শুরুতে আরবে যে জিনিসটির জন্য কুরাইশ গোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে, সেটি হচ্ছে তাদের হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর হওয়ার বিষয়টি আরবীয় বংশধারার দিক দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ছিল। এ কারণে তাদের বংশটি ছিল আরবদের দৃষ্টিতে পীরজাদার বংশ। তারপর যখন কুশাই ইবনে কিলাবের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে তারা কাবা গৃহের মুতাওয়াল্লী ও পরিচালকে পরিণত হলো এবং মক্কায় তাদের আবাস গড়ে উঠলো তখন তাদের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশী বেড়ে গেল। কারণ এখন তারা ছিল আরবের সবচেয়ে বড় তীর্থ স্থানের পরিচালক। আরবের সকল গোত্রের মধ্যে তারা ধর্মীয় পুরোহিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর হজ্জের কারণে আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না যারা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতো না। এ কেন্দ্রীয় মর্যাদাকে পুঁজি করে কুরাইশরা ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ করতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদেরকে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করে। সে সময় রোম, গ্রীস, মিশর ও সিরিয়ার যত প্রকার বাণিজ্য চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার সাথে চলতো তার সমস্ত পথই ইরান বন্ধ করে দিয়েছিল। লোহিত সাগরের পথটিই ছিল সর্বশেষ পথ। একমাত্র এ পথটিই খোলা ছিল। পরে ইরান যখন ইয়ামেন দখল করে নিল, তখন সে এ পথটিও বন্ধ করে দিল। এখন আরব বণিকরা একদিকে রোম অধিকৃত এলাকার পণ্য সম্ভার আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের বন্দরসমূহে পৌঁছিয়ে দিতে লাগলো এবং অন্যদিকে একই বন্দরসমূহ থেকে পূর্বদেশীয় বাণিজ্যপণ্য নিয়ে রোম সাম্রাজের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে থাকলো। এ ছাড়া এ বাণিজ্যটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হলো। এ সময় কুরাইশরাই বলতে গেলে এ ব্যবসায়ের ইজারাদারী লাভ করে বসেছিল। কিন্তু যেসব উপজাতীয় এলাকার মধ্য দিয়ে এ বাণিয়জ্য পথগুলো গিয়েছিল তাদের সাথে তাদের সাথে আরবদের গভীর বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছাড়া আরবের রাজনৈতিক অরাজকতার পরিবেশে এ ব্যবসায়িক আদান প্রদান সম্ভবপর ছিল না। এ উদ্দেশ্যে কুরাইশ সরদাররা শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর করতে পারতো না। এ জন্য তারা সকল উপজাতির সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে রেখেছিল। ব্যবসায়িক মুনাফায়ও তাদেরকে অংশীদার করতো। উপজাতীয় শেখ ও প্রভাবশালী সরদারদেরকে মূল্যবান তোহ্ফা দিয়ে তুষ্ট করতো। এই সঙ্গে পাতা ছিল সূদী ব্যবসায়ের জাল। এতে জড়িয়ে পড়েছিল প্রায় সকল প্রতিবেশী উপজাতীয় ব্যবসায়ী ও সরদারবৃন্দ।
এ অবস্থায় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওহীদের দাওয়াত সম্প্রসারিত হতে লাগলো তখন বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি অন্ধপ্রীতির চাইতে বড় হয়ে যে জিনিসটি কুরাইশদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠার কারণ হয়ে দেখা দিল সেটি ছিল এই যে, এ দাওয়াতের ফলে তারা নিজেদের স্বার্থহানির আশংকা করছিল। তারা মনে করছিল, যুক্তিপূর্ণ দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে শিরক ও মূর্তিপূজা মিথ্যা এবং তাওহীদ সঠিক প্রমাণিত হয়ে গেলেও তো তাকে পরিত্যাগ করে একে গ্রহণ করে নেয়া আমাদের জন্য ধ্বংসকর হবে। এমনটি করার সাথে সাথেই সমগ্র আরবের অধিবাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কাবাগৃহের পরিচালনায় দায়িত্ব থেকে আমাদের সরিয়ে দেবে। সন্ধি চুক্তির ফলে মূর্তিপূজক উপজাতিগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যার ভিত্তিতে আমাদের বাণিজ্য কাফেলা দিন-রাত আরবের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা সবই ছিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে এ দ্বীনটি আমাদের ধর্মীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং এই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও অবসান ঘটাবে। বরং বিচিত্র নয় যে, আরবের সমস্ত উপজতি মিলে আমাদের মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করবে।
এখানে এসে দুনিয়া পূজারীদের প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির অভাবের এক বিষ্ময়কর চিত্র মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করেছিলেন যে, তোমাদের সমানে আমি যে কালেমা পেশ করছি তা মেনে নাও, আরব ও আজম তোমাদের পদাবনত হয়ে যাবে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা সা’দ, ভূমিকা : ঐতিহাসিক পটভূমি) কিন্তু তারা এর মধ্যে নিজেদের মৃত্যু দেখছিল। তারা মনে করছিল, আমরা আজ যে সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করেছি এও খতম হয়ে যাবে। তারা আশংকা করছিল, এ কালেমা গ্রহণ করার সাথে সাথেই আমরা সরেজমিনে এমনই বন্ধু-বান্ধব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়বো যে, চিল-কাকেরা আমাদের গায়ের গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল না যে, মাত্র কয়েক বছর পরেই সমগ্র আরব ভূ-খন্ড মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাভূক্ত হতে যাচ্ছিল। তারপর এ একই প্রজন্মের জীবনকালেই ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর সব দেশই এক এক করে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাধীন হতে চলছিল। আর এ উক্তির পরে এক শতক অতিক্রান্ত হবার আগেই কুরাইশ বংশীয় খলিফাগণই সিন্ধু থেকে স্পেন এবং কাফ্ফাজ থেকে ইয়ামেনের উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত দুনিয়ার একটি বৃহত্তম অংশের শাসন পরিচালনা করতে যাচ্ছিল।