প্রথমত-এ কথা বলার উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শিক্ষা এবং সান্তনা দান করা। এতে নবীকে ﷺ বুঝানো হয়েছে, তিনি মক্কার কাফেরদের অজ্ঞতা, গোমরাহী ও বাহ্যিকভাবে তাদের একগুয়েমী ও হঠকারিতা দেখে যেন বেশী মনোকষ্ট ও দুঃখ না পান। মানুষকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়াই আল্লাহর ইচ্ছা। তারপর যে হিদায়াত চাইবে সে হিদায়াত লাভ করবে। আর যে পথভ্রষ্ট হতে চাইবে সে পথভ্রষ্ট হবে। সে যেদিকে যেতে চায় সেদিকেই যাবে। আল্লাহর অভিপ্রায় ও বিবেচ্য যদি এটা না হতো তাহলে নবী-রসূল ও কিতাব পাঠানোর প্রয়োজনই বা কি ছিল? সেজন্য মহান আল্লাহর একটি সৃষ্টিসূচক ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল। এভাবে সমস্ত মানুষ ঠিক তেমনি তাঁর আদেশ মেনে চলতো যেমন আদেশ মেনে চলে নদী, পাহাড়, গাছ, মাটি পাথর ও সমস্ত জীবজন্তু। (এ উদ্দেশ্যে এ বিষয়টি কুরআন মজীদের অন্যান্য জায়গায়ও বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনআম, আয়াত ৩৫, ৩৬ ও ১০৭ টীকাসহ)।
দ্বিতীয়-আল্লাহ যদি সত্যিই মানুষকে পথ দেখাতে চাইতেন আর মানুষের মধ্যে আকীদা ও কর্মের যে পার্থক্য বিস্তার লাভ করে আছে তা তাঁর পছন্দ না হতো এবং মানুষ ঈমান ও ইসলামের পথ অনুসরণ করুক তাই যদি তাঁর মনঃপুত, তাহলে এই কিতাব ও নবুওয়াতের কি প্রয়োজন ছিল? এ ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে যেসব মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছিলো এখানে তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি সব মানুষকে মু’মিন ও মুসলিম হিসেবে সৃষ্টি করে এ কাজ সহজেই করতে পারতেন। এই বিভ্রান্তি ও দ্বিধা দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসেবে যুক্তি দেখানো হয় যে, আল্লাহ যখন তা করেননি তখন নিশ্চয়ই তিনি ভিন্ন কোন পথ পছন্দ করেন। আমরা যে পথে চলছি সেটিই সেই পথ আর যা কিছু করছি তাঁরই ইচ্ছায় করছি। তাই এ ব্যাপারে আপত্তি করার অধিকার কারো নেই। এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্যও এ বিষয়টি কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনআম, আয়াত ১১২, ১৩৮, ১৪৮, ১৪৯ টীকাসহ; সূরা নূর এর (তাফহীম) ভূমিকা; ইউনুস আয়াত ৯৯, টীকাসহ; হূদ আয়াত ১১৮টীকাসহ; আন নাহল, আয়াত ৩৬ ও ৩৭ টীকাসহ।
তৃতীয়ত-এর উদ্দেশ্য দ্বীনের প্রচার ও আল্লাহর সৃষ্টির সংশোধন ও সংস্কারের পথে যেসব বিপদাপদ আসে ঈমানদারদেরকে তার বাস্তবতা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করানো। যারা আল্লাহর দেয়া বাছাই ও ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং তার ভিত্তিতে স্বভাব-চরিত্র ও পন্থা-পদ্ধতির ভিন্ন হওয়ার বাস্তবতা উপলব্ধি করে না তারা কখনো সংস্কার কার্যের মন্থর গতি দেখে নিরাশ হতে থাকে। তারা চায় আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু ‘কারামত’ ও ‘মু’জিযা’ দেখানো যা দেখামাত্র মানুষের মন পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আবার কখনো তারা প্রয়োজনের অধিক আবেগ-উত্তেজনার বশে সংস্কারের অবৈধ পন্থা-পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে (এ উদ্দেশ্যেও কুরআন মজীদের কয়েকটি জায়গায় এ বিষয়টি বলা হয়েছে। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা রা’দ আয়াত ৩১ টীকাসহ; সূরা নাহল, আয়াত ৯০ থেকে ৯৩ টীকাসহ।)
এ উদ্দেশ্যে একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ কয়টি সংক্ষিপ্ত বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব এবং আখেরাতে তাঁর জান্নাত কোন সাধারণ রহমত নয় যা মাটি ও পাথর এবং গাধা ও ঘোড়ার মত মর্যাদার সৃষ্টিকুলকে সাধারণভাবে বণ্টন করে দেয়া যায়। এটা তো একটা বিশেষ এবং অনেক উচ্চ পর্যায়ের রহমত যার জন্য ফেরেশতাদেরকেও উপযুক্ত মনে করা হয়নি। এ কারণেই মানুষকে একটি স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাঁর পৃথিবীর এসব অঢেল উপায়-উপকরণ তার কর্তৃত্বাধীনে দিয়েছেন এবং এসব সাংঘাতিক শক্তিও তাকে দান করেছেন। যাতে সে সেই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে এবং এতে কামিয়াব হওয়ার পরই কেবল কোন বান্দা তাঁর এই বিশেষ রহমত লাভের উপযুক্ত হতে পারে। এ রহমত আল্লাহর নিজের জিনিস। এর ওপর আর কারো ইজারাদারী নেই। কেউ তার ব্যক্তিগত অধিকারের ভিত্তিতে তা দাবী করেও নিতে পারে না। এমন শক্তিও কারো নেই যে, জোর করেই তা লাভ করতে পারে। সে-ই কেবল তা নিতে পারে যে আল্লাহর কাছে তার দাসত্ব পেশ করবে, তাঁকেই নিজের অভিভাবক বানাবে এবং তাঁরই সাথে লেগে থাকবে। এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে সাহায্য ও দিক নির্দেশনা দান করেন এবং তাকে নিরাপদে এ পরীক্ষা পাস করার তাওফীক দান করেন যাতে সে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু যে জালেম আল্লাহর দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাঁর পরিবর্তে অন্যদেরকে নিজের অভিভাবক বানিয়ে নেয়, অযথা জোর করে তাঁর অভিভাবক হওয়ার এমন কোন প্রয়োজন আল্লাহর পড়েনি। সে অন্য যাদেরকে অভিভাবক বানায় তাদের আদৌ এমন কোন জ্ঞান, শক্তি বা ক্ষমতা-ইখতিয়ার নেই যার ভিত্তিতে অভিভাবকত্বের হক আদায় করে তাকে সফল করিয়ে দিতে পারে।