেরই অংশ যে, তিনি ভূ-পৃষ্ঠের কিছু অংশকে প্রায় পুরোপুরিই বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে পানি ও লতাগুল্ম শূন্য মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছেন এবং অপর কিছু অঞ্চলে কখনো দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেন আবার কখনো ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যাতে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন বসতি এলাকার জন্য বৃষ্টিপাত ও তা নিয়মিত হওয়া কত বড় নিয়ামত। তাছাড়া একথাও যেন তার স্মরণ থাকে যে, এই ব্যবস্থা অন্য কোন শক্তির নির্দেশনা মোতাবেক চলছে যার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন কিছুই কার্যকরী হয় না। একটি দেশে বৃষ্টিপাতের যে সাধারণ গড় তা পরিবর্তন কিংবা পৃথিবীর ব্যাপক এলাকায় তার বণ্টন হারে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করা, অথবা কোন আগমনোদ্যত তুফানকে রোধ করতে পারা বা কোন বিমুখ বৃষ্টিকে খাতির তোয়াজ করে নিজ দেশের দিকে টেনে আনা এবং বর্ষনে বাধ্য করার সাধ্য কারোর নেই। আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজর, আয়াত ১৯ থেকে ২২ টীকাসহ, আল মু’মিনূন, টীকা ১৭, ১৮)।
১১.
এখানে পানির সাহায্যে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা সৃষ্টিকে এক সাথে দু’টি জিনিসের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এক-এ কাজটি যিনি এক মাত্র আল্লাহ‌ তাঁর জ্ঞান ও কুদরত দ্বারা হচ্ছে। আল্লাহর এই সার্বভৌম কর্তৃত্বে অন্য কেহ তাঁর শরীক নয়। দুই-মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবন হতে পারে এবং হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আন নাহল, টীকা ৫৩(ক); আল হাজ্জ, টীকা ৭৯; আন নামল টীকা ৭৩; আর রূম; টীকা ২৫, ৩৪ ও ৩৫; সূরা ফাতের, টীকা ১৯, সূরা ইয়াসীন, টীকা ২৯)।
১২.
জোড়া অর্থ শুধু মানবজাতির নারী ও পুরুষ এবং জীব-জন্তু ও উদ্ভিদরাজির নারী-পুরুষে জোড়াই বুঝানো হয়নি, বরং আল্লাহর সৃষ্ট আরো অসংখ্য জিনিসের জোড়া সৃষ্টির বিষয়ও বুঝানো হয়েছে যাদের পারস্পরিক সংমিশ্রনে পৃথিবীতে নতুন নতুন জিনিসের উৎপত্তি হয়। যেমনঃ উপাদানসমূহের মধ্যে কোনটি কোনটির সাথে খাপ খায় এবং কোনটি কোনটির সাথে খাপ খায় না। যেগুলো পরস্পর সংযোজন ও সংমিশ্রণ ঘটে সেগুলোর মিশ্রনে নানা রকম বস্তুর উদ্ভব ঘটছে। যেমন বিদ্যুৎ শক্তির মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিদ্যুৎ একটি আরেকটির জোড়া। এ দু’টির পারস্পরিক আকর্ষণ পৃথিবীতে বিস্ময়কর ও অদ্ভূত সব ক্রিয়াকাণ্ডের কারণ হচ্ছে। এটি এবং এ ধরনের আরো অগণিত জোড়া যা আল্লাহ‌ নানা ধরনের সৃষ্টির মধ্যে পয়দা করেছেন, এদের আকৃতি কাঠামো, এদের পারস্পরিক যোগ্যতা, এদের পারস্পরিক আচরণের বিচিত্র রূপ এবং এদের পারস্পারিক সংযুক্তি থেকে সৃষ্ট ফলাফল নিয়ে যদি মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার মন এ সাক্ষ্য না দিয়ে পারবে না যে, এ গোটা বিশ্ব কারখানা কোন একজন মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানবান কারিগরের তৈরী এবং তাঁরই ব্যবস্থাপনায় এটি চলছে। এর মধ্যে একাধিক খোদার অধিকার থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই।
১৩.
অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ‌ শুধু মানুষ নৌকা ও জাহাজ চালনা এবং সওয়ারীর জন্য সওয়ারী জন্তু ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষমতা তিনি এজন্য দেননি যে, মানুষ খাদ্যের বস্তার মত এগুলোর পিঠে চেপে বসবে এবং যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন তিনি কে তা চিন্তা করবে না। অনুরূপ তিনি আমাদের জন্য বিশাল সমুদ্রে জাহাজ চালনা সম্ভব করেছেন এবং অসংখ্য রকমের জীব-জন্তুর মধ্যে এমন কিছু জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন যেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের অধীন হয়ে থাকে। আমরা তাদের পিঠে আরোহণ করে যে দিকে ইচ্ছা নিয়ে যাই। তিনি আমাদের এ ক্ষমতা দান করেছেন তিনি কে তা একবারও ভেবে দেখবো না সেজন্য তিনি এসব দেননি। এসব নিয়ামত থেকে উপকৃত হওয়া কিন্তু নিয়ামতদাতাকে ভুলে যাওয়া মৃত হৃদয়-মন ও অনুভূতিহীন বিবেক বুদ্ধির আলামত। একটি জীবন্ত ও তীক্ষ্ণ অনুভূতি প্রবণ মন ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ যখনই এসব সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে তখনই তার হৃদয়-মন নিয়ামতের উপলব্ধি ও কৃতজ্ঞতার আবেগে ভরে উঠবে। সে বলে উঠবে, পবিত্র সেই মহান সত্তা যিনি আমার জন্য এসব জিনিস অনুগত করে দিয়েছেন। পবিত্র এই অর্থে যে, তাঁর সত্তার গুণাবলী ও ক্ষমতা ইখতিয়ারে অন্য কেউ শরীক নয়। নিজের খোদায়ীর ক্রিয়াকাণ্ড চালাতে তিনি অক্ষম তাই অন্যান্য সাহায্যকারী খোদার প্রয়োজন পড়ে---এই দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত। এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবো, এ অবস্থা থেকেও তিনি পবিত্র।

