কোন কোন মুফাসসির এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সূরা কাসাসের এ আয়াতটি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করার সময় পথে নাযিল হয়েছিল। তাঁদের মতে এতে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি আবার তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু প্রথমত এর শব্দাবলীর মধ্যে “মা’আদ” কে “মক্কা” অর্থে গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বিষয়বস্তু ও আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য-প্রমাণের দিক দিয়ে বিচার করলে এ সূরাটি হচ্ছে হাব্শায় হিজরাতের নিকটবর্তী সময়ের এবং এ কথা বুঝা যাচ্ছে না যে, কয়েক বছর পর মদীনায় হিজরাতের সময় পথে যদি এ আয়াতটি নাযিল হয়ে থাকে তাহলে কোন্ সম্পর্কের ভিত্তিতে এখানে এ ধারাবাহিক আলোচনার মধ্যে একে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, এ প্রেক্ষাপটে মক্কার দিকে নবী করীমের ﷺ ফিরে যাবার আলোচনা একেবারেই বেমানান ঠেকে। আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করা হলে এটা মক্কার কাফেরদের কথার জবাব হবে না বরং তাদের ওজরকে শক্তিশালী করা হবে। এর অর্থ হবে, অবশ্যই হে মক্কাবাসীরা! তোমরা ঠিকই বলছো, মুহাম্মাদ ﷺ কে এ শহর থেকে বের করে দেয়া হবে কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে নির্বাসিত হবেন না বরং শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে আবার এখানে ফিরিয়ে আনবো। এ হাদীসটি যদিও বুখারী, নাসাঈ, ইবনে জারীর ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন কিন্তু আসলে এটি ইবনে আব্বাসের নিজস্ব অভিমত। এটি সরাসরি রসূল ﷺ এর বক্তব্য সম্বলিত কোন মারফূ হাদীস নয় যে, একে মেনে নিতেই হবে।
তারপর তিনি নিজেও নবুওয়াতের প্রত্যাশী ছিলেন না। অথবা তা কামনা করতেন না এবং সেজন্য অপেক্ষাও করছিলেন না। বরং সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে অকস্মাত তিনি এ বিষয়টির মুখোমুখি হলেন। বিভিন্ন হাদীসে অহীর সূত্রপাতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে যে ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। জিব্রীলের সাথে প্রথম সাক্ষাত এবং সূরা আলাকের প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর তিনি হেরা গূহা থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গৃহে পৌঁছেছিলেন। গৃহের লোকদের বলেছিলেন, “আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও।” কিছুক্ষণ পরে ভীতির অবস্থা কিছুটা দূর হয়ে গেলে নিজের জীবন সঙ্গীনিকে সব অবস্থা খুলে বললেন। এ প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন, “আমি নিজের প্রাণের ভয় করছি।” স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন, “মোটেই না, আল্লাহ আপনাকে কখনো কষ্ট দেবেন না। আপনি আত্নীয়দের হক আদায় করেন। অসহায়কে সাহায্য করেন। অভাবী দরিদ্রকে সহায়তা দেন। অতিথি আপ্যায়ন করেন। প্রত্যেক ভালো কাজে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।” তারপর তিনি তাঁকে নিয়ে নিজের চাচাতো ভাই ও আহলে কিতাবদের একজন অভিজ্ঞ আলেম ও সদাচারী ব্যক্তি ওয়ারাকাহ ইবনে নওফালের কাছে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনার পর ওয়ারাকাহ বললেন, “আপনার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন সেই একই আসমানী দূত বা নামূস (বিশেষ কাজে নিযুক্ত নির্দিষ্ট ফেরেশতা) যিনি মূসার (আ) কাছে এসেছিলেন। হায়! যদি আমি যুবক হতাম এবং সে সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে বহিস্কার করবে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কি আমাকে বের করে দেবে?” জবাব দিলেন, “হ্যাঁ আজ পর্যন্ত এক ব্যক্তিও এমন অতিক্রান্ত হননি, যিনি এ ধরণের বাণী বহন করে এনেছেন এবং লোকেরা তাঁর দুশমনে পরিণত হয়নি।
এ সমগ্র ঘটনাটি এমন একটি অবস্থার ছবি তুলে ধরে, যা একজন সরল মানুষ একটি অপ্রত্যাশিত ও চরম অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তার জীবনে দেখা দিতে পারে। যদি নবী ﷺ প্রথম থেকেই নবী হবার চিন্তা করতেন, নিজের সম্পর্কে চিন্তা করতেন যে, তাঁর মতো মানুষের নবী হওয়া উচিত এবং কবে কোন ফেরেশতা তাঁর কাছে পয়গাম নিয়ে আসবে তারই প্রতীক্ষায় ধ্যান সাধনা করে নিজের মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন, তাহলে হেরা গূহার ঘটনাটি সংঘটিত হবার সাথে সাথেই তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন এবং বলিষ্ঠ মনোবল নিয়ে বিরাট দাবী সহকারে পাহাড় থেকে নামতেন, তারপর সোজা নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে পৌঁছে নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দিতেন। কিন্তু এখানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা পরিদৃষ্ট হয়। তিনি যা কিছু দেখেন তাতে বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে পৌঁছেন। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। মনটা একটু শান্ত হলে চুপি চুপি স্ত্রীকে বলেন, আজ গুহার নিসঙ্গতায় এ ধরণের একটি ঘটনা ঘটে গেছে। জানি না কি হবে। আমার প্রাণ নিরাপদ নয় মনে হচ্ছে। নবুওয়াত প্রার্থীর অবস্থা থেকে এ অবস্থা কত ভিন্নতর।