সওয়ারী পিঠে বসার সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের মুখ থেকে যেসব কথা উচ্চারিত হতো সেগুলোই এ আয়াতের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের সর্বোত্তম বাস্তব ব্যাখ্যা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় নবী (সা.) যখন সওয়ারীতে বসতেন তখন তিনবার আল্লাহু আকবর বলতেন। তারপর এই আয়াতটি পড়ার পর এই বলে দোয়া করতেনঃ

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ فِى سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللَّهُمَّ هَوِّنْ لَنا سَفَرَ اطْوِ لَنَا الْبُعْدَ اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِى الأَهْلِ اللَّهُمَّ اصْحَبْنَا فِى سَفَرِنَا وَاخْلُفْنَا فِى أَهْلِنَا (مسند احمد , مسلم , ابو داود , نسائى , دارمى ترمذى)

“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার এই সফরে আমাকে নেকী, তাকওয়া এবং এমন কাজ করার তাওফীক দান করো যা তোমার পছন্দ। হে আল্লাহ, আমার জন্য সফরকে সহজ এবং দীর্ঘ পথকে সংকুচিত করে দাও। হে আল্লাহ‌ তুমিই আমার সফরের সাথী ও আমার অবর্তমানে আমার পরিবার পরিজনের রক্ষক। হে আল্লাহ, সফরে আমাদের সঙ্গী হও এবং আমাদের অনুপস্থিতিতে পরিবার পরিজনের তত্বাবধান করো।”

হযরত আলী বলেনঃ একবার রসূলুল্লাহ ﷺ বিসমিল্লাহ বলে রিকাবে পা রাখলেন এবং সওয়ার হওয়ার পর বললেনঃ الحمد لله سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا.......... তারপর তিনবার الحمد لله (আল্লাহু আকবার) বললেন ও তিনবার الله اكبر বললেন এবং তারপর বললেনঃ

سُبْحَانَكَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ قَدْ ظَلَمْتُ نَفْسِى فَاغْفِرْ لِى

“তুমি অতি পবিত্র। তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

এরপর তিনি হেসে ফেললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল, আপনি কি কারণে হাসলেন। তিনি বললেন, বান্দা رَبِّ اغْفِرْ لِى (হে রব আমাকে ক্ষমা করে দাও।) বললে আল্লাহর কাছে তা বড়ই পছন্দনীয় হয়। তিনি বলেনঃ আমার এই বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া রক্ষাকারী আর কেউ নেই। (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী প্রভৃতি।)

আবু মিজলায নামক এক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, ‘একবার আমি সওয়ারী জন্তুর পিঠে উঠে سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا আয়াতটি পড়লাম। হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ তোমাদের কি এরূপ করতে বলা হয়েছে। আমি বললামঃ তা হলে আমরা কি বলবো? তিনি বললেনঃ এভাবে বলোঃ সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমাদের ইলামের হিদায়াত দান করেছেন। তাঁর শোকর যে, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ পাঠিয়ে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তাঁর শোকর যে, তিনি তাঁর মাখলুকের জন্য সৃষ্ট সর্বোত্তম উম্মতের মধ্যে শামিল করেছেন। তারপর এ আয়াত পাঠ করো (ইবনে জাররি, আহকামূল কুরআন-জাসসাস)।

১৪.
অর্থাৎ প্রতিটি সফরে যাওয়ার সময় স্মরণ করো যে, সামনে আরো একটি বড় সফর আছে এবং সেটিই শেষ সফর। তাছাড়া প্রত্যেকটি সওয়ারী ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনাও যেহেতু থাকে যে, হয়তো বা কোন দুর্ঘটনা এ সফরকেই তার শেষ সফর বানিয়ে দেবে। তাই উত্তম হচ্ছে, প্রত্যেকবারই সে তার রবের কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়টিকে স্মরণ করে যাত্রা করবে। যাতে মরতে হলেও একেবারে অবচেতনার মৃত্যু যেন না হয়।

এখানে কিছুক্ষণ থেমে এই শিক্ষার নৈতিক ফলাফল ও কিছুটা অনুমান করুন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, ব্যক্তি কোন সওয়ারীতে আরোহণের সময় জেনে বুঝে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এভাবে আল্লাহকে এবং তাঁর কাছে নিজের ফিরে যাওয়া ও জবাবদিহি করার কথা স্মরণ করে যাত্রা করে সে কি অগ্রসর হয়ে কোন পাপাচার অথবা জুলুম নির্যাতনে জড়িত হবে? কোন চরিত্রহীনার সাথে সাক্ষাতের জন্য, কিংবা কোন ক্লাবে মদ্য পান বা জুয়াখেলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ও কি কোন মানুষের মুখ থেকে একথা উচ্চারিত হতে পারে অথবা সে তা ভাবতে পারে? কোন শাসক কিংবা কোন সরকারী কর্মচারী অথবা ব্যবসায়ী যে মনে মনে এসব কথা ভেবে এবং মুখে উচ্চারণ করে বাড়ী থেকে বের হলো সেকি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে মানুষের হক নষ্ট করতে পারে? কোন সৈনিক নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত ঘটানো এবং দুর্বলদের স্বাধীনতা নস্যাত করার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়ও কি তার বিমানে আরোহণ কিংবা ট্যাংকে পা রাখতে গিয়ে মুখে একথা উচ্চারণ করতে পারে? যদি না পারে, তাহলে এই একটি মাত্র জিনিস গোনাহর কাজের প্রতিটি তৎপরতায় বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।