তারপর স্বামীর জীবন, তাঁর অবস্থা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে জানতে পারে? যদি তিনি পূর্বাহ্ণেই এ অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকতেন যে, তাঁর স্বামী হচ্ছেন নবুওয়াতের প্রার্থী, তিনি সর্বক্ষণ ফেরেশতাদের আগমনের প্রতীক্ষা করছেন, তাহলে তার জবাব কখনো হযরত খাদিজার (রা.) জবাবের অনুরূপ হতো না। বরং তিনি বলতেনঃ হে স্বামী! ভয় পাও কেন? দীর্ঘদিন থেকে যে জিনিসের প্রত্যাশী ছিলে তা পেয়ে গেছো। চলো, এবার পীর গিরির দোকান পাঠ সাজাও। আমি মানত, নাজরানা ইত্যাদি সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি স্বামীর জীবনের যে চেহারা দেখেছিলেন তার ভিত্তিতে একথা বুঝতে তার এক মুহূর্তও দেরী হয়নি যে, এমন সৎ, ত্যাগী ও নির্লোভ ব্যক্তির কাছে শয়তান আসতে পারে না, আল্লাহ তাঁকে কোন বড় পরীক্ষার সম্মুখীনও করতে পারেন না বরং তিনি যা কিছু দেখেছেন তা নির্জলা সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়ারকাহ ইবনে নওফালের ব্যাপারেও একই কথা। তিনি কোন বাইরের লোক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নবী করীম ﷺ এর ভ্রাতৃসমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং নিকটতম আত্মীয়তার প্রেক্ষিতে তাঁর শ্যালক। তারপর একজন ঈসায়ী আলেম হবার ফলে নবুওয়াত, কিতাব ও অহীকে কৃত্রিমতা ও বানোয়াট থেকে বাছাই করার ক্ষমতা রাখতেন। বয়সে অনেক বড় হবার কারণে নবীর ﷺ শৈশব থেকে সে সময় পর্যন্ত সমগ্র জীবন তার সামনে ছিল। তিনিও তাঁর মুখ থেকে হেরা গূহার সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক শোনার পর সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠেন, এ আগমনকারী নিশ্চিতভাবেই সেই একই ফেরেশতা হবেন যিনি হযরত মূসার (আ) কাছে অহী নিয়ে আসতেন। কারণ হযরত মুসা (আ) সাথে যা ঘটেছিল এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ একজন অত্যন্ত পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী সহজ-সরল মানুষ, মাথায় কোন প্রকার পূর্ব চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই, নবুওয়াতের চিন্তায় ডুবে থাকা তো দূরের কথা তা অর্জন করার কল্পনাও কোনদিন তাঁর মনে জাগেনি এবং অকস্মাৎ তিনি পূর্ণ সচেতন অবস্থায় প্রকাশ্যে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এ জিনিসটি তাঁকে দুই আর দু’ইয়ে চারের মতো নির্দ্ধিধায় নিশ্চতভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে দেয় যে, এখানে কোন প্রবৃত্তির প্ররোচনা বা শয়তানী ছল চাতুরী নেই। বরং এ সত্যাশ্রয়ী মানুষটি নিজের কোন প্রকার ইচ্ছা-আকাংখা ছাড়াই যা কিছু দেখেছেন তা আসলে প্রকৃত সত্যদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।
এটি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের এমন একটি সুস্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ যে, একজন সত্যপ্রিয় মানুষের পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন। তাই কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এ জিনিসটিকে নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউনূসে বলা হয়েছেঃ
قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
“হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যদি আল্লাহ এটা না চাইতেন, তাহলে আমি কখনো এ কুরআন তোমাদের শুনাতাম না বরং এর খবরও তোমাদের দিতাম না। ইতিপূর্বে আমি তোমাদের মধ্যে আমার জীবনের দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছি, তোমরা কি এতটুকু কথাও বোঝো না?” (ইউনূসঃ ১৬ আয়াত)
আর সূরা আশ্-শূরায় বলা হয়েছে,
مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا
“হে নবী! তুমি তো জানতেও না কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমি এ অহীকে একটি আলোয় পরিণত করে দিয়েছি। যার সাহায্যে আমি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চাই তাকে পথ দেখাই।” (আশ্-শূরাঃ ৫২ আয়াত)
[আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনূস ২১, আনকাবুত ৮৮-৯২ এবং শূরা ৮৪ টীকা।]