১৫.
অংশ বানিয়ে দেয়ার অর্থ আল্লাহর কোন বান্দাকে তাঁর সন্তান ঘোষণা করা। কেননা সন্তান অনিবার্যরূপেই পিতার স্বগোত্রীয় এবং তার অস্তিত্বের একটি অংশ। তাই কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর কন্যা বা পুত্র বলার অর্থ এই যে, তাকে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তায় শরীক করা হচ্ছে। এছাড়াও কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর অংশ বানানোর আরেকটি রূপ হচ্ছে, যেসব গুণাবলী ও ক্ষমতা ইখতিয়ার শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট সেই সব গুণাবলী ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে তাকেও শরীক করা এবং এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তার কাছে প্রার্থনা করা, কিংবা তার সামনে ইবাদাত-বন্দেগীর অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা, অথবা তার ঘোষিত হালাল ও হারামকে অবশ্য পালনীয় শরীয়ত মনে করে নেয়া। কারণ, ব্যক্তি এক্ষেত্রে ‘উলুহিয়াত’ ও ‘রবুবিয়াত’ কে আল্লাহ‌ এবং বান্দার মধ্যে ভাগ করে দেয় এবং তার একটা অংশ বান্দার হাতে তুলে দেয়।
১৬.
এখানে আরবের মুশরিকদের বক্তব্যের অযৌক্তিকতাকে একেবারে উলংগ করে দেয়া হয়েছে। তারা বলতোঃ ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে। তারা মেয়েদের আকৃতি দিয়ে ফেরেশতাদের মূর্তি বানিয়ে রেখেছিলো। এগুলোই ছিলো তাদের দেবী। তাদের পূজা করা হতো। এ কারণে আল্লাহ‌ বলছেনঃ প্রথমত, যমীন ও আসমানের স্রষ্টা আল্লাহ। তিনিই তোমাদের জন্য এ যমীনকে দোলনা বানিয়েছেন। তিনিই আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তোমাদের উপকারার্থে তিনিই এসব জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন, একথা জানা এবং মানা সত্ত্বেও তোমরা তাঁর সাথে অন্যদের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছো। অথচ তোমরা যাদের উপাস্য বানাচ্ছো তারা আল্লাহ‌ নয়, বান্দা। এছাড়াও আরো সর্বনাশ করেছে এভাবে যে, কোন কোন বান্দাকে শুধু গুণাবলীতে নয়, আল্লাহর আপন সত্তায়ও শরীক করে ফেলেছে এবং এই আকীদা তৈরী করে নিয়েছে যে, তারা আল্লাহর সন্তান। তোমরা এ পর্যন্ত এসেই থেমে থাকোনি, বরং আল্লাহর জন্য এমন সন্তান স্থির করেছো যাকে তোমরা নিজেদের জন্য অপমান ও লাঞ্চনা মনে করো। কন্যা সন্তান জন্মলাভ করলে তোমাদের মুখ কালো হয়ে যায়। বড় দুঃখভারাক্রান্ত মনে তা মেনে নাও। এমন কি কোন কোন সময় জীবিত কন্যা সন্তনকে মাটিতে পুতে ফেলো। এ ধরনের সন্তান রেখেছো আল্লাহর ভাগে। আর তোমাদের কাছে যে পুত্র সন্তান অহংকারের বস্তু তা তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে? এরপরও তোমরা দাবী করো, ‘আমরা আল্লাহকে মেনে চলি’।
১৭.
অন্য কথায় যারা কোমল, নাজুক ও দুর্বল সন্তান তাদের রেখেছো আল্লাহর অংশে। আর যারা বুক টান করে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ার মত সন্তান তাদের রেখেছো নিজের অংশে। এ আয়াত থেকে নারীদের গহনা ও অলংকারাদি ব্যবহারের বৈধতা প্রমাণিত হয়। কারণ আল্লাহ‌ তাদের জন্য গহনা ও অলংকারকে একটি প্রকৃতিগত জিনিস বলে আখ্যায়িত করেছেন। হাদীসসমূহ থেকেও একথাটিই প্রমাণিত হয়। ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও নাসায়ী হযরত আলী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী ﷺ এক হাতে রেশম ও অপর হাতে স্বর্ণ নিয়ে বললেনঃ এ দু’টি জিনিসকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম। তিরমিযী ও নাসায়ী হযরত আবু মূসা আশআরীর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ রেশম ও স্বর্ণের ব্যবহার আমার উম্মতের নারীদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে। আল্লামা আবু বকর জাসসাস আহকামূল কুরআন গ্রন্থে এ মাসয়ালা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে নীচের বর্ণনাসমূহ উদ্ধৃত করেছেন।

হযরত আয়েশা বলেন, একবার যায়েদ ইবনে হারেসার ছেলে উসামা ইবনে যায়েদ আঘাত প্রাপ্ত হন এবং রক্ত ঝরাতে থাকে। রসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তিনি তার রক্ত চুষে থুথু করে ফেলছিলেন এবং তাকে এই বলে সোহাগ করছিলেন যে, উসামা যদি মেয়ে হতো আমি তাকে অলংকার পরাতাম। উসামা যদি মেয়ে হতো আমি তাকে ভালভাল কাপড় পরাতাম।

হযরত আবু মূসা আশআরী বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ

لَيْسَ الْحَرِيرُ وَالذَّهَبُ حَرَامٌ عَلَى ذُكُورِ أُمَّتِى وَحِلال لإِنَاثِهِمْ

“রেশমী কাপড় এবং স্বর্ণের অলংকার পরিধান আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম এবং নারীদের জন্য হালাল।”

হযরত আমর ইবনে আস বর্ণনা করেছেন, একবার দু’জন মহিলা নবীর ﷺ খেদমতে হাজির হলো। তারা স্বর্ণের গহনা পরিহিত ছিল। তিনি তাদের বললেনঃ এর কারণে আল্লাহ‌ তোমাদের আগুনের চুড়ি পরিধান করান তা কি তোমরা চাও? তারা বললো, না। নবী (সা.) বললেন, তাহলে এগুলোর হক আদায় করো অর্থাৎ এর যাকাত দাও।

হযরত আয়শার উক্তি হচ্ছে, যাকাত আদায় করা হলে অলংকার পরিধানে কোন দোষ নেই।

হযরত উমর (রা.) হযরত আবু মূসা আশআরীকে লিখেছিলেন তোমার শাসন কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলে যেসব মুসলিম মহিলা আছে তাদেরকে তাদের অলংকারাদির যাকাত দেবার নির্দেশ দাও।

আমর ইবনে দীনারের বরাত দিয়ে ইমাম আবু হানিফা বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আয়েশা তাঁর বোনদের এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তাঁর মেয়েদেরকে স্বর্ণের অলংকার পরিয়েছিলেন।

এসব বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর আল্লামা জাসসাস লিখছেনঃ নারীদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম হালাল হওয়ার সপক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যেসব হাদীস আছে সেগুলো নাজায়েয হওয়া সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে অধিক মশহুর ও সুস্পষ্ট। উপরোল্লেখিত আয়াতও জায়েয হওয়াই প্রমাণ করছে। তাছাড়া নবী ﷺ এবং সাহাবাদের যুগ থেকে আমাদের যুগ (অর্থাৎ চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ যুগ) পর্যন্ত গোটা উম্মতের কার্যধারাও তাই আছে। এ ব্যাপারে কেউ কোন আপত্তি উত্থাপন করেনি। এ ধরনের মাসয়ালা সম্পর্কে “আখবারে আহাদের” ভিত্তিতে কোন আপত্তি গ্রহণ করা যেতে পারে না।

১৮.
অর্থাৎ পুরুষ বা নারী কোনটাই নয়। বক্তব্যের ধরন থেকে আপনা আপনি এ অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে।
১৯.
আরেকটি অনুবাদ এও হতে পারে, “এরা কি তাদের সৃষ্টির সময় উপস্থিত ছিল? ”
২০.
নিজেদের গোমরাহীর ব্যাপারে এটা ছিল তাদের “তাকদীর” থেকে প্রমাণ পেশ। এটা অন্যায়কারীদের চিরকালীন অভ্যাস। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, আল্লাহ‌ আমাদের করতে দিয়েছেন বলেই তো ফেরেশতাদের ইবাদাত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তিনি যদি না চাইতেন তাহলে আমরা কি করে এ কাজ করতে পারতাম? তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে আমাদের এখানে এ কাজ হচ্ছে, কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সেজন্য কোন আযাব নাযিল হয়নি। এর অর্থ, আমাদের এ কাজ আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় নয়।
অনুবাদ: